Wednesday, December 27, 2023

অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব : প্রাঙ্গিক কথা

"অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব  :  প্রাসঙ্গিক কথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

গত ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর তারিখ রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বিসর্জনখ্যাত  ও রাজন্যস্মৃতি বিজড়িত শহর উদয়পুরে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল "অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব" । প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে না পারলেও দ্বিতীয়দিন শুরু থেকে  শেষ পর্যন্ত ঠায় বসে থেকে সমগ্র অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি । ঐতিহ্য ও আধুনিকতার নকশিকাঁথা জড়ানো এই শহরে রাজ্য ও বহির্রাজ্য থেকে  স্বনামধন্য অতিথি কবি সাহিত্যিক যাঁরাই এসেছেন প্রত্যেককেই শুরু থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন উদ্যোক্তারা । দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়বেলায় ফিরে যাবার তাড়া দেখে কবি অশোক দেব মঞ্চে যখন অনুযোগ করছিলেন তখন বিদায়ী অতিথিরা প্রত্যেকেই দুহাত তুলে তাঁদের আতিথেয়তার প্রশংসা করে গেছেন ।  আর দ্বিতীয়দিনটিতে আমি উপস্থিত থেকে উপলব্ধি করেছি এই উচ্ছ্বাস সত্যিই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল । দ্বিতীয়দিন পুরোটা সময় ধাপে ধাপে কবিতাপাঠের আসর ছিল । ফাঁকে ফাঁকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । আলোচনায় উদয়পুরের প্রাচীন ইতিহাস, ভারতবর্ষের নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং কবিতায় স্বদেশভাবনা বিষয়ে মনোগ্রাহী আলোচনায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন যথাক্রমে বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিমান ধর, নাট্যব্যক্তিত্ব পার্থ মজুমদার এবং সন্তকবি মিলনকান্তি দত্ত । সেখানে আমি কবিতাপাঠসহ উত্তপূর্বের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও কার্বি ভাষার পাঁচজন কবিকে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও এই পর্যায়ের কবিতাপাঠে সামান্য সঞ্চালনার দায়িত্বও পালন করে কৃতার্থ হয়েছি । 

অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করার জন্যে কবি অশোক দেব, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, মনোজিৎ ধর, ভাস্করনন্দন সরকার ও খোকন সাহার স্নেহচ্ছায়ায় অনিরুদ্ধ সাহা, মৃদুল দেবরায়, খোকন সাহা প্রমুখদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তরুণ কবিদের পুরো ব্রিগেড বেশ কদিন আগে থেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে  কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়েছিলেন । তারুণ্য ছাড়া এতবড়ো কর্মযজ্ঞ সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে না । এই অনুষ্ঠানকেও তাঁরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন । 

উদ্যোগ সুশৃঙ্খল হলেও যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদেরও বোধ-বিবেচনার প্রয়োজন হয় শৃঙ্খলার গতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে । অপ্রিয় হলেও বলতেই হয়, সঞ্চালকদের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের পাত্তা না দিয়ে কবিদের একাংশের একটার জায়গায় একাধিক কবিতা পাঠ, একটি হলেও দীর্ঘ কবিতা পাঠ, অনর্থক গৌরচন্দ্রিকা দান, কবিতাপাঠের প্রারম্ভিক ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের গতিকে অনেকাংশে শ্লথ করে দিয়েছে । ফলে রাজধানীমুখী কবিদের একাংশের ঘরে ফেরার তাগাদাকে বাড়িয়ে তোলে । অবস্থা বেগতিক দেখে সময়মতো কবি অশোক দেব নিজে সঞ্চালনার দায়িত্ব নিজের হাতে না নিলে অনুষ্ঠান কখন শেষ হত বলা যায় না ।

 কবিরা একটু মগ্নতায় থাকেন, খ্যাপাটে, পাগলাটে হন । তাই তাঁরা প্রশ্রয়ও পেয়ে থাকেন । এই প্রশ্রয়ের সুযোগে বারোজনের  একটা কবিটিম কিসব স্বঘোষিত কবিতা পড়ে গেছেন একফাঁকে । সেগুলো যেমন ছিল দীর্ঘ তেমনি গুগল থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা আধানিবন্ধ আর পাঁচালি ধরনের ছাড়া কিছুই নয় । যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ কবিরা তাদের অত্যাশ্চর্য সব কবিতা পড়ে শ্রোতৃমন্ডলীকে চমকে দিচ্ছিলেন তার মাঝখানে এঁরা ও আরো কয়েকজন এমনই কবিতানামক কিছু পড়ে বেরিয়ে গেলেন । আর এসবের কারণে কবিতা পড়তে না পেরে, মূল্যবান আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে দুঃখ নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে । 

