ফাটিয়া যাওত ছাতিয়া
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
এক দীর্ঘ পদযাত্রার নাম জীবন । ভাবসাগর আর ভবসাগর অতিক্রমণের ভ্রমণবিন্যাস জীবনের ধারা । সবটাই পরিব্রাজন । হেঁটে যাওয়া কিংবা সাঁতার । জীবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের অন্তিমে ক্রমশ অনন্তের দিকে । ক্রমাগত পথ পেরোতে পেরোতে ফেলে আসা সাদা খইয়ের ধানের মতো স্মৃতির শুভ্র স্তবক । স্মৃতির দর্পণে ভাসে প্রিয় মুখ সব । যে মুখ জড়িয়ে আছে মায়াবন্দর । চলমান সময়ের স্রোতে ভালোবাসা এক একান্ত অনুষঙ্গ । জীবন পেরিয়ে যায় ভালোবাসার অলৌকিক জলপথ । যে পথের দু'ধারে স্বপ্ন সবুজ পাড় আর হৃদয়ের ছলাৎ ছলাৎ জলধ্বনি । জীবননাইয়ার আলোআঁধারী নৌকো তির তির করে এগিয়ে যায় । ভালোবাসার মরমি কথা মন ও মনন জুড়ে যখন বেজে যায় দুই দৈবীঘুঙুরের মতো । তখন জীবনের গান ও খোঁজে স্বরলিপির সাংকেতিক খাতা । ভালোবাসার গান বাঁধা হয় নিবিড় নান্দনিক স্বরলিপিতে । ভালোবাসা কি ? শুধু কি হৃদয়ে হৃদয় জড়ানো ব্যাকুল অনুভূতি ? শুধু কি অন্তরঙ্গ আকর্ষণ ? নিভৃত মনের গোপন কথকতা ? আবেশমুখর সময়ের দলিল ? প্রশ্ন জাগে বারবার । কখনো বিশ্বাস হয় । প্রত্যয় ভাঙে কখনোবা । নিরন্তর গূঢ়সন্ধান চলে নিবিড় বন্ধনের । যতক্ষণ মগ্ন থাকা যায়, ভালোবাসার কাছে নতজানু থাকা যায় । চেতনার গভীরে এক গাঢ়ছাপ স্পষ্ট হয়ে যায় । উল্কিপ্রকট মুহূর্তগুলো বিচ্ছুরিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে মেঠোপথময় অস্তিত্বের অবয়বে । শিমুল তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ে যায় ভালোবাসার স্বপ্ন । আকাশে ভাসমান মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে শুধুই ভাসে প্রিয় মুখ । ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী । ভালোবাসার বকুলসই । পরতের পর পরত অনিঃশেষ বস্ত্র জড়িয়ে যেতে থাকে শরীরে । ভালোবাসার নামে । সহস্র পেশির আকর্ষণেও খোলেনা যেন ভালোবাসার ব্যস্তবসন । জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে । শরীরময় । মন জুড়ে ।
ভালোবাসা এক প্রিয় গার্হস্থ্যের নাম । প্রতিদিন বেড়ে উঠে সে পরিপাটি হয়ে । অসীম যাতনার ভেতরেও অপার আনন্দ। ভালোবাসা এক করতে জানে । বিশাল জলপরিধি নিয়ে সেজে ওঠে ঘরকন্না ভালোবাসার নামে । চেতনার চিলেকোঠায় আলো দেখায় রহস্যময় প্রদীপের প্রজ্জ্বলিত সলতে । কখনো কাঁপে বেদনায় তার শিখা । কখনোবা অত্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার রোশনাই । যাপিত জীবন ঘিরে ভালোবাসা মায়াকুহেলিকা রংধনু বিস্তার করে । ভালোবাসা এক অনন্য ফসল । নিরবধি চর্যার স্বপ্নভুবন । জীবনের মধুঘ্রাণ ভালোবাসায় বসত করে । পুরাকথার বুননের মত চেতনালগ্ন নীরবতা ভালোবাসার প্রান্তরে । সে প্রান্তর মধুবৃন্দাবন । বন-প্রান্তর, পাখপাখালি, লতাবিতান, ভ্রমণবিলাস, ময়ূর আর গোপজন মিলে ভালোবাসার আনন্দময়দান সেখানে । শ্রীরাধার কৃষ্ণপ্রীতি চিরকালীন ভালোবাসার উপমা । সেই শাশ্বতপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ একদিন ছেড়ে যান তাঁর ভালোবাসার গোবাট । কংসবধের নিমিত্ত চলে যান মথুরায় । অতলান্ত দুঃখের পারাবারে ভেসে যেতে থাকে রাধার ভালোবাসা । ফেলে আসা ভালোবাসার জন্য কৃষ্ণ কী ব্যাকুল হয়েছেন কোনদিন ? হয়েছেন কি কোনদিন বিরহভাবুক তার দয়িতার জন্যে ? সে কথা লেখেনা কোনো পুরাকাহিনি । কৃষ্ণ পারেননি মহান করে রাখতে তাঁর প্রেমকে । শুধুই কামুক ছলনায় কলঙ্কিত হয়েছে তাঁর ফেলে আসা ভালোবাসা । অতীন্দ্রিয় উন্নয়ন নেই তাঁর ভালোবাসায় । প্রেমিকের পরিণতি ঘটেছে রাজনেতৃত্বে ।
কৃষ্ণপ্রস্থানের সাথে সাথে কিন্তু অবসান হয়নি রাধাপ্রেমের । কালিয়ার পরিত্যক্ত প্রেম রাধার অন্তর ভাসিয়েছে সীমাহীন অনন্ত বিরহে । যে বিরহ সৃষ্টি করেছে হৃদয়দ্রাবী মাথুরপদাবলি । একের ফেলে আসা ভালোবাসা অন্যের জন্যে হৃদয়মথিত বেদনার আর্তি । বিদীর্ণ হৃদয়ের কারুণ্যমিশ্রিত শাশ্বত আলেখ্য । সান্নিধ্যনিবাসে ভালোবাসা ঝড় তোলে । স্বপ্নজগতের সুগন্ধীবাসভূমে পৌঁছায় । আর ছেড়ে গেলে সেই ভালোবাসা বাস্তবের আঘাতে ভেঙে যায় । ফেলে আসা ভালোবাসার দুই দিক । একদিকে বিরহের শোকোচ্ছ্বাস । অন্যদিকে জীবন সংগ্রামের বাস্তবমাথুর । এক পিঠে অনন্ত সুখের ভিতর দুঃখবিধুর একাকীত্ব । আর অপর পিঠে জীবনের কঠিন ও শাশ্বত সত্য । জীবনপ্রবাহের সত্যলোক স্পষ্ট হয় তাতে ।হৃদয়পারাবারের দুই পাড় ভাঙে দুইভাবে । দুই অনুভবে ।
No comments:
Post a Comment