দ্রোহ ও দাহভরা 'আগুনপাখি'
আমাদের চারপাশে অহরহ অসংখ্য কবিতা সৃষ্টি হয়ে চলেছে । সেই সমস্ত কবিতায় কতটা জীবন আছে, কতটা সাহস, প্রেরণা কিংবা সান্ত্বনার অভিব্যক্তি রয়েছে তা মূল্যায়ন করা কবিতার এক ধ্রুব ইঙ্গিত । সময়ে সময়ে কবিতার সৌন্দর্য দর্শনে জীবনকে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যায় । এক এক কবিতায় এক এক দৃষ্টিতে জীবনের আলো-ছায়ার রং বদল ঘটে এবং বস্তুবাস্তবের অর্থ ও তাৎপর্য অনেক পাল্টে যায় । কবিতার কথা তার জীবন তার দাহ দ্রোহ কবিকে চিহ্নিত করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ১৫ আগস্ট ২০২১ জ্ঞানবীক্ষণ, উদয়পুর, ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত রূপন মজুমদারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আগুনপাখি'র বারোটি কবিতায় সেই অনুভবই ধরা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।
কবি রূপন মজুমদার মজুমদার এই সময়ের এক শক্তিমান তারুণ্য । তার কবিতা জীবনের ঘাত প্রতিঘাত এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে অনুসরণের কথা বলে বারবার । তার কবিতায় দেখি–' মাটি আঁকড়ে বেঁচে থাকা/আমার পূর্বপুরুষের রক্ত ঘাম (রক্ত ঘাম) অথবা 'বাবার রেখে যাওয়া সেই.../জামাটির গায়ে/ এতকালের লেপ্টে থাকা ঘামের গন্ধ/ কেমন যেন বারুদ বারুদ ঠেকাচ্ছে । (উত্তরাধিকার সূত্র) । এই উত্তরাধিকারকে, এই কর্মময় জীবনকে পুরুষানুক্রমে ধরে লালন ও যাপন করার কথা কবিরূপন মজুমদার বারবার বলেন তার কবিতায় । 'সেই কাজ ফুল হাতে আসবে ঠাকুরদাদা থেকে বাবা/ এভাবে একদিন বাবা থেকে আমি..../ যার ভার বইতে বইতে আমার মেরুদন্ড বেয়ে যায় ।'( ফুল )
কবিতা রূপনের কাছে দ্রোহপ্রতীক । 'জ্বলন্ত ইশতেহারে রেখেছি হাত,/ আগুনে পুড়ছে পান্ডুলিপি/ ছিড়া জিন্সের পকেটে রাত্রি ভরে/পুড়ে যাওয়া দুহাত মেলেছি ।' (আড়ি-১) অথবা 'আমার শরীরে পা রেখে.../ দ্রোহের কবিতার অন্তরীণ আগুন/ জ্বলে ওঠে নীরবে ।
নিলাম হয় প্রত্নপ্রভাত আর.../ হরিৎ মাটির সোঁদা গন্ধ । তবু পেশী টান টান করে ধরে রাখে বেঁচে যাওয়া ভয়ার্ত স্বরলিপির সুর ।/আগুনপাখি)এবং বারবার ব্যর্থ হয়ে মাতৃভূমির প্রতি শিশুময় অভিমানে বলতে পারেন 'সাথে পড়ছে চোখের ঘুম/ নিলাম ওঠা বউয়ের শাড়ি/ ভরা জনসভায় দাঁড়িয়ে বলছি/ ভারত বর্ষ তোমার সাথে আড়ি । /আড়ি-২)
তরুণের রক্তে ক্রোধ, বিক্ষোভ অবশ্যম্ভাবী । অবহেলা আর বঞ্চনায় ক্রুদ্ধ হলেই কবি অনায়াসে বলে উঠেন 'এখন অক্ষর দেখলে জোট বাঁধতে ইচ্ছে করে । ঠিক যেমন করে বাধে রাজনৈতিক নৈশ প্রহরীরা' ।( অভ্যাসের আগুন ) 'আবার অখন্ড অন্ধকার সহস্ত্র পদচরণে/ বেড়ে ওঠে বৈঠাহীন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে/কত মানুষের খেরওয়ারি হুল (পাহারা) 'পেরেক বিছানো পথ হেঁটে যেতে যেতে.../ মুছে দিই ধুলোর উপরে যাবতীয় ইতিহাস ও সম্ভাবনা' (পাহারা)
মস্তিষ্কের কোষে এত যে দাহ, এত যে যন্ত্রনা তবুও কবির 'ইদানিং ঈশ্বর দেখতে ইচ্ছে করে/চোখ বুজলেই দেখি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বৈভব ।/মিছিল ঝুলছে রাত্রিদিন ।(ঈশ্বর)। ঈশ্বর কিংবা দৈব নিয়ন্ত্রিত জীবনে কবির মুক্তি আসেনা । আসে না তৃপ্তি ।জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত হয় । তবুও জীবন ঘনিষ্ঠ কবি জীবনকে ভালোবেসে যান । আর 'আড়ালে উঁকি মেরে দেখি,/ জোনাক মুখ পুড়ছে চিতাকাঠে ।/কংক্রিট বিছানো কযোজন ভূমি পেরিয়ে গেলে,/ সিগনালের ওই পাড় হতে কারা যেন স্থির বিশ্বাসে ডাকে/মিশে যেতে গহীন অন্ধকারে'।(সিগন্যাল) কিন্তু হতাশায় নিমজ্জিত হতে চান না কবি জীবনের শেষেও আবার এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেন ।ফিরে ফিরে আসতে চান এই মাটিতে । কবি বলেন 'আমার লাশ পোড়া মুঠো মুঠো ছাই,/ তোমার ভরসাবৃত মাটিতে ছড়িয়ে দিও,/ আমি গঙ্গায় ভেসে বিলীন নয়/ এ মোহিনী প্রকৃতি মানুষের মাঝে থাকতে চাই '(ছাই)।
প্রথম প্রয়াসেই বাংলাকবিতার অঙ্গনে কবি নিজেকে জোরালোভাবেই হাজির করতে পেরেছেন ।
No comments:
Post a Comment