Saturday, April 29, 2023

স্থাননাম দমদমা



স্থাননাম দমদমা


অশোকানন্দ রায়বর্ধন


দমদমা ( বিশেষ্য পদ ) মানে উঁচু জায়গা বা টিলা । আরবি শব্দ 'দম্দমহ্' থেকে পরিবর্তিত হয়ে শব্দটি বাংলায় এসেছে । খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সম্রাট আকবরের প্রশাসনের বর্ণনাসমৃদ্ধ নথি আবুল ফজলের 'আইন ই আকবরী'তে এই শব্দটি পাওয়া যায় । মূলত, পলি, কাঁকড়, নুড়ি ও বালি মিশ্রিত ভূভাগ দেখা যায় দমদমায় । 


আবার কোথাও কোথাও দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ভূভাগ বা জমির মাটি একদম নরম হতে দেখা যায় । পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা জল এইভূমিতে এসে জড়ো হয়ে নিচের মাটিকে নরম করে রাখে । উপর থেকে যা বোঝা যায় না । ওই ভূমিতে পা দিলেই পাসহ শরীর সেখানে ডুবে যেতে থাকে । স্থানীয়ভাবে এই ভূভাগকেও 'উৎলা' বা 'দলদলি' বা 'দমদমা বলে থাকেন । অনেকসময় গৃহপালিত পশুরা সেখানে আটকে পড়ে । একসময় ত্রিপুরার সর্বত্রই এই ধরনের জমি ছিল । রাজন্য আমলে এই জাতীয় জমিকে ঘিরে হাতি ধরার ফাঁদ পাতা হত । একে 'খেদা' বলে । বুনো হাতি একবার এখানে এসে পড়লে তার বিশাল শরীর নিয়ে আর উঠতে পারত না ।


দমদমা শব্দের আরেকটি অর্থ  সামরিক ব্যবস্থাপনায় পাওয়া যায় । সৈন্যদের বন্দুকচালনার প্রশিক্ষণ চলাকালীন নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে আঘাত করার কৌশলগত দক্ষতা অর্জন করার জন্য উঁচু মাটির ঢিবি তৈরি করা হত । সে অর্থে 'উঁচু জায়গা' মানে 'দমদমা' । আবার এও হতে পারে, যেখান থেকে সেনাবাহিনীর গুলির আওয়াজ দ..ম দ..ম শোনা যেত সেই জায়গাটি দমদমা । আগরতলা শহরেরে সন্নিকটে চানমারি ও দমদমিয়া নামে দুটি জায়গা রয়েছে । কোলকাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন স্থান দমদম বিখ্যাত জায়গা । সেখানেও সেনানিবাসের উদাহরণ রয়েছে । যেহেতু সেনানিবাস ছিল তাহলে সৈখানে একসময় চানমারিও ছিল ।


আমাদের গ্রামাঞ্চলে প্রাচীন রীতিতে যে মাটির বা ছনবাঁশের ঘর রয়েছে তার ছাদের অংশকেও স্থানীয় বাংলায়  দমদমা বলা হয় । ঘরের ভিতরে উপরে টিনের চালের নিচে বাঁশের বেড়া দিয়ে ছাদ ঢেকে দেওয়া হতো । তার দুটো উদ্দেশ্য । এক, রৌদ্রের তাপ থেকে ঘরের ভেতরের অংশ রক্ষা করা । দুই, কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী যত্নে রেখে দেওয়া । আগের দিনে গাছ থেকে সুপারি পাড়া হলে তা দমদমায় বিছিয়ে রাখা হত । ছাদের গরমে সুপারির খোলসটি দ্রুত শুকিয়ে যেত । অনেকে আগুনের উৎপাত থেকে ঘরের সামগ্রী রক্ষা করার জন্য দমদমার উপরে পুরু মাটির আস্তরণ দিয়ে রাখতেন ।


এবারে আসা যাক, সাব্রুমের দমদমার কথায় । সাব্রুম ও তার আশপাশ এলাকার মধ্যে এই স্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু । তাই তার নাম দমদমা হতে পারে । সাব্রুমের প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী জানা যায়, এখানে একসময় ত্রিপুরার রাজার সেনানিবাস ছিল । হয়তো তাদের চাঁদমারি ছিল এই দমদমায় । তা থেকেও দমদমা হতে পারে । 