এর পরপরই আবার কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানকে গতিপথে ফিরিয়ে আনতে মঞ্চে উঠে এলেন রাজ্যের বেশ কজন সুখ্যাত বরিষ্ঠ কবি এবং উদয়পুরের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমী বাহিনী । ঠিক সেই পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান যে নান্দনিক মাত্রায় পৌঁছেছিল, স্পষ্টতই বলব, যাঁরা অসময়ে ফিরে গেছেন তাঁরা রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্পদকে চাক্ষুষ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন । উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের পুরো নির্যাস নেওয়ার জন্য টানা দুদিন অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন । সবাই উপস্থিত থাকতে পারলে পারস্পরিক বহু বিষয়ে ভাববিনিময় করা যেত যা এ অঞ্চলের সাহিত্যের সমৃদ্ধির সহায়কও বটে । তবে তরুণরা এবং উত্তরপ্রান্তের ধর্মনগর, কৈলাশহর থেকে আসা কবিরা দেখেছি টানা দুদিন কাটিয়েই ঘরে ফিরেছেন । এটা এই উৎসবে আশার আলো । অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় বাঙালির লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি কবিগানের মাধ্যমে । দক্ষিণের দুই কবিয়াল দিলীপ দে এবং সুভাষ নাথ কৃষ্ণ ও গান্ধারীর ভূমিকা নিয়ে গান করে আসর মাত করে দেন । উদ্যোক্তারা যদি এই কবিগানের মাধ্যমে দ্বিতীয়দিনের অনুষ্ঠান শুরু করতেন তাহলে প্রথমত আমাদের ঐতিহ্য প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত । দ্বিতীয়ত, সকালের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল । তাদের সামনে এই অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা হলে আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে জানতে পারত । আগামীদিনে এজাতীয় অনুষ্ঠান হলে উদ্যোক্তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারেন ।

 আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েতরাজ ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে । শেষদিন রাত বারোটায় সর্বশেষ অতিথি প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়ে ঘুমোতে গেছেন । ঘুম তাঁদের কতটা হয়েছে জানিনা । সকালে আমরা বেরোনোর আগেই প্রতরাশ তৈরি । কথায় কথায় বললেন, বাইরে থেকে অতিথিরা এসেছেন বলেই উদয়পুরের সম্মান রক্ষার্থে তাঁরা নিয়ম ভেঙে রাত দশটার জায়গায় বারোটা পর্যন্ত লজ খোলা রেখেছেন ।

ভোরে বেরোবার আগে রাঙামাটির রাঙারোদ আমাদের গায়ে ইতিহাসের কুয়াশা মাখিয়ে দিচ্ছিল । রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৬ ) ত্রিপুরার রাজদরবার উদয়পুরে রত্নকন্দলী ও অর্জুনদাস বৈরাগি নামে দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন । সেদিন রাজা এই অতিথিদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন । সেই ধারারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল এ দুদিনের অনুষ্ঠানে । দুদিনের 'অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব' এটাই উৎকর্ষতা

ছবি : সম্রাট শীল, অনামিকা লস্কর, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, শ্রীমান দাস ও আরো অনেকে

