Wednesday, December 25, 2024

বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদান : লোকশিক্ষার উপায়

বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদান : লোকশিক্ষার উপায়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
Abstract : Folklore is specially based on oral literature. It has a deep impact on society in various aspects.  It is commonly seen in any community and society that a tradition of folk culture is hereditarily practiced from the time in memorial. The main object of Bengali oral literature is to create an ideal life for human being. Various components of culture enriches the people mentally and philosophically. The folk tales, folk songs, proverbs, riddles,rhymes, folk dance, folk drama etc have plenty of component for folk teaching. Bengali folk literature in imbibes morality in humans to make their life with ethics and religious.  Apart from this, the paper will also stress on the element of Bengali folk culture which plays a vital role in building values and morality.

key word : lokojiban, lokosanskriti, lokoshiksha,
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ভূমিকা :

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । সমাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক একটি জনসংগঠন বা জনগোষ্ঠী । প্রতিটি জনসংগঠন বা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু জীবন যাপন প্রণালী রয়েছেই । যাপনরীতি বা প্রণালী হল সংস্কৃতি । সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক । সমাজের মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদেই কিছু রীতিনীতির সৃষ্টি করেছে । পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে মানুষ সমাজে টিকে থাকার তাগিদ অনুভব করে । সেই তাগিদই নিয়ম নীতি নির্ধারণের প্রেরণা দেয় । এই নিয়মনীতির মধ্যে যে সমস্তগুলো দিয়ে মননের চর্চা করা হয় সেগুলোই হল সংস্কৃতি । নৃতত্ত্ববিদ হারসকোডিটস তাঁর Man and his works গ্রন্থের সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন – 'A culture is a way of life of people' অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালী ।

লোকসমাজের সমষ্টিগত আত্মিক সংযোগ ও জীবনযাপন পদ্ধতি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতি লোকসংস্কৃতি । লোকসংস্কৃতি বিষয়ের প্রবরপুরুষ উইলিয়াম ব্যাসকম ( W R Bascom ) এর ভাষায়–'folklore includes folk art, folk crafts, folk tools, for custumes, folk costoms, folk belief, folk medicine, folk recipes, folk music, folk games, folk gester and Folk speach as well as verbal art .'

লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য, শিল্পতত্ত্ব প্রভৃতি এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে অন্বিত যে স্বতন্ত্র বিষয়রূপে লোকসংস্কৃতির শিক্ষাগত শৃঙ্খলা ও স্থাপন অত্যন্ত দুরুহ ব্যাপার । লোকসংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভূমিকা থাকে তাদের সমষ্টিগত জ্ঞানচর্চা ও মননচর্চার মাধ্যমেই লোকসংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধিত হয় । লোকসংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানানুশীলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্মোচন ঘটে । এই বহুমুখী তৎপরতার ফলে যে সমস্ত দিকগুলি লোকসংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় সেগুলি হল–অতীত অনুসন্ধান, আঙ্গিক সংস্থান, শৈল্পিক রসাস্বাদন, ব্যবহারিক উপযোগ, প্রসঙ্গানুষঙ্গগত অনুধাবন, ফলিত প্রয়োগ, ভবিষ্যৎ অনুশীলন এবং লোকশিক্ষা ।

'লোকসংস্কৃতি' শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাই 'লোক' আর 'সংস্কৃতি' ।  'লোক' বলতে বোঝায় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন । তারা যখন বংশপরম্পরায় একই রকম আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, একই রকম খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত, তাদের শিল্পসাহিত্য, সংগীত, লৌকিক দেবদেবী, লোকাভিনয়, একই জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিষ্ঠিত করে অর্থাৎ একই রকম রাজনৈতিক, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে জীবনধারা দোলায়িত হয় তখন সেই ঐতিহ্যনির্ভরসংহত গোষ্ঠী লোক বলে বিবেচিত হয় । আর এই সমস্ত মানুষদেরকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সংস্কৃতি আবর্তিত হয় তাকেই লোকসংস্কৃতি বলা হয় ।  লোকসংস্কৃতির স্রষ্টা সংহত ব্যক্তি মানুষ অথবা সমগ্র সমাজ । লোকসংস্কৃতি সমগ্র সমাজে আজও স্বীকৃত বলেই এর রেণুসমূহ সজীব, সচল ও প্রাণবন্ত বলেই অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের ত্রিবেনীস্পর্শ হয়ে অনন্তকাল বিস্তৃত ধারায় বয়ে চলেছে । রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন– প্রাচীন হয়েও চির নতুন ।

