Sunday, December 17, 2023

ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

 ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


নৃত্য মূলত এক ধরনের শারীরিক প্রকাশভঙ্গিমা । এই প্রকাশভঙ্গিমা সামাজিক, ধর্মীয় এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হতে লক্ষ করা যায় । মানব সমাজের আদিম পর্বের নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যে জাদুবিশ্বাসের একটা পর্যায় ছিল । এই জাদুবিশ্বাসজনিত প্রভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে শুভ ও শুভ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রক্রিয়া হল নৃত্য । শিকার ধরা, দেবতাকে সন্তুষ্ট করা, রোগ নিরাময়, ভূত-প্রেত ইত্যাদি কল্পিত শক্তি ও হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ নৃত্য ভঙ্গিমার ব্যবহার করত । মানবজীবনে নানা পর্যায়কে পালন করতে গিয়েও নৃত্যের বিষয়টা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । শিকারজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির ফলে ক্রমান্বয়ে যখন কৃষি জীবনে পদার্পণ করে তখনও চাষবাসসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে আনন্দমুখর করে তোলার জন্য নাচের মাধ্যমকে গ্রহণ করেছে । কৃষিকর্ম ও কৃষিক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরে নাচের যে প্রচলন রয়েছে তার মধ্যেও জাদুবিশ্বাস অত্যন্ত প্রকট রয়ে গেছে । এককথায় প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নাচের প্রচলন ছিল । প্রাচীন মিশরীয় দেওয়ালচিত্র বা প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গি খোদিত থাকতে দেখা গেছে । সে থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের মানবসংস্কৃতিতেও নৃত্যের সুদূর অতীতের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । সময়ের ক্রমবিবর্তনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচের প্রচলনও বেড়ে গেছে ।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে দুই ধরনের নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । তার একটি হল লোকনৃত্য ও অপরটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । সভ্যতার প্রাকলগ্নে প্রচলিত আদিম নৃত্য গোষ্ঠীজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নৃত্যকলায় পরিণত হয়েছে । তা একটা পর্যায়ে এসে মানুষের সমাজ জীবনচর্যায় সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে । তখন এর মধ্যে কিছু কিছু নান্দনিক ভাবনার সংযোজন ঘটেছে । এইসব নৃত্যের মধ্যে কিছু তাৎপর্যমূলক অনুষ্ঠানাদির সংযোজন ঘটেছে । ফসলের উৎসব, নর-নারীর মিলনোৎসব, শস্য ও সন্তান সংক্রান্ত উর্বরতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নৃত্যানুষ্ঠান সম্পৃক্ত হয়ে গেছে । আদিম নৃত্যের এই পর্যায়ে এসে লোকনৃত্যে উত্তরণ ঘটেছে । বিভিন্ন পর্যায়ের লোকনৃত্যে দেখা গেছে যে, এই নৃত্যসমূহ দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয় । পাশাপাশি এই নৃত্যে সংঘবদ্ধ গান বা কোরাস সংগীত ও বিভিন্ন রকম লোকবাদ্য যেমন–ঢোল, কাঁসি, করতাল, বাঁশি, ধামসা, মাদল ও বিভিন্ন তারযন্ত্রের ব্যবহার করা হয় । এই নৃত্যসমূহ বিশেষ কোনো অঞ্চলের অধিবাসী উপজাতীয় জনগণের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে । ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতীয় জনগণের স্ব স্ব লোকনৃত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । 

কোনো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হলো, তার গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ । এর মাধ্যমে কোনো নৃত্যকে শাস্ত্রীয় বা লোকনৃত্য হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব । লোকনৃত্য ছন্দ বা সংযমের কঠোর নীতিনির্দেশিকা ততটা মান্য করে না । পাঞ্জাবি ভাংরা নৃত্য বা নাগা উপজাতিদের নৃত্যে যেরকম তীব্র গতি থাকে তার তুলনায় শাস্ত্রীয়নৃত্যে যথেষ্ট সংযম ও ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । আমাদের ত্রিপুরারাজ্যেও গড়িয়ানৃত্যেও জোরালো বাদ্যযন্ত্র ও গতি লক্ষ্য করা যায় । পক্ষান্তরে মনিপুরী নৃত্যে ধীর সংযম ও ছন্দের অবতারণা করতে দেখা যায় । এছাড়া লোকনৃত্যে পোশাক কেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । কিন্তু শাস্ত্রীয়নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা আর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । লোকনৃত্যের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর জীবিকার ধরন, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মচর্চার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান । ফলে তাদের জীবনাচরণের বিভিন্ন বিষয়কে গতিময় ও দলবদ্ধ পরিবেশন করতে দেখা যায় লোকনৃত্যে । এই নৃত্য তাদের জীবনঘনিষ্ঠ নৃত্য ।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের জাতি ও জনজাতিদের লোকনৃত্যের মত ত্রিপুরার জনজাতিগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকনৃত্যের ধারা রয়েছে । তারমধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনুসৃত নৃত্যধারাটি বৃহত্তর বাঙালি জাতির নৃত্যের ধারারই অনুসরণ । কিন্তু জনজাতীয়দের যে উনিশটি শাখা রয়েছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব লোকনৃত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা রয়েছে । তাদের মধ্যে একমাত্র রিয়াংদের নৃত্যের মধ্যে কিছুটা ধ্রুপদী আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায় । যদিও তা ভারতীয় স্বীকৃত শাস্ত্রীয়নৃত্যের মধ্যে গণ্য নয় । ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নৃত্য, যা মণিপুরী নৃত্য নামে বিশ্বের সমাধিক পরিচিত তার উৎস মনিপুরে হলেও ত্রিপুরার রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতা লাভের ফলে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অসীম আগ্রহের ফলে তাঁর সৃষ্ট শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বিশাল পরিচিতি পেয়েছে । মনিপুরী নৃত্য আজ ভারতের অন্যতম শাস্ত্রীয় নৃত্য । এই নৃত্য বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত । ত্রিপুরা রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার নিবিড় ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে । যা আজও প্রবহমান ।

No comments:

Post a Comment