মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের ( ১৮৬২ খ্রি. – ১৮৯৬ খ্রি. ) পুত্র রাধাকিশোর মানিক্য ( ১৮৯৬ খ্রি. – ১৮০৯ খ্রি. ) প্রায় ৪০ বছর বয়সে ত্রিপুরা সিংহাসনে আরোহন করেন । যুবরাজ থাকাকালীন সময়েই তিনি ত্রিপুরারাজ্যের শাসন পরিচালনার বিষয়ে তাঁর দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের মহিষী ভানুমতী দেবীর অকাল প্রয়াণে ব্যথিত হয়ে মহারাজা কিছুদিনের জন্য বৃন্দাবনধামে চলে গিয়েছিলেন । তখন ত্রিপুরারাজ্য ও তৎসন্নিহিত চাকলা রোশনাবাদ অঞ্চলের জমিদারি পরিচালনার জন্য বীরচন্দ্র মানিক্য একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেছিলেন । যুবরাজ রাধাকিশোর মানিক্য ছিলেন সেই মন্ত্রিপরিষদের সভাপতি । মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের অনুপস্থিতিতে তিনি বেশ বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজকার্য ও শাসনকার্য পরিচালনা করেছিলেন ।
সিংহাসনে আরোহণের পর পরই তাঁকে কয়েকটি প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় । ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে রাজবাড়িসহ রাজ্যের অনেক দালানকোঠা ভেঙে পড়ে । সেগুলি মেরামত করতে গিয়ে এবং কারুকার্যমন্ডিত নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁকে আর্থিক সংকটে পড়তে হয় । এদিকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রকিশোরকে যুবরাজ পদে নিয়োগ করার পরেই শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র । এই নিয়ে বড় ঠাকুর সমরেন্দ্রচন্দ্র দেববর্মণ সরব হয়ে ওঠেন । ইংরেজ সরকারের কাছে নালিশ করেন তিনি । মামলাও হয় । অন্যদিকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে সারা ত্রিপুরারাজ্যব্যাপী অনাবৃষ্টির ফলে কৃষিজ ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় । ফলে পাহাড়ে কন্দরে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেওয়ায় প্রজা সাধারণের দুঃখ দুর্দশা শুরু হয় । তখন তিনি দুঃস্থ প্রজাদের বিনামূল্যে খাদ্য সুস্থ সরবরাহ করেন । ধীরে ধীরে তিনি সমস্ত সংকট কাটিয়ে উঠে প্রশাসনিক সংস্কারে হাত দেন । প্রশাসনকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ১৮৯৮ সালেই তিনি একটি কার্যনির্বাহী সভা গঠন করেছিলেন । প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পূর্বের তিনটি বিভাগের স্থলে পাঁচটি বিভাগ সৃষ্টি করেন । নতুন দুটি বিভাগের প্রধান কার্যালয় গড়ে তোলা হয় বিলোনিয়া ও খোয়াইতে ।
রাধাকিশোর মানিক্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ ও তহশিল বিভাগকে আলাদা করেন । পুলিশ বিভাগকে তহশিল ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় । পুলিশ ও তহশীল বিভাগকে পৃথক করার পর ত্রিপুরা রাজ্যে অনেকগুলি নতুন নতুন থানা ও তহশিল কাছারি গড়ে তোলা হয় । সে সময় ত্রিপুরা রাজ্যে প্রথম পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন জে. সি. দত্ত । সেই সময়েই সাব্রুম থানা ও তহশিল কাছারি স্থাপন করা হয়েছিল । বর্তমানে যেখানে থানার দালানটি রয়েছে তার বেশ কিছুটা দক্ষিণে সামনের দিকে তরজার ছানি ও তরজার বেড়া দেওয়া চৌচালা বড় ঘর ছিল । পাশেই বড়বাবু থাকতেন । এর লাগোয়া একটি লম্বা একই প্যাটার্নের ঘরই ছিল ব্যারাক । এই থানার একটু পূর্বদিকে অর্থাৎ বর্তমানে যেটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় সেখানেই ছিল মহকুমা শাসকের কার্যালয় । আরেকটু এগুলো পূর্ব দিকে বর্তমান এসডিপিও অফিসের পাশেই ছিল জেলখানা । মহকুমা শাসকের অফিসের উল্টোদিকে যে রাস্তা নেমে