Wednesday, October 22, 2025

ঊনবিংশ শতকের যুবসমাজ ও দেবী কালিকা

🌺 ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব

ভূমিকা–

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল বাংলার সমাজজীবনের এক নবজাগরণের যুগ। সমাজে একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে জন্ম নিল এক নতুন চিন্তাধারা, যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। অন্যদিকে তেমনি সমাজের অন্তরাত্তায় জেগে উঠেছিল জাতীয়তাবোধ ধর্ম চেতনা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান । এই আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে বাঙালির এক মহান প্রতীক রূপে উদ্ভাসিত হন মা কালিকা । এই সময়ের যুবকরা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী চিন্তার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ইংরেজ শাসনের ফলে দমিত জাতির চেতনায় মা কালী হয়ে ওঠেন প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার প্রতীক । কালীর রুদ্র ভয়ংকর অথচ মাতৃত্বময় রূপ যুবকদের মনে জাগিয়ে তোলে এক অন্তর্গত শক্তি তারা অনুভব করেন মা কালী ধ্বংস করেন কেবল অশুভকে অন্যায়কে । তিনি যেন তাঁদেরও সাহস যোগান অন্যায় ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ।সংহার ও সৃষ্টির মিলিত শক্তির দেবী । কিন্তু এই নববোধের ভেতরেই এক গভীর মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল— আধুনিকতার আকর্ষণ ও ঐতিহ্যের টান। উনবিংশ শতাব্দীতে মা কালীর পূজা বাঙালি যুব সমাজের মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করে মূলত বিভিন্ন জমিদার ও ধনী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রচলন শুরু হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও রামপ্রসাদের মত ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে এই পূজা আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই সময়ের যুবকেরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তির সাথে উপাসনা করে ।
এই যুগের যুবসমাজ, যারা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগছিল, তারা নিজের জাতীয় ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক খুঁজতে গিয়ে ফিরে তাকায় মা কালিকা-র দিকে।
তিনি তাঁদের কাছে হয়ে ওঠেন আত্মশক্তির মূর্তি, জাতীয় গৌরবের প্রতীক ও নবজাগরণের মাতৃরূপ।

নবজাগরণ ও যুবসমাজের মানসিক পরিবর্তন

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজে নানা সামাজিক কুসংস্কার জাতপাত অন্ধবিশ্বাস ও নারী নির্যাতন চলছিল । শুরুতে বাংলা সমাজে একদিকে রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে যুক্তিবাদী চিন্তার উত্থান, অন্যদিকে সমাজে গভীর কুসংস্কার, জাতিভেদ ও অন্ধবিশ্বাসের প্রভাব ছিল প্রবল।
এই বৈপরীত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল সেই সময়ের যুবসমাজ।
তারা একদিকে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত, অন্যদিকে নিজের শিকড়ের সন্ধানে ব্যাকুল। এই প্রেক্ষাপটে মা কালীর অনুমুক্ত নির্ভীক ও রক্তমাখা রূপ সমাজের চোখে হয়ে ওঠে সংস্কার ভাঙ্গা শক্তির প্রতীক রূপ । যেমন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, 'আমাদের চাই না ভীরু ভক্তি চাই কালীর মতো শক্তি ও সাহস ।' এই আহ্বান যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল আত্মবিশ্বাসে ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে ।
এই সন্ধানেই তারা আবিষ্কার করে মা কালিকা-র রূপে নিজের ঐতিহ্য, শক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রতীককে।

