Tuesday, September 27, 2022

MY PENSION FROM DEC 2022

FOR FEB21 : BP=40500 DA=00 COMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 : DA (8% )=3240 REC=00
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=37940
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=40500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 00 COMM = 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NET = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

Monday, September 26, 2022

মহালয়া

মহালয়া এক বিশেষ তিথি ৷ মহালয়া বলতে বোঝায় পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবীপক্ষের শুরু ৷ পিতৃপক্ষ সূচিত হয় প্রধানত দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরের পূর্ণিমা তিথিতে ৷ শেষ হয় অমাবস্যা তিথিতে ৷অপরদিকে উত্তরভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয় ৷ সংস্কার অনুযায়ী ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা পঞ্চদশী অর্থাৎ অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়কে বলা হয় পিতৃপক্ষ বা প্রেতপক্ষ বা অমরপক্ষ ৷ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, এই সময় প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষবর্গের আত্মারা মর্ত্যলোকে নেমে আসেন নিজেদের ফেলে যাওয়া গৃহ ও পরিজনের প্রতি মায়াবশত ৷ মহালয়ায় তাঁরা সকলে মরজীবনের পরিবেশে ফিরে আসেন বলে অর্থাৎ তাঁদের বিদেহী আ়ত্মারা ফিরে আসেন বলেই তাঁদের জীবিত উত্তরপুরুষেরা সেই দিনটিতে তর্পনের দ্বারা তাঁদের বিদেহী আত্মার পরিতৃপ্তি বিধান করে প্রতিটি গৃহেই আনন্দোৎসব পালন করে থাকেন ৷ ' আলয় ' যেদিন 'মহ' অর্থাৎ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে সেই দিনটাকেই বলাহয় 'মহালয়া' ৷ 
এতে বোঝা যায় যে মহালয়া হলো পূর্বপুরুষের পুজো বা প্রেতপুজোর এক বিশেষ তিথি ৷ এই পূর্বপুরুষ পুজো বা প্রেতপুজো মানবসংস্কৃতির ইতিহাসে মানুষের আদিম বিশ্বাসের সঙ্গে বহু প্রাচীনকাল থেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ৷
পুরাণকাহিনিতে আছে, মহাভারতের যুদ্ধে কর্ণ যখন মৃত্যুমুখে পতিত হন তখন তাঁর আত্মাকে খাদ্য হিসেবে গহনা নিবেদন করা হয় ৷ কর্ণ বিস্মিত হয়ে এর কারণ অনুসন্ধানের জন্যে দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হন ৷ ইন্দ্র জানান যে, কর্ণ তাঁর জীবদ্দশায় কখনো পূর্বপুরুষের প্রতি খাবার, জল ইত্যাদি উৎসর্গ করেন নি ৷ উপরন্তু দাতাকর্ণ শুধুমাত্র সোনাই দান করে গেছেন আজীবন ৷ আর তাঁর সেই কর্মফলের কারণেই তাঁর ক্ষেত্রে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ৷ কর্ণ এই বিষয়টা জানতেন না বলে তাঁকে পনেরো দিনের জন্যে মর্ত্যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো যাতে তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের জল ও খাবার উৎসর্গ করতে পারেন ৷ হিন্দু পুরাণ মতে, এই পিতৃপক্ষ সময়কালে তিন পূর্ববর্তী প্রজন্মের আত্মা পিতৃলোকে ( স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি) অবস্থান করেন ৷ পরবর্তী প্রজন্মের কারও মৃত্যুর পর যমরাজা আত্মাকে পিতৃলোকে নিয়ে যান এবং প্রথম প্রজন্ম স্বর্গলোকে উন্নীত হয় ৷
পুরাণ মতে এদিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে ৷ অশুভ অসুরশক্তির কাছে পরাভূত দেবতারা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হন ৷ চারদিকে অশুভ শক্তির আস্ফালন ৷ এই অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার লক্ষ্যে দেবতারা সমবেত হন ৷ অসুরশক্তির বিনাসে তাঁরা এক মহাশক্তির আবির্ভাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ৷ দেবতাদের তেজোরশ্মি থেকে আবির্ভূত হলেন অসুরদলনী দেবী দুর্গা ৷ মহালয়ার কাল হলো ঘোর অমাবস্যা ৷ দেবী দুর্গার আবির্ভাবে তাঁর মহাতেজের জ্যোতিতে সেই অমাবস্যা দূরীভূত হয় ৷ প্রতিষ্ঠিত হয় শুভ শক্তির ৷ অসুরবিনাশিনী দেবী দুর্গা স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল তথা ব্রহ্মান্ডের অর্থাৎ 'মহানিকেতন'র অধিশ্বরী ৷ তাঁরই আগমনী তিথির নাম 'মহালয়া'

Monday, September 19, 2022

'মৃগ' শব্দ

সংস্কৃত মৃগ্ শব্দের অর্থ অন্বেষণ । মৃগয়া মানে পশু অন্বেষণ বা পশু শিকার । মৃগ শব্দের আদি অর্থ পশু । ক্রমে অর্থসংকোচের ফলে মৃগ অর্থে হরিণ বোঝায় । কখনও বা বিশেষণ পদ সহযোগে অন‍্য প্রাণীকেও বোঝায় । সেইরূপ– শাখামৃগ > বানর । মহামৃগ > হাতি । মৃগেন্দ্রকেশরী > সিংহ ইত‍্যাদি ।

