ঘ্রাণের উল্লাস, স্নানের পয়ার
ভালোবাসা মুগ্ধ অন্তরের পদাবলি ।
ভালোবাসা শুধু নিঃস্ব করে না । হৃদয়ের আত্মীয়ও করে । আর সেই ভালোবাসা যদি হয় কবিতায় সহবাস, তাহলে সেই হংসধ্বনি সমোচ্চার আন্দোলিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে । কবিতার অনুভবে যারা ঋদ্ধ তারা পরস্পরের আত্মার ধ্বনি শোনে । হৃদয় থেকে বেরিয়ে এ নিনাদ দেশকালের সীমা টপকে যায় ঋজুগতিতে । এক চিরায়ত বন্ধন সৃষ্টি হয় আত্মীয়তার মতো । স্থানিকতা থেকে মহাস্থানগড় । উৎস থেকে অনন্তবাথান । এক অদৃশ্য হাওয়াপথ তৈরি হয়ে যায় অমোঘ কলকন্ঠে । ঘন বনে ঢাকা টিলাপথের শেষ প্রান্তের উত্তুঙ্গ টংঘর থেকে হাইটেক প্রাসাদের অন্তঃকোন অবধি ।
কবিতার দীঘল শরীর যখন বুনো নৈঃশব্দ্যের থেকে উঠে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে, তার শরীর থেকে সরে যায় সমস্ত প্রাকৃত বাকল । অন্তর্লীন রহস্যের সাত সমুদ্দুর উদোম খেয়াঘাটে যেন প্রণয়প্লাবন ছড়িয়ে দেয় । ফিনকি দিয়ে উঠে শীৎকারবগাথা । কামগান । বিগত শ্রাবণে অবিশ্রান্ত স্নানের পর তার শরীরে মেদুর কারুকথা ভেসে ওঠে । মুক্তোর রেণুর রুপালি জলজ ভ্রূণ কুহকবার্তায় টেনে আনে সৌররশ্মি । থেকে থেকে উড়ালপাঁচালি আর গোধূলিতানের নম্র সুর বেড়ে ওঠে মুগ্ধ চরাচরে । তখন ক্ষীরনদীর ধারা যেন অবিরল ভেসে যায় পাললিক জ্যোৎস্নার অলৌকিক চরাচর
পথে ।
তোমার আমার মাদকনির্যাস হে কবিতা, ভূর্জপত্রের ঠোঙায় ভরে রেখে দেবো অমোঘ জীবনে । আমি আজ আর্যপুত্র, তুমি আর্যনারী । আমাদের মিলনবাসনার পানশি ঝরেপড়া শিউলি তুলে নেবে । কামে ও প্রেমে টইটুম্বুর করে দেবে আমাদের প্রণয়সন্ধ্যা । জীবনের আসন্ন কৌমকোমল বার্তা অবিনাশী সমর্পণের মায়ায় বিদগ্ধ শিস দিয়ে যাবে বিষাদের হাটে । কলকল কথাপুঞ্জ অনিঃশেষ স্রোতে গড়িয়ে যাবে পাতাসবুজ অরণ্যের গা ঘেঁষে । শব্দের পর শব্দের সাতকাহন পলিমাটির গভীরে চলে যাবে । মানুষ আর মানুষীর চিরন্তন কথাই তোমার বশীকরণভাষা । এই ভাষাতেই অনন্তজীবন আর মৃত্তিকামৃদঙ্গের তান । দেহাতি চাঁদের ওলান থেকে ঝরে পড়া সন্ধ্যার নস্টালজিয়া নিঃসঙ্গে হেঁটে যায় অনন্তের আলপথে । একথা জানে আখড়ায় বাউলের কন্ঠ ।
লোকচরাচরে শেষ উপত্যকা পেরিয়ে মহাবিশ্বের রহস্যের দিকে যাত্রা কবিতার । সেই মহাসড়কে জোছনার ডিঙা আছে কিনা কে জানে ! সেখানে চলে কি জীবনতাঁতির অনন্তবয়ন ? সেখানে কি খলনারীর ফাঁদ পেতে রাখে বিষকন্ঠী মরণবালা ?
এ দুয়ের দ্রোহে আর প্রেমের কবিতার অভিযাত্রা । মহাকবিতার সৃজন । এ এক আঁধারঘেঁষা ছলাখেলা । এখানে কবি অবোধ খেলোয়াড় । তার উষ্ণীষ গড়ায় শব্দের ভূমিতে । জগত বালুকার বুকে লেখে সে জীবনের আদ্যপাঠ আর মরণের বিরহপত্রিকা । এইসব শব্দপুঞ্জে জেগে ওঠে আনন্দজলধারার কবোষ্ণ দুপুর ।
রোদ্রের লালনগীতি সুরের প্লাবন নিয়ে মেঠোশরীরে উঠে আসে কাম নদীর জল ভেঙে । সঞ্জীবনীকথায় পাতাঝরা কথক পরকীয়া প্রহরে গোধূলিছায়ায় পবিত্র গলায় মায়া শোলক আওড়ায় । সমস্ত শব্দের অর্থ তখন মধুকূপী ঘাসের মতো শরতের বাতাসে নেচে ওঠে । উত্তরের দৈববাতাস হরিহর প্রতিমার যুগলমূর্তিকে ফিনফিনে কাঁপন দিয়ে যায় । কলঙ্কের টিপ খুলে চন্দ্রকরোটি যেন অষ্টমঙ্গলার ঘরের দেওয়া অবধি উঁকি দিয়ে দেখে । মানুষবিহীন খেয়াঘাটে তখন কাঁপতে থাকে অনাথ নৌকো আর মুমূর্ষু নদী । নিবিড় শীর্ণ গাংচিলেরা উড়ে যায় অগ্রগামী ভোরের দিকে । অফুরান পদাবলির বিরহগান মায়া সন্ধ্যায় তির তির করে কাঁপে । বাতাস আনমনা হয়ে যায় কবিতার জন্য ।
No comments:
Post a Comment