রাজনৈতিক অস্থিরতা : বাংলা কবিতায় ভিন্নতর স্বরায়ণ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
কবিতা মানুষের আবেগ অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে । তাই সাহিত্যক্ষেত্রে কবিতার বহুমুখী প্রভাব থাকে । মানুষের জীবনযাপন নানাঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় । তেমনি কবিতাও মানবমনের পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়াকে প্রস্ফুটিত করে তোলে । বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট নানারকম রাজনৈতিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে মানুষকে এগোতে হয় । ইতিহাসের এটাই বিধান । অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানব হৃদয়ের গভীরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় । কখনো বা হাহাকার ধ্বনিত হয় । মানবের গহন হৃদয়ের আর্তনাদের শৈল্পিক প্রকাশ ঘটে কবিতায় । বাংলা কবিতার ধারার মধ্যে এই চাঞ্চল্যের লক্ষণ বারবার প্রস্ফুটিত হয়েছে । তা কখনো উচ্চকিত ও কখনো নিচুস্বরে । প্রেম-প্রকৃতি-ঐশ্বর্য-আধ্যাত্মিকতা-বিদ্রোহ ইত্যাদি প্রকাশের উজ্জ্বল হাতিয়ার কবিতা । বিষয়বৈচিত্র্যের অভিনবত্বের মধ্যে প্রকট হয় বাংলাকবিতার নানা স্বর । জীবনরসের বহুমাত্রিক বিচ্ছুরণের ফলেই সৃষ্টি হয় বহুবিধ স্বরের । আধুনিক জীবন রাজনৈতিক আবর্তে চালিত হয় ।তাই সময় সময়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাকাব্যক্ষেত্রেও নতুন স্বরায়ন ঘটে । রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এই স্বরায়নের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় কবিতার এক একটি পর্যায়ের । সৃষ্টি হয় এক একটি আন্দোলনের ধারার । সেই ধারা বাংলাকাব্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বৈষ্ণব সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য শাক্তপদাবলী ও আধুনিক গীতি কবিতা, গদ্য কবিতা এবং সমকালের উত্তরাধুনিক কবিতার পর্যায় পর্যন্ত সমানভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে ।
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এদেশকে বহু সময় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে । নদীমাতৃক বঙ্গভূমির উর্বর পলিমাটিতে প্রচুর শস্য উৎপন্ন হয় । যার ফলে এই জনপদের মানুষজন সুখে সম্ভোগে জীবন যাপন করতে পারতেন । কিন্তু বাংলাদেশের অফুরন্ত শস্যভান্ডার ও প্রাকৃতিক সম্পদ এখানকার শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবনে আঘাত হয়ে নেমে এসেছে বারবার । 'অপনা মাসে হরিণা বৈরী'র মতো এদেশের সম্পদের লোভে বারবার বিদেশি অত্যাচারীরা এদেশকে আক্রমণ করেছে । বহিঃশত্রুর সঙ্গে লড়াই করে প্রতিরোধ করার মত ক্ষমতা এদেশের মানুষের একসময় ছিল না । ফলে ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে বাঙালির পরাজয়ই ভবিতব্য ছিল । সে সময়ে বাঙালিজাতির মধ্যে জাতীয় চেতনার অভাবের কারণেই বিদেশী শত্রুরা অনায়াসে এ দেশ আক্রমণ ও অধিকার করতে পেরেছিল ।
বাংলাদেশের মানুষের সহজ সরল জীবনযাত্রা, ভাবপ্রবণতা ও কল্পনা প্রিয়তার কারণে তাদের সৃষ্ট সাহিত্যে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাপ তেমন পড়েনি । বাঙালির কাব্যের আদি নিদর্শন 'চর্যাপদে' সমাজের দুঃখ দুর্দশার চিত্র ডাকাতদল সহ নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার চিত্র পাওয়া যায় ।
কিন্তু সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের ও কোন যোগাযোগ তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না । তাঁছাড়া তাদের জীবনের অসঙ্গতিগুলোকে তাঁরা দৈবের হাতেই ছেড়ে দিতেন । কোনরকম প্রতিবাদমুখরতা এই সময়ের সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া যায় না সেইসময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ জানতে হলে ইতিহাসের আশ্রয় নিতে হয় । কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থাকে । সেসময়ের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যাঁরা রচনা করেছিলেন তারা মূলত ছিলেন বিজয়ী শাসকদলের প্রতিনিধি । বিজিত বাঙালি জনগোষ্ঠীকে তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন । ফলে তার মধ্য থেকে বাঙালির রাজনৈতিক জীবনের সঠিক চিত্র প্রকাশিত হয় না । স্বাভাবিক কারণেই সে সময়ে বাঙালি মননে প্রতিবাদী চেতনার উপস্থিতি থাকলেও তা সেই সব ইতিহাসকারগণ চেপে গিয়েছেন । বরং তাঁদের লেখায় বাঙালিচেতনা দুর্বল, অসত্য ও পলায়নপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে । ইতিহাসের শুরুর দিকে বাঙালির পরাজয়ের প্রসঙ্গটি অধিক মাত্রায় গুরুত্ব পেয়েছে । আত্মরক্ষা ও স্বদেশরক্ষায় বাঙালি চরিত্রের দুর্বলতার কথা মুখ্যরূপে প্রকাশ করা হয়েছে ।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাসাহিত্যের কোনো প্রামাণ্য নিদর্শন না থাকায় ও তুর্কিবিজয় ও পাশাপাশি সময়ে সৃষ্ট ধ্বংসলীলাকে লক্ষ্য রেখে ১২০০ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত একটা সময়কে বাংলাসাহিত্যের অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত করা হয়েছে । ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার সেনবংশের শাসক বৃদ্ধ লক্ষণ সেনের রাজধানী নদিয়া বিনা বাধায় জয় করে এদেশে মুসলমান রাজত্বের সূত্রপাত করেন । এখানে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের ঘটনাটি সত্য । কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি বা শাসকের যে গালগল্প সৃষ্টি করা হয়েছিল তা সর্বতোভাবেই বানানো । এইসময়ে বাংলাভাষায় রচিত সাহিত্যের নিদর্শন না পাওয়া গেলেও অন্যান্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া যায় । প্রাকৃত ভাষায় রচিত গীতিকবিতা 'প্রাকৃতপৈঙ্গল' এইসময়ের রচনা । রামায়ণ পণ্ডিতের 'শূন্যপুরাণ', ডাক ও খনার বচন, হলায়ুধ মিশ্রের সেক শুভোদয়া এবং বেশ কিছু সঙ্গীত এই সময়ে সৃষ্টি হয় । রামাই পন্ডিতের শূন্যপুরাণ ধর্মপূজার শাস্ত্রগ্রন্থ । গদ্যপদ্যমিশ্রিত চম্পুকাব্য । এই কাব্য সেসময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কিছু চিত্র পাওয়া যায় । ব্রাহ্মণ্যশাসনের অবসান ও মুসলমান শাসনের প্রবর্তনের ফলে সৃষ্ট তৎকালীন সামাজিক চিত্র এখানে পাওয়া যায় । 'আপনি চন্ডিকা দেবী তিই হৈলা হায়া বিবি / পদ্মাবতী হৈলা বিবি নূর । / যথেক দেবতাগণে সবে হয়্যা এক মন / প্রবেশ করিল জাজপুর । / দেউল দেহরা ভাঙ্গে কাইড়া ফিড়া খায়ে রঙ্গে / পাখড় পাখড় বোলে বোল । / ধরিয়া ধর্মের পাএ / রামাই পন্ডিত গাএ / ঈই বড় বিষম গন্ডগোল ।।' এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় নবাগত মুসলমান শাসকদের অত্যাচার ও ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেকালের লৌকিক দেবদেবীদের গায়ে ইসলামের মোড়ক লাগানোর প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল । কারণ মুসলিম বিজয়ীগণ এ দেশ দখল করেই প্রথমে ধর্মের উপর আঘাত হানে। প্রজাসাধারণের উপর অত্যাচার, উৎপীড়ন, লুণ্ঠন, বিগ্রহ, মন্দির ধ্বংস করতে শুরু করে । ধর্মহানির সম্ভাবনা যখন প্রকট হয়ে ওঠে তখন সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাঁদের আরাধ্যা দেবদেবীকে মুসলিম নামের রূপান্তরিত করেন । ক্ষমতালোভী বিদেশী শাসকদের জিঘাংসা, রাজ্যলিপ্সা, যুদ্ধ, হত্যা ও ধ্বংসলীলার মাঝে পড়ে অসহায় মানুষ সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে না পারলেও গোপন কৌশল নিয়ে বাংলার ব্রাত্য দেবদেবী সমূহকে আঘাত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন । পাল ও সেন যুগে বাংলাদেশে বসবাসকারী অনার্যদের সঙ্গে ধর্ম, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা ছিল । তারা স্বাধীনচেতা ও দুর্ধর্ষ হলেও একসময় আর্যদের কাছে নতিস্বীকার করেছিল । ফলে তাদের লোকধর্মের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু আর্যীকরণ ঘটেছিল । লৌকিক দেবদেবীরা আর্য দেবতায় রূপান্তরিত হয়ে যায় । আবার মুসলমান আক্রমণের ফলে এই লোকায়ত দেবদেবীদের আরেক প্রস্থ পরিবর্তন ঘটে । রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র রচিত সংস্কৃত চম্পুকাব্য শেখ শুভোদয়া ( ১২ শতকের শেষে বা ১৩ শতকের গোড়ার দিকে ) অধ্যাত্মমহিমা ও পিরের মাহাত্ম্য বিষয়ক কাব্য । এখানেও তেমন কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না । শুধুমাত্র রোগ শোক ও প্রেতাত্মার প্রভাব সংক্রান্ত কিছু লৌকিক সংস্কারের চিত্র পাওয়া যায় । বস্তুত লক্ষণ সেনের পতনের পরপরই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটিও চাপা পড়ে গিয়েছিল । সেসময়ের সাহিত্যের নিদর্শনে বাঙালিজাতির এই দুঃখজনক পরাজয়ের কোন ছাপ স্পষ্টত পড়েনি । অর্থাৎ বাঙালিজাতির যে আত্মবোধ বা জাতীয়তা বোধ তা তখনো এই জাতির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেনি । জাতীয়তাবোধ থাকলেই তার মধ্যে স্বদেশচেতনার উপলব্ধি জাগ্রত হত ।
মধ্যযুগে বাংলাদেশ যখন বিদেশি শাসকের পুরোপুরি করায়ত্ত সেসময়ে বাঙালির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে আবির্ভাব ঘটে শ্রী চৈতন্যদেবের । মুসলমানদের অত্যাচারে হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ যখন বিপন্ন ও বিনষ্ট হওয়ার অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই সময়ে আবির্ভাব ঘটে চৈতন্যদেবের । তিনি বাংলাদেশে প্রেমের বার্তা ও ক্ষমার মন্ত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন । বিপন্ন বাঙালি জাতিকে রক্ষা করার জন্য । ধর্মীয় চেতনার পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে তিনি একটি বহুধা বিভক্ত জাতিকে একত্রিত করলেন । আপাত দৃষ্টিতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এর সংশ্রব না থাকলেও বাঙালির রাষ্ট্রীয়চেতনার একটি যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় । এই ধর্মীয় জাগরণের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের মধ্যে এক নতুন জীবনবোধ সৃষ্টির প্রয়াস তখন থেকেই শুরু হয় । এই নবচেতনার মধ্যে জাতীয়চেতনারও একটা অস্পষ্ট উপলব্ধি নিহিত ছিল । আমরা দেখি উনবিংশ শতাব্দীতে জাতীয় চেতনাও এই ধর্মীয় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ।
চৈতন্যপরবর্তী যুগের শ্রেষ্ঠ বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে অনার্য বাঙালির শৌর্যের চিত্র ধরা পড়েছে । বন্য হিংস্র পশুকে পর্যদস্থ করবার, বধ করবার ক্ষেত্রে সুকৌশলী এই দুর্ধর্ষ জাতির কাহিনি পড়লে বিশ্বাস করতে প্রাণ চায় না যে, এরা অনায়াসে বিদেশির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে । এরা ভীতু । আসলে এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সমকালীন ইতিহাসলেখকরা বাঙালির এরকম দুর্বল চরিত্র চিত্রণ করেছেন ।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু চরিত্রটিতে তো এরকম কোন দুর্বলতার স্থান নেই । ধর্মমঙ্গল কাব্যে আধ্যাত্মিকতার প্রচার থাকলেও রাজনীতি এখানে প্রধান বিষয় । সপ্তদশ শতাব্দীর যুদ্ধদীর্ণ সময়ে ঘনরাম চক্রবর্তী সমাজের অন্ত্যজদের দেবতাকে নিয়ে এই কাহিনি রচনা করেন । আর এই ধর্মমঙ্গল কাব্যেই স্বদেশচেতনার আভাস দেখতে পাওয়া যায় । এই কাব্যের গৌড়যাত্রা পালায় রানি তার পুত্রকে গৌড়ে পাঠাবার সময় বলেছেন, 'পরাধীন পরান বিফল হেন গণি' । প্রাণপ্রিয় পুত্র যুদ্ধে চলে যাচ্ছে । তার বিচ্ছেদে তিনি শংকিতা । কিন্তু এত দুঃখের মধ্যেও পরাধীনতার বিড়ম্বনা ও তার ফলে পরান অর্থাৎ জীবন যে অর্থহীন তা তিনি অনুভব করতে পারছেন । এটা প্রকৃতপক্ষে স্বদেশানুভব । মঙ্গলকাব্যের যুগে একমাত্র ধর্মমঙ্গল এই রাষ্ট্রচেতনার প্রত্যক্ষ পরিচয় পাওয়া যায় ।
