নজরুলের কবিতা ও গানে লোকসাধারণ ও লোকায়ত দর্শন
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বাংলা সাহিত্যের অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম । বিদ্রোহী ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা স্বদেশ চেতনা, বৈপ্লবিক চেতনা এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ করেছেন । তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে গেছেন দেশের জনগণের মধ্যে । বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবিকতার মূর্ত প্রতীক রূপে স্মরণীয় হয়ে আছেন । তাঁর অবিস্মরণীয় চিন্তা-চেতনা এবং জীবনদর্শনের আদর্শ সবকিছুই তিনি মানুষের কল্যাণেই নিবেদন করেছেন । তাঁর শিল্পসাহিত্যের প্রতিটি ধারাতেই সমগ্র মানুষের কল্যাণ কামনার ভাষায় ধ্বনিত হয়েছে । শৈশব থেকেই তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি ঘটেছে । বিদ্যালয় শিক্ষাগ্রহণ তাঁর পক্ষে ততটা সম্ভব না হলেও তিনি অসাধারণ মেধা ও মননচিন্তার অধিকারী ছিলেন । সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চকোটির মানুষের অন্তরে পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের বিশালতা ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছিল । তাঁর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন তেজস্বী চেতনাশক্তি এবং আধুনিক মননভাবনায় সমৃদ্ধ হয়ে তিনি একাধারে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সৈনিকজীবন, কুলি-মজুর ও দক্ষ রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উন্নীত ছিলেন । সাধারণ মানুষের স্বার্থে তাঁর প্রতিবাদীচেতনা সেসময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভীষণ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । পরাধীন ভারতের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষজনের মুক্তির বার্তা নিয়ে তিনি তাঁর লেখনি ধারণ করেছিলেন । তাঁর গগনচুম্বী মননশীলতা ও সৃজনক্ষমতা সেইসঙ্গে বলিষ্ঠ সাহিত্যভাবনা তাঁকে বাংলাসাহিত্যভুবন চিরকালের জন্য স্মরণীয় করে রাখবে ।
তাঁর গান, কবিতায় সাধারণ মানুষ,সমাজের উপেক্ষিত জনগণ যেমন কৃষাণ, জেলে, কুলি, মজুর নারী শ্রমিক বেদে, বাউল, সাঁওতাল, পতিতা, হরিজন, প্রভৃতি অখ্যাত, উপেক্ষিত সাধারণ জনগণের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখনী ধারণ করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন :
"কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন
কর্মেও কথায় সত্য আত্মীয়তার করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি ।
................................................
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের
মর্মের বেদনা করিয়া উদ্ধার
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করে দাও তুমি ।"
রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই সেই অসাধারণ প্রতিভার প্রকাশ ঘটে । নজরুলের কবিতা গল্প উপন্যাস গান ও নাটকে রবীন্দ্রনাথের আশার প্রতিফলন ঘটতে থাকে । বাংলার লোকায়ত জীবনের চরম দুর্দশাগ্রস্ত পরিশ্রমী মানুষগুলোকে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এক অসাধারণ মাত্রায় উপনীত করেছেন ।
নজরুল বাংলার লোকায়ত জীবনের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন । তিনি নিজেও ছিলেন একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান । কাজেই তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে গ্রামীণ জীবনকে দেখেছেন । বাংলার জীবনযাত্রার কেন্দ্রে রয়েছে সাধারণ মানুষ । এই মানুষগুলোই হল লোকমানুষ । অর্থাৎ সাধারণ মানুষ । এদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই । এরা স্বশিক্ষিত । গভীর দুর্দশা এবং কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে বসবাস করলেও এই মানুষগুলোই তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন । এঁদের শিল্পচর্চার মাধ্যমে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে । তাঁদের গানের সুরে এক অপূর্ব দোলার সৃষ্টি হয় বাংলার ভুবনে । তাঁদের জীবনের দুঃখ-বেদনা তাঁদের সংগীত, নৃত্যানুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে থাকে বাংলার লোকায়ত আকাশ বাতাস । কবি নজরুল ইসলাম এই লোকায়ত জীবনকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন । লেটোগান রচনা করার সময় তিনি গ্রামীণ সরল মানুষজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ পেয়েছেন এবং তাঁদের লোকজ চিন্তাভাবনাকে বোঝার সুযোগ পেয়েছেন । পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় কিংবা ঢাকা কুমিল্লার মতো শহরে বিচরণ করলেও বাংলার গ্রামীন সাধারণ লোকায়ত জীবনের সঙ্গে তাঁর যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল তার কোন ফারাক ঘটেনি । এ সম্পর্কে তিনি তার নিজের সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় ( ২ জুন ১৯৪২ ) 'আমার সুন্দর' নিবন্ধে আত্মমূল্যায়ন করে লিখেছেন—
" আট বছর ধরে বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলায়, প্রতি মহকুমায়, ছোট বড় গ্রামে ভ্রমণ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে, কখনো কখনো বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতাম । এই প্রথম আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ভালোবাসলাম । মনে হল এই আমার মা তার শ্যামস্নিগ্ধ মমতায়, তার গভীর স্নেহরসে, আমার দেহ-মন-প্রাণ শ্রান্ত উদার আনন্দ ছন্দে ছন্দায়িত হয়ে উঠল । আমার অন্তরের সুন্দরের এই অপরূপ প্রকাশকে এই দেখলাম প্রকাশ-সুন্দর রূপে ।"