স্বাধীনতাপরবর্তী ও ত্রিপুরা রাজ্যের ভারতভুক্তির পরে বাংলাদেশের নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলা থেকে বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এসে এখানে বসতি গড়েছেন । নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের বাংলায় বহু আরবি ফারসি শব্দ প্রবেশ করেছে । মূলত, বহু প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আরব ও অন্যান্য দেশের বণিকগণ আসা-যাওয়ার ফলে তাদের শব্দ সেই অঞ্চলের বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে । তাছাড়া বাংলাদেশের চট্টগ্রামের মিরশ্বরাই এর কাছে দমদমা নামেএকটি গ্রাম আছে । সেখানকার কোন মানুষ পরবর্তী সময়ে এখানে এসে বসবাস করার ফলে পূর্ব স্মৃতি ধরে রাখতে তার নাম দমদমা রাখতে পারেন । 


বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-আসাম-এ বহু স্থাননাম দমদম, দমদমা, দমদমিয়া ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । এরকম বহু স্থাননামের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে । 

ছবি : নেট থেকে সংগৃহীত ।

Sunday, April 23, 2023

আ ড্ডা ম ন্ত্র

আড্ডা শব্দকর্মীদের অক্সিজেন । আড্ডা চলুক আরো আরো । আমি সংসারের ঝক্কি ঝামেলায় হাঁপিয়ে উঠলে ইতিউতি ও আগরতলার পরিযায়ী ঠেকে নিজেকে ঝালাই করে আসি । তারপর কলম নিয়ে বসলে দু চারটে হাবিজাবি লেখা বেরিয়ে যায় । আর আমি আত্মসন্তুষ্টির ঢেঁকুর তুলি ।

Tuesday, April 18, 2023

ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়

ত্রিপুরার শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় 


অতি প্রাচীনকাল থেকেই ত্রিপুরা ছিল একটি প্রভাবশালী স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য । আদিযুগে চন্দ্রবংশীয় রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন । ত্রিপুরার অধিবাসীরা খুবই আনন্দপ্রিয় ও উৎসব প্রিয় জাতি । প্রাচীনকালে তাঁরা সর্বপ্রাণবাদীতে ( Animism ) বিশ্বাসী ছিলেন । পরবর্তী সময়ে তাঁরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন । তখন থেকে তাঁরা হিন্দু ধর্মে নানা শাস্ত্রীয় শিষ্টাচারের পাশাপাশি তাঁদের লৌকিক ধর্মাচরণ
গুলিও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছেন । বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো নানারকম পূজা পার্বণ এবং সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়ে তাঁরা সারা বছর মেতে থাকেন । সেইসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে তাঁরা নৃত্য ও সঙ্গীতে মেতে ওঠেন । মূলত লোকনৃত্যই তাঁদের প্রধান ঐতিহ্য । নৃত্য ও সঙ্গীতে পারদর্শিতার কারণে প্রাচীনকাল থেকেই তাঁরা ভারতের বিশিষ্ট নৃত্য পারদর্শী জাতি হিসেবে সমাদৃত । তাঁদের প্রত্যেকটি ধর্মাচরণ ও সামাজিক অনুষ্ঠানের সাথে নৃত্যের ঐতিহ্য নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে ।

ত্রিপুরা রাজ্যের লোকনৃত্যের ধারা যেমন সাধারণ জনগণের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়েছে তেমনি শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যচর্চা রাজপুরুষদের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে । ত্রিপুরা রাজ্যের সুশীলসমাজে সংস্কৃতি চর্চা তথা নৃত্য-গীত-নাটক ও সাহিত্যচর্চার যে বিস্তার আমরা বর্তমানে দেখতে পাই, তার সূত্রপাত ঘটেছিল ত্রিপুরার রাজদরবারে ও রাজবাড়ির অন্দরমহলে । ত্রিপুরার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চাই হোক, বাউল ভাটিয়ালি সবই রাজপুরুষদের হাত ধরে সর্বসমক্ষে উপস্থাপিত হত । সংগীত, নৃত্য, নাটক বাদ্য, সাহিত্যের সমস্ত ধারার চর্চাই রাজ পরিবারের সংঘটিত হত । নৃত্যের ক্ষেত্রে প্রধানত রাজপুরীতে মনিপুরী নৃত্যের প্রচলন ছিল । তারপরও বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে বা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রাজবাড়িতে বাইরে থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীরা আসতেন । বিখ্যাত কথক শিল্পী কুলন্দর বক্স, অলকানন্দা, কনিজ, চাঁদাবাইজি, ইমামি বাইজি, গহরজান, মালেকজান প্রমুখগণ সেইসব আসরে অংশগ্রহণ করতেন । রাজপরিবার থেকে শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার সেই ধারা প্রবাহিত হয়ে ক্রমে অভিজাত শ্রেণিরও আগ্রহ ও চর্চায় উৎসাহ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায় । মূলত রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট  শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চা রাজন্যোত্তর পর্যায়ে  গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কালেও প্রসারিত হয় ।