 মা কালিকা : শক্তি ও জাগরণের দেবী–

মা কালিকা শাক্তধর্মে শক্তির চূড়ান্ত রূপ।
তিনি একাধারে ভয়ংকর ও করুণাময়ী, বিনাশিনী ও জননী।
তাঁর রূপের মধ্যে নিহিত আছে সৃষ্টি ও ধ্বংসের এক অদ্বিতীয় দ্বন্দ্ব—
যা জীবনদর্শনকেই প্রতিফলিত করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে মা কালী হয়ে ওঠেন বিপ্লবীদের আদর্শ দেবী । শোনা যায় অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুবগোষ্ঠীর অনেক যুবক গোপনে কালীপূজার আসরে অস্ত্র প্রতিজ্ঞা নিতেন দেশের স্বাধীনতার জন্য । ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল । তাঁদের কাছে কালী মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ন্যায় শক্তি । এই সময় যুবকরা মায়ের মাতৃরূপকে ভক্তি ও ভালবাসার সাথে পূজা করতেন যা তাদের আধ্যাত্মিক চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল । যুবকরা নিজেদের মুক্তি সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনায় কালীর কাছে প্রার্থনা করতেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর কবিতা, গান ও নাটকে কালীর প্রতীকী উপস্থিতি সমাজ চেতনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল । বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম সংগীতেও মাতৃভূমি কল্পিত হয়েছে দেবী মূর্তি রূপে । পরবর্তীকালে এই ভাবনা বিকশিত হয়ে কালীমূর্তিতে জাতীয় মাতার রূপ ধারণ করে । কালী সাধক কবিরাজ রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্তের গানে কালী শুধু ভক্তির দেবী নন । তিনি এক দার্শনিক চিন্তার কেন্দ্র । তাঁদের গানের যেমন আছে ভক্তির আবেগ তেমনি আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ।কালী পূজা বাঙালি যুব সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল । যার ফলস্বরূপ অনেক সাহিত্য ও সংগীত তৈরি হয়েছিল সে সময়ে ।

রামপ্রসাদ সেন তাঁর গানে লিখেছিলেন– 
> “কালো তোমার রূপ রে কালী, তাতে যে আলো ঝরে।”

এই ‘কালো’ রূপের মধ্যে যে আলো, সেই আলোই ঊনবিংশ শতাব্দীর তরুণদের চিন্তায় আনল আত্মপ্রত্যয়ের জ্যোতি।
তারা বুঝল, কালী মানে কেবল অন্ধকার নয়—অন্ধকার ভেদ করা আলোর শক্তি। এই সময়ের সাহিত্য ও সমাজে নারীর প্রতিচ্ছবি নতুন করে দেখা হচ্ছিল । মা কালীর চিত্র, যিনি একাধারে ভয়ংকরী ও মমতাময়ী, যুবসমাজকে শেখান নারীর শক্তিকে শ্রদ্ধা করতে । তাকে দেবীরূপে নয় । শক্তির প্রেরণার উৎস রূপে দেখতে । এর মধ্য দিয়ে সমাজে নারী পুরুষের সমতার ভাবনা জন্ম নেয় । এই ভাবনাই পড়ে নারী মুক্তি আন্দোলনের দর্শনকে প্রভাবিত করে ।

স্বামী বিবেকানন্দের কালীভাবনা ও যুবচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব সবচেয়ে গভীরভাবে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দ-এর দর্শনে।
তাঁর কাছে কালী ছিলেন ভয়ের নয়, বরং শক্তির দেবী।
তিনি বলেছিলেন—

> “যে কালীকে তুমি ভয় পাও, সেই কালীই শক্তির মূর্তি। তাঁর পূজা মানে নিজের মধ্যে সেই শক্তির জাগরণ।”

বিবেকানন্দের আহ্বান ছিল স্পষ্ট—

 যুবকরা যেন নিজেদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে চিনতে শেখে, নিজের জাতি ও সমাজের মুক্তির জন্য সেই শক্তিকে কাজে লাগায়।
এই ভাবনা যুবসমাজকে দার্শনিক শক্তির পাশাপাশি কর্মের অনুপ্রেরণাও দিয়েছিল।