Tuesday, September 13, 2022

ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর ( ননী মামু ) কোলকাতার ঠিকানা

দমদম নাগেরজলা থেকে অটোতে ছাতাকল নামতে হবে । সেখান থেকে লিচুবাগান বাজার মনসা মন্দিরের কাছে ( একটা পুকুর আছে ) গৌরাঙ্গ আবাসন/ অ্যাপার্টমেন্ট ) ।

Wednesday, September 7, 2022

দেশভাগের বিভীষিকা : বাঙালি জাতিসত্তার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা

দেশভাগের বিভীষিকা : বাঙালি জাতিসত্তার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ত্রিখণ্ডিত হয়ে স্বাধীন হলেও তার পেছনে আরো কিছু কারণ রয়ে গেছিল । তার মধ‍্যে দেশের ভেতর দীর্ঘকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বঞ্চনার ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে । এই অর্থনৈতিক বঞ্চনার ফলে উপনিবেশিক শাসনে আর্থসামাজিক কাঠামোয় গ্রাম বাংলার অধিকাংশ হিন্দু ও মুসলমান জনগণ বিশেষভাবে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছিল । অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে বিভিন্নভাবে উপেক্ষিত এই সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ  জমা হয়ে উঠেছিল । সেই  ধূমায়িত বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগ এর কাজটি করেছিলেন দুই ধর্মের মৌলবাদী নেতৃবৃন্দ । তার ফলেই সারা দেশব্যাপী ৪০ এর দশকে ছড়িয়ে পড়েছিল হিংসার রাজনীতি এবং এই অবস্থায়ই চল্লিশের দশকের ধর্মীয় হিংসার উত্তাল তরঙ্গমালা দেশভাগের অবস্থা সৃষ্টি করেছিল ।

আপাতদৃষ্টিতে ভারত বিভাগের পশ্চাৎপট হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা-কলহকে দায়ী করা হলেও Transfer of Power Documents এর ভিত্তিতে মনে করা হয়, "ভারত সাম্রাজ্য বিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবিভাগও ব্রিটিশ নীতির অচ্ছেদ‍্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল । ক্রিপস মিশনে আমরা দেখি এই ব্রিটিশনীতির অকালবোধন, ক‍্যাবিনেট মিশনে তার পূজারতি ও মাউন্টব্যাটেন মিশনে তার পূর্ণাভিষেক ( সুকুমার সেন / ভারত বিভাগ : ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা- উনিশ ) । 

মাউন্টব্যাটেন মূলত ভারতবর্ষকে ভাগ করার জন্যই এদেশে এসেছিলেন । এটলি মন্ত্রীসভা ১৯৪৭ এর ২০ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষণা করেন । তখনও হস্তান্তরের দিনক্ষণ ধার্য হয়নি । ২৪শে মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসেন এবং দেশভাগের কথা ঘোষণা করেন । এভাবে 15 আগস্ট ১৯৪৭ ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনক্ষণ স্থির হয়ে যায় । ৮ই জুলাই ইংল্যান্ড থেকে প্রাক্তন ইংরেজ বিচারক সিরিল র‍্যাডক্লিফ ভারতে আসেন সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়ে । তিনি এর আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে আসেননি । মানচিত্র পাঠ করার ( cartographic knowledge )  প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতাও তাঁর ছিলনা । ভারতবর্ষের মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধেও কিছুই জানেন না ।তিনি এলেন  ভারতবর্ষকে ভাগ করার দায়িত্ব নিয়ে । তিনি সরেজমিনে তদন্তেও গেলেন না । টেবিলে বসেই মানচিত্রের উপর কলম চালালেন । তিনি মাউন্টব‍্যাটেনের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় পেয়েছিলেন । এদিকে জওহরলাল নেহেরু ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ দেশটাকে যতটা সম্ভব দ্রুত ভাগ করার জন্য চাপাচাপি শুরু করেন । ( দেশ ভাগ- দেশত‍্যাগ, অনুষ্টুপ, প্রথম প্রকাশ-১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ, বর্তমান সংস্করণ- ২০০৭ পৃষ্ঠা-২২ ; লিওনার্দো মোসলে 'দি লাস্ট দেজ অফ দি ব্রিটিশ রাজ'– পৃষ্ঠা ২২১) । এই তাড়াহুড়োর ফল ভয়াবহ হল । দেশের দুইটা অঞ্চলের বুকে নেমে এলো অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় । দুইটা প্রদেশের মানুষের নতুন পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু'। তাদের ছেড়ে যেতে হলো পূর্বপুরুষের বসতি, নদী, মাঠ , প্রান্তর । আশৈশব হেঁটে যাওয়া পরিচিত বনবাদাড় । পেছনে পড়ে রইল স্বজনের  শ্মশান ও কবর । অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হল রিফিউজি ক্যাম্প, ফুটপাত আর রেলস্টেশন ‌কিংবা খোলা আকাশ । কারো কারো স্থান হল আন্দামানে কিংবা দণ্ডকারণ্যে ।

