প্রদীপের আড়ালের এক স্বাধীনতা সংগ্রামী
বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য আমার বাবা প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন জীবনভর এতো লাঞ্ছিত হয়েছেন যে, সে কথাগুলো আর বলতে চাইতেননা শেষদিকে । তিনি প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না । সর্বোপরি তাঁর কর্মকান্ডের ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার একটা প্রধান কারণ তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তাম্রপত্র গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ । ভারতের স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ভারত সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন । সেসময়ে সাব্রুম মহকুমায় বসবাসকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে হরেন্দ্র ভৌমিক, নরেন্দ্র ভৌমিক, কিরণ ভৌমিক আশুতোষ দে প্রমুখগণ, নিজেদের কাগজপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি বাবাকেও অনুরোধ করেন কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য । স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত মণীন্দ্র ঢালী সেসময়ে সাব্রুম শহর থেকে হেঁটে ছোটোখিলে গিয়ে বাবকে অনুরোধ করেন তাঁর আবেদন জমা দেওয়ার জন্যে । কিন্তু বাবার একই কথা ছিল, আমি কলাপত্রের ( তাম্রপত্রকে বাবা এই শব্দ বলতেন ) জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করিনি । শেষ মুহূর্তে বিলোনিয়া থেকে সুরেশ চৌধুরী ও হারাণদাদু ( বিপ্লবী শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী– যাঁর কথা শৈলেশ দে-র 'আমি সুভাষ বলছি' বইতে উল্লিখিত আছে ) খবর পাঠান বাবার কাছে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য । সত্বর দরখাস্ত পাঠাবার জন্য । তাঁরা কয়েকদিনের মধ্যে সবার কাগজ জমা দিয়ে দেবেন । কিন্তু বাবা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন । যেহেতু আমার প্রয়াত পিতৃদেব এইধরনের অভিমানী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেকারণে আমরাও স্বাধীনতসংগ্রামীর সন্ততি বলার মতো গর্বিত পরিচয় দেওয়ার সুযোগ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হলাম । যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় দেখে যাচ্ছি এই মহকুমায় অবস্থানকারী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সন্তানদের জীবনমানের তেমন কোনো ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি । এমন কোনো বিশেষ পরিচিতিও পায়নি । এক প্রজন্ম পরেই পূর্বজদের সব অবদান স্মৃতির অতলে চলে গেছে ।
মাঝে মাঝে কথার ছলে বাবার মুখে যতটুক শুনেছি, স্বর্গীয় অনাদিরঞ্জন সেন , স্বর্গীয় মনোরঞ্জন বর্ধন ( মনাদা ), বিভূতি চক্রবর্তী, স্বর্গীয় রেবতী পাল, স্বর্গীয় সুরেশ চৌধুরী, শৌরীন্দ্রকিশোর দত্তচৌধুরী, অমর সরকার প্রমুখ আরো বেশ কয়েকজন ছিলেন একই বিপ্লবীদলের সদস্য । তাঁদের নেতা ছিলেন শচীন্দ্র চন্দ্র পাল । তারাগুজার নবীনচন্দ্র সেনের গোলকানন্দ ঔষধালয় ছিল ফেনীতে । আমাদের দাদু অর্থাৎ আমার বাবার মামা রজনীকান্ত নন্দীর ( যিনি সেকালে আর কে নন্দী নামে সেকালে সমধিক পরিচিত ছিলেন ) 'সাধনা ঔষধালয় ঢাকা'-র বিপণী ছিল ফেনীর পাঁচগাছিয়া রোডে । সেকারণে অনাদিরঞ্জন সেনের সঙ্গে আমার বাবা মনোরঞ্জনের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল । গোলকানন্দ ঔষধালয় বিপ্লবীদের মিলিত হওয়ার গোপন স্থান ছিল । বাবা বলতেন গোলকানন্দ ঔষধালয়ের 'এন সুধা' নামে কালাজ্বরের ঔষধ এবং সাধনা ঔষধালয়ের 'সাধনা দশন' নামে দাঁতের মাজনের খুব নাম-ডাক ছিল ।
৪২ সালের শুরুর দিকে ট্রেন লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ফেনী স্টেশনের অনতিদূরে বোমা-বারুদ নিয়ে অ্যাম্বুশে বসেছিলেন কয়েকজন বিপ্লবী। তাঁরা দলে এগারো জন ছিলেন । কেউ বোধহয় আগে থেকে পুলিশের কাছে সংবাদটা পৌঁছে দিয়েছিল । নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা এসে তাঁদের অ্যাম্বুশ নেওয়া জায়গাটার একটু আগে থেমে যায় । একদল সৈন্য ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে বিপ্লবীদের ধাওয়া করে । ধরা পড়ে যান অনাদিরঞ্জন ও মনোরঞ্জন ( মনাদা ) । বাবার মুখে শোনা, পুলিশ সেদিন অনাদিরঞ্জনের উপর অন্যদের চেয়ে বেশি নির্যাতন করেছিল । দুজনেই সুপুরুষ ছিলেন । তারা ভেবেছিল নোয়াখালি অঞ্চলের টেররিস্টদের নেতা এই দুজনেই । পুলিশ কথা আদায়ের জন্যে