অদ্বৈত মল্লবর্মনের জন্মভিটে ও তিতাসভ্রমণ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
নদী আমার বড়ো প্রিয় । শৈশব থেকে জীবনের এই সন্ধ্যাবেলা অবধি আমি বহু নদী দেখেছি । নদীর শরীরের বহু রকমফের দেখেছি । কোনো নদী টপকে পেরিয়ে যাওয়া যায় । আবার কোনো নদীর বিশালতা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয় । ব্রহ্মপুত্র, কপিলী, কুশিয়ারা, বরাক, জুরি, মনু, দেও, ধলাই, হাওড়া বিজয়, গোমতী আর ফেনী দেখতে দেখতে এক জীবন আমি কাটিয়েছি । মাঝে মাঝে দেখেছি গঙ্গা, যমুনা, ময়ূরাক্ষী, মহানন্দা, গোদাবরী ও কাবেরী । বাংলাসাহিত্যের পাঠ নিতে এসে পড়তে হয়েছে বেশ কখানা নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, সমরেশ বসুর গঙ্গা, বিভূতিভূষণের ইছামতি, তারাশঙ্করের কালিন্দী, দেবেশ রায়ের তিস্তা পারের বৃত্তান্ত । এইসব উপন্যাস ছাড়িয়ে আমাকে বেশি মাত্রায় আকৃষ্ট করেছে অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম । একে তো তিতাস এর কাছাকাছি আমার বাস্তুভিটে বলে । আর দ্বিতীয়ত, এই উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টির ক্ষেত্রে অদ্বৈতের জেলেজীবন ঘনিষ্ঠতার প্রভাবে । অন্যান্য উপন্যাসিকদের মতো তিনি দুচার দিনের জন্য জেলেঘরের অতিথি নন । তিনি এই যাপনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে যুক্ত । তিনি তিতাসপারের জেলেদের সন্তান । তাঁর চোখের দেখা আর অন্তর্দৃষ্টিতে হয়েছে এই উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টি । ফলে এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই হয়ে উঠেছে রক্তমাংসে জীবন্ত । আর দেশভাগের ফলে এই তিতাসপারের জেলে পরিবারের অনেক উত্তরসূরী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমার ত্রিপুরায় । তিতাসবেষ্টিত ভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহু মানুষ রয়েছেন এখানে । এপারে । ফলে ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের দিক থেকে আমরা গভীর মিল পাই দুই ভূখণ্ডের । শুধু কাঁটাতারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ।'
বাংলাদেশে কোনদিন যাইনি । আমি জন্মাইওনি ওখানে । তবে আমার মা-বাবা সহ পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আবহমান পুববাংলার ভূমিপুত্রকন্যা । তাঁদের মুখে শুনেছিলাম তাঁদের ভদ্রাসনের ও বিশাল ভূখণ্ডের পরস্তাব । মায়ের মুখে শুনতাম তাঁদের পিতৃভূমি নোয়াখালির সোনাগাজি বিষ্ণুপুর কুঠির কালিবাড়ি । আর মাতুলালয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া । তাঁর মুখে শুনতাম কয়েকটা জায়গার নাম কসবা, নবীনগর, বিটঘর, বিদ্যাকূট, সরাইল, ইত্যাদি । কোন দিকে, কোন মহল্লায় কিছুই জানিনা । কোন গ্রামে তার মাতুলালয় তাও জানা হয়নি । অদ্বৈতের তিতাস পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা, তিতাসের কথা কিছুটা জেনেছি । সেই থেকে তিতাসকে দেখার খুব ইচ্ছে আমার । কদিন আগে এল আমার কাছে সে সুযোগ আলাদিনের প্রদীপ এর মতো । আমাদের রাজ্যের বিশিষ্ট কবি তিতাসের সন্তান দিলীপ দাস আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি বাংলাদেশে যাব কিনা । ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোকর্ণঘাটে তিতাস পাড়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় অদ্বৈত গ্রন্থমেলা ২০২৪ । ২০-২১-২২ ফেব্রুয়ারি । তিতাসের আর অদ্বৈতের নাম শুনেই আমি লাফিয়ে উঠলাম । তার উপর আমার পিতামাতৃভূমির কিঞ্চিৎ হলেও দর্শন সুযোগ । দিলীপদার প্রস্তাব আমার কাছে মনে হল যেন কোন এক ফেরেস্তার পাঠানো 'বিপিন মাঝির নাও' । আমি সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলাম তাঁর প্রস্তাব । 'নিয়ে রশা রশি করি কষাকষি পোঁটলা পুটুলি বাঁধি' আমি তৈরি হতে লাগলাম কুড়ি তারিখের জন্য ।