 একদিকে সাধারণ জনগণের লোকনৃত্যের নিজস্ব ধারা, অন্যদিকে রাজন্য পৃষ্ঠপোষকতায় শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার ধারা পাশাপাশি ত্রিপুরায় প্রবাহিত হলেও ভারতভুক্তির পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৭৪ বছর কেটে গেলেও রাজ্যের শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রসার তেমনটা ঘটেনি । কি কারণে শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চা প্রসারের ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে সেই বিষয়গুলি তুলে ধরা হচ্ছে ।

প্রথমত, শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চাকে এ রাজ্যে এখনো অভিজাতদের চর্চার বিষয় বলে মনে করা হয় । এছাড়া সাধারণ দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরাই রাজ্যের প্রধান জনগোষ্ঠী । ফলে আর্থিক দৈন্যও এই নৃত্য চর্চার প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে ।

দ্বিতীয়ত, এই রাজ্যের জনগণের এক বৃহৎ অংশই নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন । জীবন জীবিকার জন্য লড়াই করতে করতে তাঁরা শাস্ত্রীয়নৃত্যের মতো কলার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন না । সংগ্রামী জীবনে পারিবারিক দায় দায়িত্ব সামলানোই তাঁদের প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় । ফলে নৃত্যচর্চার জন্য বাড়তি সময় দেবার মতো সুযোগ থাকে না । 

তৃতীয়ত, যেহেতু রাজ্যের মানুষের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবিকার নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা । এই নৃত্য চর্চার মাধ্যমে যদি জীবিকা উপার্জনের সুযোগ না থাকে তাহলে কেউই এই নৃত্যচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হবেন না । ত্রিপুরারাজ্যে বহু গুণী নৃত্যশিল্পী রয়েছেন যাঁরা রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরে থেকে নৃত্যচর্চায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পর কোনরকম সরকারি চাকরি পাননি । ফলে চাকুরির প্রতিযোগিতার বাজারে নৃত্যশিল্পীরা মার খেয়ে যান । জীবনযুদ্ধে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁর অধীত বিদ্যাকে বিসর্জন দিয়ে অন্ন জোগাড়ের ধান্দায় নেমে পড়েন ।

চতুর্থত, রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নের ফলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় । যে কোন রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা সেখানকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকে প্রভাবিত করে থাকে । রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথেই শিল্পীর নৃত্য চর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও বাধার সৃষ্টি হয় । কোন কারণে যদি কোন শিল্পী শাসক গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন তাহলে তাঁকে তার শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে বেগ পেতে হয় । দেখা গেছে, চাকুরির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও শিল্পীর রাজনৈতিক পরিচিতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় । সমাজে কতটা তাঁর অবদান রয়েছে সে বিষয়ে মূল্যায়ন করা হয় না । দেখা যায়, কোন শিল্পী চাকরি পাবার পর তার শিল্পসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে জীবিকা নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর ঘর সংসারে মেতে থাকেন । শিল্পচর্চার প্রতি আর আগ্রহী হন না ।

 পঞ্চমত, শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার সঙ্গে যারা জড়িত এবং প্রতিভা সম্পন্ন তাদের বৃহত্তর ও পরিসরে পরিচিত করানোর কোন সুযোগ সরকারি ভাবে থাকে না । ফলে রাজ্যের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী কোন পরিবারের সন্তানের কাছে শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চা 'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় / পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি'র মতো। খেলাধূলা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিভাদের স্বীকৃতি ও উন্নয়নের জন্য যে ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক অনুদান থাকে নৃত্যশিল্পীর ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও পরিলক্ষিত হয় না ।

