রাত তো অনেক হল ৷ এই নির্জন লতাবিতান, এই নিঃসঙ্গ মাধবীকুঞ্জ কেমন যেন পরিহাস করে চলেছে ৷ ঘিয়ের প্রদীপের সলতেটা উসকে দিয়েই কেটেছে সারারাত ৷ যতোক্ষণ তেল ছিল আলো দিয়ে গেছে ভালোই ৷ তেল কম আসায় আলোটাও কমে আসছে ৷ ভয়ডরহীন ছিল ৷কেটে গেছে প্রহরগুলো কালিয়ার প্রতীক্ষায় ৷ এখন এই গোপন বনকুঞ্জ অসহ্য হয়ে উঠছে ৷ কিছুই দেখা যাচ্ছে না নিকুঞ্জপথের ৷ শুধু রাতচরা পশুগুলোর ছুটোছুটিতে মসমস করে উঠছে পথের শুকনো ঘাসপাতাগুলো ৷ কুঞ্জের বাইরে চারদিকে অবিরাম ঝিঁ ঝিঁ ডাক ৷ দুষ্টুটার নুপূরের শব্দের মতো তার কান দুটো ভরিয়ে তুলছে ৷ একাকী ফুলসেজে গড়িয়ে যাচ্ছে সে ৷ নরম শয্যা তার প্রিয় শরীর হয়ে উঠছে ৷ যেন আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে তাকে ৷ বসন্তবাতাস মোহ ধরিয়ে দিচ্ছে ৷ মাতাল হয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে বিছানায় ৷ কান্তর শরীরের ওম লাগছে যেন তার শরীরে ৷ আশ্লেষঘন নিঃশ্বাস পড়ে তার ৷ 'হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে / পরাণ পিরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে ৷'
উত্তাল ঝড় ওঠা শরীর একসময় শান্ত হয় ৷ রাগমোচনের উল্লাস তার চোখে মুখে, শরীরময় ৷ দয়িতের ছোঁয়া তাকে কী আকুলতাই না দিয়েছে ৷ কতোক্ষণ যে ঘোরের মাঝে ছিল খেয়াল নেই তার ৷ রাগমোচনের তৃপ্তিতে বুকে আঁচল জড়িয়ে বিস্রস্ত বেশবাস সামলানোর জন্যে উঠে বসতেই তার সম্বিত ফিরে এল ৷ কোথা কান্ত ! কোথা কান্ত ! কোথায় কালিয়া ? কার সঙ্গসুখে কাটাল এতোক্ষণ ? সে কী ভুল ? সে কী মিথ্যে ? সে কী স্বপ্নই কেবল ? ডুকরে কেঁদে উঠল রাধারানি ৷তছনছ বিছানায় ৷ আজ নিশিতেও এলে না প্রিয় ৷ ছুঁয়েও দেখলে না আমাকে ৷ ফাঁকি দিলে আজও ৷ 'প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর' ৷ হে প্রিয় ! জানি না আজ কোন গোপবালার কুঞ্জে কাটল তোমার রাত ! তোমার অনঙ্গমোহন শরীর কার ছোঁয়া পেল ৷ মথিত হল সুখে ৷
মদনমোহিনী রাই কেঁদে চলেছে একাকী ৷ গুমরে ওঠা চাপা গুঞ্জনধ্বনি বিষাদকুঞ্জের বাইরে নিভৃতে এগিয়ে চলেছে ৷ প্রত্যুষের পাখিরা বাসায় কিচিরমিচির করে ডেকে উঠল ৷ তেল শেষ হয়ে আসা প্রদীপের শিখাটা দপ করে নিভে গেল ৷
Monday, January 15, 2018
স্পর্শকাতরতা
Sunday, January 14, 2018
ভিক্ষাবৃত্তি