লোকসংস্কৃতির উপাদান :

লোকসংস্কৃতি বা বিষয়কে অনুধাবনের জন্য তার উপাদান বৈচিত্র্যকে জানা প্রয়োজন । যে উপাদানগুলো লোকসংস্কৃতির পরিচয় গ্রহণ করে সেগুলোকে বলা হয় লোকসংস্কৃতির উপাদান । লোকসংস্কৃতিবিদগণ তাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং নানাভাবে বর্গীকরণও করেছেন । এক্ষেত্রে মার্কিন লোকসংস্কৃতির আর এম ডরসন ( R M Dorson ) বিশেষ অবদান রেখেছেন । তিনি লোকসংস্কৃতি ও লোকজীবনের অধ্যয়নের জন্য এ বিষয়কে চারটি বর্গে বিভক্ত করেছেন । বর্গগুলো হল– যথাক্রমে ১. মৌখিক সাহিত্য ২. বস্তুগত সংস্কৃতি ৩. সামাজিক লৌকিক প্রথা এবং ৪. লোকঅভিকরণ শিল্প । এই বর্গ বিভাজনটি লোকসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । প্রসঙ্গক্রমে বাংলা লোকসংস্কৃতির উপাদানবৈচিত্র্য সম্পর্কে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিচে আলোচনা করা হচ্ছে ।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লোকবিজ্ঞানের প্রধান বারটি শাখার উল্লেখ করেছেন ।  ১. গাথা ২.উপকথা ৩. ছড়া ৪.পল্লীগান ৫. প্রবাদ ৬. হেঁয়ালি ৭. পুরান কথা ৮. লোকাচার ৯.লোকসংস্কার ১০. খেলাধুলা ১১. খাওয়া-দাওয়া ১২. হস্তশিল্প ।

প্রবীণ লোকসংস্কৃতিবি ড. দুলাল চৌধুরী বাংলা লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির উপাদান সংক্রান্ত আলোচনায় লোকসংস্কৃতিকে ২৪টি ভাগে ভাগ করেছেন:- ১. ছড়া ২.গীত/গান ৩. ধাঁধা ৪. প্রবাদ প্রবচন ৫. কথা–রূপকথা, উপকথা, ইতিহাসকথা, ব্রতকথা, ৬. গীতিকা/গাথা ৭. লোকনৃত্য ৮. লোকউৎসব-অনুষ্ঠান মেলা ৯. আচার, মন্ত্র-তন্ত্র ১০. লৌকিক দেবদেবী ১১. লোকনাট্য ১২. লোকশিল্প ১৩. লোকভাষা ১৪. লোকাচার ১৫. লোকবিশ্বাস-সংস্কার ১৬. লোকদর্শন ১৭. লোকক্রীড়া ১৮. লোকঔষধ ১৯. কিংবদন্তি ২০. লোকবাদ্য ২১. লোকচিত্র ২২. লোকঅলংকার সজ্জা ২৩. লোকযান ও ২৪.লোকঐতিহ্য ।

আবার ড. আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর 'লোক সাহিত্য' শীর্ষক গ্রন্থে মূলত লোকসংস্কৃতির ১৩ টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন–১. ধাঁধা ২. ছড়া ৩. মন্ত্র ৪. খেলাধুলা ৫. লোককথা ও লোককাহিনি  ৬. লোকপুরাণ ৭. কিংবদন্তি ৮. প্রবাদ ৯.গীতিকা/গাথা, ১০.গীতি ও গান ১১.লোকঔষধ ১২.উৎসব ও অনুষ্ঠান ১৩. বিবাহ উৎসব, ঈদ উৎসব, দুর্গোৎসব ।

লোকশিক্ষা :