 ষষ্ঠত, ত্রিপুরা রাজ্যের বিদ্যালয়ের শিক্ষা পাঠ্যক্রমে একাদশ-দ্বাদশ স্তরে ২০২০ সালে সংগীত নৃত্যশিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা  হলেও নৃত্যের কোন শিক্ষা পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি । এখানে শুধুমাত্র কন্ঠসঙ্গীত শিক্ষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় ।

 সপ্তমত, ত্রিপুরায় নৃত্য শিক্ষার অগ্রনী প্রতিষ্ঠান ত্রিপুরা মিউজিক কলেজের শিক্ষা পাঠ্যক্রমেও সবগুলো শাস্ত্রীয় নৃত্য শিক্ষণের ব্যবস্থা নেই । শুধুমাত্র কথক, ভরতনাট্যম ও মনিপুরী নৃত্যশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে । তাও কেবলমাত্র স্নাতক স্তরে । আর স্নাতকোত্তর স্তরে শুধুমাত্র কথক নৃত্য ২০১১ সাল থেকে শুরু হয়েছে ।

অষ্টমত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও অনেক সময় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার সুযোগকে কাটছাঁট করা হয়ে থাকে । উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করতে পারি যে, এক সময়ে রাজ্যের ব্লক মহকুমাস্তরে ও রাজ্যস্তরে যুব উৎসবে শাস্ত্রীয় নৃত্যে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল । প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শ্রেষ্ঠ শিল্পী জাতীয় স্তরে অংশগ্রহণের সুযোগ পেত । কিন্তু বর্তমানে যুব উৎসবে শাস্ত্রীয় নৃত্যে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই । শিল্পীর যোগদানের অপ্রতুলতার কারণ দেখিয়ে বিষয়টাকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে ।

 নবমত, রাজ্যের সাংস্কৃতিক চর্চার ঐতিহ্যগত পরম্পরা ও বাতাবরণ রয়েছে । রাজ্যে বহু ইলেকট্রনিক্স চ্যানেল রয়েছে যেগুলোতে বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই চ্যানেলগুলো কোনরকম শাস্ত্রীয় নৃত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন না । এছাড়া রাজ্যের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মঞ্চে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী মহোদয়গণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানকে আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে নৃত্যের আয়োজন করা হয়ে থাকে । কিন্তু সেখানেও শাস্ত্রীয় নৃত্য ব্রাত্য থেকে যায় ।

এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে রাজ্যের শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রসার ঘটাতে গেলে বিশেষ সার্ভের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সরকারিভাবে ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার এই সাপেক্ষে প্রধানত নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গুলি গ্রহণ করা যেতে পারে —

এক • সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়  গ্রামস্তর পর্যন্ত নৃত্যচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে । ক্ষেত্রপ্রচার দপ্তরের মাধ্যমে গ্রামস্তরে ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শনের করে সাধারণ জনগণকে আগ্রহী করে তোলা যেতে পারে ।

দুই • সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামেগঞ্জে শাস্ত্রীয় নৃত্যশিক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলতে হবে । সেখানে উপযুক্ত প্রশিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় নৃত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে । পক্ষান্তরে এজাতীয় পদক্ষেপকে বিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গেও জুড়ে দেওয়া যায় ।

তিন • উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন বেকার নৃত্যশিল্পীদের চাকুরীতে নিয়োগের মাধ্যমে তাদের জীবন জীবিকার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে । হলে তারা নিশ্চিন্তে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রসারে আত্মনিয়োগ করতে পারবে ।

চার • বিদ্যালয়ে ও ক্লাব স্তরে সরকারি ব্যয়ে নৃত্যশিক্ষকের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রশিক্ষণ শিবির করার ব্যবস্থা করতে হবে । প্রশিক্ষণান্তে শিক্ষার্থীরা নিজেদের শিল্পপ্রদর্শনের সুযোগ পাবে ।