মাউন্টব্যাটেন, জওহরলাল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তৎপরতায় ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় । বাংলা ও পাঞ্জাবের উপর দিয়ে এই কয়দিন রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হয়েছিল । এই কয়দিন শুধু মৃতদেহ নিয়ে ট্রেনগুলি পারাপার করেছিল । বাংলা সীমান্ত দিয়ে লক্ষ লক্ষ হিন্দু।নর-নারী, বৃদ্ধ ও শিশু উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় প্রবেশ করে । অন‍্যদিকে সামান্য সংখ্যক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ব পাকিস্তানের চলে যায় । ব্রিটিশ নীতির দূরভিসন্ধি ও কংগ্রেস-লীগের ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দেশের দু প্রান্তের দুটি জাতি তাদের জাতিসত্তা চিরতরে হারিয়ে খন্ডিত ও রক্তাক্ত স্বাধীনতা লাভ করে ।

 ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে অখন্ড বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষের ভাগ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ নেমে এসেছিল । মান-সম্মান ও ধর্মনাশের ভয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নবসৃষ্ট পশ্চিমবঙ্গে, সংলগ্ন আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় । পাকিস্তানের অন্তর্গত মানুষ ভারতে অন্তর্ভুক্ত পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লিতে আশ্রয় নেয় । ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের দুই প্রান্তের  দুটি জাতির নিজস্ব সত্তা ও দ্বিখন্ডিত হয়। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে সেদিন রক্তাক্ত স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেছিল । আর পূর্ব প্রান্তের বাঙালির জাতিসত্তা চিরতরে দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল । এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তাদের নাম দেওয়া হয় 'মোহাজের' । আর পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সমস্ত মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বলা হলো 'উদ্বাস্তু' বা 'বাস্তুহারা' । আবার কোথাও কোথাও এদের নাম দেওয়া হলো 'পাকিস্তানি' কোথাও বা 'ভাটিয়া' বা 'বাঙাল' নামে  স্থানীয় জনগণের তাচ্ছিল্যের শিকার হয় । 

পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্বপাকিস্তানের স্থানীয় মানুষের কাছে এক নতুন মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল । যেন তারা মানুষ নয় । যে নামে তারা পরিচিতি পাক না কেন এদের সবার ভাগ্যে উপেক্ষা, অবহেলা,অনাদর ছাড়া যেন আর কোন প্রাপ্তি থাকার কথা ছিলনা । তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল তারা ততটা উপেক্ষা অবহেলা বা অনটনের শিকার হয়নি । পূর্ব পাঞ্জাব থেকে যারা পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিল তাদের ভাগ্যেও বেশি দুর্দশা ঘটেনি। ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গে যারা ধর্ম হারাবার ভয়ে বা প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের পরিচয় দেওয়ার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে, 'সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলার ভূখন্ডে ঢুকল ওরা চোরের মতো । ছিন্নমূল নিঃস্ব মানুষ পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটার মায়া কাটিয়ে ছুটেছিল এপার বাংলায় । সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা, পৈশাচিক নির্যাতনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা আর সামনে ছিল অনুষ্ঠিত ভবিষ্যৎ । যে মাটি ছিল মায়ের মতো, যার ফসলে ওদের জন্মগত অধিকার, সেখানে ওরা পরবাসী । এপারে ঝোপেঝাড়ে, বিলে, অনাবাদি ভূখণ্ডে গড়ে উঠলো নতুন বসতি । যেসব জমি আগাছা ভরা, পরিত্যক্ত, যেখানে কোনদিন ভুল করেও যায়নি মানুষ, বর্ষা ডেকে আনে প্রাণঘাতী বন্যা, সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল বসতি । সরকারি অনুদানের ছিটে ফোঁটা জুটল কপালে । কিন্তু বেঁচে থাকতে, মাটির উপর শক্ত দুপায়ে দাঁড়াতে তার ভূমিকা ছিল নগণ্য । যারা এল দান হাতে, ভাগ্য ফিরল তাদেরই, মানুষকে মানুষ বঞ্চিত করে, না খাইয়ে হাত-পা বেঁধে ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তার ইতিহাস রক্তাক্ত না হলেও মর্মান্তিক । একটি জাতিকে নিষ্ঠুরভাবে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র কত যে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল তার প্রমাণ সেদিনের অন্ধকারময় ইতিহাস । বাঙালিকে সেদিন ছিঁড়ে খেয়েছে বাঙালি-অবাঙালি সবাই । তাদের পরিণত করা হয় একটি জড়পিন্ডে । অক্ষম অপদার্থ অলস এক জেনারেশনে ! যাদের কোনো ভূমিকা নেই ! মানুষের যাবতীয় সদগুণকে পিষে মারা হল ‌। ওদের পরিচয় হলো 'উদ্বাস্তু' ( কমল চৌধুরী : বাংলায় গণ আন্দোলনের ছয় দশক ( দ্বিতীয় খন্ড ), পত্র ভারতী, এপ্রিল ২০০৯, পৃষ্ঠা-৮৫ ) । এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আগত উদ্বাস্তু সম্বন্ধে যা যা বলা হয়েছে সন্নিহিত রাজ‍্যগুলির ক্ষেত্রেও  তা বিন্দুমাত্র অতিকথন নয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালি হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ এবং সংলগ্ন আসাম, ত্রিপুরায় কিভাবে কত দুঃখ লাঞ্ছনা আর উপেক্ষা সহ্য করে কোনক্রমে প্রাণধারণ করেছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছে তার তুলনা বাঙালির ইতিহাসে সম্ভবত অনুল্লেখিত থেকে যাবে ।

