প্রশ্ন: নমস্কার স্যার, আপনি কেমন আছেন?
উত্তর: নমস্কার । ভালো আছি আমি ।
প্রশ্ন: বর্তমানে অবসর জীবন কিভাবে কাটছে আপনার?
উ : কই ? আমার অবসর কোথায় ? সাংসারিক দায়দায়িত্ব, নানা সামাজিক কাজকর্ম, লেখালেখি, বইপড়া, ঘোরাঘুরি ও ঘুম । এই নিয়ে চলছে বেশ ।
প্রশ্ন: আজকের দিনে সাহিত্যে অনেকটা ব্যাপ্তি আপনার।সাহিত্যে আপনার হাতেখড়ি পর্বের কথা শুনতে চাই
উ: সাহিত্যপাঠে ও চর্চায় আমি এখনও শৈশব কাটিয়ে উঠতে পারিনি । স্কুলে পড়াশুনার সময় থেকেই টুকটাক ছড়া কবিতা লেখালেখির মধ্য দিয়ে সাহিত্যচর্চার হাতে খড়ি । আমার সৌভাগ্য যে, বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে গল্পকার মানিক চক্রবর্তী, দেবতোষ চৌধুরী, সদ্যপ্রয়াত কাশিনাথ দাশ, সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী,প্রাণতোষ কর্মকার, মাণিকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিক্ষকদের নিবিড় স্নেহসাহচর্য পেয়েছি । তাঁরাই আমার লেখালেখিতে প্রেরণা জুগিয়েছেন । কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ম্যাগাজিন আমার প্রথম লেখালেখির প্ল্যাটফর্ম । বিলোনিয়া কলেজজীবনে অধ্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সরকার ( খ্যাতিমান ভাষাগবেষক পবিত্র সরকারের অনুজ ) প্রমুখ এবং হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, হরিভূষণ পাল, ভূপাল সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত, সুবোধ কংসবনিক ও কৃষ্ণকুসুম পালের যত্ন পেয়েছি আমি । হরিনারায়ণদা আমাকে খুব কাছে কাছে রাখতেন । সে সময়ের তরুণ গল্পকার রুমা পাল আমার লেখালেখির নিবিড় পাঠক ও সমালোচক ছিল । কিন্তু শক্তিময়ী রুমা একসময় লেখালেখি থেকে একদমই সরে যায় । যা আমাদের সাহিত্যপরিমন্ডলে তথা বাংলাসাহিত্যের জন্যে এক বিরাট ক্ষতি বলে আমি আজও মনে করি । আমার বাংলায় স্নাতকোত্তর যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমার গ্রামের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন মজুমদারের( কবি রূপন মজুমদারের দাদু ) প্রত্যক্ষ অবদান আমি কোনোদিন ভুলবনা । পরবর্তী সময়ে রাজ্যের পরিমন্ডলে লেখালেখিতে অগ্রজ কবিমানস পাল ও নকুল রায় জাগরণ সাহিত্যবাসরের ও সৈকত সাময়িকীর মাধ্যমে হাত ধরে তুলে এনেছেন । প্রয়াত কবি অরুণ বনিক আমার দুঃখের দিনের মরূদ্যান ছিলেন । আমাকে তিনি পাঠসমৃদ্ধির জন্যে বহু বইপত্র জুগিয়ে গিয়েছেন । আমার বইপড়ার অভ্যাস ছোটোবেলা থেকেই । স্কুলবেলায় পেয়েছি স্কুল লাইব্রেরির সুযোগ । সেখানে সরকারি কোয়ার্টার্সে থাকতেন চিকিৎসক দম্পতি ডা. মুকুন্দলাল বসু ও ডা. লীলা বসু । তাঁদের একমাত্র সন্তান শিবাজী বসু বয়সে একটু ছোটো হলেও খেলার সাথী ছিল । তাদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল । সেখানে বাছাই করা সব বই, পুজো সংখ্যা, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদের বিশাল সংগ্রহ ছিল । আমি নাইন টেনে পড়তেই সেগুলো শেষ করেছি । তাঁরা সেসময় নবকল্লোল, শুকতারা ও দেশ পত্রিকা রাখতেন । আমার বাবা রাখতেন জাগরণ ও অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার । তারপর কলেজ লাইব্রেরি, বিলোনিয়া ও সাব্রুমের পাবলিক লাইব্রেরির সুযোগ তো পেয়েছিই । আর অনবরত উৎসাহ জুগিয়েছেন রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিব্যেন্দু নাগ ও দিলীপ দাস । প্রবন্ধচর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ভূপেন দত্তভৌমিক ও মৃণালকান্তি কর । লোকসংস্কৃতির পাঠ নিয়েছি ড. রঞ্জিত দে ও ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর কাছে ।
প্রশ্ন: এ যাবৎ আপনার ক'টি বই প্রকাশিত হয়েছে?