পাঁচ • মেধা-অন্বেষণ প্রকল্পের মাধ্যমে মেধাবী শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী বাছাই করে তাদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা সহ আর্থিক বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে ।

ছয় • রাজ্যের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে । ফলে শাস্ত্রীয় নৃত্যের নতুন নতুন শিল্পী উঠে আসবে ।

 সাত • রাজ্যের বাইরে থেকে বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যের দলকে রাজ্যে আমন্ত্রণ করে এনে তাদের রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নৃত্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে । পাশাপাশি রাজ্যের  শাস্ত্রীয় নৃত্যের শিল্পীকেও রাজ্যের বাইরে নৃত্যশৈলী প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে ।

আট • চাকুরিক্ষেত্রে শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং যাচাইয়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে শিল্পীর শিল্পসত্তার মূল্যায়ন করতে হবে । পাশাপাশি দুস্থ ও মেধাবী শিল্পীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিতে হবে ।

এক কথায়, সরকারিস্তরে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিলে রাজ্যের শাস্ত্রীয় নৃত্যকে আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেওয়ার যোগ্য করে তোলা যাবে নিশ্চিতই ।

Monday, April 17, 2023

'পুঙ্গির' পুত- উৎস

'পুঙ্গির পুত'-র উৎস

বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বার্মিজ ভাষায় 'ফুঙ্গি' বলা হয় । অনুশাসন মান্যকারী সেই সন্ন্যাসী যদি পুত্রসন্তানের জন্মদাতা হন তবে সেই অবৈধ সন্তানকে ' ফুঙ্গির পুত'> পুঙ্গির পুত বলা হয় ।  চট্টগ্রামী বাংলায় 'প'কে 'ফ' উচ্চারণ করা হয় । পূর্ববঙ্গের অন্যত্র 'ফ' বর্ণটি অল্পপ্রাণতা পেয়ে 'প' উচ্চারিত হয় ।এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আরাকান বংশোদ্ভুত মগ বা বা মার্মা জনগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে । তাদের একটা অংশ দক্ষিণ ত্রিপুরা ও ত্রিপুরার অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন ।

Friday, April 7, 2023

ফসল সংরক্ষণের লৌকিক প্রযুক্তি

ফসল সংরক্ষণের লৌকিক কৃষিপ্রযুক্তি

 আগেরকার দিনে ধান,গম প্রভৃতি খাদ্যশস্য ও সরষে, তিল, তিশি ইত্যাদি তৈলবীজ ও মটর, ছোলা ইত্যাদি দানাশস্য সংবৎসরের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা হত । এই ফসলগুলোকে সাধারণত গোলায় তুলে রাখা হত । গোলা তৈরিতেও যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্য ছিল । জলপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষার জন্য গোলাকে একটু উঁচুস্থানে বসানো হত । ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্যে গোলার বাহির দিক গোবর-মাটির শক্ত প্রলেপ দেওয়া হত । কীটনাশক হিসেবে গোলার ভেতরে ছড়িয়ে রাখা হত নিম, নিশিন্দা ইত্যাদির পাতা । একসময় গ্রামদেশে সুপুষ্ট পাকা টম্যাটো  গাছশুদ্ধ উপড়ে উল্টো করে ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হত । আর রসুন গাছশুদ্ধ তুলে বেনীর মতো পাকিয়ে থোকা থোকা দীর্ঘদিন এভাবে ঝুলানো অবস্থায় রাখা হত । যখন দরকার পেড়ে রান্নায় ব্যবহার করা হত । ফসলের মূল ঋতু ছাড়া অন্য সময়ের জন্য সঞ্চয়ের গ্রামীন প্রযুক্তি ছিল এটা । আবার আলু, মাষ্টি আলুর মতো অনেক ফসল পাতলা করে কেটে কড়া রোদে শুকিয়ে রেখে দেওয়া হত ।