তারপর পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগের রচিত ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে বাঙালির শক্তি ও শৌর্যের পরিচয় পাওয়া যায় । দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের ফলে যে জাতি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে এসে দেখা যায় সে জাতির প্রতিনিধি এক রাজপুরুষ তার সংগ্রামী চেতনা ও বৈভবের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন । ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের বর্ণনায়— 'যশোর নগর ধাম / প্রতাপাদিত্য নাম / মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ । / নাহি মানে পাতসায় / কেহ নাহি আঁটে তায় / ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ ।।' প্রতাপাদিত্যের শৌর্য প্রসঙ্গে কবি আরো বলেছেন— 'বর পুত্র ভবানীর / প্রিয়তম পৃথিবীর / বায়ান্ন হাজার যার ঢালী । / ষোড়শ হলকা হাতি / অজুত তরঙ্গ সাথী / যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী ।। তৎকালীন বাংলাদেশে প্রতাপাদিত্যের সমরশক্তি দেখে তদানীন্তন সম্রাটেরও টনক নড়ে গিয়েছিল । প্রতাপাদিত্যের পরেই সংগ্রামী মেজাজের ভূস্বামী হলেন সীতারাম রায় । সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামকে নিয়ে উপন্যাসও রচনা করেছেন । দেশপ্রেমিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসসমূহের চরিত্রের মধ্য দিয়ে স্বদেশপ্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন । তার মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব 'আনন্দমঠ' । তাঁর অন্যান্য রচনায় স্বদেশ প্রীতি ও ইতিহাসানুরাগ যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তার তুলনায় আনন্দময় একেবারে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি । আনন্দমঠে বঙ্কিমচন্দ্র একটি যুগোপযোগী সশস্ত্র বিপ্লবের কথা চিত্রিত করেছেন । অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে এই উপন্যাসে শক্তিসাধনার একটি নতুন ধারা বাঙালি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন । মাতৃভাবনা এখানে স্বদেশভাবনায় রূপান্তরিত হয়েছে । এখানেই উদ্ধৃত হয়েছে মাতৃরূপা জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি । তাঁর বিখ্যাত বন্দেমাতরম কবিতা ও সংগীতে এই বন্দেমাতরম সংগীত গাইতে গাইতে ফাঁসির রজ্জুকে চুম্বন করে শহিদ হয়েছেন বাংলার বিপ্লবীরা ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-রামায়ণ-মহাভারত-মঙ্গলকাব্য-বৈষ্ণব সাহিত্য-শাক্ত পদাবলি প্রভৃতি কাব্যচর্চার মাধ্যমে বাঙালির প্রাচীন ও মধ্যযুগের যথেষ্ট মননশীল ভাবনার প্রকাশ পেয়েছে । কিন্তু এই কাব্যসৃষ্টিতেও বাঙালির জাতিসত্তাকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস তেমনভাবে নেওয়া হয়নি । উনবিংশ শতাব্দীতে এসে সাহিত্য ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বদেশচেতনার স্ফুরণ ঘটতে শুরু করল । বাংলাকাব্যেও এই স্বদেশভাবনার উপস্থিতির প্রসঙ্গে একজন আলোচক উল্লেখ করেছেন— '১৮৩০ হইতে ১৮৯৬ পর্যন্ত এই পর্বের বাংলাকাব্যকে জাতীয় আন্দোলনের কাব্য বলা যাইতে পারে। এ যুগের কাব্যের লক্ষ্য যে অনির্দেশ্য সৌন্দর্যালোক নয়, জাতীয় আদর্শ প্রচারের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করিয়া এ যুগের কাব্যের লক্ষ্যকে ভিন্নমুখী করা হইয়াছে । যে কাব্য লঘু পক্ষবিস্তার করিয়া শূন্যাভিমুখী হইবে সেই কাব্যের স্কন্ধে গুরু বস্তুভার ঝুলাইয়া দিয়া তাহাকে বাস্তব জগতের দিকে টানিয়া রাখা হইয়াছে । ( আধুনিক বাংলা কাব্যের ভূমিকা তারাপদ মুখোপাধ্যায় ) ।
এই সময়ের কবিদের মধ্যে স্বদেশভাবনার কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অগ্রগণ্য । তাঁর 'স্বদেশ' কবিতা দেশপ্রীতির বড়ো উদাহরণ । 'জানো নাকি জীব তুমি / জননী জনমভূমি / যে তোমারে হৃদয়ে রেখেছে / থাকিয়া মায়ের কোলে, / সন্তানের জননী ভোলে /কে কোথায় এমন দেখেছে ?/ মিঠা মণি মুক্তা হেম / স্বদেশের প্রিয় প্রেম / তার চেয়ে রত্ন নাই আর ।' দেশকে ভালোবাসার পাশাপাশি এখানে মাতৃভাষার প্রতিও গভীর মমত্ব প্রকাশ করা হয়েছে । 'বৃদ্ধি কর মাতৃভাষা / পুরাও তাহার আশা / দেশে কর বিদ্যাবিতরণ ।' পাশাপাশি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসঙ্গটি ও এখানে উল্লেখ্য । প্রসঙ্গত এই মাতৃভাষাপ্রেমই পরবর্তীকালে বাংলাভাষা আন্দোলন নাম নিয়ে বৃহত্তর রূপ নিয়েছিল । ঈশ্বর গুপ্ত বাঙালিজাতিকে দেশভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস নিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে তাঁর ভাবানুসারীদের মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয় । তাঁদের মধ্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় নবীনচন্দ্র সেন, তাঁদের কাব্য রচনার মাধ্যমে দেশপ্রেমকে বিকশিত করেছেন । রঙ্গলালের , পদ্মিনী উপাখ্যান দেশপ্রেমের বক্তব্যে পুরোপুরি সময়োপযোগী কাব্য । বাংলা কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে রঙ্গলালের উত্তরসূরী হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাহিত্যজীবনের স্থায়িত্বকাল অত্যন্ত অল্প । এই সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাকাব্যকে