দেশভাগের পরের প্রথম নয় বছরেই পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন ২১ লক্ষেরও বেশি মানুষ । ডিসেম্বর ১৯৪৯ এ খুলনা এবং ১৯৫০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি বরিশাল ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার পর এক লাখের কাছাকাছি মানুষ ভারতে চলে আসেন ১৯৫০ সালের ১৮ই এপ্রিল 'নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি: বা :দিল্লি চুক্তি: সম্পাদিত হয় । দেশভাগের পরে বিভিন্ন সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে কতজন উদ্বাস্তু এপারে এসেছিলেন সে বিষয়ে সঠিকভাবে বলা যায় না । তবে একটা পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালে পূর্ববঙ্গ থেকে এপার বাংলা এসেছিলেন ২১ লক্ষ ৪ হাজার ২৪২জন । ১৯৬১ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ৩০ লক্ষ ৬৮ হাজার ৭৫০ জন । ১৯৭১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়ে ছিল ৪২ লক্ষ ৯৩ হাজার জন । ফলে এই বিরাট সংখ্যার জনগণ একপ্রকার নিঃস্বভাবেই ভিটেমাটি ছেড়ে এদেশে এসেছিলেন । 'নেহেরু লিয়াকত চুক্তি' বা দিল্লি চুক্তি' ১৮ এপ্রিল ১৯৫০ উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পূর্ণ সমাধান করতে পারেনি । শরণার্থী আগমনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ৪৭ এর পর পঞ্চাশে, ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে হযরত বাল মসজিদের দাঙ্গার সময়, ৬৫ তে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রাক্কালে, এবং একাত্তরের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত অনবরত শরণার্থীরা ভারতে আসতে থাকে । এরা পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মানুষ । চোরাগোপ্তাভাবে সেই স্রোত আজও অব‍্যাহত রয়েছে ।

দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে অনেক বেশি সংখ্যক উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল । কিন্তু বাস্তবে উদ্বাস্ত আগমনের চাপ পাঞ্জাব অপেক্ষা পশ্চিমবঙ্গ ও সন্নিহিত রাজ্যসমূহে অনেক বেশি ছিল। এর কারণগুলি প্রথমত, পাঞ্জাবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আয়তনে অনেক ছোট প্রদেশ । দ্বিতীয়ত, লোক বিনিময়ের ফলে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের উদ্বাস্তুরা লাভবান হয়েছিল । দেশভাগের ফলে পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে যে সংখ্যক উদ্বাস্তু পূর্ব পাঞ্জাবে এসেছিল তার থেকে অনেক বেশি মানুষ পূর্ব পাঞ্জাব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। হলে তাদের ফেলে আসা সম্পত্তি বাড়িঘর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে ব্যবহৃত হয়েছিল । 

দাঙ্গা ও দেশভাগ নামক বিপর্যয়ের ফলে যেসব মানুষ তাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত হয়ে আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের  বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছিল তারা সরকারি সাহায্য ততটা পায়নি, যতটা পেয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা । পশ্চিমবঙ্গের  সরকারের আমলা থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ সবার কাছে শুধু প্রতারণা আর ঘৃণায় পেয়েছিল । উপরন্তু তাদের ভাগ্যে জুটেছিল অলস ও নিষ্কর্মা অপবাদ । পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুরা নানাভাবে প্রত্যাখ‍্যাত ও প্রতারিত হয়ে ক্যাম্প গুলিতে মনুষ‍্যেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল । জন্ম, মৃত্যু তথা প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কোন প্রকার আব্রু ছিল না । কিন্তু তারপরও এসব মানুষ এদেশের মাটিতে এদেশে জন সমাজে শেকড়ের সন্ধানে  নিরন্তর নিয়োজিত ছিল । উদ্বাস্তুদের ক্রমাগত আগমনে স্থানীয় সরকার গুলো যেমন অসহায় তেমনি কেন্দ্রীয় সরকার ও উদাসীন ফলে এদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা মিটে গিয়েছিল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে । কিন্তু ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের সমস্যা আজও মেটেনি । পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যে স্থান সংকুলনের অভাবে উদ্বাস্তুরা কখনো আন্দামানে, কখনো দণ্ডকারণ্যে নির্বাসনের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে । নদী-নালা দেশের মানুষ এইসব উদ্বাস্তুদের পক্ষে আন্দামান বা দণ্ডকারণ্য নির্বাসনে তুলল শাস্তি । আন্দামান বা দণ্ডকারণ্যে এই অসহায় মানুষগুলি স্বেচ্ছায় যায়নি তাদের একরকম জোর করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল । সেখানেও পরিকাঠামোর অভাবে সরকারি সাহায্যের অপ্রতুলতার কারণে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন আরেকপ্রস্থ প্রহসনে রূপান্তরিত হয়েছিল । শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিম্নতম জীবন যাপন করতে বাধ‍্য হয় । শরনার্থী শিবিরের দিনযাপনে নিদারুণ যন্ত্রণা ও গ্লানি থেকে বাঁচার জন্য অনেকেই স্বেচ্ছায় শিবিরগুলো ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম, শহরাঞ্চল ও শহরতলিগুলিতে নিজেদের বাঁচার পথ খুঁজতে থাকে । আর একেবারে নিরুপায় যারা তারা রয়ে যায় । কিন্তু সেই সংখ্যাটি নেহাত কম নয় ।

