"অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব : প্রাসঙ্গিক কথা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
গত ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর তারিখ রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বিসর্জনখ্যাত ও রাজন্যস্মৃতি বিজড়িত শহর উদয়পুরে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল "অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব" । প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে না পারলেও দ্বিতীয়দিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঠায় বসে থেকে সমগ্র অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি । ঐতিহ্য ও আধুনিকতার নকশিকাঁথা জড়ানো এই শহরে রাজ্য ও বহির্রাজ্য থেকে স্বনামধন্য অতিথি কবি সাহিত্যিক যাঁরাই এসেছেন প্রত্যেককেই শুরু থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন উদ্যোক্তারা । দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়বেলায় ফিরে যাবার তাড়া দেখে কবি অশোক দেব মঞ্চে যখন অনুযোগ করছিলেন তখন বিদায়ী অতিথিরা প্রত্যেকেই দুহাত তুলে তাঁদের আতিথেয়তার প্রশংসা করে গেছেন । আর দ্বিতীয়দিনটিতে আমি উপস্থিত থেকে উপলব্ধি করেছি এই উচ্ছ্বাস সত্যিই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল । দ্বিতীয়দিন পুরোটা সময় ধাপে ধাপে কবিতাপাঠের আসর ছিল । ফাঁকে ফাঁকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । আলোচনায় উদয়পুরের প্রাচীন ইতিহাস, ভারতবর্ষের নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং কবিতায় স্বদেশভাবনা বিষয়ে মনোগ্রাহী আলোচনায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন যথাক্রমে বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিমান ধর, নাট্যব্যক্তিত্ব পার্থ মজুমদার এবং সন্তকবি মিলনকান্তি দত্ত । সেখানে আমি কবিতাপাঠসহ উত্তপূর্বের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও কার্বি ভাষার পাঁচজন কবিকে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও এই পর্যায়ের কবিতাপাঠে সামান্য সঞ্চালনার দায়িত্বও পালন করে কৃতার্থ হয়েছি ।
অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করার জন্যে কবি অশোক দেব, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, মনোজিৎ ধর, ভাস্করনন্দন সরকার ও খোকন সাহার স্নেহচ্ছায়ায় অনিরুদ্ধ সাহা, মৃদুল দেবরায়, খোকন সাহা প্রমুখদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তরুণ কবিদের পুরো ব্রিগেড বেশ কদিন আগে থেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়েছিলেন । তারুণ্য ছাড়া এতবড়ো কর্মযজ্ঞ সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে না । এই অনুষ্ঠানকেও তাঁরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন ।
উদ্যোগ সুশৃঙ্খল হলেও যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদেরও বোধ-বিবেচনার প্রয়োজন হয় শৃঙ্খলার গতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে । অপ্রিয় হলেও বলতেই হয়, সঞ্চালকদের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের পাত্তা না দিয়ে কবিদের একাংশের একটার জায়গায় একাধিক কবিতা পাঠ, একটি হলেও দীর্ঘ কবিতা পাঠ, অনর্থক গৌরচন্দ্রিকা দান, কবিতাপাঠের প্রারম্ভিক ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের গতিকে অনেকাংশে শ্লথ করে দিয়েছে । ফলে রাজধানীমুখী কবিদের একাংশের ঘরে ফেরার তাগাদাকে বাড়িয়ে তোলে । অবস্থা বেগতিক দেখে সময়মতো কবি অশোক দেব নিজে সঞ্চালনার দায়িত্ব নিজের হাতে না নিলে অনুষ্ঠান কখন শেষ হত বলা যায় না ।
কবিরা একটু মগ্নতায় থাকেন, খ্যাপাটে, পাগলাটে হন । তাই তাঁরা প্রশ্রয়ও পেয়ে থাকেন । এই প্রশ্রয়ের সুযোগে বারোজনের একটা কবিটিম কিসব স্বঘোষিত কবিতা পড়ে গেছেন একফাঁকে । সেগুলো যেমন ছিল দীর্ঘ তেমনি গুগল থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা আধানিবন্ধ আর পাঁচালি ধরনের ছাড়া কিছুই নয় । যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ কবিরা তাদের অত্যাশ্চর্য সব কবিতা পড়ে শ্রোতৃমন্ডলীকে চমকে দিচ্ছিলেন তার মাঝখানে এঁরা ও আরো কয়েকজন এমনই কবিতানামক কিছু পড়ে বেরিয়ে গেলেন । আর এসবের কারণে কবিতা পড়তে না পেরে, মূল্যবান আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে দুঃখ নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে ।
এর পরপরই আবার কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানকে গতিপথে ফিরিয়ে আনতে মঞ্চে উঠে এলেন রাজ্যের বেশ কজন সুখ্যাত বরিষ্ঠ কবি এবং উদয়পুরের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমী বাহিনী । ঠিক সেই পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান যে নান্দনিক মাত্রায় পৌঁছেছিল, স্পষ্টতই বলব, যাঁরা অসময়ে ফিরে গেছেন তাঁরা রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্পদকে চাক্ষুষ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন । উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের পুরো নির্যাস নেওয়ার জন্য টানা দুদিন অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন । সবাই উপস্থিত থাকতে পারলে পারস্পরিক বহু বিষয়ে ভাববিনিময় করা যেত যা এ অঞ্চলের সাহিত্যের সমৃদ্ধির সহায়কও বটে । তবে তরুণরা এবং উত্তরপ্রান্তের ধর্মনগর, কৈলাশহর থেকে আসা কবিরা দেখেছি টানা দুদিন কাটিয়েই ঘরে ফিরেছেন । এটা এই উৎসবে আশার আলো । অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় বাঙালির লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি কবিগানের মাধ্যমে । দক্ষিণের দুই কবিয়াল দিলীপ দে এবং সুভাষ নাথ কৃষ্ণ ও গান্ধারীর ভূমিকা নিয়ে গান করে আসর মাত করে দেন । উদ্যোক্তারা যদি এই কবিগানের মাধ্যমে দ্বিতীয়দিনের অনুষ্ঠান শুরু করতেন তাহলে প্রথমত আমাদের ঐতিহ্য প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত । দ্বিতীয়ত, সকালের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল । তাদের সামনে এই অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা হলে আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে জানতে পারত । আগামীদিনে এজাতীয় অনুষ্ঠান হলে উদ্যোক্তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারেন ।
আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েতরাজ ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে । শেষদিন রাত বারোটায় সর্বশেষ অতিথি প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়ে ঘুমোতে গেছেন । ঘুম তাঁদের কতটা হয়েছে জানিনা । সকালে আমরা বেরোনোর আগেই প্রতরাশ তৈরি । কথায় কথায় বললেন, বাইরে থেকে অতিথিরা এসেছেন বলেই উদয়পুরের সম্মান রক্ষার্থে তাঁরা নিয়ম ভেঙে রাত দশটার জায়গায় বারোটা পর্যন্ত লজ খোলা রেখেছেন ।
ভোরে বেরোবার আগে রাঙামাটির রাঙারোদ আমাদের গায়ে ইতিহাসের কুয়াশা মাখিয়ে দিচ্ছিল । রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৬ ) ত্রিপুরার রাজদরবার উদয়পুরে রত্নকন্দলী ও অর্জুনদাস বৈরাগি নামে দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন । সেদিন রাজা এই অতিথিদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন । সেই ধারারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল এ দুদিনের অনুষ্ঠানে । দুদিনের 'অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব' এটাই উৎকর্ষতা
ছবি : সম্রাট শীল, অনামিকা লস্কর, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, শ্রীমান দাস ও আরো অনেকে
No comments:
Post a Comment