মানুষ বিভিন্ন কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে ৷সেই নির্ধারিত কর্মই হল পেশা বা বৃত্তি ৷ যখন একটিমাত্র কর্মই কারো পেশা হয়ে দাঁড়ায় তখন ওই পেশার সঙ্গে তার কর্মের পরিচয় যুক্ত হয়ে যায় ৷ সমাজে এরকম বহুবিধ বৃত্তি রয়েছে ৷ আমাদের ভারতীয় সমাজে দেখা যায় কিছু কিছু বৃত্তি বংশপরম্পরাক্রমে চলে আসে এবং এইসব বৃত্তিতে তারা নিজস্ব ঘরানা ও দক্ষতার পরিচয় রাখে ৷ আবার কিছু পেশা ব্যক্তিবিশেষের ক্রমাগত উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ৷ পেশাগত পরিচয়ের মাধ্যমেই কেউ কেউ সমাজে পরিচিতি লাভ করেন ৷ পেশাগত দিক দিয়ে অনেকে আবার বিশেষ চারিত্র বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে থাকেন ৷ যেমন ' বান্যা ' ভাঁড়ু দত্তকে কবিকঙ্কন ধূর্ত চরিত্র হিসেবে অঙ্কন করেছেন ৷ কাস্টমারকে ঠকানোর জন্যে সেই বলতে পারে 'সোনা রূপা নহে বাপা, এ বেঙ্গা পিত্তল/ঘষিয়া মাজিয়া বাপা কইরাছ উজ্জ্বল' ৷
পেশার মধ্যে আবার স্তরবিভাজনও রয়েছে ৷ সংস্কৃত প্রবাদে রয়েছে - বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী তদর্ধং রাজসেবায়াং / তদর্ধং কৃষিকর্মেন ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ ৷ তেমনি বাংলা প্রবাদ রয়েছে - উত্তম পেশা সদাগরি /মধ্যম পেশা চাষা / মধ্যম পেশা মাইগ্গা খাওন/জীবনের নাই আশা ৷ প্রবাদোক্ত 'মাইগ্গা খাওন'টাই হল খুঁজে খাওয়া বা ভিক্ষাবৃত্তি ৷ যে ভিক্ষালব্ধ অন্নে জীবিকা নির্বাহ করে সে হল ভিক্ষুক ৷ সমাজের সবচাইতে নিরুপায় পেশা হল ভিক্ষাবৃত্তি ৷ সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গৃহস্থের দোরে দোরে ঘুরে অন্ন আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের মতো অসহায় পেশার নাম হল ভিক্ষা ৷ তাই ভিক্ষুককে সমাজও করুণার চোখে দেখে ৷ ভিক্ষুককে দান করার মধ্য দিয়ে অনেকে পরমার্থের সন্ধানও করেন ৷ আমাদের বাঙালি হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ পরিবারে উপনয়ন অনুষ্ঠানকালে নবোপবীতধারীকে কয়েকঘর মুষ্ঠিভিক্ষা করার রীতি প্রচলিত আছে ৷ আবার ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী বোষ্টমরা ভিক্ষান্নে জীবনযাপনের মতো কৃচ্ছতা বেছে নেন ৷
ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে আহৃত অন্নের মানের বিচার করা যায় না ৷ কথায় বলে, 'ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া' ৷ যা ভাগ্যে জোটে তাই পরমান্ন ৷ ভিক্ষাবৃত্তিতে কিছু সমস্যাও রয়েছে ৷ পরিচিতির কারণে 'গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না' ৷ অনেকসময় কুকুরের কামড়ের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে গৃহস্থকে অনুরোধ করে বলতে হয় 'থাক ভিক্ষে, তোর কুত্তা সামাল' ৷ আমাদের আধ্যাত্মিক সঙ্গীতে ঈশ্বরানুরাগীর আবেদনেও 'আমি দীন ভিখারি, পারের কড়ি ফালাইছি হারাইয়া' বলে বিষয়টি প্রতীকী রূপ নিয়ে গভীর বার্তা করে এসেছে ৷ তবে অনেকসময় ভিক্ষাবৃত্তির মতো মর্মবাহী পেশার মাধ্যমে অনেকেই যে আখের গোছায় সে বিষয়ে ব্যাখ্যায় আর যাচ্ছি না ৷ ভুক্তভোগী মাত্রেরই কমবেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে ৷ তবে ভিক্ষাবৃত্তির ভদ্র ও আধুনিক সংস্করণ বলে আমার মনে হয় চাঁদাবাজি ৷
শেষ করব মধুকবির একটি বিখ্যাত উদ্ধৃতি দিয়ে ৷ ইংরেজীচর্চার মোহে বিদেশে গিয়ে বিফল মনোরথে পুনরায় বাংলাভাষার চর্চা শুরু করার লগ্নে তাঁর বিখ্যাত 'বঙ্গভাষা' কবিতায় লিখেছেন , 'পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি/কাটাইনু বহুকাল সুখ পরিহরি' ৷ আসলে ভিক্ষাবৃত্তি সুখের পেশা নয় ৷
Friday, January 12, 2018
সংক্রান্তি
তোমার হাত কী মোহনীয় হয়ে উঠবে এই সংক্রান্তির সন্ধ্যায়
নিকোনো উঠোন আলপনায় রাঙানো হয়ে গেলে ক্লান্ত হাত
পড়শির পরশ চাইবে নিভৃতে অন্তত প্রশংসামুখর দুচোখ
যেমন মাহেন্দ্রসূর্য কুসুমশোভন হাসিতে স্বচ্ছ উঠোনে বুলোবে চোখ
পিটুলিগোলার রঙ ভেসে উঠতেই
তোমাকেও মনে হয় সেজে উঠেছ
মাঘসকালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
বুড়ির ঘরের সামনে যেন আগুন উত্তাপের একমাত্র পরিষেবাপুষ্ট
রক্তিম আঁচের আভায় একমাত্র তুমি যেন সুন্দরী হয়ে ওঠো কুয়াশাভোরে
পৌষের শেষ সকাল এভাবেই প্রাতঃভ্রমণ সারে তোমাকে নিয়ে ৷
Tuesday, January 9, 2018
বাঁশি
ছুটে যাবার জো নেই জোরকদমে
প্রহরগুলো প্রহরীর হাতুড়ি হাতে
বুকের ভেতর ঘন্টা বেজে ওঠে
বাঁশি তো থামে না ৷ সাত সকাল থেকে
সাত ঘাটে হাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ ৷
ঘর দোর কেঁপে ওঠে ৷ অচিন খাঁচার ঘেরাটোপে এত ব্যাকুলতা আছে ৷ জানি না যে ৷
বাঁশি তোকে বারণ করেছি কতো ৷ কাঁদাবি না আর ৷
সংকেতের অঝোর ধারা ৷ কলঙ্কে পোড়ে আমার দুই আখর ৷
এ নাম লুকোবো কোথায় ৷ মরমিয়া বাঁশি আমার !