 বঙ্কিমচন্দ্র ও দেশমাতার কালীরূপ–

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর চিন্তায় মা কালিকা এক নতুন অর্থে উদ্ভাসিত হন।
তাঁর “বন্দে মাতরম্‌” কবিতায় মাতৃভূমিকে কালীস্বরূপ কল্পনা করা হয়েছে—
তিনি অন্নদা, করুণাময়ী, কিন্তু প্রয়োজনে ভয়ংকর রণদুর্গা।
এভাবেই কালী দেবী হয়ে উঠলেন দেশমাতার প্রতীক।

এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল দেশপ্রেমে, জাতীয়তাবাদে ও আত্মবিসর্জনের চেতনায়।
মা কালিকা এখানে ধর্মীয় সত্তা নয়, বরং এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।

 অরবিন্দ ঘোষ ও বিপ্লবী চেতনা–

শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ-এর চিন্তায় কালী রূপান্তরিত হন বিপ্লবের দেবী হিসেবে।
তিনি লিখেছিলেন—

> “যখন জাতি নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন কালী আসেন ধ্বংস করতে, যাতে নতুন সৃষ্টি সম্ভব হয়।”

এই ভাবনাই পরবর্তী বিপ্লবী আন্দোলনের যুবকদের মনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
তারা কালীকে দেখেছিল অন্যায় ও দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রেরণাদাত্রী হিসেবে।

কালীপূজা : সমাজসংহতি ও আত্মচেতনা–

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কালীপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল সামাজিক সংহতির প্রতীক।
শিক্ষিত যুবকরা নিজের পাড়ায়, সমাজে একত্রিত হয়ে কালীপূজার আয়োজন করত।
এই মিলনই জাতিগত ঐক্যের এক প্রতীক হয়ে ওঠে।
কালীপূজার আধ্যাত্মিকতা থেকে জন্ম নেয় সমষ্টিগত আত্মশক্তির ধারণা।

                       নারীশক্তি ও কালীভাবনা–

মা কালিকা নারী হয়েও সর্বশক্তিময়—এই ভাবনা ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায় নারীর মর্যাদা নিয়ে।
এই সময়েই নারীশিক্ষা ও নারীসমতার আন্দোলন শুরু হয়, যার পেছনে ছিল শক্তিস্বরূপা কালীচেতনার প্রভাব।
নারী আর দুর্বল নয়—তিনি সৃষ্টি, করুণা ও সাহসের প্রতীক।

মানসিক ও নৈতিক প্রভাব–

যুবসমাজ মা কালিকার ভক্তি থেকে শুধু ধর্মীয় আশ্রয় নয়, পেয়েছিল মানসিক দৃঢ়তাও।
কালী তাঁদের শিখিয়েছিলেন—
ভয় নয়, আত্মবিশ্বাসই জীবনের মূলমন্ত্র।
অতএব, কালীভক্তি হয়ে উঠেছিল তাদের কাছে এক নৈতিক পুনর্জাগরণের পথ।

উপসংহার–

ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল বহুমাত্রিক—
আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক।
তিনি ছিলেন একাধারে ভক্তির দেবী ও কর্মের অনুপ্রেরণা, জাতীয়তাবাদের মাতা ও ব্যক্তিসত্তার শক্তি।

বিবেকানন্দের ভাষায়—

> “শক্তি যদি জাগে, তবেই জাতি বাঁচে।”

মা কালিকার উপাসনার মধ্য দিয়েই এই যুগের যুবসমাজ সেই শক্তি খুঁজে পেয়েছিল—
যা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল, জাতীয় চেতনা জ্বালিয়েছিল,
এবং বাঙালির নবজাগরণের ভিত রচনা করেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজের কাছে মা কালী ছিলেন শুধু উপাস্য দেবী নন, বরং চেতনার প্রতীক, শক্তির উৎস ও বিপ্লবের প্রেরণা । তাঁর রুদ্ররূপে সেসময়ের যুবক দেখেছিলেন সংস্কার ভাঙা ও প্রতিবাদের শক্তি । তাঁর মাতৃরূপে পেয়েছিলেন সান্তনা ও মমতা ।

