সুমন পাটারি : রাজ্যের সাহিত্যের অঙ্গনের উজ্জ্বল সাদা পালক
সুমন পাটারি ত্রিপুরার সন্তান । আমার গর্বের দক্ষিণ জেলার । রাজ্যের জন্যে দিয়েছে গর্বের পুরস্কার । যুব সাহিত্য একাডেমি সম্মান - ২০২২ । তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাইখোরাতে একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে । আমাকে বাইখোরা বাজার থেকে বাইকে তুলে সোজা অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যায় । তরুণ সৈনিকের মতো একহারা দৃপ্ত চেহারা । সুমনের কবিতায়ও সেইরকমের তীব্র ঋজুতার ছাপ । তারপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে । ভদ্র, নম্র ও চলাফেরায় একদম সাদাসিধে । কিন্ত জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অত্যন্ত সংবেদনশীল । একবার আমরা একসঙ্গে রাজ্যের বাইরেও গেছি । একদম কাছে থেকে দেখেছি সুমনকে । এই যাত্রাপথে সুমন আমাকে সন্তানসুলভ দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছিল । আমার খাওয়া দাওয়া সময়মতো ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুতেই ওর লক্ষ্য ছিল । আমার কষ্ট হলেই সুমন তৎপর হয়ে উঠত আমার অসুবিধা দূর করার জন্য ।
নিষ্পাপ শিশুর মতো সুমনকে নাগরিক জটিলতায় আচ্ছন্ন করেনি । সুমন একদিন সকালবেলায় এসে আমাকে বলল তার সদ্য লব্ধ অভিজ্ঞতার কথা । সে ময়দানের সামনের মোড়ে দাঁড়িয়েছিল । তার বাবার বয়সী একজন বৃদ্ধ এসে আব্দার যে, লোকটার টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেছে । সুমন যদি কিছু টাকা দেয় তাহলে লোকটা বাড়ি যেতে পারবে । সুমন তাকে পঞ্চাশ টাকা দেয় । লোকটা তখনকার মতো চলে যায় । কিছুক্ষণ পরে সুমন লক্ষ করে লোকটা আবার এসে পাশের লোকটার কাছ থেকে একই কায়দায় টাকা চাইছে । শহুরে তঞ্চকতায় বেকুফ হয়ে যায় সুমন । সুমনের ভাষায় তার 'বাবার বয়সী' লোকটার আচরণে সে বিস্মিত । এতোটাই স্বচ্ছ সুমন ।
কর্ম বা ভাগ্য বিষয়টাকে বিশ্বাস না করলেও জীবনের উত্থান ও বিপর্যয়কে গতিমুখের নির্ণায়ক বলে মেনে নিতেই হয় । সুমনের বাবা সংসারের কর্তা । তাঁর পরিশ্রমের আয়ের উপরই চলছিল তার পড়াশুনা । ত্রিপুরা রাজ্যের ইকফাই ইউনিভার্সিটি থেকে বিসিএতে দুর্দান্ত ফল করে রাজ্যের বাইরে পড়তে যায় এমসিএ । কিন্তু বিধি যে সুমনের দিকে অলক্ষ্যে চেয়ে হাসছিল কে জানে ! বাইখোরা বাজারে সুমনের বাবার ধান চালের ব্যবসা । হঠাৎ একদিন স্তুপ করে রাখা বস্তার সারি থেকে একটা এক কুইন্টাল ওজনের ধানের বস্তা পেছন থেকে ছিটকে পড়ে গদিতে বসে থাকা সুমনের বাবার পিঠে । ঘাড়ে ও মেরুদন্ডের হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁর । উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা ছেড়ে সুমনকে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে । বাবার চিকিৎসা ও সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে সুমনের কাঁধেই । বাবার চিকিৎসার জন্যে সব সহায় সম্পদ বিক্রি করেও বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারেনি আর । এরপর নানারকম ছুটকো পেশা, প্রাইভেট পড়ানো ইত্যাদি করে চলতে থাকে সুমনের জীবনযুদ্ধ । বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে জীবনের পাঠ নিতে থাকে সুমন । সেইসঙ্গে কবিতাযাপনও সমানে চলে । সেকারণেই সুমনের কবিতাও প্রাত্যহিক জীবন অভিজ্ঞতার স্পষ্টতায় উজ্জ্বল । আমি সুমন পাটারির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি নিবিড় পাঠ করার ও আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম সেদিন । একদম জোরালো কব্জিতে তোলা ভাষাই সুমনের কবিতা ।
কার্যকারণে অনেকদিন দেখা হয়না । কিছুদিন আগে সেলিমদা ধর্মনগর থেকে 'পাখি সব করে রব'-র বিশেষ সংখ্যা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে । দক্ষিণ ত্রিপূরার কয়েকজন কবির কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে । সুমনের কপিও ছিল । কিন্তু আমি যেদিন বাইখোরা যাই সেদিন ও বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকায় আর দেখা হয়নি । ওর কপিটা কবি তারাপ্রসাদ বনিকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম ।
নোয়াখালি অ্যাকসেন্ট থাকে সুমনের কথাবার্তায় । মনে হবে আনস্মার্ট এক গ্রাম্য যুবক । সুমনের ইংরেজি উচ্চারণ ও অনর্গল কনভার্সেশন শুনলে অনেকেই চমকে যাবেন । বাহ্যিক দর্শনে রাজ্যের মেধাবী ও গুণী এই তরুণকে চিনতে অনেকেই ভুল করবেন । সুমন যদি তার উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারত তবে আজ সে একজন নামজাদা আইটিয়ান হতে পারত । অথবা বড়ো কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আসীন থাকত ।
যাই হোক, লক্ষ্মীর ঝাঁপির ভেতরের রজতকাঞ্চনের ভান্ডার হাতে না এলেও সরস্বতীর বীণাতন্ত্রীতে ঝংকার তুলে তার শব্দকথা বহুদূর ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, আমার সন্তানপ্রতিম রাজ্যের গর্ব সুমন পাটারি । তোমাকে স্নেহ ও আদর হে কবি !
অশোকানন্দ
২৫. ৮. ২০২২.
No comments:
Post a Comment