গোকুল জেনে গেছে আমার পরকিয়া মাঠ ৷
ব্যঞ্জনে ভুল বর্ণ ৷ ভুল উনুন জ্বালি ৷
পোড়া কলস ডাকে কেবল ডাকে কালিন্দীর ঘাট ৷
Sunday, December 17, 2017
বিজয়
আজ রাতে মরালমিথুনের সাক্ষী হব বলে
বনকর রোড ধরে বৈদ্যপাহাড়ের ঠিকানা
খুঁজে খুঁজে মধ্যরাত ৷ নিদ্রিত বিনন্দিয়ারা
জানল না কজন মুক্তিযোদ্ধার নবীন বান্ধব
অতীতের গ্রেনেড বয়ে নিয়ে ইতিহাস খোঁজে ৷
সূর্যের সন্ধান চাই উষ্ণ আকাশের পরিচিত ওমে
সূর্যের সন্ধান চাই বীজধানের ঘুম ভাঙাতে
সূর্যের সন্ধান মায়ের শরীরের সবুজ মেখলায়
প্রিয়ার চোখ থেকে সন্ত্রাস হটাতে সূর্যের খোঁজ
দূরে দূরে রাতচরা পাখিরা জেগে উঠে জানান দেয় মিলিটারি বুটের দাম্ভিক পদাতিক শব্দ
দশকের পরও যাদের স্বভাবের বদল হয় না ৷
স্বাধীনতা ওদের কাছে অসহনীয় উৎপাত ৷
তারপরও আমরা উল্লাস করব আজ রাতে
বাজি ও পটকায় ৷ আমাদের পূর্বপুরুষেরা
আজ স্বাধীনতার পতাকা ওড়াতে সক্ষম ৷
সে শুধু তাদের জয় নয় ৷ আমাদেরও গৌরব ৷
রক্তের স্মৃতি বড়ো দাগ কাটে স্বাধীন মানুষের
উঠোনপাটে ৷ খোলা হৃদয় জেগে ওঠে স্বপ্নে ৷
বিজয়ের সাহসী ঘ্রাণ কাঁটাতার টপকে আসে
কালো রাত মুছে ফেলে কড়া নাড়ে নির্মল ভোর ৷
Friday, December 15, 2017
* উগার *
আহা ! একটি হারিয়ে যাওয়া ঘরগেরস্থালির শব্দ ৷ সারা বছরের খোরাকি ধান ও বীজধান রাখা হত সময়ে ব্যবহারের জন্যে ৷ এই ভাঁড়ারঘরই হল 'উগার' ৷ ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো গেরস্থালির স্বল্পপ্রয়োজনীয় কিছু কিছু জিনিসের ঠিকানা ছিল এই 'উগারের তলে' ৷ আবার ছিঁচকে চোর গেরস্থবাড়িতে পেশাগত কিংবা নেশাগত উদ্দেশ্যসাধন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়লে আত্মরক্ষার জন্যে উগারের তলায় আশ্রয় নিত ৷ বাংলার লোককাহিনিতে আছে বোকা জামাই লোভ সামলাতে না পেরে রাতের আঁধারে পায়েসের হাঁড়িতে মাথা ডুবিয়ে দিশেহারা হয়ে লোকলজ্জার ভয়ে উগারের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল ৷ 'উদ্বৃত্তাগার' অর্থাৎ যে গৃহে বাড়তি জিনিস রাখা হয় ৷ এই শব্দটি ক্রমান্বয়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছে 'উগার' ৷ আঞ্চলিক বাংলার এমন বহু মজাদার শব্দ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ৷
বাংলাদেশের বিজয়দিবসে একটি লুপ্তপ্রায় বাংলা শব্দকে অর্গলমুক্ত করার প্রয়াস নিলাম ৷
Wednesday, December 6, 2017
তাগিদ
সদ্য পাটভাঙা মৌসুমী মেঘ উড়ে এসে
উঠোনের উত্তর কোনায় বাতাবি লেবুর
খইফোঁটা ফুলের গন্ধে গাঢ় নিঃশ্বাস নেয়
চরাচর নিঝুম হয়ে গেলে রহস্যে পরকিয়া
চিঠিতে শব্দ উঠে আসে হামাগুড়ি দিয়ে
নিদাঘের তাপমাত্রা কমে এলে তুমি নাকি
ভালোবাসার জন্যে ভাটিয়ালি বেছে নাও
ঘাট থেকে জল তুলে নেয়ার কালে কালিয়াভীতি
নতুন করে ব্রজবুলি লেখার তাগাদা শোনায়
ঘোমটা থাক বা না থাক
তোমার মুখের স্মিতভুবনই এখন
আমার গোপন চাবিকাঠি
সে কী তোমার জানা আছে?