 প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছরে উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উপর জোর দেন । তাই ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরবর্তী পাঁচ বছর 'পুনর্বাসনের যুগ' নামে অভিহিত হয় । ভাষাগত সমস্যা না থাকায় পাঞ্জাবের পাঞ্জাবি ও সিন্ধ্রি উদ্বাস্তুরা, দিল্লি, হরিয়ানা হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিয়ে সেখানে তারা তাদের বাসস্থান গড়ে তোলে । কিন্তু বাঙালি উদ্বাস্তুরা ভাষাগত সমস্যা ও অন্যান্য কারণে পশ্চিমবঙ্গ ত্রিপুরা ও আসামে আশ্রয় নিতে বাধ‍্য হয় । পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরনার্থীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নেহরু সরকার উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন । কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের উদ‍্যোগে যথেষ্ট তৎপরতা দেখা গিয়েছিল । এই প্রয়াস শুরু থেকেই  সুপরিকল্পিত ও সুসংহতভাবে পরিচালিত হয় । কিন্তু পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জন‍্য সেই আন্তরিকতা ছিল না । পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের সেদেশে তাদের সম্পত্তির অধিকার রয়েছে বলে অজুহাত খাড়া করে তাদের সমপরিমান ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয় । অথচ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের তাদের ক্য়ক্ষতির সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় । এই বৈষম‍্যমূলক আচরণের ফলে বাঙালি উদ্বাস্তুরা একদল কায়িক শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হয় । নবসৃষ্ট এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা আজও ঘুচেনি । দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই দরিদ্র মানুষগুলো আজও বিদেশী, বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত।  তাদেরকে আজ 'সন্দেহজনক বিদেশী' বলে সনাক্ত করে, আটক করে 'নো ম‍্যানস ল‍্যান্ডে নির্বাসনে কাটাতে হচ্ছে । পূর্ববাংলা থেকে আগত এই মানুষগুলো ও তাদের উত্তরপ্রজন্মের উপর অমানবিক আচরণ ও  নির্যাতন ও অবিচার চলতে দেওয়া যায় না । পূর্বসূরিদের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে তাদের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটানোর সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার । তাদের জন‍্যে সম্মানজনক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা প্রদান করার জন‍্যে সরকারি স্তরে পদক্ষেপ নেওয়াও দরকার।

দেশভাগের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষ ও তার উত্তরপ্রজন্ম হয়তো স্বপ্ন দেখেন জাতিসত্তার পুনর্মিলনের । কিন্তু এ আর তো হবার নয় । বরং এই উপমহাদেশের মধ‍্যে কোনো ঐক‍্যবদ্ধ সংগঠন সৃষ্টির মাধ‍্যমে একদিকে যেমন পারস্পরিক প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ‍্যমে শান্তি-সম্প্রীতি নিবিড় বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় তেমনি পিতৃ-পিতামহের দেশটার স্মৃতিকেও বুকের গভীরে আঁকড়ে ধরে রাখা যায় ।

Tuesday, August 30, 2022

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী

বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য আমার বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন জীবনভর এতো লাঞ্ছিত হয়েছেন যে, সে কথাগুলো আর বলতে চাইতেননা শেষদিকে । তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না । সর্বোপরি তাঁর কর্মকান্ডের ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে  যাওয়ার একটা প্রধান কারণ তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাম্রপত্র গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ । ভারতের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ‍্যোগ গ্রহণ করেন । সেসময়ে সাব্রুম মহকুমায় বসবাসকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ‍্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক আশুতোষ দে প্রমুখগণ, নিজেদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি বাবাকেও অনুরোধ করেন কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন‍্য । স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত মণীন্দ্র ঢালী সেসময়ে সাব্রুম শহর থেকে হেঁটে ছোটোখিলে গিয়ে বাবকে অনুরোধ করেন তাঁর আবেদন জমা দেওয়ার জন‍্যে । কিন্তু বাবার একই কথা ছিল, আমি কলাপত্রের ( তাম্রপত্রকে বাবা এই শব্দ বলতেন ) জন‍্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করিনি । শেষ মুহূর্তে বিলোনিয়া থেকে সুরেশ চৌধুরী ও হারাণদাদু ( বিপ্লবী শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী– যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে উল্লিখিত আছে ) খবর পাঠান বাবার কাছে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন‍্য । সত্বর দরখাস্ত পাঠাবার জন‍্য । তাঁরা কয়েকদিনের মধ‍্যে সবার কাগজ জমা দিয়ে দেবেন । কিন্তু বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন । যেহেতু আমার প্রয়াত পিতৃদেব এইধরনের অভিমানী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেকারণে আমরাও  স্বাধীনতসংগ্রামীর সন্ততি বলার মতো গর্বিত পরিচয় দেওয়ার সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম । যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যাচ্ছি এই মহকুমায় অবস্থানকারী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সন্তানদের জীবনমানের তেমন কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি । এমন কোনো বিশেষ পরিচিতিও পায়নি । এক প্রজন্ম পরেই পূর্বজদের সব অবদান স্মৃতির অতলে চলে গেছে ।

