ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সংবাদপত্রের সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, সঠিক দিশা দেখানোর ক্ষেত্রে সংবাদপত্র অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে । আর এই অভিযাত্রায় সংবাদপত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে একদল অতন্দ্র সৈনিক সমস্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন । এঁরা হলেন সাংবাদিক । এই সাংবাদিকরা একাধারে সংবাদদাতা, সংবাদসংগ্রাহক ও সংবাদলেখক বা সংবাদপরিবেশক । মানুষের কাছে উপস্থাপনের পূর্বে একটি সংবাদকে অনেকগুলি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় । এই সমগ্র প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের আমরা সাংবাদিক বলি । ইংরেজিতে বলা হয় জার্নালিস্ট । সাংবাদিকতা শব্দটি ইংরেজি জার্নালিজমের প্রতিশব্দ । জার্নালের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় কড়চা বা রোজনামচা । ধীরে ধীরে অর্থ বিস্তারের ফলে এই জার্নাল শব্দটি দিয়ে পত্রপত্রিকায় ইত্যাদিও বোঝানো হতে থাকে । পত্রপত্রিকার সাথে যুক্ত কর্মরতদের জার্নালিস্ট বলা হয় । বাংলায় তারই রূপান্তর সাংবাদিক ।
একসময় সাংবাদিকের কর্মপরিধি শুধুমাত্র মুদ্রণমাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু এই ব্যবস্থায় দীর্ঘ পথপরিক্রমার পর নতুন শতাব্দীতে এসে গণমাধ্যমে আমূল রূপান্তর ঘটে গেছে । এর আগে বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসেছিল দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যম টেলিভিশন । বর্তমানে তার অনেক রূপভেদ ঘটে গেছে । সংবাদ জগতে সাম্প্রতিককালে অভূতপূর্ব উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সংবাদ সম্প্রচারের ক্ষেত্রটির ও বিস্তার লাভ ঘটেছে । ফলে গণমাধ্যমের প্রতিটি অঙ্গনে কাজ করা সাংবাদিকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে । সাংবাদিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও তাঁদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবনের নিরাপত্তা আজও সেই তিমিরই রয়ে গেছে । বিভিন্ন গণমাধ্যমের মালিকরা সরকারের লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে অসম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ার দিকেই বেশি যত্নবান । সাংবাদিকদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে তেমন যত্নবান নন । এ কারণেই সাংবাদিকদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে নিজস্ব সংগঠনের । যার মাধ্যমে তাঁরা মালিকপক্ষ ও সরকারের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়াগুলো উত্থাপন করতে পারেন ।
ত্রিপুরা রাজ্যে সাংবাদিকদের মহান পেশাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন । সেদিন শুধুমাত্র মুদ্রণমাধ্যমেই সংবাদপত্র প্রকাশিত হত এই রাজ্যে । কিন্তু বর্তমানে রাজ্যে মুদ্রণমাধ্যমের পাশাপাশি বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রসার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে । ফলে বর্তমানে এই পেশায় বহু তরুণ তরুণীরা এগিয়ে এসেছেন । তাঁরা গণমাধ্যমের জন্য যে পরিমাণ মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করছেন সেই পরিমাণ সাম্মানিক বা বেতন আজও মালিকপক্ষের কাছ থেকে পাচ্ছেন না । সংবাদকর্মীদের বেতন ভাতা ও সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে মুদ্রণমাধ্যমের যুগে মালিকপক্ষের যে মানসিকতা ছিল, আজকের উন্নত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও সেই অবস্থায়ই রয়ে গেছে । ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অতীতে যেমন এই গণমাধ্যম কর্মীদের পাশে ছিল, তেমনি আজকের দিনের বৃহৎ পরিসরেও তার গঠনমূলক ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে । সাংবাদিক ও সংবাদ কর্মীদের সার্বিক স্বার্থরক্ষাই এই সংগঠনের মূল কাজ । ফলে এই সংগঠন সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক দাবি দাওয়ার জন্য যেমন সোচ্চার রয়েছে তেমনি তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার নিয়মিত উদ্যোগও নিচ্ছে । পাশাপাশি নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিজেদের জড়িয়ে রাখছে । যার ফলে এই সংগঠন আজ ত্রিপুরা রাজ্যের বৃহত্তম সাংবাদিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে ।