উ: পাঁচটি । বিনীত চুম্বন ( কাব্যগ্রন্থ ), ভার্চুয়াল রাই ( কাব্যগ্রন্থ ), ত্রিপুরার লোকজীবন ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), লোকসংস্কৃতির তত্বরূপ ও স্বরূপসন্ধান ( প্রবন্ধ ), মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি (সম্পাদিত প্রবন্ধ ) ।
প্রশ্ন: সাহিত্যের কোন শাখায় অধিক যাপন আপনার এবং কেন?
উ: কবিতা এবং কবিতাবিষয়ক গদ্যরচনা । কারণ কবিতাই আমার প্রথম প্রেম । কবিতায় আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি । জগৎ জীবন প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে আমার অনুভব, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, হতাশা, সংক্ষোভ, শ্লেষ, প্রতিবাদকে আমি কবিতার মাধ্যমেই প্রকাশ করতে অভ্যস্ত । আমার আত্মপর্যবেক্ষণের শব্দরূপও কবিতা ।
প্রশ্ন: লোকসংস্কৃতি গবেষণায় সুদীর্ঘ ব্যাপ্তি আপনার। ঠিক কিসের নেশায় এটাকে নিয়ে এতো চর্চা?
উ: ব্যাপ্তি শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে । ব্যাপ্তি শব্দের অর্থ বিশালতা । যা আমার আদৌ নেই । আমার শুধু তৃষ্ণা আছে । অপার তৃষা । তৃষ্ণা মেটানোর জন্যেই আমি আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের উৎসজলসত্র খুঁজে ফিরি । লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির সমূহ আত্মবীজ । সেখান থেকেই ছড়ায় তাবৎ সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা । যে জাতির লোকসংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি সামগ্রিকভাবে তত সমৃদ্ধ । হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির শেকড় সন্ধান । সমাজেতিহাস সন্ধান । এই অনুসন্ধানও এক তীব্র নেশা । খুঁজতে খুঁজতে কত গভীরে চলে যাওয়া যায় । অরূপরতনের ভান্ডারে প্রবেশ করা যায় । একটা জাতির দর্শনকে উপলব্ধি করা যায় । সেই জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় জাতির গৌরবমন্ডিত অতীত । ইতিহাসেরও উপাদান । নেশাটা আমার ঠিক এখানেই । অতীতসমুদ্রে ডুবে থাকা মূল্যবান সাংস্কৃতিক বৈদুর্যমণি তুলে আনার ডুবুরির ভূমিকায় নবিশ আমি । 'ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন' । এ নেশাই আমার জন্মতিলক ।
প্রশ্ন: সাহিত্যের এ সুদীর্ঘ যাপনে যদি আপনার কোনো অভিমান, অভিযোগ,ক্ষোভ বা বিরক্তির কথা জানতে চাই, জানতে পারি কী?
