ধরগো তোরা, হাতে হাতে ধরগো...
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
হড়পা বানের নাম শুনেছিলাম। এবার চাক্ষুষ করলাম আমরা । দেখলাম গোটা রাজ্য কিভাবে তছনচ হয়ে যায় তার ভয়াল তান্ডবে । প্রকৃতির এই উদ্দাম মত্ততায় আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশও উপদ্রুত । কাঁটাতারের ওপার থেকেও ভেসে এসেছে হাহাকার । আমরা জল আর পানিতে ভাগ করি । কিন্তু তার তো কোনো সীমানা নেই । খেপে গেলে সে সসাগরার দখল নিতে চায় । আমরা প্রকৃতিকে চিনি না । প্রকৃতির রুদ্ররোষের খবর জানি না । যে প্রকৃতি আমাদের সবকিছু দেন তাঁকে আমরা ধ্বংস করি । তাঁর বুক টেনে চিরে ফেলি । প্রকৃতি সহ্য করতে করতে একদিন ফুঁসে ওঠেন ক্রোধে । প্রতিশোধের হাতিয়ার নামিয়ে দেন জনপদে ।
পৃথিবীতে যখন মানবতার সংকট দেখা দেয়, যখন মানুষের লোভ গগনচুম্বী হয়ে ওঠে, মনুষ্যত্ব বিপন্ন হয় তখনই প্রকৃতি জেগে ওঠে মানুষকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেন । মানষের ঘুমিয়ে পড়া বিবেককে জাগানোর জন্য প্রকৃতি মাঝে মাঝে তার আয়ুধ প্রয়োগ করেন । আর তাতে মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় । প্রতিবেশিকে আপন মনে হয় । দুঃখে, দুর্দৈবে, দুর্দিনে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ লাগাতে ইচ্ছে হয় । একে অন্যকে সাহস জাগাতে ইচ্ছা হয় । প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াতে সাধ জাগে । আবার এসময়ে আসল বান্ধবকেও চেনায় । পরিচয় হয় সৎ প্রিয়জনের সঙ্গে । এবারের বন্যায় প্রকৃতি আমাদের সে পাঠ দিয়ে গেছেন । কিভাবে আর্ত মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়িয়ে পড়ে তা আমরা দেখেছি । আর্ত মানুষ এবারে দেখেছেন সাংসদ না থাকুক সজ্জন, সৎ জন, প্রিয়জন তাঁদের পাশে আছেন । একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় থেকে আমরা অন্যপ্রদেশের দুর্যোগে আমাদের সাধ্যমতো সম্বল নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছি । আর আমাদের দুর্দিনে সেই প্রিয় প্রতিবেশিদের দেখলাম হিমশীতল প্রতিক্রিয়ায়, মধ্যরাতের নীরবতায় । আবার এমন প্রতিবেশীও দেখলাম যারা অকারণ অন্ধ অজ্ঞ দোষারোপ করে শুধু চিলচিৎকার করে গেছে এই দুঃসময়ে । এরা নিজেদের দুর্দিনেও ত্রাতা হবার যোগ্যতা অর্জন করেনি । একদিন বোধ হবে এদের । এরা নিজের দেশের বিপন্নদের সেবায়ও লাগেনি । শুধু কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে ফাঁকা আওয়াজ করে গেছে । কারো প্রতি ক্ষোভ নেই আমাদের । বরং এইসময়ে আমরা নিজেরা পরস্পর কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি । নিজেরা নিজেদের চিনতে পেরেছি । শুধু একরাশ নীরব অভিমান আর ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে আমরা আবার আমাদের সংসার গড়ব ।
জল কমে গেছে অনেকটা। পলিবিছানো প্রলয়ভূমির উপর নিথর হয়ে থাকা বাস্তুভূমিতে কপর্দকহীন অশ্রুসম্বল বন্যার্তরা ফিরছেন । যেন কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত বিষাদভূখন্ডে ফিরছে সর্বহারা ভূমিপুত্রকন্যারা । এবারে সংকট দেখা দেবে খাদ্য ও পানীয় জলের । ঘরে রাখা খাদ্যশস্যসহ সব ফসল মাঠে মারা গেছে । কৃষকের ঘরের আয়ের উৎস শেষ । অপেক্ষা করতে হবে নতুন ফসল আসা পর্যন্ত ।
এই আর্তসময়ে সরকারের নিকট আমার বিনীত আবেদন, আগামী ফসল ঘরে ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি আর্ত পরিবারে বিনামূল্যে রেশনসামগ্রী বিলির ব্যবস্থা করা হোক । ধান ও অন্যান্য শস্যবীজ ও সার-ঔষধের ব্যবস্থা করা হোক বিনামূল্যে। ততদিন পর্যন্ত হাতখরচা হিসেবে নিয়মিত কিছু আর্থিক অনুদান দেওয়া হোক । শিশু, বৃদ্ধ, অসহায় ও অসুস্থদের তালিকাভুক্ত করে তাদের যথাযথ পরিষেবার আওতায় আনা হোক । একা সরকারের পক্ষে সবদিক রক্ষা করা সম্ভব নয় । হৃদয়বানগণ ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরাও আর কটাদিন পাশে থাকুন । বিশ্বাস আমরা আবার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবই ।
শিল্পী তাঁর কল্পনা, মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে তাঁর শিল্পকে নান্দনিক করে তোলেন । তাঁর সৃজন বিপর্যস্ত হলে ক্ষুব্ধ হন তিনি । পরিত্যক্ত শিল্পের উপর আবার বোলান তাঁর চারুতুলি । প্রকৃতিও তেমনি । তাঁর এই বিধ্বংসী তান্ডবের অন্তরালেই রয়েছে সৃজনের বীজ । যা তিনি নিয়েছেন দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবেন আমাদের । কারণ আমরা প্রকৃতির সন্তান । তিনি শুধু শাসন নয় । সোহাগও আমাদের করবেন ।
No comments:
Post a Comment