কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক
জীবনের দুই চেতনা । একটা বাইরের । আরেকটা ভেতরের । বহির্চেতনা আর অন্তর্চেতনা । বাইরেরর চেতনা মৌমাছির মতো আহরণ করে প্রকৃতি মকরন্দ ।আর সেই মকরন্দ জমা হয় অন্তরের মৌচাকে । রূপ নেয় মধুতে । জীবনের মধু-আর মননের মধু । বাইরের চেতনার আদিগন্তপাথার থেকে অন্তর্চেতনার মায়াঅলিন্দে । এই পরিনিমজ্জন ও পরিব্রাজন, এটাই মগ্ন চেতনার কেলিকুহেলি । মগ্ন চেতনার সহজসাধনায় প্রাণবিন্দু জেগে ওঠে । সৃষ্টি পা রাখে শিল্পের পৈঠায় । শিল্প হয়ে ওঠে প্রকৃত ও প্রাকৃত শিল্প ।
প্রতিটি সত্তা বাইরে ব্যক্তি । অন্তরে শিল্পী । কবিও অন্তর্লোকের শিল্পী । মগ্নসংসারের কারিগর । মাটির তাল নিয়ে শিল্প গড়ে মৃৎশিল্পী । এই মাটি যতক্ষণ ভূমিতে ততক্ষণ মাটি । শিল্পীর হাতে তা হয়ে ওঠে পার্থিব বস্তুর প্রতিরূপ প্রকৃতির নিপুণ সৌন্দর্যকে আহরণ করেন তিনি । আর আরোপ করেন তা নিজের সৃষ্টিতে । তাঁর মগ্নচেতনায় সৃষ্টিকে সুন্দর করার গোপন কৌশলগুলি জেগে ওঠে । শিল্পী সে কৌশল প্রয়োগ করেন তাঁর সৃষ্টিতে । বাইরের উঠোনের সৃষ্টিকে প্রাণিত করার তাগিদে অন্তরের প্রকোষ্ঠেও প্রবাহিত হয় আর এক সৃজনবাতাস । জেগে ওঠে কুলকুণ্ডলিনী, সৃষ্টিসম্ভবা ।
কবির অন্তরে বাহিরেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে নিরন্তর । কবির সামনেও আছে প্রকৃতি । সে চিরন্তনী নারী । যাকে ভালোবেসে আশ মেটে না । যাকে দেখে দেখে নয়নের পিপাসা পরিসমাপ্তি হয় না । যার রূপ অরূপ, অপরূপ, সাগরপ্রতিম । সেই গহীন সাগরে ডুবে মরতে চান কবি । কিংবা চান অলীক রত্ন সন্ধান করতে । সে এক অনিঃশেষ কল্পমৈথুনে যুগনদ্ধ হন কবি ও প্রকৃতি । জগৎ সৃষ্টির আদিকারণ নারী । আর আদিরমণী প্রকৃতি । প্রকৃতি আদ্যাশক্তি । প্রকৃতির শক্তিতে পুরুষ শক্তিমান । প্রকৃতির শক্তিতে কবি হন শক্তিমান । যার নাম কবিত্বশক্তি । প্রকৃতি ভিন্না । কবি ভিন্ন । আবার কবি ও প্রকৃতি অভিন্ন অবশ্যই ।
কবি ও প্রকৃতির পারস্পরিক শৃঙ্গারফসল কবিতা । প্রকৃতির আশ্লেষে নিষিক্ত হয় শব্দডিম্ব । কবির শুক্ররক্তের কল্পনারসের সঙ্গে শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয় কাব্যভ্রূণ । এ এক পরাবোধিক প্রক্রিয়া । 'আলে গুরু উঅসই শিষ, / বাকপথাতীত কাহিব কিস / গুরু বোব সে শিষ কাল, / যত ভি বোলই / তত ভি টাল ।'–এর বর্ণনা বাক্যপথের অতীত । এর ভাষা অনুক্তপ্রয়াসী । এখানে এসেই মোড় নিতে হয় পথের । 'প্রভু কহে এহো বাহ্য, / আগে কহ আর ।'
কবি জীবনদাতা । কবি শব্দের জীবনদান করেন । শব্দের ব্যবহার হয় কবির হাতে গূঢ়ভাবে । সাংকেতিক অর্থে । কবির নিজস্ব ভুবনে শব্দ হয়ে ওঠে নবীন চিত্রভাষ্য । প্রতিটি শব্দের যে স্বাভাবিক চিত্রকল্প, চেনারূপ মানসপটে নিহিত থাকে তার মধ্যে কবির ব্যবহৃত শব্দ আনে নতুন ভাষা, নতুন রূপ, নতুন ছলম । অর্থের দিক থেকেও এক নতুন জাদুকথার যেন সৃষ্টি হয় । কবির মননে এবং দর্শনে এক সান্দ্র ভাষাশৈলী তৈরি হয়ে যায়, যা কবির এক নিজস্ব ভাষাভূগোল । নিজস্ব ছন্দবাতায়ন । একান্ত আপন কাঁঠালিচাঁপায় সাজিয়ে তোলেন কবি ।