মাঝে মাঝে কথার ছলে বাবার মুখে যতটুক শুনেছি, স্বর্গীয় অনাদিরঞ্জন সেন , স্বর্গীয় মনোরঞ্জন বর্ধন ( মনাদা ), বিভূতি চক্রবর্তী, স্বর্গীয় রেবতী পাল, স্বর্গীয় সুরেশ চৌধুরী, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী, অমর সরকার প্রমুখ আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন একই বিপ্লবীদলের সদস‍্য । তাঁদের নেতা ছিলেন শচীন্দ্র চন্দ্র পাল । তারাগুজার নবীনচন্দ্র সেনের গোলকানন্দ ঔষধালয় ছিল ফেনীতে । আমাদের দাদু অর্থাৎ আমার বাবার মামা রজনীকান্ত নন্দীর ( যিনি সেকালে আর কে নন্দী নামে সেকালে সমধিক পরিচিত ছিলেন ) 'সাধনা ঔষধালয় ঢাকা'-র বিপণী ছিল ফেনীর পাঁচগাছিয়া রোডে । সেকারণে অনাদিরঞ্জন সেনের সঙ্গে আমার বাবা মনোরঞ্জনের নিবিড়  বন্ধুত্ব ছিল । গোলকানন্দ ঔষধালয় বিপ্লবীদের মিলিত হওয়ার গোপন স্থান ছিল । বাবা বলতেন গোলকানন্দ ঔষধালয়ের 'এন সুধা' নামে কালাজ্বরের ঔষধ এবং সাধনা ঔষধালয়ের 'সাধনা দশন' নামে দাঁতের মাজনের খুব নাম-ডাক ছিল ।

 ৪২ সালের শুরুর দিকে ট্রেন লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন‍্যে ফেনী স্টেশনের অনতিদূরে  বোমা-বারুদ নিয়ে অ্যাম্বুশে বসেছিলেন কয়েকজন বিপ্লবী। তাঁরা দলে এগারো জন ছিলেন । কেউ বোধহয় আগে থেকে পুলিশের কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিয়েছিল । নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা এসে তাঁদের অ্যাম্বুশ নেওয়া জায়গাটার একটু আগে থেমে যায় । একদল সৈন‍্য ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে বিপ্লবীদের ধাওয়া করে । ধরা পড়ে যান  অনাদিরঞ্জন ও মনোরঞ্জন ( মনাদা ) । বাবার মুখে শোনা,  পুলিশ সেদিন অনাদিরঞ্জনের উপর অন‍্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিল । দুজনেই সুপুরুষ ছিলেন । তারা ভেবেছিল নোয়াখালি অঞ্চলের টেররিস্টদের নেতা এই দুজনেই । পুলিশ কথা আদায়ের জন‍্যে বাবার বাঁহাতের তর্জনীতে মোটা সুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল । যার ফলে বাবার সেই আঙুলটা চিরতরে বাঁকা হয়ে যায় । এই কেইসে তাঁদের দুজনকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয় । এইসময়ে যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসারের কথা বাবা প্রায়শই বলতেন তার নাম পূর্ণ নাথ । যেমন নৃশংস তেমনি বিপ্লবীদের কাছে ত্রাস ছিলেন এই পূর্ণ নাথ । দুই পকেটে দুটো পিস্তল নাকি রাখতেন । বিপ্লবীদের প্রচন্ড নির্যাতন করতেন তিনি । নিরীহ তরুণদের ধরে টেররিস্ট বলে জেলে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ আদায় করতেন । এই নিষ্ঠুর দারোগা পূর্ণ নাথের ভয়ে বিপ্লবীরা পালিয়ে বেড়াতেন । বাবা কোলকাতায় পালিয়ে গিয়ে ইলেকশন দপ্তরে সুপারভাইজারের চাকরি নেন । বাবা যখনি দেশের বাড়ি ( তাঁর মামাবাড়ি ) ফেনীর আমিরাবাদে পৌঁছাতেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে সাদা পোষাকে পুলিশ ছেয়ে যেত । তাঁর সঙ্গে কে মেশে, কোথায় যান সব খেয়াল । একবার কোলকাতার মানিকতলার তাঁর মেসে বিপ্লবীদের খোঁজে হানা দেয় । চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আগের রাতেও এখানে ছিল । কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তাঁরা সরে পড়েন । পুলিশ সন্দেহবশত বাবাকে ধরে নিয়ে যান । কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কিছু জানতে পারেননি । তার উপর বাবার অফিসের একজন ই়ংরেজ অফিসারের সরাসরি হস্তক্ষেপে তিনি সেযাত্রা বেঁচে যান । বাবা বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন‍্য প্রায়ই বাড়িছাড়া থাকতেন । এজন‍্যে পরবর্তী জীবনে বাবাকে প্রায়ই খোঁচা দিয়ে বলতেন, দেড়সের চাল দি' হপ্তা কাডাইছি আঁই । অনঅ কি কষ্ট কইত্তামনি ?

