সব পথ শেষে.....
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
দীর্ঘদিন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম । চাকুরির শেষের কদিন আধিকারিক পদেও ছিলাম । ফলে অনেক ছাত্রের সান্নিধ্যে এসেছি তেমনি বহু গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্যেও এসেছি ।আর তেমনি এসেছি শিক্ষাবিভাগীয় কিছু আপদ ঊর্ধতন কর্মকর্তাদেরও । যারা দলগুণে ওই পদগুলোতে বসে সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে অবিরাম অভব্য ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত । কোনোরকম সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেই আনন্দিত । চাকরিজীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রাপ্ত সেইসব লাঞ্ছনাগুলো ভুলে থেকেছি শুধু এই মহান ঈশ্বর পেশায় শিক্ষক হতে আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন বলে । আর অগণিত ছাত্র-শিক্ষকের,অভিভাবকদের ও সমাজের দেওয়া সম্মানকে মাথায় রেখেছি বলে । নইলে নাম করে বলে দিতে পারি, কোন আপদের কাছ থেকে কখন কি ব্যবহার পেয়েছিলাম এই আমি । বেশ কবছর হল, এই মহান পেশা থেকে অবসরে চলে এসেছি । এখনও শিক্ষক বলে সম্মান পাই । ছাত্রের কাছ থেকে । ছাত্রের বন্ধুজনের কাছ থেকেও শিক্ষকের মর্যাদা পাই । পূর্বপেশার পরিচয় পেয়েও অনেকে শিক্ষকের মর্যাদা দেন । এই প্রাপ্তিই আমার শেষ পারানির কড়ি । এ নিয়েই ওপারের ডাক এলেই পেরিয়ে যাব বুক ফুলিয়ে ।
শিক্ষক শব্দটাকে আমি মনেপ্রাণে নামাবলির মতো জড়িয়ে নিয়েছি আমার চেতনায় । তাই শিক্ষকের অমর্যাদা, শিক্ষকের লাঞ্ছনায়, শিক্ষকের গ্লানিতে আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে সবসময় । আজ কয়েকবছর হয়ে গেল আমাদের রাজ্যের এক বিরাট সংখ্যক শিক্ষক নিত্যদিন দারিদ্র্য, বুভুক্ষা, অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়ছেন । একটা বিশাল অংশের শিক্ষক-শিক্ষিকা হতাশায়, অনাহারে, রোগজর্জরিত হয়ে চিকিৎসার অভাবে চিরবিদায় নিয়ে গেছেন । তাদের নিয়ে শুধু দলবাজি হয়েছে । ভোটবাণিজ্য হয়েছে । কিছুদিন ভুল তথ্য দিয়ে একদল অবুঝকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে । বলা হয়েছে এরা শিক্ষকের যোগ্য নয় । যখন এই বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত একজন আত্মহননের পথ বেছে নেন তখনই সবার সম্বিত ফেরে । এখনও যাঁরা লড়ে যাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে এমন যোগ্যতার অধিকারী বেশ কজন আছেন । বেশ কজন আছেন প্রশাসনের অন্য যোগ্য পদে না গিয়ে শিক্ষকতার পেশায় এসেছেন । বেশ কজন কর্পোরেট সেক্টরের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের রাজ্যে এসে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন শুধু এই মহান ব্রতটাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্যে । আর এখানে এসে তাঁরা আজ পদে পদে লাঞ্ছিত হয়েছেন, আজও হচ্ছেন ।
১০৩২৩শিক্ষকদের সমস্যা আজ রাজ্যের জ্বলন্ত সমস্যা । চাকরি হারিয়ে আজ তাঁরা পরিবার পরিজন নিয়ে দিশাহারা । আমার চাকুরিকালীন সময়েই তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছিলেন । কাজেই তাঁদের নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে কর্মচ্যুতি সবটা সম্বন্ধেই আমার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে । চাকুরির সুবাদে এই শিক্ষকদের একটা বড়ো অংশের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচয় রয়েছে । এঁদের অনেকে আমার ছাত্র, আমার একসময়ের সহকর্মী, অনেককে শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মশালা, প্রোগ্রামে পেয়েছি, অনেককে ডি এল এড-এ পড়িয়েছি । কাজেই তাদের যোগ্যতা, মেধা ও মনন