গেছে তার শেষ প্রান্তে বাঁদিকে দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি । তারপরে ছিল তহশিল কাছারি । মোটা মোটা কাঠের খুঁটির উপর চাম্পা কাম্পা বেড়া ও প্রথমে তরজার ও পরে টিনের ঘর ছিল তহশীল কাছারি । তহশিল কাছারির উল্টোদিকে ছিল ক্লাব হাউস । ছিল একটি বিশাল প্রেক্ষাগৃহ । সেসময়ের বিনোদনের কেন্দ্র ছিল এই হল ঘরটি । একটু দূরেই দক্ষিণে নদীর ঘাট । এই ঘাটে প্রচুর নৌকা বাঁধা থাকত । মূলত তহশিল অফিসের তরফ থেকে বনজ সম্পদের কর আদায়ের জন্য এই ঘাটটি ব্যবহৃত হত । পশ্চিমদিকে আরেকটি ঘাট ছিল যা বাজার ঘাট নামে পরিচিত ছিল । এই চত্বরটিকে কেন্দ্র করেই তার চারপাশে সেকালে সাব্রুম জনপদ গড়ে উঠেছিল । তখনকার সময়ে দাতব্য চিকিৎসালয়টিও মহকুমা শাসকের কার্যালয়ের পূর্ব পাশে ছিল । দীর্ঘকাল পর্যন্ত সাব্রুমের মানুষজনের হাটবাজার ছিল রামগড়েই । ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পর সাব্রুম বাজার গড়ে ওঠে । সেই সময় রামগড়ে ই পি আর ক্যাম্প ছিল । তারা সাব্রুম থেকে মানুষ গেলে হামলা-হুজ্জতি করত । পরে রামগড় বাজারের ব্যবসায়ী বা অন্যান্য সজ্জন ব্যক্তিরাও ভারতীয়দের পরামর্শ দেন যে তাঁরা যেন এপারে আসা যাওয়া বন্ধ করে দেন । কারণ কোনরূপ সমস্যা হলে তাঁরা রক্ষা করতে পারবেন না । এর পরেই অনাদি চৌধুরী, ভেগু চৌধুরী, গোপাল রায়চৌধুরী ১৯৪৯ সনের দিকে মডেল স্কুলের মাঠে মেলার আয়োজন করেন । সামনে বৈশাখ মাস । তাকে কেন্দ্র করে মেলার আয়োজন করেন গোপাল রায়চৌধুরী । তখন থেকে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও তিনি সাব্রুম মেলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন । শেষের দিকে তিনি বয়সের ভারে সম্ভব না হলেও মেলার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকতেন । সেদিন মেলায় লোকসমাগম বাড়ানোর জন্য সাপ্তাহিক হাট সংযুক্ত করে দেওয়া হত । মেলা হত একমাসব্যাপী । ১৯২৩ থেকে ১৯২৫ সালের দিকে সাব্রুমে ২২–২৩ ঘরের মতো বাঙালি পরিবার ছিল । দৌলবাড়ির একাংশ থেকে সাব্রুম পর্যন্ত ত্রিপুরিরা, দোলবাড়ির পশ্চিমাংশ ও ছোটোখিলে মগ জনবসতি ছিল । তবে ছোটোখিলে মুসলমান আধিক্য ছিল । সেসময়ে সাব্রুমে স্কুল ছিল না । স্কুল ও হাসপাতাল ছিল রামগড়ে । বাজারঘাট থেকে সোজা ফেনী নদীর উপর সাঁকো পেরিয়ে মানুষ রামগড় বাজারে যেত । সাব্রুম ছোটোখিলের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী সে সময় রামগড়, অযোধ্যা, দেওয়ানবাজারে কাপড় ও অন্যান্য পণ্যের ব্যবসা করতেন । বর্তমান আনন্দপাড়ার বৃহত অংশের মালিকানা ছিল প্রতাপ নাথের ( সুশীল নাথের বাবা ) । ১৯৩০–৩৫ সালের ও তার কিছু পরের প্রাচীন বাসিন্দাদের মধ্যে ছিলেন অম্বিকা মজুমদার, ভারত চৌধুরী, সতীশ ব্যানার্জি, প্রমোদ দেওয়ান, হেমচন্দ্র চৌধুরী ( প্রয়াত উপাধ্যক্ষ সুনীল চৌধুরীর বাবা ), যামিনী ভূষণ চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী, অনাদি চৌধুরী, ভেগু চৌধুরী, মনকুমার দত্ত, নবীন চক্রবর্তী, বরা দপ্তরি ( আসল নাম জানা যায়নি ), পরেশ সরকার, প্রমুখরা । সেই সময়ে গাড়ি-ঘোড়া কিছুই ছিল না । হেঁটে বিলোনিয়া কোর্টে ও আগরতলা যাতায়াত করতে হত । মনুবাজার, জোলাইবাড়ি, শান্তিরবাজার, উদয়পুর নদী পেরুতে হত জুরিন্দা নৌকা দিয়ে ।
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ ( ২৮ শে ফাল্গুন ১৩১৮ ) উত্তরভারত তীর্থ ভ্রমণের সময় কাশী থেকে সারনাথে যাওয়ার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর কাশীরাজের বাড়ি নন্দেশ্বর কুঠিতে রাধাকিশোর মানিক্য শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