Sunday, December 17, 2023

ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

 ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


নৃত্য মূলত এক ধরনের শারীরিক প্রকাশভঙ্গিমা । এই প্রকাশভঙ্গিমা সামাজিক, ধর্মীয় এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হতে লক্ষ করা যায় । মানব সমাজের আদিম পর্বের নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যে জাদুবিশ্বাসের একটা পর্যায় ছিল । এই জাদুবিশ্বাসজনিত প্রভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে শুভ ও শুভ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রক্রিয়া হল নৃত্য । শিকার ধরা, দেবতাকে সন্তুষ্ট করা, রোগ নিরাময়, ভূত-প্রেত ইত্যাদি কল্পিত শক্তি ও হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ নৃত্য ভঙ্গিমার ব্যবহার করত । মানবজীবনে নানা পর্যায়কে পালন করতে গিয়েও নৃত্যের বিষয়টা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । শিকারজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির ফলে ক্রমান্বয়ে যখন কৃষি জীবনে পদার্পণ করে তখনও চাষবাসসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে আনন্দমুখর করে তোলার জন্য নাচের মাধ্যমকে গ্রহণ করেছে । কৃষিকর্ম ও কৃষিক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরে নাচের যে প্রচলন রয়েছে তার মধ্যেও জাদুবিশ্বাস অত্যন্ত প্রকট রয়ে গেছে । এককথায় প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নাচের প্রচলন ছিল । প্রাচীন মিশরীয় দেওয়ালচিত্র বা প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গি খোদিত থাকতে দেখা গেছে । সে থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের মানবসংস্কৃতিতেও নৃত্যের সুদূর অতীতের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । সময়ের ক্রমবিবর্তনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচের প্রচলনও বেড়ে গেছে ।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে দুই ধরনের নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । তার একটি হল লোকনৃত্য ও অপরটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । সভ্যতার প্রাকলগ্নে প্রচলিত আদিম নৃত্য গোষ্ঠীজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নৃত্যকলায় পরিণত হয়েছে । তা একটা পর্যায়ে এসে মানুষের সমাজ জীবনচর্যায় সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে । তখন এর মধ্যে কিছু কিছু নান্দনিক ভাবনার সংযোজন ঘটেছে । এইসব নৃত্যের মধ্যে কিছু তাৎপর্যমূলক অনুষ্ঠানাদির সংযোজন ঘটেছে । ফসলের উৎসব, নর-নারীর মিলনোৎসব, শস্য ও সন্তান সংক্রান্ত উর্বরতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নৃত্যানুষ্ঠান সম্পৃক্ত হয়ে গেছে । আদিম নৃত্যের এই পর্যায়ে এসে লোকনৃত্যে উত্তরণ ঘটেছে । বিভিন্ন পর্যায়ের লোকনৃত্যে দেখা গেছে যে, এই নৃত্যসমূহ দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয় । পাশাপাশি এই নৃত্যে সংঘবদ্ধ গান বা কোরাস সংগীত ও বিভিন্ন রকম লোকবাদ্য যেমন–ঢোল, কাঁসি, করতাল, বাঁশি, ধামসা, মাদল ও বিভিন্ন তারযন্ত্রের ব্যবহার করা হয় । এই নৃত্যসমূহ বিশেষ কোনো অঞ্চলের অধিবাসী উপজাতীয় জনগণের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে । ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতীয় জনগণের স্ব স্ব লোকনৃত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । 

কোনো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হলো, তার গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ । এর মাধ্যমে কোনো নৃত্যকে শাস্ত্রীয় বা লোকনৃত্য হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব । লোকনৃত্য ছন্দ বা সংযমের কঠোর নীতিনির্দেশিকা ততটা মান্য করে না । পাঞ্জাবি ভাংরা নৃত্য বা নাগা উপজাতিদের নৃত্যে যেরকম তীব্র গতি থাকে তার তুলনায় শাস্ত্রীয়নৃত্যে যথেষ্ট সংযম ও ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । আমাদের ত্রিপুরারাজ্যেও গড়িয়ানৃত্যেও জোরালো বাদ্যযন্ত্র ও গতি লক্ষ্য করা যায় । পক্ষান্তরে মনিপুরী নৃত্যে ধীর সংযম ও ছন্দের অবতারণা করতে দেখা যায় । এছাড়া লোকনৃত্যে পোশাক কেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । কিন্তু শাস্ত্রীয়নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা আর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । লোকনৃত্যের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর জীবিকার ধরন, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মচর্চার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান । ফলে তাদের জীবনাচরণের বিভিন্ন বিষয়কে গতিময় ও দলবদ্ধ পরিবেশন করতে দেখা যায় লোকনৃত্যে । এই নৃত্য তাদের জীবনঘনিষ্ঠ নৃত্য ।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের জাতি ও জনজাতিদের লোকনৃত্যের মত ত্রিপুরার জনজাতিগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকনৃত্যের ধারা রয়েছে । তারমধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনুসৃত নৃত্যধারাটি বৃহত্তর বাঙালি জাতির নৃত্যের ধারারই অনুসরণ । কিন্তু জনজাতীয়দের যে উনিশটি শাখা রয়েছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব লোকনৃত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা রয়েছে । তাদের মধ্যে একমাত্র রিয়াংদের নৃত্যের মধ্যে কিছুটা ধ্রুপদী আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায় । যদিও তা ভারতীয় স্বীকৃত শাস্ত্রীয়নৃত্যের মধ্যে গণ্য নয় । ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নৃত্য, যা মণিপুরী নৃত্য নামে বিশ্বের সমাধিক পরিচিত তার উৎস মনিপুরে হলেও ত্রিপুরার রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতা লাভের ফলে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অসীম আগ্রহের ফলে তাঁর সৃষ্ট শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বিশাল পরিচিতি পেয়েছে । মনিপুরী নৃত্য আজ ভারতের অন্যতম শাস্ত্রীয় নৃত্য । এই নৃত্য বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত । ত্রিপুরা রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার নিবিড় ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে । যা আজও প্রবহমান ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

