নেই কেন সেই গোলা নেই কেন
অশোকানন্দ রায়বর্ধন ।
বাঙালির জীবনপ্রণালী একসময় মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল । ছয় ঋতুকে ঘিরে কৃষিকর্মের মধ্য দিয়েই সংবৎসরের আহার্য সংগ্রহ করা হত । গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বর্ষার বৃষ্টিজলে ভিজে যে ফসল ফলানো হত , শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের শেষদিকে সে ফসল ঘরে আসত । কার্তিক এবং অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল । হেমন্তের দুটি রূপ । কার্তিক মাসটি ছিল অভাব অনটনের মাস । এইসময় বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত । সারাবছরের অন্নসংস্থান করার জন্য যে খাদ্যশস্য জমিয়ে রাখা হত সেই ধান-চাল কার্তিকে এসে ফুরিয়ে যেত । ধান-চালের ভান্ডার খালি হয়ে যেত । তাই কার্তিকমাসের একটা দুর্নাম ছিল । এই মাসকে বলা হত 'মরা কার্তিক' । রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও মন্দাক্রান্ত কার্তিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায় । আর অগ্রহায়ণমাসে পাওয়া যায় এর বিপরীত চিত্র। এই সময় মাঠে মাঠে সোনালি ফসলে ভরে যায় । শুরু হয় ফসল কাটা । ঘরে ঘরে শুরু হয় ব্যস্ততা । চলে নবান্নের আয়োজন । কৃষাণী বধূ উঠোন নিকানোর কাজ শুরু করে । চলে ধান মাড়াই, পাকা ধান শুকানোর কাজ । একসময় পাকা ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে ।
একসময় গ্রামে বর্ধিষ্ণু কৃষকের প্রতীক ছিল ধানের গোলা । ধানের গোলা বাঙালির গ্রামীন শস্যগুদাম । বাঙালির সংসার বলতেই একটা কথা প্রচলিত ছিল 'গোয়ালভরা গোরু, পুকুরভরা মাছ আর গোলাভরা ধান' । গ্রাম বাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল এই ধানের গোলা । সম্পন্ন গৃহস্থরা ধান রাখার জন্যে এই গোলার ব্যবহার করতেন । অতীতদিনে বাড়িতে ধানের গোলা না থাকলে গৃহস্থরা সেই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিতেন না । নোয়াখালি অঞ্চলের একটা প্রবাদে পাই 'হোলা বিয়া করাইবা জাত চাই / মাইয়া বিয়া দিবা ভাত চাই' । কৃষকের ধানের গোলার সঙ্গে ধনের দেবী লক্ষীর নিবিড় সম্পর্ক । লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় ধানের গোলার চিত্রও অংকন করা হয় আজো । বিয়ের পর নববধূ শ্বশুরবাড়িতে এলে তাকে ধানের গোলা দেখানোর লোকাচার দক্ষিণ ত্রিপুরায় আজো রয়েছে ।
গ্রামদেশে শস্য সংরক্ষণের লোকজ প্রযুক্তি এই ধানের গোলা । গোলাঘরে ধান, বীজ রাখলে সেগুলো ভালো থাকে । শোবার ঘরে বা অন্যত্র ধান বা শস্যাদি রাখলে ইঁদুর ও সাপের প্রকোপ বেড়ে যায় । তাই গোলাঘরে ধান-বীজ সংরক্ষণ নিরাপদ । আগের দিনে বাড়িঘর নির্মানেও বাস্তুশাস্ত্র বা স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা হত । বলা হত ' দক্ষিণদুয়ারী ঘরের রাজা / পুবদুয়ারী তার প্রজা / উত্তরদুয়ারীর ভাত নাই / পশ্চিমদুয়ারীর কপালে ছাই' । আগেরদিনে বাড়িঘরের দক্ষিণদিক খোলা রাখা হত । সেই দিক দিয়ে বাড়ির প্রবেশপথ থাকত । গৃহস্থবাড়ির ঐশ্বর্যসূচক এই গোলাঘর দক্ষিণদিকেই একপাশে থাকত । যাতে বহিরাগতরা এই গৃহস্থের ঐশ্বর্যের অনুমান করতে পারতেন । প্রবাদেও তেমনি রয়েছে 'পুবে হাঁস, পশ্চিমে বাঁশ / উত্তরে কলা আর দক্ষিণে খোলা / গোলা' ।
এই ধানের গোলা নির্মানে লৌকিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও ছিল সেইসময় । ধানের গোলা তৈরির জন্যে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন । তখনকার দিনে দশগ্রামে হয়তো দুচারজন গোলা তৈরির দক্ষ শ্রমিক পাওয়া যেত । তাদের খবর দেওয়া হলে তারা এসে স্থান নির্বাচন করত । তারপর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যোগাড় হলে গোলা তৈরির কাজ শুরু হত । অপেক্ষাকৃত ধনাঢ্যরা বেশ শক্তপোক্ত গোলাঘর তৈরি করতেন । তারা পুরোটা বাঁশবেতের সাহায্যে করতেন । বাঁশ, বাঁশের পিঠের অংশের বেত,বাঁশ কেটে শক্ত কঞ্চি, বেত ইত্যাদি দিয়ে গোলাকার কাঠামো তৈরি করা হত । এরপর তার গায়ে ভেতরে ও বাইরে বেশ পুরু করে এঁটেল মাটির আস্তরণ লাগানো হত । চোর-ডাকাতের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে গোলার মুখ রাখা হত অনেক উপরে । বন্যা ও ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ধানের গোলা অনেক উঁচুতে বসানো হত । নির্মিত গোলার মাথায় বাঁশ, ছন বা খড়ের ছাউনি থাকত । ধনী গৃহস্থরা কেউ কেউ টিনের ছানিও দিতেন ।