রাজ্যের সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম এই সংগঠন এ বছর ৪৫ বর্ষে পদার্পণ করল । এই সংগঠনের উদ্যোগে রাজ্যের কর্মরত সাংবাদিকদের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন গত ২৪ শেও ২৫ শে ফেব্রুয়ারি আগরতলার ভগৎ সিং যুব আবাসে অনুষ্ঠিত হয় । সেই সঙ্গে কর্মরত সাংবাদিকদের গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় মিডিয়া কর্মশালার । এই কর্মশালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের যুববিষয়ক ও ক্রীড়ামন্ত্রী টিঙ্কু রায় । এছাড়াও ছিলেন ইন্ডিয়ান ফেডারেশন অফ ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল বিপিন ধুলিয়ান, কলকাতার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর প্রাক্তন রেসিডেন্ট এডিটর সুব্রত নাগচৌধুরী, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব চিত্রশিল্পী এম এ তাহের, বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী মো আবদুল হাদীসহ আরো অনেকে । উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি ধ্রুবরঞ্জন সেন । মন্ত্রীমহোদয় তাঁর ভাষণে সাংবাদিকদের অভাব অভিযোগের বিষয়ে সহমত পোষণ করেন এবং তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন । মিডিয়া ওয়ার্কশপে আলোচকগণ সাংবাদিকদের পেশাগত মান উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্র শিল্পী এম এ তাহের তাঁর বিষয়ভিত্তিক চিত্রসংগ্রহের বিস্তৃত তথ্য আলোচনায় তুলে ধরেন ।
সম্মেলনের দ্বিতীয়দিন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে সংগঠনের বার্ষিক অধিবেশন শুরু হয় । সভার শুরুতে সচিব সুনীল দেবনাথ সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ও বার্ষিক হিসেব পেশ করেন । এরপর এই সভার সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিজয় পাল কিছু সাংগঠনিক প্রস্তাব ও দাবিসনদ পেশ করেন । তারপরেই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর খোলামেলা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সাংবাদিক তপন বনিক ( কুমারঘাট ), সজলদেব ) কল্যাণপুর ), সুভাষ ঘোষ ( আগরতলা ), তপন রায় ( সাবরুম ),সরযু চক্রবর্তী ( আগরতলা ), অতনু দত্ত ( খোয়াই ), এবং বর্ষিয়ান সাংবাদিক নারায়ণ পাটারী । তাঁরা প্রত্যেকেই আলোচনাকালে কিছু কিছু সাংগঠনিক ত্রুটি বিচ্যুতির প্রতি ইঙ্গিত করেন এবং নতুন কিছু প্রস্তাব সংযোজন এর জন্য আবেদন রাখেন । বিশেষ করে আর্থিক বিষয়ে আরো স্বচ্ছতার প্রয়োজন অনুভব করেন সকলে । নিয়মিত ক্যাশবই লিপিবদ্ধ করা ও অডিটের উপর গুরুত্ব দেন অভিজ্ঞ সদস্যরা । সম্মেলনের দাবী সনদ গুলোর মধ্যে সাংবাদিকদের নিয়োগপত্র, বেতনক্রম, প্রেস এক্রিডিয়েশন, মুখ্যমন্ত্রী জনারোগ্য যোজনার সুবিধা, সাংবাদিকদের পারিবারিক পেনশন, ইত্যাদি দাবি দাওয়ার প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়া হয় । বর্তমানে গণমাধ্যমের বহুধাবিস্তৃতির কারণে সংগঠনের লোগো পরিবর্তনেরও প্রস্তাব রাখা হয় । সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশিত সংগঠনের মুখপাত্র 'মাধ্যম'-র প্রচ্ছদে নমুনা লোগোর ছবি ছাপা হয় । লোগোটি নির্মাণে 'মনন মেধা তরঙ্গায়িত মাধ্যম ও সংবাদপত্র–সবকিছুর মিশেল দেওয়া হয়েছে । নীলাভ প্রচ্ছদপটে আলোর নিরন্তর স্ফুরণ–মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রকাশ বুঝিয়েছে । ্প্রস্তাব এসেছে সংগঠনের একটি পতাকা গ্রহণের । সদস্যপদ পদ্ধতির আধুনিককরণেরও । সেইসঙ্গে 'মাধ্যম'কে নিয়মিত প্রকাশ করার ও প্রস্তাব রেখেছেন সংগঠনের প্রাক্তন সচিব নবেন্দু ভট্টাচার্য মহোদয় । এই প্রক্রিয়ার ফাঁকে ত্রিপুরা সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে শুভ্রজিৎ ভট্টাচার্য মহাশয় এইডস মহামারীর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাংবাদিকদের সোচ্চার হওয়ার আবেদন রাখেন । তাঁর আলোচনা অত্যন্ত সময়োপযোগী ছিল ।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে নতুন কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । সভার পক্ষ থেকে সংগঠনের সমস্ত সদস্যদের মতামতকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্যানেল আহবান করা হয় । সভায় উপস্থাপিত তিনটি প্যানেল থেকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে আগামী দুই বছরের জন্য সংগঠনের রাজ্য কমিটি গঠিত হয় । এই কমিটির সভাপতি বিজয় পাল ও সচিব সুনীল দেবনাথসহ ২১ জন সদস্য রয়েছেন ।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই দ্বিবার্ষিক সম্মেলন শেষ হয় । মূলত যাদের শিক্ষা, দীক্ষা, মেধা, মনন, শ্রম, কৃষ্টি, যোগ্যতা, চিন্তা, চেতনা, আদর্শ, কঠোর পরিশ্রম ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গোটা সংবাদজগৎ পরিচালিত হয়, তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সহায়ক ভূমিকা গ্রহণের অঙ্গীকারের মাধ্যমে সংগঠনের আগামী পথ চলার দিশা নির্ধারিত হয় এই সম্মেলনে ।
No comments:
Post a Comment