বাংলা সাংবাদিকতার ধারা ও কাজী নজরুল ইসলাম
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সাংবাদিকতার জগতে আধুনিকতার সূচনা ঘটে ১৮ শতকের ইউরোপে । উপনিবেশিক শাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এশিয়ার অন্যান্য অনেক দেশের আগেই ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চলের সাংবাদিকতার সূত্রপাত হয় । ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকির 'বেঙ্গল গেজেট' প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলায় আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হয় । পত্রিকাটির বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সকল পক্ষের জন্য উন্মুক্ত হলেও এটি কারো দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন একটি সাপ্তাহিক রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক পত্রিকা । ১৮১৮ সালে বাংলা সাংবাদিকতার সূচনা হয় । সে বছর বেঙ্গল গেজেট ( কলকাতা ) দিকদর্শন ( কলকাতা ) এবং সমাচার দর্পণ ( শ্রীরামপুর ) নামে তিনটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল । প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ শ্রীরামপুর থেকে ১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় । ১৮৪৭ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার রংপুর থেকে 'রংপুর বার্তাবহ' প্রকাশিত হয় ও ঢাকা থেকে 'ঢাকা প্রকাশ' ১৮৬১ সালে এবং 'ঢাকা দর্পণ' ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয় ।
বাংলা ভাষায় বাঙালি পরিচালিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র সংবাদ প্রভাকর ( প্রথম প্রকাশ : ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন ) । সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত । এই পত্রিকাটির সেকালে রাজনৈতিক চেতনা প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না । তবে সাহিত্য, শিক্ষা ইত্যাদি প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল । এরপর হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় 'হিন্দু পেট্রিয়ট' এবং দ্বারকাননাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত 'সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ' ( ১৫ নভেম্বর, ১৮৫৮ ) । হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সেই সময়ে ইংরেজদের দ্বারা অত্যাচারিত প্রজাদের পক্ষে কলম ধরেন 'হিন্দু পেট্রিয়ট'র সম্পাদক হিসেবে । হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদনা করেন ১৮৫৬ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত । ১৮৫৪ থেকে হরিশচন্দ্র ইংরেজদের শাসন আর নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন । এক নির্ভীক, দৃঢ়চেতা, বঙ্গসন্তান হিন্দু পেট্রিয়টের আপোসহীন সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় নিবন্ধের মাধ্যমে নীল বিদ্রোহের একের পর এক বিবরণ প্রকাশ করতে থাকেন তাঁর সংবাদপত্রে । ফলে নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয় । ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয় । হরিশচন্দ্র এই মত দেন যে কঠোর শোষণের ফলে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে । সম্ভবত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ই দেশে প্রথম সংবাদপত্র সম্পাদক যিনি বিভিন্ন জায়গায় সংবাদদাতা রেখেছিলেন । যশোরে তাঁর সংবাদদাতা ছিলেন শিশির কুমার ঘোষ । ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় বসুমতি নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের 'ডন' পত্রিকা ।দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে নব নব চিন্তাধারা সঞ্চরণে ডনের কৃতিত্ব অনন্য সাধারণ । এর আয়ুষ্কাল ছিল ১৬ বছর । ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পত্রিকাটি পরিবর্তিত হয় 'দি ডন এন্ড সোসাইটিজ ম্যাগাজিন' নামে । শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের নভেম্বরে । ১৯০৬ সালের মার্চ মাসে সন্ত্রাসবাদীদের মুখপাত্ররূপে 'সাপ্তাহিক যুগান্তর' প্রকাশিত হতে থাকে । এই পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত । রাজদ্রোহিতার অভিযোগে ভূপেন্দ্রনাথ ও ব্রহ্মবান্ধবকে অভিযুক্ত করা হয় । বিদেশী শাসকদের অধীনে থাকা বিচারব্যবস্থাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন ব্রহ্মবান্ধব । ফলে কারাগারে বন্দী থেকেই তাঁর মৃত্যু হয় ।