কুড়ি ফেব্রুয়ারি, শিশুসাহিত্যিক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী সস্ত্রীক, কবি মাধব বনিক, কবি ও প্রাবন্ধিক সন্দীপ দে এবং আমি সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ আখাউড়া সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পা রাখতেই দুজন ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন । তাঁদের মধ্যে একজন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান তথা সাহিত্যিক ও দ্বিতীয় অদ্বৈত গ্রন্থমেলা ২০২৪ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব আমির হোসেন । এবং অপরজন তাঁরই অনুগত সহযোগী আব্দুল আজাদ । আমির হোসেন একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যবোধসম্পন্ন সৎ ও আন্তরিক সংগঠক । পেশায় স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক । গণিত বিষয়ের মেধাবী শিক্ষক তিনি । লেখালেখির জগতেও তিনি সুপরিচিত । কবিতা, গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও জীবনীসাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর নিজের একটি গ্রন্থাগার রয়েছে । তার নাম 'চেতনায় স্বদেশ' । তাঁর গ্রন্থাগারেও নিয়ে গেছেন আমাদের । সেখানে পরিচয় হয়েছে মো. ইউনুস ভাইয়ের সাথে । আমির হোসেনভাই এবং আজাদ ভাই ধরাধরি করে আমাদের সামানপত্র টোটোতে তুলে আমাদের প্রথমে নিয়ে পৌঁছালেন আখাউড়া । তারপর আবার সেখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রান্তে কুরুলিয়া খাল পেরিয়ে কাউতলি মোড়ে সৌধ হিরন্ময়ের পাশে জেলা পরিষদের ডাকবাংলায় পৌঁছে দিলেন । আখাউড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসতে ঘুরে ফিরে বারবার এই তিতাসকে পেরুচ্ছিলাম । গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে তিতাসনদী শরীরের শিরা উপশিরার মত ঘিরে রেখেছে । কুরুলিয়া খালটি খনন করা হয়েছিল জলপ্লাবন থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে । ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই এই কুরুলিয়া খাল খনন শেষে উদ্বোধন করেন সেই সময়ের লাটবাহাদুর এন্ডারশন সাহেব । এ কারণে এই খালটির আরেক নাম এন্ডারশন খাল । ত্রিপুরার মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের উদ্যোগে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমে এই খালটি খনন করা হয়েছিল । এই খাল খননের ফলে বর্ষায় তিতাস নদীর জলের চাপ কমে যাওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বন্যারোধ সম্ভব হয় । পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভৈরবের জলপথের দূরত্ব অনেকটা কমে যায় । ১৯৭১ সালের শেষ দিকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের চারদিকে অবস্থান নিতে থাকে তখন পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় ৬ ডিসেম্বর রাজাকারদের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক কে এম লুৎফর রহমানসহ জেলা কারাগারে আটক অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারন মানুষকে চোখ বেঁধে শহরের এক প্রান্তে কুরুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে । তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই হিরণ্ময় সৌধ ।
আমরা ডাকবাংলোয় ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে এসে দেখা করেন কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী, আহ্বায়ক গ্রন্থমেলা কমিটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুরপরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো আ কুদ্দুস, ইঞ্জিনিয়ার সুমন দত্ত, এডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, ফারুক আহমেদ ভূঁইয়া, মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ, এস এম ইউনুস ও মালিকরতন শর্মা প্রমুখগণ । কুদ্দুস সাহেব বিসিএস ক্যাডারের অফিসার হলেও এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । তাঁরই উদ্যোগে শুরু হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মনের জন্মভিটে গোকর্ণঘাটে গ্রন্থমেলা । ইতোমধ্যে এই ঘাটে পাশের একটি জায়গাকে দখলমুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে অদ্বৈত মল্লবর্মণ স্মৃতি গ্রন্থাগার ও গবেষণা কেন্দ্র । তারই লাগোয়া করা হয়েছে একটি মুক্তমঞ্চ । অদ্বৈতের ভিটেকে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ করার লক্ষ্যে এই এলাকায় আরো কিছু কাজের পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে ।