সম্বন্ধে আমার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে । সেকারণেই তাদের দুঃখে ও লাঞ্ছনায় আমার কলম আমাকে তাড়িত করে তাদের জন্যে লিখতে । আমার আর কি এমন যোগ্যতা রয়েছে । আমাদের রাজ্যে তো কত শিক্ষকই তো জাতীয় স্তরে, রাজ্যস্তরে সম্মানিত হয়েছেন । রাষ্ট্রপতির হাত থেকে রাজ্যপালের হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করেছেন । অনেকেই শিক্ষাবিভাগীয় অনেক পদ সামলেছেন । তাঁরা সম্মানের সব সর ননী খেয়ে মোহন্ত হয়ে বসে আছেন । এই অবহেলিত শিক্ষকদের জন্যে একটা কাশিও দেননা তাঁরা । এই শিক্ষকরা যখন রুটি রুজি ফিরে পাওয়ার জন্যে রাজপথে নেমে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা নির্যাতিত হন তখনই আমার প্রাণ কেঁদে ওঠে কিছু লেখার জন্যে । আমার সেইসব লেখা সোস্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায় । লিখে যে শুধু বাহবা পাই তা না । আমার কোনো বক্তব্য যদি একাধিক গ্রুপে বিভক্ত এই শিক্ষকদের কোনো গ্রুপের সামান্য মনঃপূতও না হয় তাহলে আমার চোদ্দোপুরুষ তুলে গালাগাল করতে ছাড়েন না । তুই-তোকারি থেকে শুরু করে ভাষাব্যবহারে তাঁরা যে শিক্ষক সেই চিহ্নটুকুও মুছে ফেলেন । আমি নীরবে হজম করি । প্রথমত ভাবি, তাদের বিষয়ে নাক গলানোর তো আমার অধিকার নেই । দ্বিতীয়ত, তাদের মতো অবস্থায় থাকলে আমারও হয়তো হিতাহিত জ্ঞান থাকত না । তাঁদের অস্তিত্বের সংকটই তাঁদের ক্ষুব্ধ করে তোলে । কমেন্টগুলোর স্ক্রিনশট রেখে মাঝে মাঝে দেখি আর চোখের জলে ভাসি । তবুও কেন জানি বেহায়ার মতো লিখে ফেলি ।
এই শিক্ষকরা বড়ো বেশি আবেগপ্রবণ । তাই তাঁদেরকে সবাই খেলার পুতুল ভাবে । রাজনীতির দাবার বোড়ে করে । সর্প হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ফুঁক করে । ওদের উপদলে ভাগ করে আন্দোলনকে দুর্বল করে । ওরাও একদল অবস্থান করলে আর একদল যায় না । একদল লাঠিপেটা জলকামানে বিধ্বস্ত হলে আর একদল টুঁ শব্দটি করে না । ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে একদল আর একদলকে লুকিয়ে যায় । একদল ক-এর ছত্রচ্ছায়ায় থাকে তো আর একদল ব-এর তোষামোদে কার্যোদ্ধারের স্বপ্ন দেখে । তারপরেও একসময় মোহভঙ্গ হয় কারো কারো । যাদুকরের মায়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায় কেউ কেউ ।
এই দুখি শিক্ষকদের একাংশ সবশেষে তাদের আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন সম্প্রতি । তাঁরা তাদের চাকরি ফিরিয়ে দেবার দাবিতে আমরণ অনশনের পথ বেছে নিয়েছেন । এযাবত নেওয়া তাঁদের সমস্ত প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে ভেবেই তাঁরা এই দুঃখজনক পথ বেছে নিয়েছেন । না খেয়ে খেয়ে একদল মানুষ প্রকাশ্যে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন একি কাম্য ! একজন সাধারণ নাগরিক কি এদৃশ্য সহ্য করতে পারবেন ?।আজ তাদের আন্দোলন ত্রয়োদশ দিনে পড়ল । প্রতিদিন অনশনকারীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন । যে কোনো সময় দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যেতে পারে । এদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে, প্রবোধ দেওয়ার জন্যে কেউ কাছে ভিড়ছেন না । সমাধানের ক্ষেত্রেও অহেতুক বহু কালহরণ হয়ে গেছে । পাষন্ড শিক্ষাবিভাগীয় অফিসারদের কথা শুরুতেই বলেছি ।ওদের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করা সোনার পাথরবাটি । যদি বোধোদয় হয় তো তা সুস্বাগত । রাজনৈতিক দলগুলো এখন জল মাপবে । কারণ সামনে নির্বাচন । এই সংকটময় সময়ে সাধারণ মানুষ তাদের পাশে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই । এই অসহায় শিক্ষকদের সামনে সত্যিই আর দ্বিতীয় পথ নেই । নেই আর ।
No comments:
Post a Comment