Saturday, April 29, 2023

স্থাননাম দমদমা



স্থাননাম দমদমা


অশোকানন্দ রায়বর্ধন


দমদমা ( বিশেষ্য পদ ) মানে উঁচু জায়গা বা টিলা । আরবি শব্দ 'দম্দমহ্' থেকে পরিবর্তিত হয়ে শব্দটি বাংলায় এসেছে । খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সম্রাট আকবরের প্রশাসনের বর্ণনাসমৃদ্ধ নথি আবুল ফজলের 'আইন ই আকবরী'তে এই শব্দটি পাওয়া যায় । মূলত, পলি, কাঁকড়, নুড়ি ও বালি মিশ্রিত ভূভাগ দেখা যায় দমদমায় । 


আবার কোথাও কোথাও দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ভূভাগ বা জমির মাটি একদম নরম হতে দেখা যায় । পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা জল এইভূমিতে এসে জড়ো হয়ে নিচের মাটিকে নরম করে রাখে । উপর থেকে যা বোঝা যায় না । ওই ভূমিতে পা দিলেই পাসহ শরীর সেখানে ডুবে যেতে থাকে । স্থানীয়ভাবে এই ভূভাগকেও 'উৎলা' বা 'দলদলি' বা 'দমদমা বলে থাকেন । অনেকসময় গৃহপালিত পশুরা সেখানে আটকে পড়ে । একসময় ত্রিপুরার সর্বত্রই এই ধরনের জমি ছিল । রাজন্য আমলে এই জাতীয় জমিকে ঘিরে হাতি ধরার ফাঁদ পাতা হত । একে 'খেদা' বলে । বুনো হাতি একবার এখানে এসে পড়লে তার বিশাল শরীর নিয়ে আর উঠতে পারত না ।


দমদমা শব্দের আরেকটি অর্থ  সামরিক ব্যবস্থাপনায় পাওয়া যায় । সৈন্যদের বন্দুকচালনার প্রশিক্ষণ চলাকালীন নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে আঘাত করার কৌশলগত দক্ষতা অর্জন করার জন্য উঁচু মাটির ঢিবি তৈরি করা হত । সে অর্থে 'উঁচু জায়গা' মানে 'দমদমা' । আবার এও হতে পারে, যেখান থেকে সেনাবাহিনীর গুলির আওয়াজ দ..ম দ..ম শোনা যেত সেই জায়গাটি দমদমা । আগরতলা শহরেরে সন্নিকটে চানমারি ও দমদমিয়া নামে দুটি জায়গা রয়েছে । কোলকাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন স্থান দমদম বিখ্যাত জায়গা । সেখানেও সেনানিবাসের উদাহরণ রয়েছে । যেহেতু সেনানিবাস ছিল তাহলে সৈখানে একসময় চানমারিও ছিল ।


আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রাচীন রীতিতে যে মাটির বা ছনবাঁশের ঘর রয়েছে তার ছাদের অংশকেও স্থানীয় বাংলায়  দমদমা বলা হয় । ঘরের ভিতরে উপরে টিনের চালের নিচে বাঁশের বেড়া দিয়ে ছাদ ঢেকে দেওয়া হতো । তার দুটো উদ্দেশ্য । এক, রৌদ্রের তাপ থেকে ঘরের ভেতরের অংশ রক্ষা করা । দুই, কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী যত্নে রেখে দেওয়া । আগের দিনে গাছ থেকে সুপারি পাড়া হলে তা দমদমায় বিছিয়ে রাখা হত । ছাদের গরমে সুপারির খোলসটি দ্রুত শুকিয়ে যেত । অনেকে আগুনের উৎপাত থেকে ঘরের সামগ্রী রক্ষা করার জন্য দমদমার উপরে পুরু মাটির আস্তরণ দিয়ে রাখতেন ।


এবারে আসা যাক, সাব্রুমের দমদমার কথায় । সাব্রুম ও তার আশপাশ এলাকার মধ্যে এই স্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু । তাই তার নাম দমদমা হতে পারে । সাব্রুমের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী জানা যায়, এখানে একসময় ত্রিপুরার রাজার সেনানিবাস ছিল । হয়তো তাদের চাঁদমারি ছিল এই দমদমায় । তা থেকেও দমদমা হতে পারে । 


স্বাধীনতাপরবর্তী ও ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পরে বাংলাদেশের নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা থেকে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এসে এখানে বসতি গড়েছেন । নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বাংলায় বহু আরবি ফারসি শব্দ প্রবেশ করেছে । মূলত, বহু প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আরব ও অন্যান্য দেশের বণিকগণ আসা-যাওয়ার ফলে তাদের শব্দ সেই অঞ্চলের বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে । তাছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই এর কাছে দমদমা নামেএকটি গ্রাম আছে । সেখানকার কোন মানুষ পরবর্তী সময়ে এখানে এসে বসবাস করার ফলে পূর্ব স্মৃতি ধরে রাখতে তার নাম দমদমা রাখতে পারেন । 


বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম-এ বহু স্থাননাম দমদম, দমদমা, দমদমিয়া ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । এরকম বহু স্থাননামের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে । 

ছবি : নেট থেকে সংগৃহীত ।

No comments:

Post a Comment