 সংক্ষেপে বলা যায়,
ঊনবিংশ শতাব্দীর যুবসমাজের উপর মা কালীর প্রভাব ছিল
আত্মশক্তির জাগরণ, দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা, এবং নবজাগরণের আত্মা। মা কালী হয়ে উঠেছিলেন এক যুগের মানসিক মুক্তির প্রতীক যা পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাগরণের পথ প্রশস্ত করে ।

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা

অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের কালীপূজা 

   ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অগ্নিযুগ শব্দটি এসেছে সেই সময়ের বিপ্লবী যুবকদের আত্মোৎসর্গ ও অনলস দেশপ্রেমের জন্য । এটি মূলত ১৯০৫ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়কে নির্দেশ করে । যখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর বাংলার যুবসমাজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় । এই বিপ্লবীদের মানসিক জগতের গভীরে যে শক্তি কাজ করেছিল তার অন্যতম উৎস ছিল মা কালিকা । সংহার, শক্তি ও মুক্তির চিরন্তন প্রতীক । তিনি রুদ্ররূপে ধ্বংস করেন অন্যায় । আবার মাতৃত্বের রক্ষা করেন সৃষ্টিকে । বিপ্লবীরা এই রূপেই দেখেছিলেন তাঁদের আদর্শ দেবীকে । যিনি অন্যায়ের বিনাশে অনুমোদন দেন, দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করার সাহস যোগান । তাঁরা বিশ্বাস করতেন যেমন কালী অসুর বধ করেন তেমনি পরাধীনতার অশুভ শক্তিকেও বিনাশ করতে প্রেরণা দেন ।

শোনা যায়, অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, এমনকি ছোটো ছোটো যুব বিপ্লবীগোষ্ঠী কালীপূজার রাতেই গোপনে অস্ত্র স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করতেন । মেদিনীপুর শহরের কর্নেলগোলা কালীমন্দিরেই দীক্ষা নিয়েছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। ধুপের ধোঁয়া, প্রদীপের আলো, ঢাকের শব্দে মিশে যেত শপথের ধ্বনি । সেই পবিত্র অন্ধকারে জেগে উঠত আগুন । যা পরে জ্বালিয়ে দিত সাম্রাজ্যের শেকল ।

আজও যখন অন্যায় দেখি, নিপীড়ন দেখি, দুর্নীতি দেখি, তখন মনে হয় আমাদের দরকার সেই আগুন, সেই সাহস যা একদিন অগ্নিযুগের যুবকদের জাগিয়েছিল মা কালিকার আহ্বানে।

 হে চেতনার যোদ্ধাগণ, চলুন আমরা আজও সেই মন্ত্র জাগি–

এলো আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, 
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে ।।

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির

প্রাচীন ত্রিপুরার প্রাচীন কালীমন্দির 

ত্রিপুরার উদয়পুরে অবস্থিত মাতা ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির একটি প্রাচীন কালীমন্দির । ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা ধন্য মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । তবে ত্রিপুরারাজ্যে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার আরো প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । আমরা জানি যে, প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা আরও বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল । সেই হিসেবে কুমিল্লা ও একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল । কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় চন্ডীমন্দির বা চন্ডীমুড়া মন্দির নামে একটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে । চন্ডীমুড়ায় দুটি মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত । দক্ষিণ পাশের মন্দিরটি চন্ডী মন্দির ও উত্তর পাশের মন্দিরটি শিব মন্দির । চন্ডী মন্দিরটি দেবী কালিকার উদ্দেশ্যে নিবেদিত । এই চন্ডীমন্দির সম্বন্ধে একটি পুরাণ কাহিনি প্রচলিত রয়েছে । দেবী চন্ডী যখন শুম্ভ নিশুম্ভ নামক দুই অসুরের সাথে যুদ্ধ করছিলেন তখন বেশ কিছু অসুর জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গায় পালিয়ে আসে । দেবী তখন এখানে অসুরদের বধ করেন । দেবীর দেহতাপের ফলে পাহাড়ের মাটির রং লাল হয় । ফলে এই পাহাড়ের নাম লালমাই পাহাড় হয় ।