অরণ্যবাসী এবং গুহাবাসী মানুষ প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেছে এবং অন্যদিকে বন্য হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গেও যুদ্ধ করে তাকে টিঁকে থাকতে হয়েছে । ক্রমাগত সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ সমাজবদ্ধতা ও আন্তরিক জৈবিক মানবিক সম্পর্কের খোঁজ পেয়েছে । এভাবে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে শিষ্টাচার, সংঘবদ্ধতা ও শৃঙ্খলার পাঠ গ্রহণ করেছে । এছাড়া তার জীবনযাপনের জন্য প্রকৃতির বিভিন্ন গতিপ্রকৃতিকে সে লক্ষ্য রেখেছে এবং তার দ্বারা সে ঋতুপরিক্রমার পরিচয় জানতে পেরেছে । এটা তার কৃষিজীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে । মানুষ সমাজবদ্ধ জীব । সমাজে বসবাস করতে করতে মানুষ তার যাপনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে । এই শিক্ষা আবার দুই প্রকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । লোকজীবন অতিবাহিত করার ফাঁকে ফাঁকে লোকসমাজের মানুষের মনে যে সংস্কৃতির প্রবণতা বা চাহিদা তৈরি হয় তা সে নিবৃত্তি করতে পারে লোকশিক্ষার মাধ্যমে । লোকশিক্ষার মধ্যেও আমরা দুটি শব্দ পাই 'লোক' এবং 'শিক্ষা' । 'লোক' মানে সাধারণ মানুষ । 'শিক্ষা' শব্দের অর্থ জ্ঞান অর্জন, শাসন, নির্দেশনা বা নিয়ন্ত্রণ । পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে মানুষ প্রকৃতির এবং পারিপার্শ্বিকতার কাছ থেকে বিভিন্ন রকম শিক্ষা লাভ করে থাকে সেটাই লোকশিক্ষা । প্রতিদিনের যাপনের পাশাপাশি স্বাভাবিকভাবেই লোকসমাজ এই শিক্ষা লাভ করে থাকে । এই শিক্ষা মানুষকে তার মনের দিক থেকে ভাবের দিক থেকে এবং আবেগের দিক থেকে সবল ও সক্ষম করে গড়ে তোলে । লোকশিক্ষা মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে অর্জন করে থাকে । প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ শিক্ষাই হল লোকশিক্ষা । লোকের শিক্ষা লোকের জন্য শিক্ষা এবং লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষা ।

লোকশিক্ষার উপাদান :

সমগ্র শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় কয়েকটি মূল উপাদানের উপর ভিত্তি করেই চলমান থাকে । তেমনি লোকশিক্ষার উপাদানক্ষেত্র বলতেও তেমনি কিছু চলমান উপাদানের ক্রিয়াশীল সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে । লোকশিক্ষার যদিও কোন সংঘটিত মাধ্যম নেই তবুও তার মধ্যে কিছু উপাদান লক্ষণীয়ভাবে ধরা পড়ে সেগুলো হল ১. শিক্ষার্থী : গ্রামের চাষী শ্রমিক আমার কুমোর ও লোকসমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন ২. শিক্ষক : লোকগায়ক, কথক ঠাকুর, যাত্রাপালা পটুয়া, বাউল প্রকৃতির শিল্পীসমাজ ৩. বিদ্যালয় : খেলার মাঠ, চন্ডীমন্ডপ, বৈঠকখানা, গাছতলা প্রভৃতি স্থান ৪. পাঠ্যক্রম : লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগ । যেমন লোককাহিনি, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, রূপকথা ডাক ও খনার বচন, গীতিকা, লোকসংগীত লোকনৃত্য, লোকশিল্প, লোকচিকিৎসা, লোকনাটক এবং লোকগণিত ইত্যাদি ।