রাধাকিশোর মানিক্যের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মহাসমারোহে বীরেন্দ্রকিশোরের রাজ্য অভিষেক হয় । পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে সাব্রুম বিভাগ খোলা হয় । এর আগে এই বিভাগের কাজকর্ম প্রথমে উদয়পুর ও পরে বিলোনিয়া থেকে পরিচালিত হত । ১৯১০ সালের সাব্রুম বিভাগ খোলা হলেও যথেষ্ট পরিকাঠামোর অভাবে প্রায় ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিলোনিয়া থেকেই সাব্রুমের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো হত । বিলোনিয়ার হাকিমই এই মহকুমার সর্বময় কর্তা ছিলেন । তিনি মাঝে মাঝে বিভাগ পরিদর্শনে আসতেন । প্রথমদিকে ত্রিপুরার রাজপরিবারের ঠাকুর বংশের বিশিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিরা সাব্রুমের বড়ো হাকিমের দায়িত্ব পালন করতেন । মহকুমা শাসককে সেকালে হাকিম বলা হত । তিনি প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা দুটোই দেখতেন । চল্লিশের দশকের পর থেকে ক্রমান্বয়ে যে কয়জন সাব্রুম মহকুমায় হাকিমের দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের সবার নাম জানা না গেলেও মোটামুটি ভাবে যোগেন্দ্র গাঙ্গুলী, বিপিন দত্ত, জয়সিং ঠাকুর, কুলেশপ্রসাদ চক্রবর্তী, হরিমোহন মিত্র, মানিক গাঙ্গুলী,সত্যব্রত সরকার প্রমুখরা সাবরুমে হাকিমের দায়িত্ব পালন করে গেছেন । উল্লেখ্য যে, হাকিম যোগেন্দ্র গাঙ্গুলীর পুত্রই হলেন পরবর্তী সময়ের হাকিম মানিক গাঙ্গুলী । মানিক গাঙ্গুলী সাব্রুমের উন্নয়নের জন্য প্রচুর ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন যেহেতু বাবার আমলেও তিনি সাব্রুমে ছিলেন এবং এখনেই বেড়ে উঠেছিলেন সেইজন্য সাব্রুমের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল । পরবর্তী সময়ে তিনি জেলাশাসক হয়েও সাব্রুমের উন্নয়নের কথা ভাবতেন । সেইসময়ে সাব্রুমের দরিদ্র এলাকা ও রিফুজি পুনর্বাসিত এলাকা মানিকগড় তাঁর নাম অনুসারে রাখা হয় । সাব্রুমের বিভিন্ন উন্নয়নের মধ্যে রাস্তাঘাট,হাইস্কুল, দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সংস্কার তাঁর আমলে হয়েছিল ।
১৯০৫ সালে সাব্রুম থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে । রাজ্যের অন্যান্য অংশের তুলনায় এখানে অপরাধের পরিমাণও কম । আজও সাব্রুমের বারুণীমেলা, রামঠাকুর উৎসব, বৈশাখীমেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটলেও এমন শক্তপোক্ত নিরাপত্তার দরকার হয় না । মানুষ সুশৃংখলভাবে আনন্দ উপভোগ করেন ।
প্রথমদিকে কারা সাব্রুম থানার কর্মকর্তা ছিলেন তার পুরোপুরি তথ্য পাওয়া না গেলেও বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে বিভিন্ন সময়ে যারা বড়বাবু ও অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের দায়িত্বে ছিলেন তাদের যতটুকু সন্ধান পাওয়া যায় তার মধ্যে শৈলেন দত্ত, কিরণ ঘোষ, গোবিন্দ বসাক ( হরিগঙ্গা বসাকের পরিবারের সদস্য ) আবু বর্ধন, অর্ধেন্দু ঘোষ, প্রমুখরা ছিলেন বলে জানা যায় । মহেন্দ্র রায় নামে একজন ছিলেন ৬৩–৬৪ সালের দিকে । দেশভাগ হওয়ার পর প্রথম দিকে সাব্রুম থানার কর্মীরাই সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে ছিলেন । সেই সময়ে পাকিস্তানি ই পি আররা মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সীমান্ত জুড়ে চোরাগুপ্তা হামলা হুজ্জতি করত । ভারতীয় ভূখণ্ডে উঠে চাষিদের খেতকৃষি করতে বাধা দিত । এজন্য প্রায়ই সাব্রুম থানা থেকে কর্মীদের গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হত । এছাড়া সীমান্তের গ্রামগুলিতে গোরু