এক সময় কাজী নজরুল ইসলামের এই ভাবনা বিশ্বমানবতাবাদের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় । তিনি তাঁর শিল্প, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, প্রবন্ধে বিশ্বমানবতার যে জয়গান গেয়েছেন তার সূত্রটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন বাংলার লোকজ জীবনের মধ্যে । তিনি তাঁর রচনার এক জায়গায় বলেছেন, "এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল সমাজের সুন্দরের ধ্যান তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার সাধনা । যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব । আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি ।"
কাজী নজরুল ইসলামের লোকজনঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে কবি জীবনানন্দ দাশ এক গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন করেছেন । তিনি উল্লেখ করেছেন যে,
"বাংলার এ মাটি থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাসে প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি নজরুল ইসলাম । তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম । পরবর্তী কবিরা এর সুযোগ থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধুকবি বলে জনসাধারণ মেনে নেবে । জন ও জনতার বন্ধু দেশপ্রেমিক কবি নজরুল । এই জিনিসের বিশেষ তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারা যায় যে, সময়ও যেখানে জনমানুষ তার প্রার্থিত জিনিস পেয়েছে বলে মনে করে সেখানে বাস্তবিকই তা অদ্বিতীয় ।"
কাজী নজরুল ইসলাম সবার উপরে মানুষ সত্য এ কথাটি বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর সাহিত্য ও কাব্যসৃষ্টির প্রধান শক্তিই ছিল এখানে । নিপীড়িত মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তাঁর কলমকে বিরামহীন গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন । তিনি সুন্দরের ধ্যান ও স্তব গানের পাশাপাশি এদেশের কৃষক-জেলে-মজুর-শ্রমিক-তাঁতি-জোলা-নাপিত-কামার-কুমার-ফেরিওয়ালা-মাঝি এই লোকমানুষদের ও সর্ব মানবতাবাদের জয়গান গেয়ে ফিরেছেন । তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-মুসলিম-পারসিক-অগ্নিউপাসক-ইহুদি-উপজাতি সকল মানুষকে একমানুষ হিসেবে দেখেছেন । এবং সবার সম্মিলিত এক মিলনমোহনা রচনার স্বার্থে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে সজাগ রেখে গেছেন । সে কারণেই তাঁর সৃষ্টি মানুষের অন্তর স্পর্শ করে আছে । ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ কামনায় তিনি সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন, লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন । মানুষের কল্যাণার্থে সোচ্চার হয়েছেন । তিনি ভারতবর্ষের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রয়াস নিয়েছেন । হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নানা ধর্মের মানুষের মধ্যে যাতে হিংসা হানাহানির বাতাবরণ সৃষ্টি না হয় এবং সমস্ত ভারতবাসী যাতে একসূত্রে গাঁথা হয়ে থাকে একসঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করেন এই ছিল তাঁর মূলচিন্তা । প্রাণের আকুতি নিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন–
গাহি সাম্যের গান–
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান
কে তুমি ? –পার্সি, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভিল, গারো ? ( মানুষ )
তিনি 'মানুষ'কবিতায় বারবার মানুষের জয় গান গেয়েছেন তিনি বলেছেন–
"গাহি সাম্যের গান–
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান
নেই দেশ কাল পাত্রের ভেদ অভেদ ধর্ম জাতি
সব দেশে সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।"
"আদম দাউদ ইশা মশা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির বিশ্বের সম্পদ ।"
"ও কে ? চন্ডাল ? চমকাও কেন ? নহে ও ঘৃণ্য জীব
ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব ।
আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী সম্রাট
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে করিবে নান্দীপাঠ ।"
সমাজের একেবারে নিম্নবর্গের মানুষজন, প্রান্তিক মানুষগুলি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় । তিনি এইসব প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছেন । জাতপাতের ভেদাভেদ তিনি মানেন না । তিনি বলেন 'শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র ।' সমাজের অবহেলিত নিম্নবর্গের মানুষ যারা–ডোম, মেথর, কুলি-মজুর, কৃষক, তাঁতি, জেলে, জোলা, নাপিত, কামার, কুমোর, ফেরিওয়ালা, মাঝিমাল্লার সুখ,দুঃখ আবেগ অনুভূতিকে কবি গভীরভাবে অনুভব করেছেন। নজরুল তাঁর কবিতায় ও গানে এদের মুক্তির বার্তা তুলে ধরেছেন ।
"হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,
পাহাড় কাটা, সে পথের দুপাশে পড়িয়া যাদের হাড়,
তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,
তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধুলি,
তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,
তাদেরই ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান !"