লোকসংস্কৃতির উপাদান ও লোকশিক্ষা

লোকসংস্কৃতির জন্ম সাধারণ মানুষের মুখে মুখে, চিন্তা এবং কর্মে । হাজার বছর ধরে এই সংস্কৃতি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়তে থাকে । লোকসংস্কৃতির উপাদানসমূহকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । ১. বস্তুগত সংস্কৃতি ও ২. অবস্তুগত সংস্কৃতি । লোকসংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান বলতে সেই সমস্ত উপাদানকে বুঝায় যেগুলোকে স্পর্শ করা যায় ও চোখে দেখা যায় । আর অবস্তুগত সংস্কৃতি হল, যেগুলো আমরা অনুভব করি । চোখে দেখতে পাই না । মানুষের চিন্তা থেকে এইসব সংস্কৃতির জন্ম নেয় এবং মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে । বস্তুগত সংস্কৃতির তিনটি বিভাগ–লোকশিল্প, লোকপ্রযুক্তি ও লোকযান । বাংলা লোকশিল্পের মধ্যে পড়ে তাঁতশিল্প, শাঁখা বা শঙ্খশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেতশিল্প, দারুশিল্প, গৃহনির্মাণ শিল্প, নকশী কাঁথা, পিঠে পুলি ইত্যাদি । লোকপ্রযুক্তি হল লাঙ্গল জোয়াল,কাস্তে, মই ও বিভিন্ন কৃষিকাজের উপযোগী সরঞ্জাম, জাল, ঢেঁকি, চরকা ইত্যাদি । লোকযানসমূহ হলো নৌকা, পালকি, চাঙ্গাড়ি ইত্যাদি । লোকজীবনের প্রয়োজনীয় এইসব শিল্প দ্রব্যাদি নির্মাণের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় না । মানুষজন কাজ করতে করতেই এগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠে এই দক্ষতা প্রজন্মান্তরেও বাহিত হয়ে থাকে । কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য বিশেষ কোনো লোকউপাদান  উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষ পেশাজীবী লোকজন সমাজে থাকেন যেমন কামার, কুমোর,ছুতোর ইত্যাদি । এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মননের উৎকর্ষতাও ঘটে । যার ফলে সৃষ্ট লোকউপাদান দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে । 

লোকসংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদানের পরিসরটি বিশাল । এখানে রয়েছে লোকসাহিত্য, লোকনৃত্য, লোকসংগীত, লোকউৎসব, লোককাহিনি, লোকক্রীড়া, লোকচিকিৎসা, লোকনাটক ও লোকগণিত ইত্যাদি । আগেই বলা হয়েছে বস্তুগত উপাদানগুলি মূলত মননচর্চার ফসল । মানুষের মনের অন্তর্নিহিত চেতনার অভিব্যক্তি প্রকাশ ঘটে এই অবস্তুগত লোকসংস্কৃতিক অবদান সমূহের মধ্যে । ফলে তার মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষেরা নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের বিকাশ, আচার-আচরণের শিক্ষা, সর্বোপরি জীবনযাপনের উপযোগী নানা তথ্যের সন্ধান পেয়ে থাকে ।

লোকসাহিত্যের প্রধান উপাদান হলো লোককথা ছোট ছোট লোককথার মধ্য দিয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে নীতিমূলক নির্দেশিকা পাওয়া যায় । যেমন 'দশের লাঠি একের বোঝা' । এই গল্পটির মধ্য দিয়ে এক বৃদ্ধ তার মৃত্যুকালে সন্তানদের মধ্যে একতাবোধের বার্তাটি দিয়ে যান । বৃদ্ধ যখন তার সন্তানদের হাতে একটি কঞ্চি দিয়ে ভাঙ্গার নির্দেশ দেন তখন তারা সহজেই এই কঞ্চিগুলি ভেঙে ফেলে । আবার তিনি যখন সেই কঞ্চিগুলিকে একত্র করে আঁটি বেঁধে একে একে প্রত্যেককে ভাঙার জন্য দেন তখন তারা কেউই এই আঁটিবদ্ধ কঞ্চিগুলি ভাঙতে সক্ষম হয় না । এর দ্বারা তাদের কাছে বার্তা যায় যে, তারা যদি নিজেদের মধ্যে কলহ বিবাদে মত্ত থাকে তাহলে অন্যেরা এসে তার সুযোগ নেবে । অপরদিকে যদি তারা একতাবদ্ধ থাকে তাহলে কেউ তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না বা বিরোধে জড়াতে পারবে না । লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে এরকম বহু লোক কথা ছড়িয়ে রয়েছে যার দ্বারা মানুষ সমাজ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে । 