সাধারণ গৃহস্থরা অল্প খরচে ধানের গোলা তৈরি করতেন । এই গোলা তৈরির প্রধান উপকরণ হল ধান মাড়াই শেষে উদ্বৃত্ত খড় । ধানের খড় দিয়ে দড়ির মতো লম্বা বিনুনি পাকানো হত । খড়ের গাদা থেকে খড় টেনে একজন বিনুনি পাকানো শুরু করতেন ।আরেকজন সহযোগী পাকের সঙ্গে সঙ্গে খড় সরবরাহ করে যেতেন । এভাবে খড়ের সাথে খড় জুড়ে জুড়ে দীর্ঘ বিনুনি তৈরি করা হয় । এই লম্বা দড়িকে গোলার জন্য নির্মিত বাঁশে কাঠামোর মধ্যে বৃত্তাকারে স্তরে সাজিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গা ঘিরে ফেলা হত । এরপর এটার বাইরে ভেতরে গোবর-মাটি-তুষের মিশ্রণ পুরু করে লেপে দেওয়া হলেই শক্তপোক্ত মড়াই তৈরি হয়ে যায় ।
কালক্রমে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে একসময় গোলাঘরে ব্যবহার কমে আসে । গোলাঘর নির্মানের অভাবে কৃষকরা বাঁশের তৈরি ছোটো আকারের জালাতে ধান রাখতে শুরু করেন । এগুলোকে 'ডোল' বলে । উত্তর ত্রিপুরার সিলেটিরা বলেন 'টাইল' । একসময় বাঁশের তৈরি ডোল বা টাইল সারা পূর্ববাংলায় ও ত্রিপুরার সর্বত্র ব্যবহার হত । চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরা বনে প্রাপ্ত 'ডলুবাঁশ' নামে এক প্রজাতির বাঁশ দিয়ে বাঙালি ও উপজাতি কামলারা এই ডোল বানাতেন । ত্রিপুরার বাঙালি ও উপজাতিদের অনেকেই এই ডোল নির্মানে দক্ষ ছিলেন । তাঁদের নির্মিত ডোল কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে গ্রাম্য বাজারগুলিতে বিক্রির জন্য তোলা হত । বাজারের বিরাট অংশ জুড়ে থাকা সারি সারি ডোলের এ দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না । সেই কামলারাও নেই । বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় ডলুবাঁশ ও এখন দুর্লভ । বাঁশবেতের এই লৌকিক শিল্পটি এখন বিলুপ্তপ্রায় । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ত্রিপুরার মগ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বুদ্ধ পূর্ণিমার সময় যে আকাশবাতি ওড়ান তার গঠন ডোলের আকৃতির হওয়ায় দক্ষিণ ত্রিপুরার বাঙালিরা এই আকাশবাতিকে 'ডোলবাত্তি'ও বলেন । এই ধানের ডোল নিয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরার একটি প্রচলিত ধাঁধা হল 'রাজার বাড়ির মেনা গাই মেনমেনাইয়া চায় / হাজার টাকার ধান খাইয়া আরো খাইতো চায়' । লৌকিক ছড়াতে যেমন রয়েছে 'ছেলে ঘুমিওনা পাড়া জুড়াবেনা / বর্গী আছে দেশে / ধানের গোলা শেষ হয়ে যাবে / খড় কুড়াবে শেষে' । তেমনি আধুনিক কবির কবিতায়ও রয়েছে ধানের গোলার প্রসঙ্গ– 'ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা / ভাঙছ ঘর বাড়ি / পাটের আড়ত ধানের গোলা / কারখানা আর রেলগাড়ি ( তেলের শিশি-অন্নদাশংকর রায় ) । রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেছেন, 'রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা মন্দির করি পাছে / তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু শেষে আমার বাড়ির কাছে ( দুই বিঘা জমি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) ।
সময়ের গতির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা আজ হারিয়ে গেছে । বর্তমান প্রজন্মের কাছে তা রূপকথার মতো শোনাবে আজ । বর্তমানে ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি গুদামঘরে ধান রাখা হয় । বাড়িঘরে পাট প্লাস্টিক ইত্যাদির বস্তায়ই আজকাল ধান মজুত করা হয় । এখন আর সেই বর্ধিষ্ণু পরিবার নেই । গ্রামীন চাষপদ্ধতিতেও এসেছে আধুনিকতা । ছোটো ছোটো পরিবার হয়ে ভেঙে গেছে বাঙালির একান্নবর্তী পরিবার । স্থান সংকুলানের অভাবেও গোলাঘরকে বিদায় জানাতে হয়েছে । যেমন বিদায় জানিয়েছে বাঙালি তার বহুবিধ লৌকিক সংস্কৃতিকে ।
No comments:
Post a Comment