কুড়ি তারিখ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিন বিকেলবেলা আমাদের গাড়ি করে গোকর্ণঘাটে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয় । কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলা প্রাঙ্গণে এসে উদ্বোধন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ সুপার জনাব মো শাফায়াত হোসেন । তিনিও লেখালেখির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন । পাশাপাশি সরকারি কর্তব্যবোধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার গুরু দায়িত্ব পালন করছেন । অনুষ্ঠান মঞ্চে সভাপতি হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মো আ কুদ্দুস, উদ্বোধক জেলা পুলিশ সুপার শাখায়াত হোসেন ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বাচিক শিল্পী সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ মো মনির হোসেন, সাবেক কাউন্সিলার আলহাজ্ব ফেরদৌসুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বাহার মোল্লা, কবি ও প্রাবন্ধিক অশোকানন্দ রায়বর্ধন শিশু সাহিত্যিক বিমলেন্দু চক্রবর্তী, পশ্চিমবঙ্গের কবি ও গবেষক ড. বিপ্লব মন্ডল । প্রত্যেকেই তাঁদের অনুভব ব্যক্ত করেন । প্রথম দিন উদ্বোধনী পর্ব শেষ করে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে সভা মঞ্চে আসতে আসতে অন্ধকার নেমে আসে । তাই মঞ্চের পেছনে নির্বাক শুয়ে থাকা ইতিহাস তিতাসকে সেদিন ভালো করে দেখতে পাইনি । শুধু মোটরচালিত নৌকোগুলোর চলাচলের শব্দ পাচ্ছিলাম কিছুটা দূরে । জেটির পর বিশাল আঁধার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি। তখনও মনের পর্দায় ভাসছিল অদ্বৈতের আঁকা ভরাযৌবনা তিতাসের ছবি ।
রাতের দিকে ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরদিন সকালে নাস্তা করার জন্য দাওয়াতে দিলেন আজাদ ভাই । এই আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে পা দিয়েই পরিচয় । অদ্ভুত মানুষ তিনি । ঢাকায় জন্মস্থান হলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করার সুবাদে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থায়ী বসবাস করছেন । আমাদের সাহায্য করার জন্য তিনি এক পায়ে খাড়া । পরদিন তাঁর ফ্ল্যাটে দাওয়াত সেরে তাঁর সহায়তায় একটি গাড়ি নিয়ে আমরা চলে গেলাম কবি মাধব বণিকের এক আত্মীয়বাড়িতে মাধবপুরে । পথেই পেলাম আমাদের রাজ্যের বামুটিয়া থেকে নেমে আসা লোহার নদীকে । প্রায় সদর উত্তরাঞ্চলের সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা ধরে বাংলাদেশের প্রান্ত দিয়ে পৌছুলাম মাধবপুর । মাধবপুর আত্মীয় বাড়িতে সযত্ন ভুরিভোজের পরেই আমাদের আবার ফিরতে হল । মনের ভেতর তাড়া দিচ্ছিল তিতাসের দেখা পাওয়ার । এছাড়া এদিন সঞ্জীবের আলোচনা ছিল । একটু বেলা থাকতেই আমরা গিয়ে হাজির হলাম তিতাসকে দেখার জন্য । কিন্তু হায় তিতাস ! কিছুতেই মেলাতে পারলাম না অদ্বৈতের তিতাস আর আজকের তিতাসের সঙ্গে । বিশাল এক নির্জন চত্বরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে তিতাস । তার যেটুকু ক্ষীণধারা রয়েছে তাও সবটাই কচুরিপানায় ঢাকা । তার মাঝেই পথ করে বয়ে চলেছে ছোটো ছোটো নৌকো আর মাঝারি আকারের বালির নৌকো । সবই যন্ত্রচালিত । ছোট নৌকোগুলি শুধু যাত্রী পারাপার করছে । দূরপাল্লার যাত্রীলঞ্চ কিছুই নেই এখন এঘাটে । এক বিধ্বস্ত ইতিহাস যেন চড়ার বুকে অসহায় পড়ে আছে । নদীর দুপারের চর জুড়ে নানা আবর্জনার স্তুপ । কিন্তু আমরা জানি না আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরো এক বিপন্ন বিস্ময় । মেলা প্রাঙ্গণের সামনে অদ্বৈত মল্লবর্মনের ভাস্কর্যটি আলোহীন পড়ে আছে । অদ্বৈতের বাস্তুভিটেতে গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর । অদ্বৈতের স্মৃতিকে বহন করে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে । ভাবছিলাম এত যে উদ্যোগ আয়োজন তাঁকে ঘিরে, কুদ্দুস সাহেব যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চলে যান তাহলে কি তা অব্যাহত থাকবে ?