লোকনৃত্যের মধ্যেও লোকশিক্ষার বিষয় নিহিত রয়েছে । বিভিন্ন পূজা-পার্বণ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে লোকনৃত্যের পরিবেশন করা হয় । তার মধ্য দিয়ে লোকসাধারণ আধ্যাত্মিকতা ও পার্থিব ভাবনার পাঠ গ্রহণ করে থাকে ।

লোকসংগীতেও রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ । যেমন, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, মুর্শিদি, জারি, সারি ইত্যাদি । এইসব সংগীতের কিছু কিছুতে যেমন বিনোদনের সম্ভার রয়েছে তেমনি সমাজ ভাবনায় উদ্দীপ্ত হওয়ার বাস্তব পাওয়া যায় । যেমন বাউল গানে ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা পাওয়া যায় । সাম্প্রদায়িক ঐক্য স্থাপনার ক্ষেত্রে লোকসংগীত এটা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে । লালনের গানে আমরা যেমন পাই– 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে / লালন বলে যেতে কি রূপ দেখলাম না এই নজরে । তেমনি কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির কন্ঠে শুনতে পাই– কৃষ্টে আর খ্রিস্টে কিছুই ভেদ নাই রে ভাই / শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে'
আবার অন্য গানে পাই 'টাকা পয়সা সোনার গয়না / মরলে কারো সঙ্গে যায় না ।' কিংবা 'রইল রে তোর সাধের ঘরবাড়ি....' ইত্যাদি জীবনবোধের পরিচায়ক বার্তাবাহী সংগীত ।

লোকসাহিত্যের একটি শক্তিমান ধারা হল প্রবাদ । প্রবাদ মূলত জীবনঅভিজ্ঞতার নির্যাস l প্রবাদের মাধ্যমে লোকচরিত্রসহ বিভিন্ন বিষয় খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা হয় এবং প্রবাদোক্ত বাক্য থেকেই লোকমানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন । যেমন প্রবাদে পাই– 'আপনি বাঁচলে বাপের নাম' । এখানে বেঁচে থাকার কঠোর সংগ্রামের বার্তাটি নিহিত রয়েছে । আবার দেখি দৈবের উপর ছেড়ে দিয়ে বলতে 'অদৃষ্টের ফল কে খন্ডাবে বল' বা 'অদৃষ্টের কিল পুতেও কিলায়' এর মধ্য দিয়ে জীবনের বাস্তব চিত্র ও অভিজ্ঞতাই প্রকাশ পায় । রূপকথার গল্পে প্রকাশ পায় কঠোর নিষ্ঠা ও অসম সাহসিকতার চিত্র । সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ক্ষীর সরোবরের মাঝখান থেকে এক নিঃশ্বাসে মন্দিরের চূড়া ভেঙে রাক্ষসের প্রাণভোমরা নিয়ে আসা সত্যিই কষ্টের কথা । জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও এজাতীয় কষ্ট স্বীকার করতেই হয় । রূপকথার গল্পের অভ্যন্তরে সেই শিক্ষনীয় বার্তাটি লিখিত থাকে ।

ডাক ও খনার বচন হল জ্ঞানীদের বচন । কবিতার ভাষায় লেখা এই বচনগুলোতে পুরনো বাংলা ইতিহাসের উপাদান, কৃষি নির্ভর সমাজের চিত্র তুলে ধরে । আবহাওয়া, খরা, বৃষ্টি, শস্যের খবর এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় । খনার বচনে কৃষি সম্পর্কে জানা যায়–'একহাত অন্তর দুহাত খাই / কলা রোও চাষি ভাই / যদি না কাটো পাত / তাতেই কাপড় তাতেই ভাত' । প্রকৃতির রুদ্ররোষের লক্ষণ ধরা পড়ে খনার একটি বচনে–'ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোনো পতির পিতা / ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা / রাজ্য নাশ গো নাশ হয় অগাধ বান / হাতে কাঠা ফেরে কিনতে না পায় ধান' । ফসল বোনার ক্ষণ হিসাবে খনার বচনে পাওয়া যায়–'শুক্লপক্ষে ফসল বোনে / ছালায় ছালায় টাকা গোনে' । ইত্যাদি ।