  বেশ কবছর আগে একজন বয়স্ক লোক আমার সাব্রুমের বাসায় এসেছিলেন বিপ্লবী মনাদার ছেলে ( আমি ) এখানে থাকে জেনে দেখা করতে । তাঁর মুখে বাবার দুঃসাহসিকতার দুএকটা কাহিনি শুনেছিলাম । তিনি বলেছিলেন বাবা গ্রামে এলেই ছেলেরা যেন সাহস পেত । বাবা তাদের ক্লাস নিতেন ।  গ্রামের যে গোপন জায়গায় তাঁরা আড্ডা দিতেন সেখানে একটা বড়ো শিমুলের গাছ ছিল । কান্ডটা বেশ মোটা । তাঁরা তার গায়ে হেলান দিয়ে মিটিং করতেন । ফলে গাছটার গুঁড়িটা তেলতেলে হয়ে গিয়েছিল । একসময় বিচক্ষণ ইংরেজ পুলিশের চোখে তাধরা পড়ে যায় এবং বিপ্লবীদের আড্ডাটা ভেঙে যায় ।

যে কুখ‍্যাত পুলিশ অফিসার পূর্ণ নাথের জন‍্য বিপ্লবীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর সেই পূর্ণ নাথকে কোলকাতার লালবাজারে স্বমহিমায় দেখা যায় । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে পূর্ণ নাথ এখানেও বিপ্লবীদের নানাবিধ মিথ‍্যা মামলায় জড়িয়ে দিতে থাকে । বাবা একদিন পূর্ণ নাথের নজরে পড়ে যান । পূর্বপরিচিত হিসাবে সম্মান না দেওয়ায় বাবা তাঁর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান । বাবাকে কোলকাতার চাকরি ছেড়ে আসামের চাবাগানে নানাসময় নানা নামে আত্মগোপন করে থাকতে হয় । শেষে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজে চাকরি পান । সেই সুবাদেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমদিকে রাজ‍্যের দুজন বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. রথীন দত্ত ও ড. রবি চৌধুরী এমবিবিএস পড়ার জন‍্য ডিব্রুগড় গিয়ে আমাদের কোয়ার্টার্সে প্রথম উঠেছিলেন । তারপর তাঁরা হোস্টেলে চলে যান । একটা কোয়ার্টার্সে জায়গা । আজীবন স্বাধীনতাসংগ্রামী খদ্দরের ধুতি-জামা পরা আমার স্বাধীনচেতা বাবাকে আসাম থেকেও পালিয়ে ত্রিপুরায় চলে আসতে হয় । বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হতে হতে বাবা একসময় স্বাধীনতা শব্দের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতেন । 

বাবা যেহেতু তাঁর বিপ্লবীজীবন সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন, আমরা তাঁর সন্ততিরাও আর সেবিষয়ের উন্মোচন করতে চাইনা । উনিশ শো ছিয়াত্তরে তাঁর আকস্মিক মৃত‍্যুর সাথে সাথে সব কিছু হারিয়ে গেছে । তবুও সত‍্য ইতিহাস কখনো চাপা থাকেনা । কিছুদিন আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দেশভাগের বিভীষিকা সম্বন্ধে কথা বলার জন‍্য । তাঁরা বোধহয় কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন । আমি একজন উত্তরপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অনুভবটা জানিয়েছিলাম । এমন শুধু আমার বাবা নয় । বহু বিপ্লবী চলে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে । 'হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে' ।

Wednesday, August 24, 2022

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল পালক

সুমন পাটারি : রাজ‍্যের সাহিত‍্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল সাদা পালক

সুমন পাটারি ত্রিপুরার সন্তান । আমার গর্বের দক্ষিণ জেলার । রাজ‍্যের জন‍্যে দিয়েছে গর্বের পুরস্কার । যুব সাহিত‍্য একাডেমি সম্মান - ২০২২  ।  তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাইখোরাতে একটি সাহিত‍্যানুষ্ঠানে । আমাকে বাইখোরা বাজার থেকে বাইকে তুলে সোজা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায় । তরুণ সৈনিকের মতো একহারা দৃপ্ত চেহারা । সুমনের কবিতায়ও সেইরকমের তীব্র ঋজুতার ছাপ । তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ভদ্র, নম্র ও চলাফেরায় একদম সাদাসিধে । কিন্ত জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অত‍্যন্ত সংবেদনশীল । একবার আমরা একসঙ্গে রাজ‍্যের বাইরেও গেছি । একদম কাছে থেকে দেখেছি সুমনকে । এই যাত্রাপথে সুমন আমাকে সন্তানসুলভ দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিল । আমার খাওয়া দাওয়া সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুতেই ওর লক্ষ‍্য ছিল । আমার কষ্ট হলেই সুমন তৎপর হয়ে উঠত আমার অসুবিধা দূর করার জন‍্য ।

