বই নিয়ে আশার আকাশপ্রদীপ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
আগরতলা বইমেলা দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আজ একটি সম্মানজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে । বিশ্বের অন্যান্য বড়ো বড়ো বইমেলার সঙ্গে আগরতলার বইমেলার নাম আজ একসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে । হাঁটি হাঁটি পা পা করে রবীন্দ্রভবনের প্রাঙ্গনে শুরু হওয়া বইমেলা আজ হাঁপানিয়া প্রাঙ্গণের বিশাল পরিসরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে । সৌন্দর্যের আন্তরিকতায় এই মেলা আজ পবিত্র ভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে । আগরতলা বইমেলার সুবাদে বইমেলার সঙ্গে জড়িত প্রকাশনা শিল্পের সৌজন্যে ত্রিপুরার সাহিত্য আজ বহির্ত্রিপুরা ও বিশ্বের গুণীজন সমাজের কাছে সুপরিচিত । ত্রিপুরার লেখালেখি আজ সসম্মানে সর্বত্র সমাদৃত । ত্রিপুরার কবি সাহিত্যিকদের নাম আজ মূলধারার সঙ্গে সমানভাবে উচ্চারিত হয় ।
এই বইমেলার শুরুর দিনে যাঁরা ছিলেন তরুণ । আজ তাঁরা অনেকেই বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন । অনেকে জীবন-মৃত্যুর সীমানা পেরিয়ে গেছেন দূরের ঠিকানায় । প্রয়াতজন ও প্রবীনদের লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে রাজ্যের সাহিত্যভবন । আর এখন তো বইমেলা জুড়ে তারুণ্যের প্রবাহ । এই সময়ে সপ্তশ্রী কর্মকার, প্রিয়াঙ্কা দেবনাথ, সঞ্জয় দত্ত, নয়ন দে, সঙ্গীতা দাস, সুধীর দাস, জগন্নাথ বণিক, শহিদুল ইসলাম, সংহিতা চৌধুরী, মন্দিরা লস্কর, আব্দুল হালিম, বিদ্যুৎ হোসেন, বিধর্ণা মজুমদার এর মত তরুণ তরুণীরা এগিয়ে এসেছেন সাহিত্যের অঙ্গনে । এঁরা অনেক বেশি প্রাণবন্ত অনেক বেশি সংগঠিত । আর সময়ের কারণে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে তাঁদের লেখা অতি দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকের সামনে সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে । মুহূর্তে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে তরুণ প্রজন্মের সৃজন । তাঁদের সৃষ্টির গুণমান সম্বন্ধেও অতি দ্রুত প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন তাঁরা । ফলে তাঁদের দ্রুতগতিতে পরিশীলিত হওয়ার সুযোগ থাকছে । হতেও হচ্ছে । তাঁদেরই মধ্যে একদল নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন নিবিড় পাঠের মধ্যে । বিশ্বের নানাভাষার ও বাংলাভাষার ধ্রুপদী সৃষ্টিসম্ভারকে তাঁরা অন্তরে আহরণ করে চলেছেন । এরাই আগামী দিনে রাজ্যের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করবেন ।
আর একদল আছেন যাঁরা সাহিত্যচর্চার নামে রাজ্যের সাহিত্যের অঙ্গনে আবর্জনা স্তূপ তৈরি করে চলেছেন । যাঁরা শুধু লেখেন । পড়েন না । সমকালের সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই তাঁদের মধ্যে কবিরাই সংখ্যায় বেশি । এঁরা এখনো শব্দচয়নে, ভাষা ব্যবহারে গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক অতিক্রম করতে পারেননি । তাঁরা বাংলা কবিতার অগ্রজ কবিদের কবিতার সঙ্গে পরিচিত নন । সমকালে বাংলা কবিতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে তাও জানেন না । এই সময়ের সমগ্র বাংলাকবিতা তো দূর অস্ত, আমাদের রাজ্যের কাব্য ও কথাসাহিত্যের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁরা অন্ধকারে । তাঁরা পড়েননি আমাদের রূপন মজুমদার, শান্তনু মজুমদার, পঙ্কজ কান্তি মালাকার, রাহুল শীল, সংগীত শীল, রুবেল হোসেন, পান্থ দাস, গোপাল দে, গোপাল বনিক, দেবব্রত চক্রবর্তী প্রমুখদের কবিতা । এঁরা তরুণতম কবি ভবানী বিশ্বাসের সাড়া জাগানো 'দিদার সুরলা গান'-র খবর রাখেন না । এরা বইমেলায় যান । লিটল ম্যাগাজিন স্টলে প্রবেশ করেন না । এঁরা অনলাইনে প্রতিদিন পুরস্কৃত হন । আর তার ছবি পোস্ট করেন সোশ্যাল মিডিয়ায় । এঁরা সাহিত্যের কাগজও করেন যা মোটেই লিটল ম্যাগাজিন পদবাচ্য নয় । অথচ এঁরা জানেন না ঘাটের পয়সা খরচা করে কি অসাধারণ সব লিটল ম্যাগাজিন করে চলেছেন জয় দেবনাথ, চয়ন সাহা, দীপেন নাথশর্মা, মিঠু মল্লিক বৈদ্য, অনামিকা লস্কর, সৈকত মজুমদার, দীপ্সি দে, উর্মি সাহাড. ঝর্ণা বনিক, গীতশ্রী ভৌমিক, শাশ্বতী দাস প্রমুখরা । এঁরা দেশ-বিদেশে সাহিত্যের চড়ুইভাতিতে যান । ত্রিপুরার প্রতিনিধিত্ব করেন । দীর্ঘবছরের বইমেলাতেও এঁদের কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি ।
বইমেলাকে অনেকেই বিনোদনের মেলা হিসেবে আজও মনে করে চলেছেন । এঁরা বইমেলায় যান । সপরিবারেই যান । সরকারি পরিবহনের সুযোগ নিয়ে বিনি পয়সায় মেলা পরিক্রমা করেন । ফুচকা খান, ফাস্টফুড খান । আচার খান । যতটা হুমড়ি খেয়ে পড়েন খাবারের দোকানে, তার দশমাংশও বইয়ের স্টল গুলোতে নয় । এঁরা খালি হাতে মেলায় ঢোকেন । খালি হাতে বেরিয়ে যান । সরকারি যান ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বাড়ি ফেরেন । ভিড় বা ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িটি তাদের বাড়ির স্টপেজ থেকে দশ হাত এগিয়ে দাঁড়ালেও বিরক্ত হন দশ কদম পেছনে হাঁটতে হবে বলে ।
আর এই প্রতিকূলতার মাঝেও থাকে আলোর স্ফুরণ । বড়ো হয় লিটিল ম্যাগাজিনের প্যাভেলিয়ান যেখানে আজও অতন্দ্র প্রহরী ৭৫ উত্তীর্ণ তরুণ নকুল রায় । আজও প্রকাশকরা যত্ন সহকারে প্রকাশ করে চলেছেন নতুন নতুন গ্রন্থ । এসে যোগ দিচ্ছেন শিক্ষিত তরুণ প্রকাশক । ধ্রুপদী ও নান্দনিক সৃষ্টি নিয়ে । জন্ম নেয় তরুণদের নতুন প্রকাশন সংস্থা । প্রকাশনার পাশাপাশি তাঁরা আয়োজন করেন নানা সাহিত্য অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ করেন দেশের ও দেশের বাইরে গুণীজনদের । বইমেলা ঘিরে রাজ্যের সাহিত্যের কর্মকাণ্ড উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে । এখানেই আগরতলা বইমেলার সফলতা । সার্থকতা ।
No comments:
Post a Comment