প্রশ্ন :-- সাব্রুম মহকুমা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা । সেখানকার রাষ্ট্রীয় জীবনের সুঃখ দুঃখ ত্রিপুরাবাসীকে আন্দোলিত করে । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের অবদান ও ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ রামগড় হানাদার মুক্ত হওয়ার দিন সাব্রুমবাসীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু বলুন ।
উ:-- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে । এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড়ের সুলতান আহমেদ, বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি তদানিন্তন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা অস্থায়ী সেতু তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সেতু দিয়ে এপারথেকে ভারতীয় সৈন্যের যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং মুক্তিবাহিনী সে দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে ছিল । ঋষ্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩ ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে ।
৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । সেদিন দুপুর থেকেই সারা সাব্রুমে প্রচন্ড উল্লাসের বাতাবরণ বয়ে যায় । মুহূর্তে স্কুল-অফিস-কাছারি ছুটি হয়ে যায় । বাজি পটকা ফুটতে শুরু করে । তখন সাব্রুম বাজার ছিল ছোটো । দোকানপাট কম ছিল । যে কয়টা বাজেমালের দোকান ছিল সবগুলো থেকে খুঁজে পেতে কয়েক বস্তা সবুজ আবির যোগাড় করা হয় । শরণার্থী শিবির গুলো থেকে খুঁজে আনা হয় বাংলাদেশের পতাকা । মাইকে বাজতে থাকে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি এবং 'শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি' গানদুটি আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের রমনা ম দানের ঐতিহাসিক ভাষণের রেকর্ড । রাজপথে শুরু হয়ে যায় আবির নিয়ে মাখামাখি । সারা রাস্তায়, নদীর পাড়ে মানুষ গিজগিজ করছে । কে শরণার্থী, কে স্থানীয় বোঝার উপায় নেই । লোকে লোকরণ্য । মানুষ ওপারে যেতে চাইছে । বি এস এফ বাধা দিচ্ছে । কে শোনে কার কথা । ফেনী নদীর উপর রামগড় থানা ও সাব্রুম বাজার বরাবর যে অস্থায়ী সেতু ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার পাক হানাদাররা সেটা ভেঙে দিয়েছিল । পরে তা আবার মেরামত করা হয় । রামগড় মুক্ত হওয়ার বার্তা পেয়ে কাতারে কাতারে মানুষ সব বাধা ঠেলে সেতু পেরিয়ে, নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে গিয়ে ওঠেন । একদল উৎসাহী এপার থেকে ঢাক বাজাতে বাজাতে ওপারে গিয়ে রামগড়ের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিলেন । সেদিনের সাব্রুমের তরুণ-কিশোরদের অধিকাংশই সেদিন ফেনী নদী পেরিয়ে রামগড় পৌছেছিলেন । স্কুল ছুটির পর ছাত্ররা বাই-সাইকেল নিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে সারা রামগড় চক্কর দিয়েছিল । যাদের বাড়ি সাব্রুম শহরের পশ্চিমদিকের গ্রাম ছোটোখিল, মনুঘাট ছিল তারা আনন্দের আতিশয্যে সাইকেলে চড়ে রামগড় পাকা সড়ক ধরে বাগানবাজারে গিয়ে নদী পেরিয়ে এপারের রানিরবাজার ঘাটে উঠে বাড়ির পথ ধরেছিল । ছাত্রদের এই অ্যাডভেঞ্চার পরবর্তী বেশ কিছুদিন জারি ছিল । বয়স্করাও কিছুদিন বাজারসদাইও করেছিলেন রামগড় বাজার থেকে ।
৮ ডিসেম্বর বিকেলে রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন।তিনি ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া 'মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মান'-এ ভূষিত হন । তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।
No comments:
Post a Comment