উ: জীবনপথ তো কুসুমাস্তীর্ণ নয় । পায়ে ফোস্কা পড়বে বলে কী পথ চলবনা ? ' ভালোমন্দ সুখদুঃখ অন্ধকার আলো / এই নিয়ে ধরনির সবকিছু ভালো ।' নইলে সবই মিছে । কাজেই এসব মনে রেখে লাভ নেই । যেখানে মনান্তর ঘটে, বা মনে ব্যথা পাই, সংঘাতে যাইনা । নিরবে সরে আসি । আমার নিজস্ব অপূর্ণতা মনে করে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করি । আমার প্রাপ্ত অভিমান, অনুভবগুলো মনে গভীরে থেকে সৃষ্টির প্রেরণাদায়ক । নিজের কাছে নিজে কতটা সৎ , দিনান্তে চোখ বন্ধ করে সেটা ভাবি সর্বদা ।
প্রশ্ন : কখনো কখনো দেখা যায় একটা অদৃশ্য শক্তির ভয়ে থমকে যায় কলম-- বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
উ: হ্যাঁ ,এরকমটা তো দেখা যায়ই । এটা সবটাই মননের ম্যাচুরিটির বিষয় । চেতনার উৎকর্ষতার স্তরানুযায়ী ফল ।সমৃদ্ধচেতনা ব্যক্তিকে অকুতোভয় করে । জীবন ধরা দেয় স্বচ্ছ কাঁচের মতো । ব্যক্তিকেন্দ্রিক বাসনা অতিক্রম করতে না পারলে নিজের চৌকাঠ থেকে বেরুনো যায়না । চেতনাদীপ্ত প্রাণ কোনো পরাশক্তিকে ভয় পায়না । ঊণচেতন দোলাচলে ভোগে । ভোগে সিদ্ধান্তহীনতায় । তার কলম সুযোগসন্ধানী । কর্তার ইচ্ছেতে যে কীর্তন করে তার কালির তলানিতে থাকে সেডিমেন্ট । শক্তিমান কর্তার বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কলম থিতু হয়ে যায় । সুদিনে যে কলমবাজ সুযোগের সন্ধানে মিছিলের অগ্রভাগে ব্যানারবাহক হয় সেই দুঃসময়ে সটকে পড়ে এবং নবব্যানারের লুব্ধবাহক হয় । তারই থাকে অদৃশ্যশক্তির রক্তচক্ষুর ভয় । প্রকৃত কলমশিল্পীর অদৃশ্যশক্তির ভয় নেই । কলমও থমকায়না তাঁর । তিনি চেনেন অশুভশক্তিকে । তাঁর স্পষ্ট ও দৃঢ় কলমকারি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে । দুঃখেও । দ্রোহেও । ফলে প্রিয়জনেরও তিনি বিরাগভাজন হন । যেখান থেকে তিনি সম্মান স্বীকৃতি পাওয়ার কথা সেখানেই তিনি বঞ্চিত হন । সুযোগসন্ধানী এবং স্তাবক সুবোধরূপী গোপাল ননীভান্ড হাতিয়ে নেন । কিন্তু প্রকৃত শিল্পীর কলম থামেনা । আঁচড়ে আঁচড়ে সমাজের ক্ষত , অশুভশক্তির মুখোশ উন্মোচন করেন তিনি ।
প্রশ্ন: রাজ্যের দক্ষিণ জেলার বাসিন্দা আপনি। দক্ষিণ জেলার অধিকাংশ মানুষ নোয়াখালি ভাষায় কথা বলে। এ ভাষায় সাহিত্য বা সৃষ্টিকর্মের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মতামত কী?