 নিষ্পাপ শিশুর মতো সুমনকে নাগরিক জটিলতায় আচ্ছন্ন করেনি । সুমন একদিন সকালবেলায়  এসে আমাকে বলল তার সদ‍্য লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা । সে ময়দানের সামনের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল । তার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ এসে আব্দার যে, লোকটার টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছে । সুমন যদি কিছু টাকা দেয় তাহলে লোকটা বাড়ি যেতে পারবে । সুমন তাকে পঞ্চাশ টাকা দেয় । লোকটা তখনকার মতো চলে যায় । কিছুক্ষণ পরে সুমন লক্ষ করে লোকটা আবার এসে পাশের লোকটার কাছ থেকে একই কায়দায় টাকা চাইছে । শহুরে তঞ্চকতায় বেকুফ হয়ে যায় সুমন । সুমনের ভাষায় তার 'বাবার বয়সী' লোকটার আচরণে সে বিস্মিত । এতোটাই স্বচ্ছ সুমন ।

কর্ম বা ভাগ‍্য বিষয়টাকে বিশ্বাস না করলেও জীবনের উত্থান ও বিপর্যয়কে গতিমুখের নির্ণায়ক বলে মেনে নিতেই হয় । সুমনের বাবা সংসারের কর্তা । তাঁর পরিশ্রমের আয়ের উপরই চলছিল তার পড়াশুনা । ত্রিপুরা রাজ‍্যের ইকফাই ইউনিভার্সিটি থেকে বিসিএতে দুর্দান্ত ফল করে রাজ‍্যের বাইরে পড়তে যায় এমসিএ । কিন্তু বিধি যে সুমনের দিকে অলক্ষ‍্যে চেয়ে হাসছিল কে জানে ! বাইখোরা বাজারে সুমনের বাবার  ধান চালের ব‍্যবসা । হঠাৎ একদিন স্তুপ করে রাখা বস্তার সারি থেকে একটা এক কুইন্টাল ওজনের ধানের বস্তা পেছন থেকে ছিটকে পড়ে গদিতে বসে থাকা সুমনের বাবার পিঠে । ঘাড়ে ও মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর । উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা ছেড়ে সুমনকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে । বাবার চিকিৎসা ও সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে সুমনের কাঁধেই । বাবার চিকিৎসার জন‍্যে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করেও বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি আর । এরপর নানারকম ছুটকো পেশা, প্রাইভেট পড়ানো ইত‍্যাদি করে চলতে থাকে সুমনের জীবনযুদ্ধ । বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের পাঠ নিতে থাকে সুমন । সেইসঙ্গে কবিতাযাপনও সমানে চলে । সেকারণেই সুমনের কবিতাও প্রাত‍্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার স্পষ্টতায় উজ্জ্বল । আমি সুমন পাটারির প্রথম কাব‍্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করার ও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন । একদম জোরালো কব্জিতে তোলা ভাষাই সুমনের কবিতা ।

 কার্যকারণে অনেকদিন দেখা হয়না । কিছুদিন আগে সেলিমদা ধর্মনগর থেকে 'পাখি সব করে রব'-র বিশেষ সংখ‍্যা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে । দক্ষিণ ত্রিপূরার কয়েকজন কবির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন‍্যে । সুমনের কপিও ছিল । কিন্তু আমি যেদিন বাইখোরা যাই সেদিন ও বিশেষ কাজে ব‍্যস্ত থাকায় আর দেখা হয়নি । ওর কপিটা কবি তারাপ্রসাদ বনিকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম ।

নোয়াখালি অ্যাকসেন্ট থাকে সুমনের কথাবার্তায় । মনে হবে আনস্মার্ট এক গ্রাম‍্য যুবক । সুমনের ইংরেজি উচ্চারণ ও অনর্গল কনভার্সেশন শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন । বাহ‍্যিক দর্শনে রাজ‍্যের মেধাবী ও গুণী এই তরুণকে চিনতে অনেকেই ভুল করবেন । সুমন যদি তার উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারত তবে আজ সে একজন নামজাদা আইটিয়ান হতে পারত । অথবা বড়ো কোনো মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন থাকত ।

যাই হোক, লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতরের রজতকাঞ্চনের ভান্ডার হাতে না এলেও সরস্বতীর বীণাতন্ত্রীতে ঝংকার তুলে তার শব্দকথা  বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, আমার সন্তানপ্রতিম রাজ‍্যের গর্ব সুমন পাটারি । তোমাকে স্নেহ ও আদর হে কবি !

অশোকানন্দ
২৫. ৮. ২০২২.