বাংলা ধাঁধার মধ্যে রয়েছে লোকশিক্ষার বার্তা । পারিবারিক জীবনে বা গার্হস্থ্য জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন বা আকর্ষণ হল মা । তাইতো মায়ের স্থান সংসারের সবার উপরে । গ্রাম্য ধাঁধায় পাওয়া যায়–'এক অক্ষরে আকার দিয়া / নাম তার লিখো গিয়া / সেই নাম সংসারে / বড়ো সবার উপরে' । ঠিক যেমনটি প্রবাদেও পাওয়া যায় 'মুড়ি বল চিড়ে বলো / ভাতের সমান নয় / মাসী বলো পিসি বলো / মায়ের সমান নয়' । মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি নিয়ে যে বাঙালির সুখের সংসার এই পারিবারিক জীবনের শিক্ষাটি এখানেই পাওয়া যায় ।

লোকসংস্কৃতির আরেকটি শাখা হল লোকগণিত । বাংলার প্রাচীন কাব্যে এমন প্রচুর লোকগণিতের সন্ধান পাওয়া যায় । বিশেষত কাব্যগ্রন্থগুলোতে কবি যখন আত্মপরিচয় দেন তার সময়কাল বা জন্মসন ইত্যাদি ছদ্ম লোকগণিতের মাধ্যমে প্রকাশ করেন । বাঙালি সমাজজীবনে মহিলাদের মধ্যে একটা প্রচলিত লোকনিষেধ রয়েছে যে, তাঁরা স্বামীর নাম উচ্চারণ করেন না । সেই ক্ষেত্রে অনেক সময় হেঁয়ালিপূর্ণ লোকগাণিতিক শব্দে তাঁরা স্বামীর পরিচয় দিয়ে থাকেন । এমন একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি–'তিন তেরো মধ্যে বারো / চার দিয়ে পূরণ করো / আমার বাড়ি নন্দীগ্রাম / আমার স্বামীর এই নাম' ।( ৩×১৩=৩৯+১২=৫১+৪=৫৫ —পঞ্চানন–শিবের অপর নাম )
এ রকম আরেকটি লোকগণিতে পাই–'অংক মুনি বলে গেছে শঙ্খ মুনির কথা / আশিহাজার তেঁতুল গাছে কত হাজার পাতা' ? ( ৮০,০০০×২=১,৬০,০০০—অঙ্কুরোদ্গমের সময় তেঁতুলগাছে দুটি পাতা থাকে ) । এছাড়া মেয়েলি ব্রতকথাগুলোর মধ্যেও সামাজিক অনুশাসনের নানা শিক্ষামূলক বার্তা থাকে । ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা সাধারণ মানুষকে নীতিশিক্ষা ও ধর্মীয় উপদেশ দেওয়ার জন্যেও অনেক সময় ছোটো ছোটো গল্পের অবতারণা করেন । তাঁরাও প্রকৃত অর্থে লোকশিক্ষক । গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের একজন শ্রেষ্ঠ লোকশিক্ষক হলেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব । ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নবজাগরণের কালে বাঁধাধরা শিক্ষার বাইরে অপ্রথাগত পদ্ধতিতে ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে তিনি লোকশিক্ষা দিয়েছিলেন ।

মূল্যায়ন

লোকসংস্কৃতির উপাদানের দ্বারা সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবন গঠনের ও বুদ্ধিবিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব । লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানগুলি ব্যক্তির নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক । পাশাপাশি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সম্প্রীতিবোধের চেতনাও সঞ্চার করা সম্ভব । লোকসাধারণের নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কারসহ একটা নিজস্ব জীবনদর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা যে অসীম তা আমরা এই আলোচনার মধ্য দিয়ে অনুভব করতে পারি । বর্তমানে যেভাবে কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাটা বিবর্তিত হচ্ছে তাতে আমাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক উপাদানের মধ্যে যে শিক্ষার বার্তাগুলো রয়েছে তা দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে । ফলে মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের একটা সংকট তৈরি হচ্ছে । সেগুলোকে দূর করতে হলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতির উপাদানের পুনরুদ্ধার এবং পাঠ্যসূচিতে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেই হচ্ছে ।

No comments:

Post a Comment