দ্বিতীয়দিন অসাধারণ আলোচনা করলেন সঞ্জীব দে তিতাসের দর্শন নিয়ে । অভিনব বিষয়নির্বাচন ও তাঁর বাচনশৈলীতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল । প্রতিদিন অনুষ্ঠানে উপচে পড়া ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছিল এখানকার মানুষের প্রাণে জড়িয়ে আছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ । শেষ দিন বৃষ্টির জন্য অনুষ্ঠান সংক্ষেপ করতে হয় । এদিন কবি মাধব বণিকের আলোচনা ছিল । কম কথা বলার মানুষ এই দুইদিন রীতিমতো উত্তেজনায় ছিলেন, কিভাবে তিনি বক্তব্য রাখবেন তা নিয়ে । যাইহোক বসন্তের বৃষ্টি তাকে টেনশনমুক্ত করে গেল । শেষদিন মঞ্চে আবৃত্তি করেন তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের সদস্যবর্গ ও বিশিষ্ট আবৃত্তিকার মো মনির হোসেন, শামস মিঠু ( ভোলা ) ও সৈয়দ ফয়সাল আহমেদ ( ঢাকা ) । আলোচনা করেন নাট্যব্যক্গোতিত্কব ও সংগঠক এবং আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের প্রাক্তন সচিব আব্দুল মান্নান সরকার । তিনি অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নামের নাট্যরূপায়ণের প্রসঙ্গের অবতারণা করেন এবং রামপ্রসাদ চরিত্রে তাঁর অভিনয়ের কথা উল্লেখ করেন । গোকর্ণ ঘাটের মালো সম্প্রদায়ের মানুষেরা পরিবেশন করেন নাটক 'অদ্বৈত এর অল্পকাহিনি' । প্রতিদিন এই মেলায় ঘোরার শেষে আমরা গোকর্ণঘাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভৌমিকের চেম্বারে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আসি । অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্পর্কে গবেষণাকর্মের জন্য বা জানার আগ্রহে কেউ গোকর্ণঘাট এলে অবশ্যই পরিমল বাবুর সঙ্গে দেখা করেন । অমায়িক সজ্জন মানুষ তিনি । এলাকায় শ্রদ্ধার পাত্রও । তাঁর ওখানেই শেষদিন দেখা হয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশেষ ব্যক্তিত্ব ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ জয়দুল হোসেনের সঙ্গে ।
রাতে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে ছোটো শ্রীমান সৌগতর মেসেজ পেলাম । কাল বাড়ি ফেরার সময় যেন একটা ফুলের চারা নিয়ে আসি । সমস্যায় পড়ে গেলাম । সকালেই তো চলে যাব আমরা । কোথায় পাবো ফুলের চারা এত রাতে । দিনের বেলা রাস্তাঘাটে যে ফুলের চারা দেখেছিলাম তা প্রায় সবই আগরতলায় পাওয়া যায় । বললাম সে কথা । ছেলে জানাল যে কোনো ফুলের চারা হলেই হবে । শুধুমাত্র প্রতীকি কিছু একটা নিয়ে যাওয়া । ছোটোবেলায় ঠাম্মার কাছে সাত ভাই চম্পা ছাড়া আরও নানাফুলের গল্প শুনেছে । ফুলের চারা দিয়ে সে ঠাম্মার দেশের বাড়ির স্মৃতি ধরে রাখতে চায় । তার আবেগপ্রবণ কথাটা শুনে মনটা কেমন হয়ে গেল । পরদিন আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন ভাবীকে সঙ্গে নিয়ে জয়দুলভাই, ফারুকভাই সহ আরো কয়েকজন । ফারুকভাইকে ছেলের আবদারের কথাটি পাড়তেই তিনি ঠিকানা বলে দিলেন কাছেই এক নার্সারীর । সঞ্জীবকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে একটা গোলাপের চারা নিয়ে এলাম । ফেরার পথে ভারি নাস্তা খাইয়ে জয়দুলভাইরা আমাদের সিএনজিতে তুলে সজলচোখে বিদায় জানালেন । যেন কন্যাবিদায় করছিলেন বাপের বাড়ির মানুষেরা । আমি ট্রলিটা সিএনজির পেছনে রাখলাম । আর সযত্নে ফুলের চারাটি হাতে নিয়ে গাড়িতে বসলাম । আমার শ্রীমান তার ঠাম্মার উদ্দেশ্যে দেশের বাড়ির ফুল নিবেদন করবে এ গাছে হৃদয়ের মতো লালগোলাপ ফুটলে । মনে মনে বললাম, বিদায় বাংলাদেশ । বিদায় পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ।
No comments:
Post a Comment