 ১৬ই ডিসেম্বর । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস । একাত্তরের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল সেদেশে আজকের দিনে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বস্তরের জনগণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ববর্গ, বিভিন্ন পেশার মানুষজন,  সমাজকর্মী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ । সেই দিনের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক, পত্র-পত্রিকাসমূহেরও বিরাট ভূমিকা ছিল । আগরতলা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমর রাজধানী । সাব্রুমের হরিনা ছিল তাদের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ।

দৈনিক সংবাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সেদিন এদেশের ও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একত্রিত হয়ে কলম ধরে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে । দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরাও এই প্রতিষ্ঠানে এসে তথ্য সংগ্রহ করতেন । যার দরুন খানসেনাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দৈনিক সংবাদ । দৈনিক সংবাদ অফিসকে ধ্বংস করার জন্য তারা গোলাও নিক্ষেপ করেছিল  দৈনিক সংবাদ অফিসের লক্ষ্য করে । কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেদিন ওই গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক, বিপুল মজুমদার, অধ্যাপক মিহির দেব, অধ্যাপক সুখময় ঘোষ, সেদিনের চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত, তরুণ সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী প্রমুখগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষভাবে নাম করতে হয় অনিল ভট্টাচার্য, স্বপন ভট্টাচার্য, ননীগোপাল চক্রবর্তী প্রমুখদের । মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহদানের লক্ষ্যে সৃষ্ট 'রোশেন আরা' মিথ তো বিকচ চৌধুরীর মেধাবী কলমপ্রসূত । আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রত্যক্ষচিত্র দুঃসাহসিকতার সঙ্গে ধারণ করেছিলেন চিত্রসাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত । ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল অরোরার সঙ্গে একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী বিমানে ঢাকা যাওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন । একমাত্র তিনি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেন পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ । ভারতীয় সাংবাদিকরা সেদিন ঢাকা পৌঁছাতে পারেননি । তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর PRO কর্নেল রিখির সঙ্গে ১৮ তারিখ ঢাকায় পৌঁছেছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে রবীন সেনগুপ্ত মৈমনসিংহ হয়ে ঢাকা পৌঁছেছিলেন ।এদিকে ৮ডিসেম্বর রামগড়ের হানাদার মুক্তির দিনে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা আজও তেমনভাবে জানানো হয়নি নতুন প্রজন্মকে । যেকারণেই প্রতিবেশী দেশ হয়েও এই প্রজন্মের একটা অংশ ক্রোধ ও ঘৃণা বর্ষণেই তৃপ্তি পায় । যা আদৌ কাম্য নয় । পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির মাধ্যমে তো বিশ্বসভায় প্রথম সারিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব ।

 আসুন, আজকের দিনে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে মৈত্রীর কথা বলি, সম্প্রীতির কথা বলি, শান্তির কথা বলি । ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক ।

ছবিঋণ : চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ– রবীন সেনগুপ্ত

Wednesday, December 13, 2023

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

টিংকুরঞ্জন দাস। ত্রিপুরার একজন সুপরিচিত কবি । প্রেমপ্রবণতা, নিসর্গচেতনার সঙ্গে সমাজভাবনা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে এক ভিন্নতর মাধুর্য দান করেছে । কবির অপর ভাবনার কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন 'ভিন্নপথের পথিক' ।  কবি তো পথিকই । জীবন ও সমাজ প্রকৃতির আলপথে বিচরণই তাঁর কাজ । এই পথের দুপাশে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় বৈচিত্র্য ফুটে উঠে, আর সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যায় । কবি বাস্তবজীবনে দায়িত্বপূর্ণপদ সামলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত । ফলে জীবনকে ভিন্ন রূপে দেখার সুযোগ রয়েছে তাঁর । রয়েছে দেখার চোখও—