চুরি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা । থানাকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এইসব ঘটনার বিহিত বিধান করতেই ব্যস্ত থাকতে হত । কোন কোন ক্ষেত্রে সাফল্য আসত । কোন কোন ক্ষেত্রে সুরাহা হত না । তার উপর ডাকাতের উপদ্রব তো ছিলই । সীমান্তের মানুষ রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত না । মানুষের সেদিনের ভীতিপূর্ণ দিনগুলোতে সাব্রুম থানায় ছিল একমাত্র ভরসা । এই অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সাব্রুমের যুবকদের নিয়ে সেদিন গঠন করা হয়েছিল ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি বা গ্রামরক্ষী বাহিনী । ১৯৬৩–৬৪ সালে যখন মহেন্দ্র রায় সাব্রুম থানার বড়বাবু ছিলেন সে সময় সাব্রুমের যুবকদের নিয়ে যে ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি গঠন করা হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন গোপাল রায়চৌধুরী ও হরিনারায়ণ বসাক । গ্রামরক্ষী বাহিনীর সদস্যেরা দুটো দলে ভাগ হয়ে একটি দল কাঁঠালছরির দিকে পাহারা দিতেন আর একটি দল দৌলবারী মগপাড়া পর্যন্ত পাহারা দিতেন । সে সময় গ্রাম রক্ষীদের হাতিয়ার ছিল গোটা কয়েক টর্চ লাইট ও দশটি বল্লম এগুলো দুদিকের দলের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত । একবার তাদের সাফল্যও আসে । এক জোৎস্না রাতে পাহারার সময় তারা দেখতে পান ফেনী নদী পেরিয়ে ওপার থেকে এপারে উঠে সাব্রুমের দিকে কারা যেন আসছে । গ্রামরক্ষীরা তাদের অনুসরণ করে সাব্রুম বাজারের কাছাকাছি এলে লোকজন ডেকে আটক করে থানায় সোপর্দ করে । গ্রামরক্ষী বাহিনীর কৃতিত্বের জন্য সে সময়ে প্রত্যেককে ১৫ টাকা করে এসপি রিওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল । সেই দলে সাব্রুমের সেদিনের কিশোর এবং আজকের বর্ষিয়ান নাগরিক তিমিরবরণ চাকমাও ছিলেন । ১৯৬৭–৬৮ সালের দিকে সাব্রুম থানার ওসি ছিলেন সেসময়ের দিকপাল ফুটবল খেলোয়াড় বিমল বর্ধন । যিনি কচি বর্ধন নামে খ্যাত ছিলেন । তিনি ক্যারাম খেলাতেও পারদর্শী ছিলেন । সে সময়ের অন্যান্য পুলিশ অফিসারদের মধ্যে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দেব । তিনি ত্রিপুরার নামী প্রকাশন সংস্থা অক্ষরের মালিক শুভব্রত দেব এবং রাজ্যের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক দেবব্রত দেবের বাবা । আর ছিলেন তরুণ অফিসার নির্মলেন্দু চক্রবর্তী এবং রাধামোহন সিনহা । পরবর্তী সময়ে ছিলেন প্রণব বোস, বীরেন মুখার্জি ও বাদল চক্রবর্তী, হরিপ্রসন্ন মজুমদার, দক্ষিণারঞ্জন দে প্রমুখরা । সবার নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি । পুলিশের মধ্যে চিত্তরঞ্জন দে, বীরেন্দ্র লাল দে, ( বি এল দে ) সুবোধ দাস, সুধীর দে, মনোরঞ্জন দাস ( পরে তিনি এসআই পদে উত্তীর্ণ হন ) প্রমুখরা ছিলেন বলে জানা যায় । রাজন্য আমল থেকে বেশ কয়েকজন চৌকিদার এই থানার আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করতেন । এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায় । কলাছড়ায় ছিলেন অসীম সাহসী ও শক্তিধর খন্ডল ত্রিপুরা । শোনা যায় তিনি একা বাঘের সঙ্গে লড়াই করেছেন । বৈষ্ণবপুর এলাকায় মরণ দাস । তার ছেলেরা বর্তমানে সাব্রুম শহরের প্রতিষ্ঠিত । মনুঘাট এলাকায় পাথরাই ত্রিপুরা ছোটোখিল এলাকায় যাত্রামোহন নাথ এবং সাব্রুমে ছিলেন নিবারণ দে । তার ছেলে নির্মল দে, জেদের বসে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে পুলিশ অফিসার হয়েছিলেন । কোন এক পুলিশ অফিসার নাকি তার বাবাকে অপমান করেছিলেন । শিলাছরি অঞ্চলে শচীন্দ্র চৌকিদার নামে একজন ছিলেন । লক্ষ্যণীয় যে রাজন্য আমলে এমন সব লোককে এসব পদে নিয়োগ করা হতো যাদের দশাশয় চেহারা ও শক্তি দেখে জনমনে একটা সমীহ তৈরি হত । অপরাধীরাও ভয়ে তটস্থ থাকত । এই সময়ে চৌকিদাররাই সেই আমলে গ্রামের প্রশাসন ধরে রাখতেন ।