বাবার বাঁহাতের তর্জনীতে মোটা সুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল । যার ফলে বাবার সেই আঙুলটা চিরতরে বাঁকা হয়ে যায় । এই কেইসে তাঁদের দুজনকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হয় । এইসময়ে যে কুখ্যাত পুলিশ অফিসারের কথা বাবা প্রায়শই বলতেন তার নাম পূর্ণ নাথ । যেমন নৃশংস তেমনি বিপ্লবীদের কাছে ত্রাস ছিলেন এই পূর্ণ নাথ । দুই পকেটে দুটো পিস্তল নাকি রাখতেন । বিপ্লবীদের প্রচন্ড নির্যাতন করতেন তিনি । নিরীহ তরুণদের ধরে টেররিস্ট বলে জেলে পুরে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা ঘুষ আদায় করতেন । এই নিষ্ঠুর দারোগা পূর্ণ নাথের ভয়ে বিপ্লবীরা পালিয়ে বেড়াতেন । বাবা কোলকাতায় পালিয়ে গিয়ে ইলেকশন দপ্তরে সুপারভাইজারের চাকরি নেন । বাবা যখনি দেশের বাড়ি ( তাঁর মামাবাড়ি ) ফেনীর আমিরাবাদে পৌঁছাতেন সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে সাদা পোষাকে পুলিশ ছেয়ে যেত । তাঁর সঙ্গে কে মেশে, কোথায় যান সব খেয়াল । একবার কোলকাতার মানিকতলার তাঁর মেসে বিপ্লবীদের খোঁজে হানা দেয় । চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা আগের রাতেও এখানে ছিল । কিন্তু পুলিশ আসার আগেই তাঁরা সরে পড়েন । পুলিশ সন্দেহবশত বাবাকে ধরে নিয়ে যান । কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কিছু জানতে পারেননি । তার উপর বাবার অফিসের একজন ই়ংরেজ অফিসারের সরাসরি হস্তক্ষেপে তিনি সেযাত্রা বেঁচে যান । বাবা বিপ্লবী কর্মকান্ডের জন্য প্রায়ই বাড়িছাড়া থাকতেন । এজন্যে পরবর্তী জীবনে বাবাকে প্রায়ই খোঁচা দিয়ে বলতেন, দেড়সের চাল দি' হপ্তা কাডাইছি আঁই । অনঅ কি কষ্ট কইত্তামনি ?
বেশ কবছর আগে একজন বয়স্ক লোক আমার সাব্রুমের বাসায় এসেছিলেন বিপ্লবী মনাদার ছেলে ( আমি ) এখানে থাকে জেনে দেখা করতে । তাঁর মুখে বাবার দুঃসাহসিকতার দুএকটা কাহিনি শুনেছিলাম । তিনি বলেছিলেন বাবা গ্রামে এলেই ছেলেরা যেন সাহস পেত । বাবা তাদের ক্লাস নিতেন । গ্রামের যে গোপন জায়গায় তাঁরা আড্ডা দিতেন সেখানে একটা বড়ো শিমুলের গাছ ছিল । কান্ডটা বেশ মোটা । তাঁরা তার গায়ে হেলান দিয়ে মিটিং করতেন । ফলে গাছটার গুঁড়িটা তেলতেলে হয়ে গিয়েছিল । একসময় বিচক্ষণ ইংরেজ পুলিশের চোখে তাধরা পড়ে যায় এবং বিপ্লবীদের আড্ডাটা ভেঙে যায় ।
যে কুখ্যাত পুলিশ অফিসার পূর্ণ নাথের জন্য বিপ্লবীদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর সেই পূর্ণ নাথকে কোলকাতার লালবাজারে স্বমহিমায় দেখা যায় । পূর্বশত্রুতার সূত্র ধরে পূর্ণ নাথ এখানেও বিপ্লবীদের নানাবিধ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিতে থাকে । বাবা একদিন পূর্ণ নাথের নজরে পড়ে যান । পূর্বপরিচিত হিসাবে সম্মান না দেওয়ায় বাবা তাঁর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান । বাবাকে কোলকাতার চাকরি ছেড়ে আসামের চাবাগানে নানাসময় নানা নামে আত্মগোপন করে থাকতে হয় । শেষে ডিব্রুগড় মেডিকেল কলেজে চাকরি পান । সেই সুবাদেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমদিকে রাজ্যের দুজন বিশিষ্ট চিকিৎসক ড. রথীন দত্ত ও ড. রবি চৌধুরী এমবিবিএস পড়ার জন্য ডিব্রুগড় গিয়ে আমাদের কোয়ার্টার্সে প্রথম উঠেছিলেন । তারপর তাঁরা হোস্টেলে চলে যান । একটা কোয়ার্টার্সে জায়গা । আজীবন স্বাধীনতাসংগ্রামী খদ্দরের ধুতি-জামা পরা আমার স্বাধীনচেতা বাবাকে আসাম থেকেও পালিয়ে ত্রিপুরায় চলে আসতে হয় । বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা নির্যাতিত হতে হতে বাবা একসময় স্বাধীনতা শব্দের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করতেন ।
বাবা যেহেতু তাঁর বিপ্লবীজীবন সম্বন্ধে নীরব থেকেছেন, আমরা তাঁর সন্ততিরাও আর সেবিষয়ের উন্মোচন করতে চাইনা । উনিশ শো ছিয়াত্তরে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর সাথে সাথে সব কিছু হারিয়ে গেছে । তবুও সত্য ইতিহাস কখনো চাপা থাকেনা । কিছুদিন আগে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দেশভাগের বিভীষিকা সম্বন্ধে কথা বলার জন্য । তাঁরা বোধহয় কোনোভাবে জানতে পেরেছিলেন । আমি একজন উত্তরপ্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে আমার অনুভবটা জানিয়েছিলাম । এমন শুধু আমার বাবা নয় । বহু বিপ্লবী চলে গেছেন ইতিহাসের অন্তরালে । 'হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে ভালোবাসে' ।
No comments:
Post a Comment