নজরুল পুরুষ ও নারীতে কোনো ভেদাভেদ রাখতে চান না । তিনি বলেছেন–
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর নারী ।"
নারীমুক্তির স্বপক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন । নারীর শরীরে যে গয়না বা অলংকার পরানো হয় এবং তা নারীর সৌন্দর্যের নিদর্শন বলে মনে করা হয় তাকে নজরুল বলছেন শেকল । নজরুল তাঁর কবিতায়ও গানে নারীর এই শৃংখল মুক্তির কথা উচ্চারণ করেছেন ।
"স্বর্ণ-রোপ্য অলংকারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী বল, কোন সে অত্যাচারী ?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সে ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা !
চোখে চোখে আজও চাহিতে পারো না, হাতে রুলি, পায়ে মল
মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেলো নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল !
যে-ঘোমটা তোমা করিয়াছি ভীরু ওড়াও সে আবরণ !
দূর করে দাস-দাসীর চিহ্ন ওই যত আভরণ !"
বাংলার লোকায়ত জীবনের এক বিশাল ব্যাপ্তি রয়েছে । শব্দটিরও রয়েছে নানারকম ব্যাখ্যা । কেউ কেউ বলেন, 'লোকেষু আয়তো লোকায়ত' । অর্থাৎ যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বহমান তা লোকায়ত । আবার কেউ কেউ বলছেন, এই প্রাত্যহিক যাপনের জগতের নামই লোকায়ত । যতটুকু আমাদের দৃষ্টির গোচর সেটুকুই লোকের পরিব্যাপ্তি । এই লোকায়ত জীবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে লোকধর্ম । লোকধর্ম বলতে দুটি ভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়কে বোঝায় । একটি হল লোকসংস্কৃতির মধ্যে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের অবস্থান । অপরটি হল বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার সাথে লোকসংস্কৃতির উপাদানের অন্তর্ভুক্তি । স্থানীয়, জাতিগত ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির সঙ্গে স্থানীয় দেবদেবীর পূজার যে ধর্মধারা প্রচলিত তাই লোকধর্ম । লোকধর্মের সঙ্গে জড়িত যেসব দেবদেবীর পূজা করা হয় তা ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না । লোকসাধারণ তাদের নিজস্ব পুরোহিতের মাধ্যমে নিজস্ব বিধিবিধানে পূজা করে থাকেন ।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতা করে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলার লোকধর্ম গড়ে উঠেছিল । ইংরেজিতে এইসব লোকায়িত ধর্মকে বলা হয় 'মাইনর রিলিজিয়াস সেক্টর' । বাংলায় গড়ে ওঠা সহজিয়া, রাধাশ্যামী, রুইদাসী, কর্তাভাজা, সাহেবধনী, বলরামি, জগবন্ধু ভজনিয়া ইত্যাদি লোকায়ত ধর্ম । এগুলো লোক হিন্দুধর্ম ।
বাংলায় লোকায়ত হিন্দু ধর্ম যেমন রয়েছে তেমনি বিদ্যমান লোকায়ত ইসলাম । ভারতবর্ষের পির, আউলিয়া, সুফি, সাঁই,দরবেশ, হযরতী, কবিরপন্থী, দাদুপন্থী ইত্যাদি লোকায়ত ইসলামের নিদর্শন । বাংলার লোকধর্মের এই ধারায় মধ্যযুগে যে ইসলামের প্রচার হয়েছে তা স্থানীয় আচার-বিশ্বাস, রীতি-নীতির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে এক বিশেষ সহজিয়া রূপ পেয়েছিল । পারস্যদেশ থেকে আসা সুফিবাদি ইসলাম এ দেশের সাধারণ জনগণের অন্তরে স্থান করে নিয়ে ইসলামের সৃষ্টি করেছিল ।