অতীতের সাব্রুম থানার কর্মপরিধি পূর্বদিকে বর্তমান করবুক মহকুমার আইলমারা, শিলাছরি, ঘোড়াকাঁপা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে জলেয়াতে ফেনীনদীর উৎস স্থলের ভূমির দাবি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেখানেও সাব্রুম থানা থেকেই ভারতীয় সৈন্যদের মুভ করানো হয়েছিল । সৈন্য আসার আগে পর্যন্ত থানার কর্মীরাই পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিহত করে । অনুরূপভাবে সে সময়ে ছোটোখিলের একটি চরভূমিকে নিজেদের বলে দাবি করে পাকিস্তানি সৈন্যরা এই ভূখণ্ডের উপর এসে তাণ্ডব শুরু করেছিল । প্রথমে সাব্রুম থানা থেকে পুলিশবাহিনী গিয়ে তাদের মোকাবেলা করে । তারপর বিএনপি এলে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হয় । সেদিন ভারতীয় সৈন্যদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সাব্রুম থানা ।
আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে সাব্রুম থানার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় । সাব্রমের সীমান্ত এলাকাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ সাব্রুম থানার হাতে আসে । ষাটের দশকের শেষ দিকে পার্শ্ববর্তী দেশ গণআন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে । পূর্বপাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতার প্রস্তুতি নেয় । সেই সময়ে রাজ্যের ও দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে সাব্রুম থানার গোয়েন্দা সেলও অনুভব করে পারে যে, ওপারে একটা গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে । সাব্রুম থানার গোয়েন্দা শাখা তখন তার কর্মতৎপরতা বাড়িয়ে দেয় । যোগাযোগ করা হয় ওপারের স্বাধীনতাকামী নাগরিক রাজনৈতিক নেতা ও সেনা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে । তাদের নেতাদের এপারে আশ্রয় দেওয়াসহ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেওয়ার সাথে সাথে তাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরিকল্পনা, অনেক অপারেশন এই সাব্রুম থানা থেকেই প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত হয়েছিল । সাব্রুম থানা থেকে দেওয়া ওয়ারলেস মেসেজের মাধ্যমেই সেদিন বাংলাদেশের আসন্ন মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তরকে অবহিত করা হয়েছিল ।
২৫ শে মার্চ ১৯৭১ এর মধ্য রাত থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় । প্রথমদিকে রামগড় ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাত । অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই রামগড় পাকবাহিনীর করায়ত্ব হয়ে যায় । তারপর এপারের সাব্রুম থানায় হয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর গোপন কার্যালয় । বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর একনম্বর সেক্টরের গোপন হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম থানা । একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত অঞ্চলের জনগণের স্থায়ী নিরাপত্তা দানের সুযোগপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে সেদিন সাব্রুম থানা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল । ৭১ এর ২৫ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ৪ মে পর্যন্ত