ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক
টিংকুরঞ্জন দাস। ত্রিপুরার একজন সুপরিচিত কবি । প্রেমপ্রবণতা, নিসর্গচেতনার সঙ্গে সমাজভাবনা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে এক ভিন্নতর মাধুর্য দান করেছে । কবির অপর ভাবনার কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন 'ভিন্নপথের পথিক' । কবি তো পথিকই । জীবন ও সমাজ প্রকৃতির আলপথে বিচরণই তাঁর কাজ । এই পথের দুপাশে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় বৈচিত্র্য ফুটে উঠে, আর সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যায় । কবি বাস্তবজীবনে দায়িত্বপূর্ণপদ সামলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত । ফলে জীবনকে ভিন্ন রূপে দেখার সুযোগ রয়েছে তাঁর । রয়েছে দেখার চোখও—
স্কুলছুট কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিত ছেলে মেয়েদের ধরে আনতে
বেরিয়ে পড়ি প্রায় সকালেই পাড়ার বাড়ি বাড়ি
দুঃখ হলেও হাসিমুখে সব দোষ করি স্বীকার
তবুও যেন ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে রেগুলার
তারপরও শুনি পথে ঘাটে,
ও, সে তো সাধারণ এক স্কুল টিচার
কাজকর্ম ফেলে রেখে সারাদিন ঝাড়ে শুধু চক ডাস্টার ।'
চিরায়ত শিক্ষকমননজাত প্রেরণা থেকে জীবনের এক ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মুখ দেখবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর । তাঁর মধ্যে তাই রয়েছে এক তন্ময়তার ভাব। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, জীবনের কঠোর-কর্কশ, সুন্দর-অসুন্দর পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা । মানুষের কল্যাণবোধ ও মঙ্গলভাবনা তাঁর কাব্যের উপজীব্য । সমকালের রাজনীতির সঙ্গে তিনি পরিচিত । দেখছেন রাজনীতির অস্থিরতা, রাজনীতির বাণিজ্য । কিন্তু হৃদয়ের বাণীই তাঁর কাব্যের প্রধান শর্ত । সেখানেই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা—
তাই এবার আর মৌ নয়,
এসো, একে অন্যের মুখে তুলে দেই এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন
বিবস্ত্র মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিই সামান্য ভালোবাসার চিহ্ন
একবার অন্তত বাঁচি
সেই সব বিবস্ত্র অভুক্ত মানুষের জন্য ।
কবি টিংকুরঞ্জন দাসের কবিতার নিবিড় পাঠের মধ্যে যে কাব্যসূত্র সমূহ প্রকট হয়ে ওঠে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজালে পাই—
ক) কবির হৃদয়ের মধ্যে কল্পনাচারিতা রয়েছে । তবে সেই কল্পনা বাস্তববিচ্যুত নয় । তার মনের মধ্যে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার যে স্বচ্ছতা রয়েছে তা তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেন ।
খ) কবির হৃদয়ে যে চিন্তা বা চেতনার বিস্তার ঘটে তা শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার জগতে নয় । বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তার প্রকাশে বলিষ্ঠতা রয়েছে ।
গ) তাঁর কবিতার বাকভঙ্গিমা আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত না হলেও তাঁর কাব্যরচনার একটা নিজস্ব ক্ষমতা বা স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে ।
ঘ) বাস্তবক্ষেত্রে কবি বা সাহিত্যিকরা স্বাধীনচেতা হন । সে কারণেই নিজেকে কাব্যবেষ্টনীর মধ্যে না রেখে প্রকাশের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন এই কবি ।
কবি তাঁর কাব্যের উপাদান তাঁর পরিচিত নিসর্গ ও সমাজপারিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করেছেন । সেকারণেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয়নিঃসৃত ও স্বচ্ছ । তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না । ভাষা ও ভাবে কৃত্রিমতা থাকলে তা কখনোই প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা । পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতাময় এই সময়ে মানুষ, মানবতা ও সময়ের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত কবির হৃদয়ের ভাষা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় । পাঠকচিত্তকে অবশ্যই এক অন্যতর ভুবনে নিয়ে যাবে এই কাব্যগ্রন্থটি ।
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
দার্জিলিং টিলা, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা
২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ ।
No comments:
Post a Comment