এর পরপরই নজরুল বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক বলিষ্ঠ অধ্যায়ের সূচনা করেন । অভিভক্ত বাংলার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম । সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী ধারার প্রবর্তন করেছিলেন । জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এবং বিপ্লবী জাগরণ ঘটাতে তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যম কেউ হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন । নজরুলের সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নবযুগ, ধুমকেতু, লাঙল ( পরবর্তী কালে গণবাণী নামে প্রকাশিত ) । এই পত্রিকাগুলো বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে । সাহিত্য, সমকালীন রাজনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত পত্রিকাগুলো । সাংবাদিক জীবন শুরুর আগে করাচি সেনানিবাসে হাবিলদার পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন নজরুলের সাহিত্যজীবন শুরু হয় । করাচি সেনানিবাস থেকে তাঁর প্রেরিত কয়েকটি গল্প কবিতা ও প্রবন্ধ কলকাতার 'সওগাত', 'প্রবাসী' ও 'বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা' প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয় । ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও ১৯২০ সালের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ সেনার ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে গেলে মার্চ মাসে নজরুল দেশে ফিরে কলকাতায় সাহিত্যিক-সাংবাদিক জীবন শুরু করেন । কলকাতায় তাঁর প্রথম আশ্রয় ছিল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মোজাফফর আহমেদের সঙ্গে । নজরুল ও মোজাফফরের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় নবযুগ পত্রিকা । এতে সম্পাদক হিসেবে ফজলুল হকের নাম মুদ্রিত হলেও মূলত নজরুল এবং মোজাফফর আহমদই
ছিলেন এই পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক । এখান থেকেই তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত হয় । খিলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের তীব্রতায় তখন সারা দেশ ছিল উত্তাল । সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের চুলচেরা বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছিল এই পত্রিকায় । নবযুগ পত্রিকাতেই কবি অত্যন্ত আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন । এখানেই তাঁর বেশ কিছু রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যার প্রতিটিতেই ছিল জ্বলন্ত দেশপ্রেমের প্রকাশ । আন্তর্জাতিক চেতনা এবং বৈপ্লবিক চিন্তার বিস্তার । অত্যাচারী ইংরেজ শাসক, দেশীয় তোষামোদকারী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও ক্ষুরধার সম্পাদকীয় রচনার মাধ্যমে তিনি সেদিন ইংরেজ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন । বিদেশী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী যে গণজাগরণ শুরু হয়েছিল তা আরো গতিশীল করতে কাজী নজরুল ইসলাম নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতার জগতে অবতীর্ণ হন । ১৯২০ সালে নবযুগ পত্রিকায় 'মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে ?' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত ১০০০ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয় । অবশ্য এই প্রবন্ধ প্রকাশের আগেও নজরুলের জ্বালাময়ী লেখার কারণে ইংরেজ সরকার তিনবার এই পত্রিকাটিকে সতর্ক করেছিল ।
নজরুল নবযুগে সংবাদ পরিবেশনের স্টাইল ও তার হেডিং প্রণয়নে ও মন্তব্যে, বড়ো সংবাদকে সুকৌশলে সংক্ষিপ্তকরণ, মাঝে মধ্যে ছোটো ছোটো কবিতা ও প্যারোডির ব্যবহারে সংবাদগুলিকে উপভোগ্য করে তুলতেন । নজরুলের কলমে কথ্যভাষার সঙ্গে আরবি, ফারশসি, দেশি শব্দের নিপুণ প্রয়োগে সেগুলোকে সরস, তীক্ষ্ণ ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত । নজরুল অনেক সংবাদের শিরোনাম দিতেন কবিতার লাইন উদ্ধৃত করে । এক্ষেত্রে বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন । যেমন রবীন্দ্রনাথের একটি গানের লাইন, 'তোমারি গেহে পালিছ স্নেহে / আমি ধন্য ধন্য হে' । সেখান থেকে নজরুল তাঁর নিজের মতো করে একটি সংবাদের শিরোনাম করলেন, 'তোমারই জেলে পালিছ ছেলে / আমি ধন্য ধন্য হে' । আর প্রত্যেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধ্যে সমৃদ্ধ । সংবাদের শিরোনামে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য তিনি লোকসাহিত্য, বৈষ্ণবপদাবলি ইত্যাদির দ্বারস্থ হয়েছেন । রবীন্দ্রনাথের কবিতার পংক্তি ভেঙে সংবাদের শিরোনাম করেছেন তিনি । যেমন, ক) আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণসখা ফৈসুল হে আমার । খ) কালাতে ধলাতে লেগেছে এবার মন্দমধুর হাওয়া / দেখি নাই কভু, দেখি নাই ওগো, এমন ডিনার খাওয়া । নবযুগ পত্রিকায় দেশের খবর, পরদেশপঞ্জি, মুসলিম জাহান, ইত্যাদি সংবাদ বিভাগ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল । মুসলিম জাহানে প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনামের নমুনা– দাড়িতে আগুন লেগে অক্কা / টরে টক্কা টরে টক্কা । অর্থাৎ জন ক্যামিয়াস নামে স্কটল্যান্ড এর এক অধিবাসী একদিন আধার রাতে ঘড়ি দেখার জন্য দেশলাই জালে দুর্ভাগ্যক্রমে তার দাড়িতে আগুন লেগে জামা ও বিছানায় আগুন ধরে যায় শেষে লোকটি আগুনে পুড়ে মরে । এই সংবাদের শেষে টিপ্পনী ছিল–'এবার টিকিট এ আগুন লাগবে কখন ? / কি আনন্দ, কি আনন্দ !