রামগড় মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল । পাক বাহিনীর ২৭শে এপ্রিল এবং ৪মে রামগড় দখল নেয় । মেজর জিয়াউর রহমান দলবল নিয়ে ভারতের সাব্রুমে চলে আসেন । তারপর সাব্রুম থানাসংলগ্ন কংগ্রেস অফিসে আস্তানা গেড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন । সেসময়ে সাব্ররুমের কংগ্ফিরেস অফিসটি মুক্তিযোদ্দাদের অফিস হিসাবে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল । রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন । তিনি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাব্রুম থানায় এসে যোগাযোগ করেন । সাব্রুম থানা ও বিএসএফের সহযোগিতায় তাঁকে আগরতলায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয় । মুক্তিবাহিনী যখন কিছুতেই রামগড় দখল করতে পারছিল না তখন সাব্রুম থানা থেকে সাহায্য করার লক্ষ্যে একটি অপারেশনের ব্লু প্রিন্ট তৈরি করা হয় । তখন সাহসী কনস্টেবল বিএল দে, সুবোধ দাস, মনা বলী, চিত্তরঞ্জন দে প্রমুখসহ একদল পুলিশ রাতের বেলা ফেনীনদী পেরিয়ে রামগড়ে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন । পাকবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া সাব্রুম থানা থেকে পরিচালিত সেদিনের সফল অপারেশন টির নাম ছিল 'অপারেশন পোড়ামাটি' । সেই আক্রমণে দিশাহারা হয়ে সেদিন পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় । রামগড় মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয় । ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম রামগড় পাক সেনাদের দখলমুক্ত হয় রামগড় বাজারে সেদিন উড়ানো হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা । সেদিন সাব্রুম থানা এভাবেই একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মক্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল । পরবর্তী সময়ে যখন চাকমা শরণার্থীরা এদেশে এসেছিল তখনও তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সাব্রুম থানা মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । ্ঙ্গে্ঙ্গে্ঙ্গে্ঙ্্ঙ্গে্্ঙ্ঙ্গ্ঙ্্ঙ্গে্ঙ
সাব্রুম থানায় একসময় এই বছর জমজমাট কালীপুজো হত । এই পুজো উপলক্ষে কবিগান, বাউল গানের আসর বসত । সেইসঙ্গে কখনো কখনো দুঃস্থদের মধ্যে বস্ত্রদানের ব্যবস্থাও থাকত । এছাড়া নানা সময়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও এই থানা অংশগ্রহণ করে থাকে । বিভিন্ন জনসচেতনামূলক, আইনি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বিদ্যালয়ের ও মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ড্রাগবিরোধী, নারীসুরক্ষা, বাল্যবিবাহ, বধূ নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় ও 'প্রয়াস' কর্মসূচি নিয়মিত রূপায়িত হচ্ছে । এককথায় সাব্রুম থানা জনপ্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়া ও সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড আজও চালিয়ে যাচ্ছে । ফলে এই থানা সম্পর্কে ঔ জনগণের একটা ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে ।
( রূপান্তর, সম্পাদক–রাজীব মজুমদার, ষষ্ঠ বর্ষ || ১৪২৫ || বইমেলা ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত )
তথ্যসূত্র :
১) শ্রীজমালা
২) রাজমালা বা তৃপুরার ইতিহাস–কৈলাশচন্দ্র সিংহ
৩) ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. জগদীশ গণচৌধুরী
৪) সুনীল চৌধুরী ( প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ )
৫)গোপাল রায়চৌধুরী ( প্রবীন নাগরিক )
No comments:
Post a Comment