বেগবতী করে তোলেন । বাংলাকাব্যের ক্ষেত্রে তিনি নবযুগের প্রবর্তক । এক সৌরপ্রতিম শৌর্যের অধিকারী মধুসূদনের মাতৃভাষা ও সাহিত্যপ্রীতির পাশাপাশি অনন্য স্বদেশপ্রেম ও তাঁর কাব্যের উপযোগ্য বিষয় ছিল । দেশবন্দনা মাতৃভাষাপ্রেম এবং স্বজাতিপ্রীতি মধুসূদনের ভাবলোক ও কল্পনার জগতকে নিবিড়ভাবে বেষ্টন করেছিল । তার মেঘনাথদ বধ কাব্যে লঙ্কাবাসীর দেশাত্মবোধের মহিমা পরিস্ফুটিত হয়েছে । এই কাব্যে ইন্দ্রজিৎ চরিত্রটি স্বদেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক । তাঁর চতুর্দশপদী কবিতা বলিতেও তিনি স্বদেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন । মধুসূদনের পর হেমচন্দ্র তাঁর কবিতাবলিতে বৃত্রসংহারে বীরবাহুতে বিশুদ্ধ দেশচেতনার ফল্গুধারা প্রবাহিত করেছেন । তাঁর ভারতসংগীতে জনজাগরণের উদাত্ত আহ্বান রয়েছে । 'বাজরে শিংগা বাজ এই রবে / শুনিয়া ভারতে জাগুক সবে / সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে / সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে / ভারত শুধুই ঘুমাইয়ে রবে ?/ । এই সময়ের আরেকজন কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁর 'অবকাশরঞ্জিনি' প্রথম ভাগ ( ১৮৭১ ) এবং রঙ্গমতি ( ১৮৮০ ) কাব্যে তাঁর স্বদেশানুভূতির প্রকাশ করেন । তারপর পলাশীর যুদ্ধ তাঁর সার্থকতম রচনা । তাঁর 'রঙ্গমতি' কাব্যে স্বাধীনচেতা শিবাজীর মহৎ আদর্শকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন ।
কবিদের কবিতায় স্বদেশভাবনা ও অন্যদিকে রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালিমানসকে উন্মাদনা মুখর করে তুলেছিল । স্বদেশমন্ত্রে উজ্জীবিত জনগণের মধ্যে এক নতুন বেগের সঞ্চার হয় । জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকামী মানুষ সারা ভারতব্যাপী বজ্রহুংকার দিয়ে ওঠে । দেশের অতীত গৌরব পুনরুদ্ধারের আওয়াজ ওঠে দিকে দিকে । রাজনৈতিক পারদ চড়ার সাথে সাথে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সরলা দেবী চৌধুরানী যে উঠলেন, 'গাহ হিন্দুস্তান / অতীত গৌরব বাহিনী মম বাণী / গাহ আজি হিন্দুস্থান ।' তার আগে ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র, গনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখগণ হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠা করে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন । শিবাজী উৎসবকে জাতীয় উৎসবের পরিণত করা হয় । রবীন্দ্রনাথ লেখেন 'শিবাজী উৎসব' কবিতা । প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর স্বদেশপ্রেমমূলক কাব্যচেতনাই যে পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছিল তা বোঝার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয় না ।
উনিশ শতকের শেষভাগে সারা দেশব্যাপী অসংখ্য গণআন্দোলন ব্রিটিশ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে । শাসক শ্রেণী ও বাংলা বিভাজনের চিন্তা করতে থাকে । ১৯০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে সে সময়ের লাট সাহেব লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ইঙ্গিত দেন । ফলে চারিদিক জনজোয়ারে উত্তাল হয়ে ওঠে । ১৯০৪ সালের ১৮ মার্চ কলকাতার টাউন হলে সমগ্র বাংলার প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন । কিন্তু স্বৈরাচারী ইংরেজ প্রতিনিধি লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করে ফেলেন । ১৯০৫ সালের ৫ জুলাই বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে । তার পাশাপাশি বাঙালি কবিরাও তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হন । এই সময় স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতার মাধ্যমে জনজাগরণ সৃষ্টি করেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাস, সরলাবালা দেবীচৌধুরানী, স্বর্ণকুমারী দেবী, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন প্রমুখগণ । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানের মাধ্যমে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন ।
এরই মধ্যে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে সাধারণ জীবনে এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলে । জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় । পূর্বের গতিশীল পৃথিবীকে স্থবির করে ফেলে একদল স্বার্থান্বেষী যুদ্ধবাজ । সমাজ অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই এক পালাবদলের সূচনা ঘটে । পুরানো মূল্যবোধগুলো গুরুত্ব হারাতে শুরু করে । অবিশ্বাস স্বার্থসংঘাত এবং নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিগুলো সমাজের বুকে প্রকট হয়ে ওঠে । প্রথম মহাযুদ্ধের সঙ্গে বাংলাদেশের তথা ভারতবর্ষের তেমন যোগাযোগ না থাকলেও দেশের শাসক ইংরেজ থাকার ফলে তার প্রভাব এ দেশের উপর ভীষণভাবে পড়েছিল । এ সময় বিশ্বজুড়ে যে আতঙ্ক যুদ্ধোত্তর নৈরাজ্য, হতাশা, ক্লান্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তার প্রভাবে পাশ্চাত্য কাব্যে এক নতুন বাঁকবদল ঘটে যায় । মহাযুদ্ধের চার বছর পর বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি টি এস এলিয়ট ( ১৮৮৮–১৯৬৫ ) রচনা করেন ' The Waste Land. ( ১৯২২ ) । প্রথম যুদ্ধের ফলে যে মানবিক অবক্ষয় দেখা দিয়েছিল যে নিদারুণ হতাশা, কুৎসিত জীবনধারণের সমরোহ, ক্লেদাক্ত মানসিকতা নিয়ে অনুষ্ঠিত নৈরাশ্যের আবর্তে বন্দী হওয়ার উপক্রম হয়েছিল এই সময়েই ইয়েটস লেখেন, What shall I do with this absurdity / O heart, O troubled heart–this caricature / the decreepit ahe that has tide to me.'
