নিভৃতনগরীর দামালজলধি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সবার একটা নদী আছে । সে নদীর দুই ধারা ।চোখের জমিনে বসত করে সেই নদী । সে এক নীরব নদী । অন্তর্গত গুহাজল । সে নদীর জোয়ার আসে ।মাঝে মাঝে সে নদী হয় খরধারা । সে কেবল গড়াতেই জানে । শব্দহীন কথা বলে সে নদী । বেদনায় কিংবা আনন্দে । আবেগনির্ঝর । ব্যথাসই । ভালো লাগার দোসরজন । মেরুকরণের উপকরণ ।মনের গভীরে লুকানো বৈভবকে বের করে আনে এই সুপ্তস্রোত । যখন বাঁধ ভাঙে তখন তীব্র তার গতি । ধূলিস্যাৎ করে দিতে পারে সব অভিমান সব দম্ভ । মনের উঠোনের কালিমাকাজল ধুয়ে নেয় গড়িয়ে পড়া অপাপবিন্দু । দীর্ণ অন্তরভুবন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয় তার উতলধারায় । গৌরমাতন ঝরায় জল । মহানামে গভীর হয় চোখের আর্দ্রতা । বাজে জলতরঙ্গ মাদলের বোলে । ঝরে জল অবিরল । জল কখনও অতিজাগতিক উল্লাস । বুকের মধ্যে আনন্দমৃদঙ্গ বেজে উঠলে বিমলবৃষ্টি নেমে আসে চোখ বেয়ে । প্রাপ্তির আনন্দ আনে নয়নবারি । আনন্দনির্ঝর জাগিয়ে তোলে ভালোবাসা । সে ভালোবাসা মানুষ মানুষীর প্রিয় বাঁধনকে করে সুদৃঢ়তর । আবার জীবনের প্রতি টানও বেড়ে যায় । পরমপুরুষের সঙ্গে ভক্তের হয় ভাবসম্মিলন । আনন্দধারা ভাসে চিরায়ত চকোর-চকোরী । প্রেমিকার চোখের দুঃখবারি চঞ্চল করে প্রেমিকের মন । আরো আরো বেশি করে ভালোবেসে মুছে দিতে চায় কষ্টের জল । জীবন বাজি রেখে শ্বাপদসংকুল যাত্রা শেষে নিষিদ্ধ স্ফটিক স্তম্ভ ভেঙে তুলে আনে আশ্চর্য কমল । বিশ্বাসের মধুগন্ধ প্রিয়নিলয়ের সুখ ।
আয় জল, আয় ঝেঁপে । বুকের পাড় ভেঙে আয় । তুই কেবল জলের বিন্দু নোস । তুই তো উথালি-পাথালি শরীরের কোণে জমা মেঘবিন্দু । আয় জলসই । আবেগের ঝরনা রেখে যাক তোর জলছাপ । মায়াবিধৌত হৃৎকমলে প্রশান্তিপ্রলেপ । ধ্যানবদ্ধ শরীর যেন মেঘমল্লার শোনে নিভৃতে । বারিপ্রবাহে ডুবে ডুবে যায়রে শরীর ! যায় । যায় । বিচ্ছেদের ও আছে বেদনাবিলাপ । মাথুরবিরহের রাইগুঞ্জন বাজে হৃদিব্রজে । অনন্তপ্রতীক্ষার নদী ভরে যায় উত্তাল উচ্ছ্বাসে । জীবনের আকাশ মেদুর হয় ।অযাচিত বিদায়ের তীব্র তির কখনও বর্ষা নামে দেহজনপদে পদাবলির সুরে । মেঘলাগোঠের আর্দ্রভুবন গুমরে কাঁদে । আর্তবিলাপের প্রতীকপ্রবাহে ভিজে যায় রাধাপথ । বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসিত নিঃসঙ্গ মায়ের সিক্ত আঁচলে জমা হয় স্মৃতি । ইতিকথায় ভরপুর ঘোলাটে চোখ বেয়েও নামে মায়াঢল । জলমহল ভাঙে ছলনার মুখোশ । কাজললতার অনুশাসন । স্তনযন্ত্রণা । দুঃখ যার চিরসখা কান্না তার পারানি । কান্নাপুকুরে ডুব দিয়ে উঠলে হয় শুদ্ধস্নান । অলৌকিক অবগাহন । এ তো জলের জলধি । এ নদীতে খেয়া দেয় বোধনের নাইয়া । যে নিয়ে যায় নতুন জীবনের পারে । আলোকিত আকাশের দিগন্তরেখায় । ভোরমহল্লার আজান ভেসে আসে নির্মলভেলায় ।
বেহুলা পেরিয়ে গেছে যে গাঙুর, সেও এক কান্নানদী । শবসন্নিহিত মান্দাসনিঃসঙ্গ যাত্রায় মৃতনদীর চড়া আর বালিয়াড়িকে সজল করেছে তার অনন্ত অশ্রুসলিল । উৎসবমুখরিত দেবসভার উচ্ছল নক্ষত্র ভেসে গেছে তার নোনাজলে ।
প্রতিটি অশ্রুবিন্দু জীবনের রঙধনু । মনের গোপন নির্মানের মলাট উন্মোচন । এ নিছক জলবিন্দু নয় । জীবনতিলক । বৃষ্টি নিয়ে খেলা যায় । অশ্রু নিয়ে নয় । প্রাণ কখনও আকুল হয়ে ডাকে,
আয় ! অশ্রু আয় ।
আয় রে, জোছনার গান ।
ভালোবাসার শ্রাবণ রে তুই ।
আয়, আয় বেদনামূর্ছনা । আদুরে উল্লাস ।
No comments:
Post a Comment