অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আমি একজন দৃঢ়চেতা স্বাধীনতা সংগ্রামীর সন্তান । যিনি তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের বিনিময়ে কোনো সাম্মানিক কোনো স্বীকৃতি গ্রহণ করেননি । তাঁর আদর্শেই আমি বেড়ে উঠেছি । প্রতিবাদী মানসিকতা নিয়েই চলি । ফলে এই স্বাধীন দেশের শাসক গোষ্ঠীর রাজনীতির সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারিনি । সারাটা জীবন ভুগতে হয়েছে তার জন্যে । কর্মজীবনে প্রাপ্য সুযোগ থেকে । দোরগোড়ায় এসে ফিরে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সম্মান । সে অনেক কথা ।
স্বাধীনতা যুদ্ধে যে দল মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করার ইতিহাস তৈরি করেছে । ক্ষমতায় এসে তারা বিরুদ্ধ মতাদর্শের মানুষগুলোকে পদে পদে লাঞ্ছিত করেছেন । বিপ্লবীদের অনেকেই স্বাধীনোত্তরপর্বে রাষ্ট্রশক্তির রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হয়েছেন বার বার । তাঁদের অতীতের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড, তাঁদের অবদান বেমালুম ভুলে গেছে স্বাধীন দেশের কান্ডারীরা । ইংরেজ আমলের চর ও পুলিশ অফিসারেরা একসময় রাষ্ট্রের হাল ধরে ফেলে । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে বিপ্লবীদের নাজেহাল করতে ছাড়ে না । নানাভাবে নানা দুর্নীতিতে তারা জড়িয়ে পড়ে । চলমান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে একসময় বিক্ষোভও হয় । গণতান্ত্রিক নিয়মে পরিবর্তনও আসে । বিক্ষুব্ধ দল ক্ষমতায় এসে শাসকেরই রূপ নেয় । নৃশংসতায় পূর্বসূরীদেরকে পেরিয়ে যায় । হয়তো আবারও বদল হয় । পতন ঘটে এক একটি স্বৈরতান্ত্রিক অধ্যায়ের । এই বিষয়গুলো ঘুরে ঘুরে আসতে দেখছি এ দেশে, এ রাজ্যে ।
পতনের পর প্রতিটি দলই নবীন সন্ন্যাসী হয়ে যায় । ভুলে যায় তাদের পূর্ব কীর্তির কথা । চলমান শাসকের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণ হয়ে কুৎসা করে আর নতুন করে স্বপ্ন দেখায় মানুষকে । চলমান শাসকেরাও পূর্বতন শাসকের কুশাসনের ক্যাসেট বাজিয়ে পূর্বের প্রতিশ্রুতি কবরে পাঠিয়ে নতুন ঠাকুমার ঝুলি নিয়ে আসে । সুযোগসন্ধানীরা দলবদল করে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে । দলবদলের কারণে ফেলে আসা সহযোদ্ধাকে ল্যাং মারে । দলে যোগ দেওয়ায় পূর্বশত্রুকে গঙ্গাজলে ধুয়ে গলায় জড়িয়ে নেয় । সবগুলো দলই ক্ষমতায় থাকলে বিরুদ্ধ মতাদর্শের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে যায় । সাধারণ মানুষকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে । নানাভাবে নির্যাতন করে । দুবেলা পার্টি অফিসে হাজিরা না দিলে, মিছিলে না গেলে, তেলের বাটি নিয়ে নেতাদের বাড়ি না ঘুরলে সে নাগরিকদের রক্ষা নেই ।
সুযোগসন্ধানীরা সুদিনে যে দলের ব্যানারবাহক হয় দিন ফুরোলে রাতারাতি অন্যদলের ঝান্ডাবাহিনীর সামনের সৈনিক হয় । যে নাগরিক বিরুদ্ধাচরণ করে তার বিরুদ্ধে মানুষ লেলিয়ে দেওয়া হয় । সে নাগরিকের কোনো নিকটাত্মীয় সরকারী চাকুরে হলে তার উপরেও কোপ আসে রাজনীতির । নিরীহ হলেও রেহাই থাকে না তার । আর কোনো সরকারি কর্মচারী অপছন্দের হলে তো তাকে সাতঘাটের জল খাইয়ে দেওয়া হয় । তাকে সাতবার গাড়ি পাল্টানো জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয় । অনেকটা পরাধীন ভারতবর্ষের দ্বীপান্তরের মতো । আবার দলীয় সূত্রে নতুন জায়গায়ও তার পরিচিতি পৌঁছে দেওয়া হয় । সেখানেও তার উপর থাকে শ্যেনদৃষ্টি । বৃটিশ আমলে পুলিশের নজরে যেমনটা ছিলেন বিপ্লবীরা । অসুস্থ মা-বাবা, সন্তান প্রিয়জন বিচ্ছিন্ন হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে শেষ হয় যাওয়া ছাড়া , পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না ।
রাজনীতির এই নোংরামিগুলোর কথা বলে লাভ নেই । নামে রাজনীতি । রাজার নীতি । নীতির রাজা । কিন্তু এটাকে পেশাগতভাবে কব্জা করে নিয়েছে অর্ধশিক্ষিত ও নোংরা মনের মানুষেরা ও তাদের পোঁধরা সুযোগসন্ধানী মানুষেরা । আমার পেশাগত জীবনে আমি পদে পদে এইসব দুর্ভোগ পেরিয়েছি । আমি বলতে পারিনি সন্তানের মুখ চেয়ে । ছেলেদুটোকে আমার দাঁড় করাতেই হবে । আমার রক্ত তো তাদের শরীরে । তারাও চাকরির জন্যে নবরত্ন তেল নিয়ে নেতা-মন্ত্রীর দুয়ারে ঘুরতে পারবে না । বলতে পারিনি পরিজনের ভাবনায় । অন্নচিন্তায় । সেই ফিরিস্তি তুলে ধরলে লেখাটা আত্মকথনে ক্লিষ্ট হয়ে যাবে । আর কারো নাম করে তাঁকে বা তাঁদেরকে সমাজে হেয় করা আমার উচিত হবে না । আমার প্রতি বিরাগভাজন হলেও অন্যের হয়তো উপকার করেছেন । তাই দুঃখটা অন্তরেই পুষে রাখলাম । কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা দিন দিন অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি বলে বড়াই করছি । কিন্তু ঈর্ষা, প্রতিহিংসায় আমরা সেই আগের যায়গাতেই রয়ে গেছি । সাধারণ ছাপোষা কর্মজীবীদের নিয়ে আজও সেই নোংরামি সমানে চলছে ।
No comments:
Post a Comment