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্বময় যে অচলাবস্থায় সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর একাধিক কবিতায় ছত্রে ছত্রে তা ফুটে উঠেছে । তৃতীয় বিশ্বের কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বযুদ্ধকে যেভাবে দেখেছেন তা বলাকা ( ১৯১৬ ) কাব্যের ৪৫টি কবিতার অধিকাংশ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে । এই কাব্যগ্রন্থের কবিতায় তিনি লেখেন– 'এবার যে ওঈ এল সর্বনেশে গো / 'বেদনায় যে বান ডেকেছে, / রোদনে যায় ভেসে গো / রক্তমেঘে ঝিলিক মারে, / বজ্র বাজে গহন পারে / কোন পাগলে বারে বারে /উঠছে অর্থ হেসে গো এবার যে ওই এলো সর্বনাশে গো । / জীবন এবার মাতল মরণ-বিহারে / এই বেলা নে মোর বরণ করে / সব দিয়ে তোর ইহারে / ।এই কাব্যগ্রন্থের 'ঝড়ের খেয়া' কবিতায় বিশ্বযুদ্ধের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেন– 'দূর হতে কি শুনিস মৃত্যুর গর্জন, ওরে দীন / ওরে উদাসীন / ওই ক্রন্দনের কলরোল, লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল ।।' প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখা সবচেয়ে আলোচিত কবিতা 'ঝড়ের খেয়া' । এখানেই তিনি বলেছেন 'এ আমার, এ তোমার পাপ' । এখানেই রয়েছে আশাবাদ 'শান্তি সত্য, শিব সত্য সত্য সেই চিরন্তন এক ।' তাঁর 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৬৪ সংখ্যক কবিতায়ও রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের কথা ।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলা কবিতায় কল্লোল ( ১৯২৩ ) কালিকলম ( ১৯২৬ ) প্রগতি ( ১৯৮৭ ) পরিচয় ( ১৯৩১ ) প্রভৃতি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে একদল কবি বাংলা কবিতার পঠন পাঠন শ্রুতির ভূগোলে এক নতুন আন্দোলন সৃষ্টি করেন । এই পর্বে এলেন নজরুল । ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফেরার পরে দেশের মানুষের উপর ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন, অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নজরুল কলম হাতে নেন । ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি 'বিজলী' সাহিত্য পত্রে তাঁর অমর সৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশিত হয় । দেশের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নজরুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সংগীত ও কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন । তাঁর 'কান্ডারী হুঁশিয়ার', 'সাম্যবাদী' ইত্যাদি কবিতা সেসময়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ইন্ধন যুগিয়ে ছিল ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৪২ এর বিপ্লব, সবমিলিয়ে যখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তাল এসময় ভারতের রাজনৈতিক বাতাবরণ বহু তরঙ্গ আবর্তে সংক্ষুব্ধ। একদিকে ফ্যাসিষ্ট বিরোধী আন্দোলন ।কমিউনিস্ট ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতভেদ ।বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সুভাষচন্দ্রের অধিনায়কত্ব, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, খন্ডিত স্বাধীনতা উদ্বাস্তু স্রোত, তেভাগা আন্দোলন, গান্ধীজীর হত্যা, সর্বোপরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর পরিণামে ( ১.৯.১৯৩৯– ২.৯.১৯৪৫ ) সমগ্র জাতি উদভ্রান্ত ও হতাশায় নিমজ্জিত । বাংলাকবিতায় চল্লিশের দশক মূলত ত্রিশের দশকের বাংলার জনমানসের রূপান্তরের অভিঘাত । এই সময়ে ভাবনার জগতেও বিস্তৃতি ঘটেছে । সাম্রাজ্যবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নবীন কবিকুল কবিতায় নতুন সুর আনলেন । কবি অরুণ মিত্র, বিমল চন্দ্র ঘোষ, দীনেশ দাস, মনিন্দ্র রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সমর সেন কবিতায় এক নবীন স্বর আনলেন । এই সময় বাংলাদেশ ফ্যাসিষ্টবিরোধী লেখক সংঘ ( ১৯৪২ ) ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ( ১৯৪৪ ) প্রতিষ্ঠিত হয় । এক অশান্ত রাজনৈতিক আবর্তন এর মধ্যেই এগিয়ে এলেন আরও বেশ কয়েকজন কবি । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, রাম বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন, জগন্নাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, গোলাম কুদ্দুস, অসীম রায়, চিত্ত ঘোষ কৃষ্ণ ধর প্রমুখরাই চল্লিশের কবি । এই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিশিষ্ট কবিতার পত্রিকাগুলো হল– কবিতা ( বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা, ১৯৩৫ ), জীবাণু ( সুশীল রায় সম্পাদিত মাসিক, ( ১৯০৬ ),নিরুক্ত ( প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১৯৪০ ), একক ( শুদ্ধসত্ব বসু সম্পাদিত, ১৯৪১ ), অঙ্গীকার ( শচীন ভট্টাচার্য ও পূর্ণেন্দু পত্রী সম্পাদিত, ( ১৯৪৯ ) প্রভৃতি । এই সময়ের কবিকুলের অগ্রজ কবিরা বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখগণও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় সময়ের কথা, দুর্ভিক্ষের কথা, গ্রামবাংলার নিরন্ন নরনারী ও সবশেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন তাদের কবিতায় । সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'সংবর্তন' ( ১৯৪৫ ) বিষ্ণু দের 'সন্দীপের চর' ( ১৯৪৭ ) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে সময়ের চিত্র বর্তমান । ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ও আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছ করেন শহীদ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় । ৮-২-১৯২৫–২১-১১-১৯৪৫ স্মরণে সাংবাদিক কবি অসীম রায় ( ৭-৩-১৯২৭ ৩৪১৯৮৬ ) লেখেন রক্তঝরা কবিতা । বাংলাকাব্যের নতুন ধারার স্রষ্টা জীবনানন্দ দাশ । ( ১৮৯৯-১৯৫৪ ) তাঁর '১৯৪৬-৪৭' কবিতায় সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সন্ত্রাস ক্লান্ত কলকাতার চিত্র পাওয়া যায় । হিন্দু মুসলমানের ঐতিহ্যগত সম্প্রীতি বিলুপ্ত হতে দেখে জীবনানন্দ কবিতায় বেদনাক্লিষ্ট উচ্চারণ করেছেন ।
ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার রক্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে আসে দেশের স্বাধীনতা । এক রাষ্ট্র ভেঙে তিন টুকরো হয় । ভাগ করা হয় দেশের সবচেয়ে সচেতন ভূমি বাংলা ও পাঞ্জাবকে । দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে । ফলে নতুন দেশে দলে দলে উদ্বাস্ত মানুষ নতুন ভূখণ্ডের খোঁজে নিজেদের পূর্বপুরুষের ভদ্রাসন ফেলে অনিশ্চিতের বুকে পাড়ি দেয় । এই চরম রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সময় কবিরাও খুঁজে পান তাঁদের স্বতন্ত্র স্বর । কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর কবিতায় ইতিহাসের এক নির্মম সত্য তুলে ধরেন–'আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে, আমাদের নিজের দেশে, / নতুন দেশে, নতুন দেশের নতুন জিনিস- মানুষ নয়, জিনিস সে, / জিনিসের নাম কি ? নতুন জিনিসের নাম উদ্বাস্তু। ( উদ্বাস্ত ) । বিষ্ণুদে তাঁর 'জল দাও' কবিতায় লেখেন–'এখানে ওখানে দেখ দেশ ছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায় পার্কের ধারে / শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায় ভাবে ওরা কি যে ভাবে !ছেড়ে / খোঁজে দেশ এইখানে কেউ বরিশালে কেউ কেউ বা ঢাকায়.....( জল দাও ) । পরবর্তী সময়ের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায়ও দেশ বিভাগ প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে । 'কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের স্কুলে নিথর দিঘির পারে / বসে আছে বক আমি কি ভুলেছি সব স্মৃতি, তুমি এক প্রতারক ? আমি কি দেখিনি কোন মন্থর বিকেলে শিমুল তুলোর ওড়াউড়ি' ( যদি নির্বাসন দাও ) ।
দেশভাগের যন্ত্রণা ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় ও ছাপ রেখে গেছে । বরিষ্ঠ কবি পীযুষ রাউত তাঁর বাস্তভূমি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার সব হারানো স্মৃতিগুলোকে তুলে ধরেন তাঁর কবিতায় । 'দেশের বাড়ি সেই কুশিয়ারা নদী কিংবা শারদীয় কাশফুল / কিংবা সবুজের পটভূমি জুড়ে হলুদ সরষে ফুল / কিংবা নারকেল বোঝায় নৌকার মিছিল কিংবা / কলকাতার গন্ধ মাখা মালবাহী স্টিমার কিংবা পাঁচিল শাসিত / তিন বিঘা জমির উপর সুবিশাল বাড়ি কিংবা উত্তরকালে / দেশ বিভাগের পর টিলা ও সমতল সমন্বিত চাতলা ভ্যালি.... কিংবা 'আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য / চিরকাল বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকব যেমন দেশের বাড়িতে /নৌকার জন্য প্রতীক্ষমান মা ও আমি' আমি ও ছোট ভাই / নদীতীরে উদ্দাম হওয়ার মধ্যে আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য....( আমরা কয়েকজন কয়েকজনের জন্য ) ।এছাড়াও অনিল সরকার, মিহিরদেব, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, দিলীপ দাস, প্রমুখের কবিতায়ও দেশভাগের যন্ত্রণা বিধৃত হয়েছে ।
দেশভাগের যন্ত্রণা শুধু এপারের মানুষকেই আশাহত করেনি । ওপারের অর্থাৎ বাংলাভাগ হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষার কবিদের মনেও চাপ ফেলেছে । 'কুষ্ঠব্যাধি' কবিতায় কবি কায়েস আহমেদ উচ্চারণ করেন– 'তাই তো চন্দ্র মোহন ! রাইতের আন্ধারে / চৌদ্দ পুরুষের ভিটা ছাইড়া নদীর / জলে চক্ষের জল মিশাইয়া নির্বাসনে /যাইতে হয় । ভাইসা যায় গো নদীর / জলে প্রতিমা ভাইস্যা যায় । বড় দুঃখ চন্দ্রমোহন বড় কষ্ট ! তবু মাটির বড় মায়া । রাইত নাই / দিন নাই মাথার ভিতরে বুকের ভিতর / খালি পাড় ভাঙ্গে । নদী /খালি কল কল কল কইরা বইয়া যায় ।' রেডক্লিফের সীমানা বিভাজন মূলত বাঙালির বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে । দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতিতে বাঙালির বুকে যে বিচ্ছেদ যন্ত্রণার মতো ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা বহুদিন বয়ে নিয়ে যেতে হবে এ জাতিকে । যার ফলশ্রুতিতে বাংলাকবিতায় জন্ম নেয় আরেক নতুন স্বরের । বহু স্বরের । দেশভাগ বাংলা কবিতার বয়নশিল্পে এমন ভাবে মিশে গেছে যে তার অস্তিত্বকে কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না বরং দেশভাগ ও বাংলা কবিতা সাহিত্যের স্বরূপে এমন এক চিহ্নায়নের সম্ভাবনা তৈরি করেছে যা কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয় ।
দেশ বিভাগের ফলে বাংলাদেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে দুটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হয়েছে । ফলে নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে দু দেশের বাংলাভাষাভাষী জনগণকে ও বাংলাসাহিত্যকে । আর এইসব রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে দেশের কর্তৃত্ব যাদের হাতে থাকে তাদের দ্বারাই সৃষ্ট ১৯৪৭ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের ফলে বাঙালি জাতি ও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে । পূর্ব পাকিস্তান নামে আলাদা ভূখণ্ডের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা প্রথমেই কোপের মুখে পড়ে তাদের ভাষা নিয়ে । সেখানে সরকারী তরফে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলা এতভাষাভাষী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ক্ষোভে গর্জে ওঠে । জন্ম নেয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলন । ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই আন্দোলন ক্রমে জোরালো হয়ে ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলনের রূপ নেয় । ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সে দেশের মানুষ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালন করে । সেই আন্দোলনে শহীদ হন রফিক, শফিক বরকত সালাম, জব্বরসহ বহু নাম না জানা মানুষ । বাহান্নর একুশের আন্দোলন সে দেশের বাঙালিদের দেশপ্রেমের আবেগ, অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই ভাষা আন্দোলন বাংলা কবিতায় নতুন স্বর সংযোজন করে । তাদের কবিতায় মাতৃভাষা প্রেমের পাশাপাশি দেশ সমাজ ও জাতির শোষণ বঞ্চনার কথা ফুটে ওঠে । এই সময়ের প্রধান কবিদের মধ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ শামসুর রহমান বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আব্দুল গনি হাজারী, আনিস চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, প্রমুখগণ ভাষাচেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করেছেন । এছাড়াও অন্যান্য কবিদের মধ্যে শহীদ কাদরী, মোহাম্মদ রফিক, হুমায়ুন আজাদ, মাহমুদ সাদিক, মোঃ নুরুল হুদা, অসীম সাহা প্রমুখৈর কবিতায়ও একুশের চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে । সেই একুশের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে এদেশেও কবিতা রচনা করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, অরুণ মিত্র, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, অনিল সরকার প্রমুখ কবিগণ । অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর 'একুশে ফেব্রুয়ারি' কবিতায় লেখেন–'গুলির মুখে দাঁড়ায় রুখে / অকাতরে হারায় জান / রক্তে রাঙা মাটির পরে / ওড়ে ওদের জয় নিশান ।'
অন্যদিকে স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৬১ সালের ১৯শে মে আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে স্টেশন চত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এগারোজন । তদানীন্তন অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা অসমিয়াকে অসমের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবে এই বিক্ষোভ শুরু হয় । সেই আন্দোলন ও পুলিশের গুলিতে নিহত হবার ঘটনায় যে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ায় কবিরাও গর্জে উঠেছিলেন । কবি অতীন দাস 'উনিশের জার্নাল' কবিতায় লিখেছেন–'না, জান দেব, তবুও জবান দেব না ।' আর এক কবি দিলীপকান্তি লস্কর উনিশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছেন, '১৯শে সব চেনার জানার আত্মার দর্পণ / ১৯ ই সংগ্রাম, উনিশই জাগরণ ।' এছাড়া কবি অনুরূপা বিশ্বাস, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য উনিশের ভাষা চেতনায় কবিতার রচনা করেন ।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পরপর কয়েকটি রাজনৈতিক আন্দোলন আমাদের দেশে হয়ে গেছে । তার মধ্যে কাকদ্বীপ আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন, এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনে আন্দোলন, ইত্যাদি । তার মধ্যে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের স্মরণে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন 'অন্নদেবতা' অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্যই চেতনা / অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা / অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা / অন্ন অগ্নি অন্ন বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা / অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার / অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার, / সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে / ধ্বংস করো ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে । এই সময়ের সর্বাধিক আলোড়ন সৃষ্টিকারী আন্দোলন হল নকশালবাড়ি আন্দোলন । ১৯৬৭ সালের ২৩ শে ম চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হয় এই আন্দোলন এই আন্দোলনের বজ্রনির্ঘোষে দেশব্যাপী প্রচন্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় । এর প্রভাব বাংলা সাহিত্যেও এক স্থায়ী ছাপ ফেলে । বাংলা কবিতায়ও ঘটে যায় অনেক রূপান্তর ও বাঁকবদল । নকশালবাড়ি আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি শহীদ সরোজ দত্ত তাঁর শ্রেণীগত অবস্থানকে জানান দিয়ে লেখেন–'গণ গগনের পথে অগ্নিরথ জনমানবের / যাহারা টানিয়া আনে তাহাদের কবি আমি' ( কোন এক বিপ্লবীর মর্মকথা ) ।সত্তরের আরেক কবি পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে নির্দেশ দাও কবিতায় তুলে ধরেন– 'আমি কোন বসন্ত দিনের ফেলে রাখা রাখি ফেরত চাই না আজ / জানতে চাই না ভবিষ্যতের নিশ্চিন্ত নির্ভরতা / জেগে উঠেছে যে ঘুম ভাঙ্গার গান / হে সময় ! আমাকে তুমি তার প্রতি অনুগত থাকতে সাহায্য করো ।' এই সময়ের শক্তিমান কবিদের মধ্যে সৃজনশীল নবারুণ ভট্টাচার্য, মনিভূষণ ভট্টাচার্য, সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, সনৎ দাশগুপ্ত বাংলা কবিতায় এক ভিন্নতর স্বরের প্রবর্তন করেন । নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতায় উঠে এসেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের চিত্র । 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না / এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না / এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না / এই রক্ত স্নাতক কসাইখানা আমার দেশ না / আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব । (এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ) ।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৭বছরের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে বহু রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গেছে । কোনো কোনো প্রাদেশিক রাজনৈতিক অস্থিরতাও সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । তার মধ্যে কারগিলের যুদ্ধ, গুজরাট দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, মনিপুরের আন্দোলন, আসামের এনআরসির আন্দোলনের ঘটনায় বাংলা কবিতার স্বর উচ্চকিত হয়েছে । যেমন মনিপুরের আন্দোলনে মহিলাদের রুখে ধারার দাঁড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবি সুবোধ সরকার একটি অসামান্য কবিতা লেখেন 'মণিপুরের মা' । 'নগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়াল মনিপুরের মা / এই মায়ের দুচোখ থেকে চোখ পেয়েছি / আশিরনখ ভাষা পেয়েছি / পেয়েছি সা রে গা মা /নগ্ন হয়ে দাঁড়াল আমার মনিপুরের মা ।'
এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষভাগে এনআরসিকে কেন্দ্র করে সমগ্র উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং আসামে তীব্র আন্দোলন শুরু হয় এই আন্দোলনে এই অঞ্চলের বাংলাভাষার কবিরাও সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন । তাদের কাব্যোচ্চারণের মাধ্যমে । অসমের বিজিত কুমার ভট্টাচার্য, শংকরজ্যোতি দেব, দিলীপকান্তি লস্কর, শান্তনু গঙ্গারিডি থেকে শুরু করে ত্রিপুরার প্রতিনিধি স্থানীয় কবিদের মধ্যে পীযূষ রাউত, দিলীপ দাস, সেলিম মুস্তাফা, সমর চক্রবর্তী, মিলন কান্তি দত্ত, মানস পাল, জ্যোতির্ময় রায়, বিশ্বজিৎ দেব, কপাংশ দেবনাথ, রাজীব মজুমদার, সুমন পাটারী, আম্রপালি দে প্রমুখরা কলম ধরেছেন । পীযুষ রাউত 'অসুস্থ শব্দ' কবিতায় লেখেন–'লিগেসি ডাটা এনআরসি /ডি-ভোটার এইসব অসুস্থ শব্দের বিরুদ্ধে / ধবনিত হোক /আমাদের প্রতিবাদ । ( অসুস্থ শব্দ ) । অমিতাভ দেবচৌধুরীর কবিতা–'ভেতরে তো ঘুরেছি অনেক / এবার বাইরে ঘুরব । অন্য গ্রহদের কক্ষপথে / ঘরপোড়া ছাই হাতে নিয়ে / শোনাব কি করে মানুষেরা স্বদেশে বিদেশি হয়ে থাকে । ( আসাম ২০১৯ ) । মানস পাল 'দেশে আজ এত দ্বেষ' কেন কবিতায় প্রশ্ন তোলেন–'আমার জন্য আজ মাটি নেই কোথাও / দেশ নেই দ্বেষ আছে / দ্বেষ আমাকে ডি-ক্যাম্পে পাঠাবে / ডি ক্যাম্প থেকে কোথায় যাব আমি, কোথায় পাঠাবে আমাকে ? কবি দিলীপ দাস তাঁর কবিতায় প্রত্যয়দৃঢ় ঘোষনা করেন–'যাদের হৃদয়ে এক খন্ড আকাশ নেই / তারা জিজ্ঞেস করছে, তোমার দেশ কোথায় ? / আমি বলেছি, সারা ভারতবর্ষ আমার দেশ । / যাদের ভিতর এক বিঘত সবুজ ঘাস নেই তারা বলছে তুমি যে ভারতীয় তার কাগজ দেখাও ! / আমি বলেছি ভারতবর্ষ যার হৃদয়ের সকল প্রান্তরে তার কাগজের টিপ ছাপ লাগে না । ( তোমার দেশ কোথায় ) । আরেকজন শক্তিমান কবি সন্তোষ রায় 'ডিটেনশন ক্যাম্প' কবিতায় লেখেন–'আমার ফলন্ত গাছ / তোমার সিল ছাপ্পর আমার ইতিহাস / তোমার সিল ছাপ্পর / আমার দলিল পর্চা / তোমার সিল ছাপ্পর / আমার স্কুল কলেজ /চাকুরী বিবাহ- /তোমার সিল ছাপ্পর / আমার সন্তান-সন্ততি /তোমার সিল ছাপ্পর / আমার জীবন স্রোত / বাঁকে বাঁকে সিল-ছাপ্পর / ঢেকে গেছে অবয়ব / চিনলে না তুমি আর । এখন আমার একদিকে ধর্ম / একদিকে ভাষা / দুই দিকে কাঁটা তার । ( ডিটেনশন ক্যাম্প ) ।
অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে । এই সময়ের উৎকণ্ঠার মধ্যে কবিরাও তাদের কলম নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন । ঘৃণা ছুঁড়ে দিচ্ছেন ধর্ষকদের প্রতি । সমবেদনা জানাচ্ছেন অভয়া নির্ভয়ার প্রতি। এ রাজ্যের কবিরাও এই চলমান অস্থিরতায় চঞ্চল । রাজ্যের এই সময়ের শক্তিমান কবি মিঠু মল্লিক বৈদ্য লেখেন–'ভারত মায়ের তিলোত্তমা, জীবনের দিচ্ছে দাম / সুরক্ষার মিথ্যা জাল ছছিঁড়ে খুবলে খেলো দেহখান । / সুরক্ষিত সমাজ স্বাধীন দেশের জয়গান, / অথচ নির্ভয়া ও অভয়া প্রিয়াঙ্কা তিলোত্তমা / রক্তে লিখছি ইতিহাস । ( এখন সময় শিকল ভাঙ্গার ) । কবি অরূপ পাটারী তার কবিতায় প্রশ্ন তোলেন আর কতকাল ধরে লিখবে তুমি / আপন দুর্ভাগ্য ও নৃশংসতার উপাখ্যান ? / পাল্টায় যেথায় শিরোনাম শুধু, / কাহিনি বর্বরতার একই প্রায় । / কখনো নির্ভয়া দিল্লির / অথবা প্রিয়াঙ্কা হায়দ্রাবাদের / আবার কখনো বা মৌমিতা কলকাতার । ( নাও তুমি রাতের দখল ) । কবি দীপেন নাথশর্মা লিখেন–'আঁধারে ঢেকে গেছে পৃথিবী / অমাবস্যার কালো হাত, / রাত এখন আরও গভীর / জেগে আছি একা কত রাত । ( নির্ভয়ারা কাঁদে ) । রেহানা বেগম হেনা প্রশ্ন রাখেন তার কবিতায়–'সমাজের চোখে লজ্জিত হয় ধর্ষিতা নারী,/ কেন নয় লজ্জিত ওই ধর্ষক অপরাধী ?
রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাজের একটি ঘটমান বাস্তব । রাজনীতি ব্যতীত সমাজ জীবন অচল । কিন্তু রাজনীতি যখন সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে এবং অত্যাচারে বেঁধে রাখে রাখতে চায় তখনই কবির মন সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে । আর সেই সংক্ষোভেরই প্রকাশ ঘটে কবিতায় । রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উচ্চকিত স্বর মননজাত ভাবনার প্রকাশ । এই স্বরে শুধুমাত্র দ্রোহ বা ক্ষোভই প্রকাশ পায় না । বাংলাকবিতার আদিকে নিহিত স্বদেশ চেতনারও এক নবতর প্রকাশ ঘটে । স্বদেশের বিপন্ন পরিস্থিতিতে জনগণের বিবেক ও মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলে এই স্বর । অস্থির সময়ে কবিতার উচ্চকিত স্বরের অবর্তমানে যে জনজাগরণ তা নিষ্ফল হয় । যার প্রত্যক্ষ উদাহরণ আমরা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি । কবি ছাড়া, কবিতা ছাড়া তাদের এই জয় কতটা সফল হবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে ।
সহায়ক তথ্যপঞ্জী
১. আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা– অশোক কুমার মিশ্র এস ব্যানার্জি কলকাতা
২.আধুনিক বাংলা কবিতার রূপরেখা– ডক্টর বাসন্তী কুমার মুখোপাধ্যায় প্রকাশ ভবন কলকাতা
৩. আধুনিক বাংলা কবিতা ।। বিচার ও বিশ্লেষণ–সম্পাদক জীবেন্দ্র সিংহরায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ।
৪. কবিতায় মানবিক উচ্চারণ-কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, প্রমা প্রকাশনী কলকাতা
৫. কবিতার একাল–সম্পাদনা ও ভূমিকা বার্নিক রায়, রূপা এন্ড কোং, কলকাতা
৬. ত্রিপুরার বাংলা কবিতা অভিজিৎ চক্রবর্তী
৭. ১৯ এর কবিতা অতীন দাস ভীতি পাবলিশার্স গুয়াহাটি
৮. আধুনিক বাংলা কাব্যের ধারা বৈচিত্র্য– কৃতি সোম, প্রমা প্রকাশনী কলকাতা
৯. কবিতার দ্বীপ ও দীপ্তি–জহর সেনমজুমদার সাহিত্যসঙ্গী কলকাতা
১০. দৈনালী, শারদ সংখ্যা ১৪৩১ পঞ্চম বর্ষ- সম্পাদক মিঠু মল্লিক বৈদ্য । ১১. দেবদ্বীপ শারদ অর্ঘ্য অক্টোবর ২০২৪– সম্পাদক অনামিকা লস্কর
১২. দেশহারা কবিতা–সম্পাদনা কিশোর রঞ্জন দে, সৈকত আগরতলা
১৩. ত্রিপুরার বাংলা কবিতা ১৪০৭–১৯৯২–সম্পাদনা রূপক দেবনাথ
১৪. ত্রিপুরার আধুনিক কবিদের স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন শিশির কুমার সিংহ, দে'জ কলকাতা
No comments:
Post a Comment