Saturday, April 1, 2023

বসন্তে মেধা ও মননের মেলা, বইমেলা

বসন্তে মেধা ও মননের মেলা, বই মেলা

 অশোকানন্দ রায় বর্ধন 

বইমেলা । আর দশটা মেলার মতো নয় এই মেলা । সংবৎসর আর সব মেলা হয় যেখানে থাকে ব্যসনের সামগ্রী । বৈভবের সমাহার । বিত্ত বাসনা নিবৃত্তির উপকরণ । মনোহারি সব সরঞ্জামের সমাবেশ । বইমেলা এসব থেকে পুরোটাই আলাদা । হ্যাঁ বইমেলারও একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে । এ টেনে নেয় গুণীজনকে । মননশীলতাকে । ঐতিহ্যের প্রতিও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে বইমেলা তার পারিপার্শ্বিকতায় । বইয়ের প্রতি প্রণয় আত্মার আকর্ষণ । বিশ্বকে আপন করে নেবার প্রক্রিয়ায় কালো অক্ষরের আনন্দযজ্ঞ । ইতিহাস সংস্কৃতিকে ভালোবাসা । তার টানেই বইমেলায় সামিল হওয়া । অজান্তেই মন বলে ওঠে– বইমেলা, 'এই কি তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ ?' তেমনি এক হার্দ্য বইমেলার নাম আগরতলা বইমেলা । বিশ্বের বঙ্গভাষী অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা । আজ ছত্রিশ বছরে পড়ল এই বইমেলা । ১৯৮১ সালের তিরিশে মার্চ মাত্র ২৪ টি স্টল নিয়ে আগরতলা রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গনে শুরু হয়েছিল এই বইমেলা । তারপর জুরি-দেও-মনু-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জলস্রোত  । শৈশব পেরিয়ে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের শ্যামল গরিমায় পৌঁছে গেছে আগরতলা বইমেলা । আজ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ জেনে গেছে আগরতলা বইমেলার নাম মাহাত্ম্য । আজই যখন দিবসের দাবদাহ ক্রমশ শীতল হয়ে আসবে, চৈতালি হওয়ার বাসন্তী আমেজে যখন অপরাহ্ন ভরে উঠবে কোমল মায়ায়, সেখানে উদ্বোধন হবে আগরতলা বইমেলার । রাজ্যের মননের উৎসবমালার প্রধান মন্ডপের ।

বই মানুষের সভ্যতার অপরিহার্য জীবনবীজ । মানব ইতিহাস সৃষ্টির ধারক ও বাহক । বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষ পরস্পর মননের আনন্দ ভাগ করে নেন । আগরতলা বইমেলাও সেজে উঠেছে সেই নেশায় । সেই আকর্ষণে । রাত দিন খাটাখাটনির পর চলছে শেষ তুলির টান । নির্মীয়মান অস্থায়ী মঞ্চের অলংকরণ । বইমেলাকে কেন্দ্র করে আগরতলা শহর জুড়ে বইপ্রকাশের উন্মাদনা । ইতোমধ্যে হইচই বাঁধিয়ে অনুষ্ঠান করে এক ঝাঁক বই প্রকাশ করে ফেলেছেন নীহারিকা, ত্রিপুরাবাণী প্রকাশনী, ভাষা, তুলসী পাবলিশিং হাউস এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো । মফস্বল শহর কুমারঘাট থেকে এসে আগরতলা শহরে গ্রন্থপ্রকাশ উৎসব সেরে ফেলেছেন স্রোত প্রকাশনীর মত বনেদি প্রতিষ্ঠান । কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বই প্রকাশ করছেন । মেলা চলাকালীন হবে আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বহিঃপ্রকাশ অনুষ্ঠান । এই মননের আনন্দে বসে নেই আজকের তারুণ্যও । সরকারি কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্র-ছাত্রী । তাঁরা কদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলপনায় আলপনায় দৃষ্টিনন্দন করে তুলছেন বইমেলার প্রবেশপথ । আমাদের চিরন্তন সাংস্কৃতি ঐতিহ্যের সঙ্গে যে 'পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি' । সময় এগিয়ে গেলেও, চারদিকে বিশ্বায়নের থাবা বিস্তৃত হলেও, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট রূপ নেওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে জাতির সংস্কৃতির গভীরে প্রবাহিত হয়, বইমেলার অভিমুখে এই পথশিল্প তারই ইঙ্গিতবাহী । আগামী কদিন আগরতলা বইমেলা জ্ঞান চর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালনের পীঠস্থান হয়ে উঠুক ।

স্যন্দন পত্রিকা, ২ এপ্রিল, ২০১৮