নবযুগ প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯২২ সালের মে মাসে নজরুল 'দৈনিক সেবক' পত্রিকায় যোগদান করেন । এই পত্রিকার মালিক ছিলেন মাওলানা আকরাম খান । দুর্ভাগ্যক্রমে নজরুল এই পত্রিকার সঙ্গে বেশি দিন যুক্ত থাকতে পারেননি । ১৯২২ সালের ২৫ জুন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর পর নজরুল এক বিরাট সম্পাদকীয় প্রবন্ধ রচনা করেন । কর্তৃপক্ষ লেখাটি কাটছাঁট করে প্রকাশ করায় নজরুল ক্ষুব্ধ হয়ে ওই পত্রিকার সংস্থা ত্যাগ করেন । ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় অর্ধসাপ্তাহিক 'ধুমকেতু' প্রকাশিত হয় । নবযুগ পত্রিকায় নজরুলের বিশেষ ভূমিকার পর ধুমকেতু পত্রিকার প্রকাশ ছিল একান্তই অবধারিত । এই পত্রিকাকে অভিনন্দন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমূখ অনেকেই আশীর্বাণী প্রেরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী ছিল—
আয় চলে আয়, যে ধুমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নি সেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন ।
অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালো হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে,
আছে যারা অর্ধচেতন ।
ধুমকেতুর সম্পাদকীয়তেই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করলেন, 'সর্বপ্রথম ধুমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায় ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশের অধীনে থাকবে না ।' নবযুগের মতো ধূমকেতুতেও সংবাদ শিরোনামে নজরুল বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন । ধূমকেতুর এরকম কয়েকটি শিরোনাম–অমৃতবাজার পত্রিকার প্রকাশক সম্পাদক মতিলাল ঘোষের মৃত্যু সংবাদ এর শিরোনাম 'মর্ত্যের মতিলাল স্বর্গে' । বোম্বাই প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কয়েকজন গভর্মেন্টের গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচর হিসেবে ধরা পড়ার পর সংবাদের শিরোনাম 'বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা / ঘর শত্রু বিভীষণ' । সত্যাগ্রহ যুদ্ধ নতুন করে শুরু হলে খবরের শিরোনাম হয় 'দুঃশাসনের বস্ত্রহরণ' । মুলতান ও তেলেনিপাড়ায় মহরম উপলক্ষে মারামারি হলে খবরের হেডিং দেন 'মহরম নিয়ে দহরম মহরম' । বার্লিনে পুলিশের সাথে কমিউনিস্ট মিছিলকারীদের হাঙ্গামার খবরের শিরোনাম 'পুলিশে কুলিশে' । সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তুরস্কের সংগ্রাম সমর্থন করে একটি শিরোনাম 'চালাও যুদ্ধ চালাও' । তারপর মন্তব্যসহ সংবাদটি পরিবেশিত হয়েছে 'সে মানে না মানা / লাঠি দেখলেই বলে না না' । দিল্লিতে এক শিশুর ট্রাম এর নিচে কাটা পড়ে মারা গেলে ট্রামচালককে জনতা মারধর করে এবং পুলিশ তাকে আটক করে । এই খবরের হেডিং দেওয়া হয় 'এসব কন্ডাক্টর ব্যাটাদের তুলো ধোনা করা উচিত' । ডাবলিনে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কেন্দ্রটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য চরমপন্থীরা বেশ কয়েকটি বোমা রেখেছিল । তারই একটি ফেটে বিকট শব্দ হয়েছিল । এই খবরের শিরোনাম দেন 'বোম ভোলানাথ' । এই উদ্ধৃতিগুলো থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, নজরুল ইসলামের সংবাদচেতনা ও তার সঙ্গে সেন্স অব হিউমার যথেষ্ট মাত্রায় সমৃদ্ধ ছিল ।
১৯২৫ সালের শেষ দিকে ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে লেবার স্বরাজ পার্টি গঠিত হওয়ার পর নজরুলের পরিচালনায় 'লাঙল' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় । সেখানে তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল যা কমুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভাবানুসরণে রচিত হয়েছিল । ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধলে লাঙল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা হ্রাস পায় । এরপর লাঙলের নাম পরিবর্তন করে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই আগস্ট 'গণবাণী' প্রকাশিত হয় । নজরুল গণবাণীর সম্পাদক ও লেখক ছিলেন । এই পত্রিকায় নজরুলের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে লেখা কবিতা মন্দির মসজিদ, লাল নিশান, কান্ডারী হুশিয়ার ইত্যাদি প্রকাশিত হয় । তাঁর লাঙল পত্রিকায় নজরুল ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' উপন্যাস যা কিনা সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির উপর রচিত, তার অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে গেছেন । এই পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতাটির জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয় এবং তাঁর এক বছরের কারাদন্ড হয় ।
কাজী নজরুল ইসলামের সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সাম্যবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে নজরুলের ভূমিকা অবিস্মরণীয় । কি কবিতায়, কি গানে যেমন তাঁর মনোভাব অখন্ডভাবে প্রকাশ করতে ভয় পাননি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি জনতার সঙ্গে একাত্ম মিশে ছিলেন । পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেছেন । শুধুমাত্র বাংলা গান ও কবিতা নয়, সাংবাদিকতার মাধ্যমে সাম্যমৈত্রীর কবি, প্রেম ও দ্রোহের অগ্রণী কবি, জাগরণ ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে গিয়েছিলেন ।
No comments:
Post a Comment