দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই বাবার সাথে ৷ যেদিন মুম্বাইয়ের একটা বিদেশী কোম্পানীতে চাকরিটা পেল সেদিন বাবার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ৷ বললেন, এতোদিনে আমার ঋণটা বোধহয় শোধ হল কিছুটা ৷ যাও ৷ রুজি রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো ৷ আমার জন্যে ভাবতে হবেনা ৷
কেন বলছেন বাবা এমন কথা ? মা তো চলে গেছেন বহুদিন আগে ৷ এখানে তো তাঁর আর কেউ নেই ৷ কয়েকজন চেনা প্রতিবেশী ছাড়া ৷ আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে ৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগও নেই ৷ বহুবছর আগে শিশুটিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন তাঁরা ৷ এখানে এসে অর্ককে নিয়েই তাঁদের স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ৷ বরাবরের মেধাবী অর্ক মুখ রেখেছে তাঁদের বারবার ৷ মা সবটা দেখে যেতে পারেননি ৷
সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছে বাবাকে ৷ কিন্তু কিছুতেই রাজি করাতে পারেনি ৷ একাই গেছে সে মুম্বাই ৷ কাজের চাপে যা হয় ৷ প্রথম প্রথম ফোনে কথা হত বাবার সঙ্গে ঘনঘন ৷ আস্তে আস্তে তাও কমে আসতে লাগল ৷ আজ এ কোম্পানি কাল ও কোম্পানী ৷ মেধার জোরে চাকরি ধরে আর ছাড়ে ৷ ক্যারিয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ তলানিতে এসে থামে ৷ এখন সে ভাইজাগে একটা কোম্পানির সিনিয়ার ম্যানেজার ৷
একটা জরুরি স্টাফ মিটিংয়ের জন্যে তৈরি হচ্ছিল অর্ক ৷ হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল ৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বরটা আননোন ৷
—হ্যালো, কে বলছেন?
—তুমি কী অর্ক রায়চৌধুরী? আমি তোমার অনুকূল কাকা বলছি ৷ তোমাদের প্রতিবেশী ৷
—হ্যাঁ হ্যাঁ কাকা চিনতে পেরেছি ৷ বলুন কী খবর ? কেমন আছেন আপনারা?
—আছি ভালো আছি ৷ অনেক কষ্টে তোমার নম্বরটা যোগাড় করেছি ৷ তুমি কী একবার আসতে পারবে? শৈবালবাবু ভীষণ অসুস্থ ৷ দেশবন্ধু নার্সিং হোমে নেওয়া হয়েছে ৷
—কী হয়েছে বাবার?
—এই বার্ধক্যজনিত অসুখ ৷ দেখো চেষ্টা করে আসতে পারো কিনা ৷ খুব ক্যাজুয়ালি বললেন কথাটা অনুকূলবাবু ৷
খুব দ্রুত অফিসের কাজ গুটিয়ে তৎকাল টিকিট কেটে সন্ধ্যের আগেই আগরতলা এসে নামল ৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নার্সিং হোম ৷ অনুকূলকাকার সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখে গেছে ৷ গেটেই দেখা হয়ে গেল ৷ এসেছ বাবা ৷ শেষরক্ষা করা গেলনা ৷ এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছেন শৈবালবাবু ৷ ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি ৷
অনেকক্ষণ অঝোরে কাঁদার পর শান্তগলায় বললেন অনুকূলবাবু, একটা যুদ্ধের শেষ হল ৷ আর সেই যুদ্ধজয়ের ফসল তুমি ৷ দীর্ঘদিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছিলাম ৷ আজ তোমার কাছে সব খুলে বলব ৷ সে অনেকবছর আগের কথা ৷ তোমার বাবার বন্ধু কালাম ৷ একসঙ্গে একগ্রামে বেড়ে উঠেছেন দুজন ৷ ধর্মে আলাদা হলেও পরস্পর হরিহর আত্মা ৷ একই সঙ্গে দুজনেই বিয়ে করে সংসারী হন ৷ শৈবালবাবুরা নিঃসন্তান ৷ কালামের ঘরে আসে এক ফুটফুটে সন্তান ৷ সুখে দুখে চলছিল দুটি পরিবার ৷ কিন্তু মর্মান্তিক এক যান দুর্ঘটনায় কালাম আর তার বউ প্রাণ হারায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যায় শিশুটি ৷ খবর পেয়ে ছুটে যান শৈবালবাবু আর তাঁর স্ত্রী ৷ দুই পরিবারের মধ্যে যাওয়া আসার সুবাদে শিশুটি শুভ্রদেবীর কোলে উঠে বসল ৷ তিনিও শিশুটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন ৷ বাড়িতে নিয়ে এলেন তাকে ৷ কিন্তু বাড়িতে কেউ ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নিলনা ৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা গ্রাম ছাড়লেন ৷ আমার পাশে এসে থাকতে লাগলেন ৷ বলে তিনি থামলেন ৷
অর্কর কাছে অনেক ঘটনা স্পষ্ট হয়ে যেতে লাগল ৷ কেন গ্রাম থেকে কেউ এলে সে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে কাছছাড়া করতেননা মা ৷ বাবা কেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলেন ৷ এখানে একমাত্র
আমি জানতাম সব ৷ শৈবালবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর তোমাকে জানাতে সব ৷
—শৈবাল রায়চৌধুরীর পার্টি কে আছেন? মেডিকেল কলেজ থেকে লোক এসেছে ৷ আসুন ৷
সম্বিত ফিরে পেল অর্ক ৷ চলুন কাকা ৷
অর্ক জানতনা তার জন্যে আরো এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে ৷ মর্গে সামনে যেতেই একজন বললেন, আপনিই কী শৈবাল রায়চৌধুরীর ছেলে অর্ক রায়চৌধুরী?
—হ্যাঁ৷
—আপনার বাবার বডি সনাক্ত করুন ৷ ডোম শবদেহের উপর থেকে চাদরটা সরাল ৷
—হ্যাঁ, এটা আমার বাবার শরীর ৷
—আচ্ছা ঠিক আছে ৷ আপনাকে কিছু কাগজে সই করতে হবে ৷ আপনার বাবা মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন ৷ আমরা বডি নিয়ে যাব কলেজে ৷
অর্কর সামনে যেন এক বিরাট মহাপুরুষের ছায়া এসে দাঁড়াল ৷ আর সেই ছায়ার আজানুলম্বিত হাত অর্কর মাথার উপর নেমে আসছে ৷ অর্ক সম্মোহিতের মতো হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে শবদেহের উপর ঢাকা চাদরের বাইরে বেরিয়ে আসা চরণযুগলে কপাল ছোঁয়াল ৷ তার বাঁধভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে যাচ্ছে পা দুখানি ৷
No comments:
Post a Comment