বাংলার লোকায়ত হিন্দুধর্মের আরও দুটি শাখা বিস্তার লাভ করেছিল । তা হল, বৈষ্ণবসাধনা ও কালীসাধনা । ষোড়শ শতকে ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা এবং লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মের উদার আহ্বান করে শ্রী চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন । এই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম লোকায়ত বৈষ্ণবধর্ম । সেকালে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার রোধ করার উদ্দেশ্যেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এক উদার সমন্বয়ধর্মী বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেছিলেন । এই লোকায়ত বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি সপ্তদশ শতকে বাংলায় আগমবাগিশের হাত ধরে শুরু হয়ে অষ্টাদশ শতকে রামপ্রসাদের মাধ্যমে প্রচার ও প্রসার পেতে থাকে শাক্তধর্ম । এই সময়ে শাক্তধর্ম নবরূপ লাভ করে এবং বাংলা সমাজ সংস্কৃতিতে তা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার লাভ করে । উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় চিন্তাধারায় যুক্ত হয়ে কালীসাধনায় এক দার্শনিক মাত্রা পায় ।
হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকধর্মের মধ্যে এক আশ্চর্য মিল বর্তমান । তা হল, স্রষ্টা ও সৃষ্টির একাত্মতা অনুভব । একে বলা হয় অদ্বৈতবাদ । অদ্বৈতবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে কোন ফারাক নেই । উভয়ে অভিন্ন । স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্কঊ প্রেমের । প্রভুভৃত্যের নয় । এ এক দার্শনিক অনুভূতি । বাংলার লোকমানুষের এই অনুভব লোকায়ত দর্শন । এই দর্শনকে ঘিরে রচিত হয়েছে বৈষ্ণবপদাবলী, শাক্তসাহিত্য বাউল ও ইসলামী গান । প্রেমচেতনায় ঋদ্ধ হয়ে স্রষ্টা ও তার সৃষ্টিকে এক করে দেখার যে দর্শন নজরুল তাঁর ধর্মীয় সংগীতসমূহে রেখেছেন তা বাংলার লোকায়ত দর্শনের উত্তরাধিকার । শ্যামা ও শ্যামসঙ্গীতে নজরুলের সমন্বয়চেতনার রূপ তাঁর স্বীয় ধর্মদর্শনের অভিব্যক্তি । তাঁর শ্যামা সংগীত গুলো যেমন–
১) মহাকালের কোলে এসে গৌরী হলো মহাকালী
২) বলরে জবা বল, কোন সাধনায় পেলে শ্যামা মায়ের চরণতল
৩) শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধুপকাঠিতে
যত জালি সুবাস তত ছড়িয়ে পড়ে চারিভিতে
৪) আমার হাতে কালি মা মুখে কালি
আমার কালী মাখা মুখ দেখে মা
পাড়ার লোকে হাসে খালি
৫) শ্মশানে জাগিছে শ্যামা অন্তিমে সন্তানে দিতে কোল
৬) মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়
৭) জগৎ জননী শ্যামা
৮) আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়
দেখে যারে আলোর নাচন–ইত্যাদিতে তিনি শাক্ত হয়ে যান । তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটাকেও একটি রাঙাজবা করে তুলে ধরতে চান । আবার শ্যামসঙ্গীতে লোকায়ত ঐতিহ্যের চিরকালীন নায়ক নায়িকা রাধাকৃষ্ণের প্রেমকেই মানবিক রূপ দান করেছেন । তিনি রূপকের আড়ালে প্রেমিকের প্রতি প্রেমাস্পদের পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষাকেই প্রকাশ করেছেন । তাঁর এই পর্যায়ের সংগীতসমূহ–
১) হে গোবিন্দ রাখো চরণে
২) প্রভুজি তুমি দাও দরশন
৩) জাগো মোহন প্রীতম
৪) হে মাধব হে মাধব হে মাধব তোমারে এই প্রানের বেদনা কব
৫) কৃষ্ণ কৃষ্ণ বল রসনা রাধা রাধা বল
৬) বনে যায় আনন্দ দুলাল বাজে চরণে নুপুরের রুনুঝুনু তান
৭) এসে নুপুর বাজাইয়া যমুনা নাচাইয়া কৃষ্ণ কানাইয়া হরি
৮) আমার নয়নে কৃষ্ণ নয়ন তারা হৃদয়ে মোর রাধা প্যারি
৯) হারিয়ে গেছে ব্রজের কানাই
১০) গাহ না অবিরাম কৃষ্ণ নাম কৃষ্ণ নাম
একেবারে ভিন্ন ধর্মের অনুসারী হয়েও বাংলার সংগীতের ইতিহাসে এত সফল বৈষ্ণব ও শাক্তসঙ্গীত রচনার কৃতিত্ব কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া আর খুব একটা দেখা যায় না । এই ধারার সংগীতে ভক্তি ও অনুরাগের পাশাপাশি শাক্ত ও বৈষ্ণবের মধ্যে মিলনের বা সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টাও নজরুলের সংগীতের মধ্যে পাওয়া যায়–