স্কুলছুট কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিত ছেলে মেয়েদের ধরে আনতে 
বেরিয়ে পড়ি প্রায় সকালেই পাড়ার বাড়ি বাড়ি 
দুঃখ হলেও হাসিমুখে সব দোষ করি স্বীকার 
তবুও যেন ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে রেগুলার 
তারপরও শুনি পথে ঘাটে,
 ও, সে তো সাধারণ এক স্কুল টিচার
 কাজকর্ম ফেলে রেখে সারাদিন ঝাড়ে শুধু চক ডাস্টার ।'

চিরায়ত শিক্ষকমননজাত প্রেরণা থেকে জীবনের এক ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মুখ দেখবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর । তাঁর মধ্যে তাই রয়েছে এক তন্ময়তার ভাব। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, জীবনের কঠোর-কর্কশ, সুন্দর-অসুন্দর পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা । মানুষের কল্যাণবোধ ও মঙ্গলভাবনা তাঁর কাব্যের উপজীব্য । সমকালের রাজনীতির সঙ্গে তিনি পরিচিত । দেখছেন রাজনীতির অস্থিরতা, রাজনীতির বাণিজ্য । কিন্তু হৃদয়ের বাণীই তাঁর কাব্যের প্রধান শর্ত । সেখানেই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা—

তাই এবার আর মৌ নয়,
 এসো, একে অন্যের মুখে তুলে দেই এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন 
বিবস্ত্র মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিই সামান্য ভালোবাসার চিহ্ন 
একবার অন্তত বাঁচি 
সেই সব বিবস্ত্র অভুক্ত মানুষের জন্য ।

কবি টিংকুরঞ্জন দাসের কবিতার নিবিড় পাঠের মধ্যে যে কাব্যসূত্র সমূহ প্রকট হয়ে ওঠে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজালে পাই—

ক) কবির হৃদয়ের মধ্যে কল্পনাচারিতা রয়েছে । তবে সেই কল্পনা বাস্তববিচ্যুত নয় । তার মনের মধ্যে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার যে স্বচ্ছতা রয়েছে তা তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেন ।

খ) কবির হৃদয়ে যে চিন্তা বা চেতনার বিস্তার ঘটে তা শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার জগতে নয় । বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তার প্রকাশে বলিষ্ঠতা রয়েছে ।

গ) তাঁর কবিতার বাকভঙ্গিমা আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত না হলেও তাঁর কাব্যরচনার একটা নিজস্ব ক্ষমতা বা স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে ।

ঘ) বাস্তবক্ষেত্রে কবি বা সাহিত্যিকরা স্বাধীনচেতা হন । সে কারণেই নিজেকে কাব্যবেষ্টনীর মধ্যে না রেখে প্রকাশের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন এই কবি ।

কবি তাঁর কাব্যের উপাদান তাঁর পরিচিত নিসর্গ ও সমাজপারিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করেছেন । সেকারণেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয়নিঃসৃত ও স্বচ্ছ । তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না । ভাষা ও ভাবে কৃত্রিমতা থাকলে তা কখনোই প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা । পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতাময় এই সময়ে মানুষ, মানবতা ও সময়ের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত কবির হৃদয়ের ভাষা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় । পাঠকচিত্তকে  অবশ্যই এক অন্যতর ভুবনে নিয়ে যাবে এই কাব্যগ্রন্থটি ।
                        অশোকানন্দ রায়বর্ধন

   দার্জিলিং টিলা, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা
          ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ    ।                    

Thursday, December 7, 2023

শবশকট

শবশকট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শববাহী গাড়িটা মায়াঘাটের শেষ দরোজায়
নির্ধারিত গমন শেষে আচমকা থেমে যায় ।
সারা পথ তার সাথে যায় লৌকিক আচার,
মাইকে বাঁধা বিচ্ছেদী সুরে কীর্তনগান,
নগ্নপদ মানুষের মৃদু শ্বাস, টবে রাখা তুলসি গাছ ।

এই গাড়িতে বসার আসন নেই । এ এক শয়নযান ।
অনন্তের যাত্রী কেবল এ যানের সওয়ার হয় ।
যে শব হয়ে চলে যায় সে জানে না তার
 সাথে কে যায়, কে না যায়, কে, না যায় !

শবশকটের রং কেউ বুঝে শুনে কালো করেছে
কারণ জীবনেরই থাকে আলোর কারুমশাল,
তারপরেই নেমে আসে কালো রঙের আঁধার ।

জীবন যাকে ছুটি দিয়েছে সেই কালো আঁধারের
কে যায়, কে না যায়, কি এসে যায় তার ।

তাকে ফেরাবার মতো কোনো বেহুলার জন্ম হয় না ।