উ: কথায় বলে নোয়াখালির লোক নাকি আফ্রিকার অরণ্যেও নাকি পাওয়া যায় । নোয়াখালি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষের ভাষা । আমাদের অন্তর্গত অর্জন । পরিচয়ের ঠিকুজি । তার বিশাল লোকসাংস্কৃতিক ভান্ডারও রয়েছে । ভুল উচ্চারণে মান্য বাংলা বলা বা বাচ্চাদের শেখানোর অপপ্রয়াস করার চাইতে ব্রাত্য আঞ্চলিক ও পূর্বপুরুষের ভাষা নোয়াখাইল্লা উচ্চারণ অনেক ভালো । নোয়াখালি ভাষাতেও যে বৈচিত্র্য আছে সেটা জানতে হবে । জানতে হবে বৃহত্তর নোয়াখালির ইতিহাস । কুমিল্লাসীমান্ত সন্নিহিত লাকসম, চোদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ, ভোলা, নোয়াখালি, মূল ভূখন্ড, নোয়াখালির সন্দীপ, চরবদু ইত্যাদি চরাঞ্চল, চট্টগ্রাম সীমান্তসংলগ্ন মীরসরাই, সীতাকুন্ড,ফেনীনদীর তীরবর্তী শুভপুর, মুহুরীগঞ্জ, খন্ডল পরগণা, লক্ষ্মীপুর, কোম্পানীগঞ্জ ইত্যাদি নোয়াখালি ভাষাভাষী অঞ্চলের উচ্চারণে কিছু কিছু ফারাক রয়েছে । উচ্চারণ শুনে বুঝতে হবে বক্তা কোন অংশের বাসিন্দা । আমাদের রাজ্যেও অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বিরাট অংশে নোয়াখালি ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত । রাজ্যের অন্যত্র ও কম বেশি এই ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন । এই জনবিন্যসটা স্পষ্ট জানা থাকা দরকার । এটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার । সাহিত্যসৃষ্টিতে এই জ্ঞান অতি অপরিহার্য । অন্যথায় তর্ক চলতে থাকবে কে ঠিকঠাক নোয়াখালি ভাষাব্যবহার করছেন তা নিয়ে । বাংলাদেশে এই ভাষা নিয়ে কাজ হচ্ছে ভালোই । নোয়াখালি ভাষায় নাটক রচিত হচ্ছে । সংবাদ চ্যানেল কাজ করছে । সোস্যাল মিডিয়া, ইউ টিউবে চর্চা হচ্ছে । অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই ভাষাব্যবহারে আগ্রহী ।
আমাদের রাজ্যেও নোয়াখালি ভাষায় কিছু কিছু সাহিত্যসৃষ্টি বিচ্ছিন্নভাবে হয়ে আসছে । এই চর্চা আরও নিবিড়ভাবে হওয়া দরকার । বিশেষ করে কথাসাহিত্যে এই ভাষাটি ব্যবহার করে দক্ষিণ ত্রিপুরার জীবনচিত্রের বাস্তব রূপ দেওয়া যায় । শুধু ভাষা নয় । নোয়াখালিভাষীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও যাপনচিত্রও স্থান পেতে পারে সাহিত্যে । ফলে এই জেলার সাহিত্যের একটা নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হবে । যা পক্ষান্তরে বাংলা আঞ্চলিক সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করবে ।
প্রশ্ন: ত্রিপুরার তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য আপনার বিশেষ পরামর্শ কী হবে ?
উ: ত্রিপুরার তরুণ কবি সাহিত্যিকরা প্রচুর লিখছেন এখন । ভার্চুয়ার দুনিয়ার সুবাদে তাঁরাও আজ বিশ্বপথিক । কাজেই সৃষ্টির মানের উত্তরোত্তর উন্নতি না ঘটালে টিঁকে থাকা যাবেনা । তার জন্যে লেগে থাকতে হবে । প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে । প্রশংসার চোটে আত্মম্ভরী হলেই বিপদ । সাপলুডোতে অনেক উপরে উঠেও সাপের মাথায় পড়লে যা হয় তা পড়তে হবে । অন্যের লেখা পড়তে হবে মনযোগ দিয়ে । নিজের লেখার নিজেই সমালোচক হতে হবে । তাতেই আসবে সিদ্ধি ।
No comments:
Post a Comment