মা আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম
মা হলেন মোর মন্ত্র গুরু ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম ।
নজরুল একদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত । তেমনি অন্যদিকে লিখেছেন ইসলামী ভক্তিমূলক গান, মুর্শিদী ও মারফতি । লেটোর দলকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতপ্রতিভার বিকাশ ঘটে । এখানে পালা রচনা করতে গিয়ে তাঁকে হিন্দু ও মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করতে হয় । তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনি ও গীতরচনার উপাদান সংগ্রহ করেছেন অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন । তাঁর সেই সময়কার রচনায় এই দুই ঐতিহ্যের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায় । নজরুলের শ্যাম ও শ্যামাসংগীতে প্রেমিকের, সাধকের যে রূপ ইসলামী গান ও ভক্তিগীতিতেও সেই একই রূপকল্পই লক্ষ্য করা যায় । এখানেও প্রেমের আবেদন তীব্র আবেগের ও অনুভবের । নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিয়ে সৃষ্টিতে মিশে এক হয়ে যেতে চেয়েছেন সাধক কবি নজরুল । সুফিবাদীরা একেই বলেন 'ফানা ফিল্লাহ' । অদ্বৈতসত্তার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া । মিলনের এমন নিবিড় অনুভব নজরুলের ইসলামী সংগীত পাওয়া যায়–
১) তাকে যে পাইতে চায় হযরত কে ভালবেসে
২) হে নামাজী আমার ঘরে
৩) তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
৪) মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
৫) ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
৬) তাওহীদেরই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম
৭) শোনো শোনো ইয়া এলাহী
৮) রোজ হাশরে আল্লাহ আমার
৯) ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ
১০) আল্লাহকে যে পাইতে চায়
গ্রামীন চিরায়ত লোকসংস্কৃতির রূপকে প্রকাশ করার জন্যই নজরুলের যত শিল্পের প্রয়াস । লোকচেতনার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার একটা যোগ রয়েছে । ধর্ম, সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটা উদার মানবতাবাদী দর্শনের নাম লোকায়ত দর্শন । বাঙালিজাতি আবহমানকাল ধরে এই দর্শনকে লালন করে আসছে । এই লোকায়ত দর্শনেরই আধুনিক প্রকাশ ঘটেছে নজরুলের কবিতা ও গানে । লোকায়ত চেতনার ধারায় সিঞ্চিত সংগীতের মাধ্যমে চলে আধ্যাত্মিক সাধনা । বাউলধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরা সংগীতের মাধ্যমে সাধনভজন করে থাকেন । তাঁদের সংগীতে ফুটে উঠে লোকসুর । নজরুলের গানের কথা সুর ও বিষয়বৈচিত্র্যে সেই লোকায়ত জীবনের ঐতিহ্যময় সহাবস্থানের বিষয়টাই বিশেষভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে ।
বর্তমান হিংসাদীর্ণ বিশ্বে যখন মানবমারণযজ্ঞের হোমানল চারিদিকে প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে , সন্ত্রাস আর আধিপত্যবাদের দাপটে সারা পৃথিবী পর্যুদস্ত, বার বার পৃথিবীর নানাপ্রান্তে রণহুংকারে কেঁপে উঠছে পৃথিবী এই সময়ে নজরুলের সৃষ্টিসম্ভারকে অধ্যয়ন করতে হবে । সত্য সুন্দর কল্যাণের পূজারী নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে মানুষের মুক্তি । বস্তুত তাঁর সাম্যবাদী ও সমন্বয়ধর্মী চিন্তা আর সম্প্রদায় নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে । হিন্দু ও মুসলমান বৈপরীত্যের যৌতুক না হয়ে চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার পরিপূরক শক্তি । এদেশে লোকজনগণ এবং লৌকিক ঐতিহ্যকেই নজরুল মানবকল্যাণের জন্য চিহ্নিত করতে পেরেছেন ।