Tuesday, May 2, 2023

কেসহিস্ট্রি আর কথাসাহিত্যে সমাজসমস্যার প্রকাশ

কেসহিস্ট্রি আর কথাসাহিত্যে সমাজসমস্যার প্রকাশ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

 মামলায় জড়িয়ে পড়লে বোঝা যায় তার মধ্যে কি জট আর জটিলতা । আইন ও বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল বিষয় । মানুষ সুবিচারের জন্য আদালতে যান । এক্ষেত্রে আইনজীবীর বিশেষ ভূমিকা থাকে । অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়ের উপর তাঁকে নজর রাখতে হয় । আইনজীবী তাঁর মক্কেলের পক্ষে বিভিন্ন রকম তথ্য উপাত্ত বিচারকের কাছে তুলে ধরেন । সে ক্ষেত্রে সাক্ষ্য বা তথ্য উপস্থাপনের সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি থাকলে বা অসাবধানতাবশত দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে তা অনেক সময় বিচার প্রার্থীর বিপক্ষে যেতে পারে । আইনজীবীর বিচক্ষণতা ও স্পষ্ট মনোভাবের ফলে মক্কেল মামলায় সঠিক বিচার পায় । আবার আইনজীবীর শুধুমাত্র ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়কে প্রাধান্য দিলে তখন বিচার ব্যবস্থা মার খায় ।

দেবরঞ্জন চৌধুরী পেশায় আইনজীবী । তার পিতাও একসময় আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । ফলে বিচারালয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের একটা যোগাযোগ রয়েছে । বিচার ব্যবস্থার নাড়িনক্ষত্র সম্বন্ধে তিনি বিশেষভাবে অবগত আছেন । বিচার ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে বহু ঘটনার সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । বিচারকার্য পরিচালনা করতে গেলে বিচারক আইনজীবী এবং মামলার বাদী-বিবাদী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহু খুঁটিনাটি দিকের উপর নজর রাখতে হয় ।

 আদালতের অলিন্দে দীর্ঘকাল পদচারণার ফলে বিশিষ্ট আইনজীবী দেবরঞ্জন চৌধুরী বিচার প্রক্রিয়াকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন । সুবিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে মক্কেলকে মামলা করার জন্য উৎসাহিত করার পাশাপাশি আইনজীবীরা যে পেশাগত দায়িত্বের উর্ধ্বে উঠে সামাজিক দায়িত্ব পালনেও ভূমিকা নিতে হয়, সে দিকটিও লক্ষ্য রাখতে হয় সে ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ।

লেখক তাঁর 'বিচারালয়ের অভিজ্ঞতা' ( প্রকাশক মৌমিতা প্রকাশনী, বইমেলা ২০০৩ ) গ্রন্থে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন । বৈঠকি ঢঙে বর্ণনা করা তাঁর কেস হিস্ট্রিগুলো পড়লে জানা যায়, কিভাবে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবীর গভীর অনুসন্ধানী পদক্ষেপের ফলে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মক্কেল সুবিচার পায় । আবার ত্রুটিপূর্ণ জবাবের কারণে এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি এক্সিবিট করার ক্ষেত্রে গাফিলতি থাকার ফলে 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে' । একেবারে সহজ সরল ভাষায় লেখক ছোটো ছোটো কেসহিস্ট্রি তুলে ধরে অত্যন্ত সুখপাঠ্য করে তুলেছেন বইটি । আইনঘটিত বিষয় হলেও আইনি কচকচি নেই বইটিতে । তাই পাঠক খুব আগ্রহের সঙ্গে বইটি পড়বেন । বাদী বিবাদীর নাম উল্লেখ না থাকলেও বর্ণিত মামলা সংক্রান্ত ঘটনা স্মরণ করে  এই গ্রন্থের মাধ্যমে রাজ্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার ইতিহাস ও জানতে পারবেন পাঠক । এটা একটা বাড়তি পাওনা ।

'দীপ শিখা' দেবরঞ্জন চৌধুরীর দ্বিতীয় গ্রন্থ । এই গ্রন্থেরও প্রকাশক মৌমিতা প্রকাশনী, আগরতলা । প্রকাশকাল বইমেলা ২০২৩ উপন্যাস না বলে এটিকে একটি বড় গল্প  বলা যেতে পারে । গল্পের মূল দুটি চরিত্র দীপ ও শিখা  কৈশোরের বন্ধুত্ব থেকে যৌবন সমাগমে পরস্পরের অজান্তে একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলে । একসঙ্গে কলেজে পড়াশোনা করতে করতে শিখাকে একদিন রাজ্যান্তরী হতে হয় । মা-বাবা ও অন্যান্য অভিভাবকদের চাপে পড়াশোনায় মেধাবী ও অন্যান্য গুণে গুণান্বিতা এই মেয়েকে তারা বিয়ে দিয়ে দেয় । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ভালো ঘরে বিয়ে হলেও একদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয় শিখা, তার স্বামী ও দুই সন্তান । দুদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মারা যায় শিখার স্বামী । দুই অসহায় সন্তান নিয়ে তার স্বামীর গৃহে স্থান হয় । এদিকে দীপ চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কলকাতার ডাক্তার নীলরতন সরকার হাসপাতালে কর্মজীবন শুরু করে । ভাগ্যক্রমে দীপের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলে শিখার । একসময় তারা পরস্পরকে চিনতে পারে ।  গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয় উভয়ের মন । কিন্তু একদিন শিখাকে সুস্থ করে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয় দীপ ।

তারপর বহুদিন পর তাদের বাল্যবন্ধু গল্পের কথক আবার যোগাযোগ তৈরি করতে পারে দীপ ও শিখার সঙ্গে । সেদিন দেখা যায়  দীপ বার্ধক্যে জর্জরিত । শিখা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে । ছেলেও প্রতিষ্ঠিত । মেয়ে ও জামাই যাদবপুরে থাকে । মেয়ের বাড়িতে এলে শিখা দীপকে দেখে যায় । উভয়ের ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হলেও কৈশোরের কাছাকাছি আসা দুটি মন এক হতে পারেনি কোনোদিন । 'ওদের কাছে তাই তাদের বাল্য জীবনের ভালোবাসা যেন জীবনের সমস্ত কিছু বলার মধ্যেও যেন অপূর্ণতা ও অভিশাপ
 ।'

এই হল গল্পের বিষয়বস্তু । নিটোল প্রেম ও অপূর্ণতার গল্প হলেও আজ থেকে ষাট সত্তর বছর আগের সামাজিক অবস্থার প্রতিই মূলত তিনি ইঙ্গিত করেছেন তাঁর গল্পে । এ প্রসঙ্গে লেখক নিজেই তাঁর গল্পের ভূমিকায় লিখেছেন, "আইনজীবী প্রফেশন থেকে নিজেকে আইনের গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রেখে মনে হল সমাজের বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং অজ্ঞতা আজও সার্বিকভাবে আমাদের সমাজের উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । তারই উদাহরণ নীরমহলের স্থপতি রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের একটি বিশেষ কীর্তি যেটিকে নষ্ট করে দেওয়ার মানসিকতা এবং আজও আমাদের সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার মেয়েদের জীবনের এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে আছে । তারই প্রকাশ করার ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র ।" 

গল্পের আড়ালে সমকালের একটি সমস্যাকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন লেখক তাঁর লেখার নিপুন বাঁধুনিতে । গল্পটি পড়ার পর পাঠককে ভাবাবে ।

No comments:

Post a Comment