শব্দ যদি প্রকৃতির ভ্রূণ, কবি যা লেখেন প্রকৃতি নিয়ে লেখেন । কবির যা খেলাধুলো । শব্দকে নিয়েই সে সব । সব শব্দই যেন তার চেনা । শব্দ কে স্পর্শ করে তিনি অনুভব করতে পারেন । শব্দের ঘ্রাণ তাঁকে মাদকতা দেয় । সৃষ্টির মাদকতা । শব্দের চিত্র তাঁর কল্পনাকে রৌদ্রমাখা আকাশে ওড়ার সাহস যোগায় । শব্দের ছবি মেঘবজ্রকৃষ্টির নভোকালিমায় ভীরু বিরহী করে তোলে । শব্দকে কেমন ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা কবির নিজস্ব পাকশৈলী । তাঁর মননতাঁতে কবি শব্দ সাজান টানা ও পোড়েনে । তার উপর দেন কারুজ্যামিতিক চিত্রকথা আর অলংকারের ছন্দিত কোলাজ । আর তাও শব্দেই সৃষ্ট । একটা আশ্চর্য উদ্ভাসিত ধানভূমি তৈরি করেন কবি তাঁর বয়নে । এ বয়ন চলতেই থাকে তো চলতেই থাকে । কবি থেমে থাকেন না । বুননে বয়নে ভরাট হয়ে উপছে পড়ে তাঁর সৃষ্টি । তাকেই বলি কবিতা । কবিতার কোন থামা নেই । কবিতার কোন অবকাশ নেই । এক মহা প্রান্তরকে ক্রমশ ছেয়ে ফেলার জন্য তার উড়াল কিংবা ভাসান কিংবা পদযাত্রা ।
তুমুল গৃহশ্রমে মগ্ন থেকেও কবি যেন নিঃসঙ্গ কীর্তনীয়া । গেয়ে ফেরেন ভোরাই একাকী । জনপদ থেকে জনকোলাহলে । বিষন্ন সায়াহ্নে কবি শব্দের ভিখারী হয়ে ওঠেন। হয়ে যান শব্দের কাঙাল । প্রাত্যহিকের পরিখাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কবির অভিসার । কোন ঘেরাটোপ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না । কোন দুর্বার বেড়ি তা়ঁকে বেঁধে রাখতে পারে না । বাস্তববন্দি শিবিরে অন্তরীণ থেকে খুঁজে নেন উন্মোচিত পরিসর ।
কবির প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি ক্ষণের চর্যায় তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পারলেও কোন ক্ষতি নেই । কবি প্রতিদিন তার শরীরভাষাকে অবগুন্ঠিত রেখে নিভৃতে চর্চা করেন কবিতাযাপনের । অনুশীলন করেন কবি হয়ে ওঠার । কবিতা নির্মাণের করণকলা অধ্যয়নের । তার যাবতীয় অধ্যাবসায় শব্দকে নিয়ে । সামগ্রিক আয়াশ কবিতার জন্যে । জীবন ও সন্ন্যাস এই দুই পরস্পর বিপরীত চর্যার বিরোধাভাসকে কবি প্রয়াসঅভিঘাতে ক্রমশ চূর্ণ করে দেন ব্যবধানের দেয়াল । জীবনের মধ্যে থেকেও কবি সন্ন্যাসকল্প পুরুষ । এ দুয়ের রসায়নে কবি খুঁজে পেতে চান আশ্চর্য সব কাব্যরহস্য ।
কবির অন্তরে এক অনন্ত দহন । 'মন পড়ে সখি জগজনে জানী । বন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী ' । কবিও পোড়েন ।কবির অন্তর পোড়ে । পুড়তে পুড়তেই কবি দেখেন জগত । কবি অনুভব করেন জীবন । মনপোড়া কবির উপলব্ধির ঘটে কাব্যিক উন্মোচন । দগ্ধচিত্তে দেখেন আদিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত আকাশ ।কবি চিনে উঠতে পারেন তাঁর চিরপরিচিত আসমুদ্র সংসারক্ষেত্রটিকে । তাঁর মাথার উপরে আকাশ শূন্য । তাঁর পরিচিত ভূমি প্রদেশ চলিষ্ণুতায় উচ্ছল । এই উচ্ছলতার যে জলধিসুনামি তাই কবিকে তোলপাড় করে । জীবনের মুহূর্মুহূ বদলে যাওয়ার বর্ণের বিচ্ছুরণে হয় কবির অন্তরের ইন্ধন । কবি জ্বলে উঠেন বারবার ।
কবির দেহেও আছে ষটচক্র । কবির সাধনাও দেহতাত্ত্বিক । কবির শরীরেও আছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ি । কবি তাঁর সাধনায় প্রকৃতি ও জীবনরসের মায়াভ্রমণ ঘটান তার শরীরময় । নাভিপদ্মে নিদ্রিতা কুন্ডলিনীকে জাগান তিনি কাব্যিক ইশারায় । শব্দের পর শব্দের বাণসৃষ্টিতে তিনি কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দেন । সেখানে ঘটে প্রকৃতি ও পুরুষের অদ্বয়মিলন । কবিও জীবনের মিলিত পরমানন্দ । এ আনন্দই কাব্যের মহাভাব । এ আনন্দ ই 'মহাসুহসঙ্গ' । এটা কবির অন্তরের স্থায়ী আনন্দ । যার জন্য কবির অনন্তবাসর । যার থেকে কবির সিদ্ধি । কবির শরীরে তখন আসে কবিতার জোয়ার । কবি তাকে প্রবহমান রাখেন তার ইচ্ছানুরূপ । এভাবেই কবি পান স্থায়ী আনন্দ ।চিরসুখ । কবির পর্যটনসার ।
No comments:
Post a Comment