সপ্তম শতাব্দীর খড়্গবংশীয় মহারাজ দেবখড়্গ তাঁর রানি প্রভাবতীর ইচ্ছাতে এই মন্দির ও একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ ও তার রানি হিন্দু ছিলেন । তিনি নিজে বৌদ্ধ হয়েও মা চন্ডীর উপাসনা করতেন । বৌদ্ধরাজ দেবখড়্গের স্ত্রী প্রভাবতী দেবী অমর কীর্তি স্থাপনে বদ্ধপরিকর হয়ে এখানে দুটি মন্দির স্থাপন করেন । একটি চন্ডীমন্দির ও অপরটি শিব মন্দির চন্ডীমন্দিরে অষ্টভুজা সর্বানী মহাসরস্বতী । অপরটিতে শিবমূর্তি স্থাপন করেন । এরপর সময়ের সাথে মন্দির দুটি হারিয়ে যায় । ত্রিপুরার যুবরাজ চম্পক রায় দেওয়ানের ভগ্নী দ্বিতীয়া দেবী এই মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন । তিনি পাহাড়ের দক্ষিণ পূর্বে একটি দিঘি খনন করেন । যার নাম দুতিয়ার দিঘি ।

জয় মা । সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা ।

গাড়ুই ব্রত

 গাড়ুই ব্রত

           গাড়ুই ব্রত লৌকিক ব্রত । এর প্রতি পরতে পরতে লোকজীবনের ছাপ রয়েছে ।ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ধানের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায় নব্য প্রস্তর যুগে ( ৭০০০-৬০০০ খ্রি.পূ. ) ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে । এরপর সিন্ধু সভ্যতায় (৩০০০-২৫০০ খ্রি. পূ.) ধান চাষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন । এটি একটি গ্রীষ্মকালীন ফসল হিসেবে চাষ করা হত । প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমূহের উপর সর্বশেষ গবেষণায় জানা গেছে যে, সিন্ধুসভ্যতায় ধারণার চেয়েও আগে থেকেই ধান চাষ হত । গবেষণা আরও জানাচ্ছে যে, সিন্ধুসভ্যতার মানুষেরা মিশ্রকৃষির ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য ছিল । তারা গ্রীষ্মকালে ধান, মিলিট ও শিম্ব জাতীয় শস্য উৎপাদন করত এবং শীতকালে গম, বার্লি ও ডাল জাতীয় শস্য উৎপাদন করত ।

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থসমূহে ধানকে 'ব্রীহি' বলা হত । ঋগ্বেদ ও যজুর্বেদসহ বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থে এটিকে একটি প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । বৈদিক যুগে ধানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্য বিবেচনা করা হত এবং ব্যাপকভাবে চাষ করা হত । বৈদিক ধর্মীয় ভাবাপন্ন হওয়ার আগে কৌম মানুষেরা লৌকিক দেবদেবীর পূজার্চনা করত । সেখানে বৈদিক ব্রাহ্মণের প্রবেশ ঘটেনি । পরবর্তীসময়ে এইসব ব্রাত্য দেবদেবীরা দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন । বাংলার লোকধর্মীয় পূজাপদ্ধতিতে নৈবেদ্য বা পূজার উপকরণ হিসাবে গৃহস্থের উৎপাদিত ফসলের অংশ বা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত সহজলভ্য উপকরণগুলোকেই নিবেদন করতে দেখা যায় । এরকম পূজায় বা আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত অনেক বিষয়ের মধ্যেই আমাদের অতিক্রম করে আসা প্রাচীন সভ্যতার কিছু কিছু বিষয় অজান্তেই থেকে যায় । এরকম শিলনোড়ার ব্যবহার প্রস্তরযুগের নিদর্শন, পূজার সামগ্রী কোশাকুশি তাম্রযুগের স্মৃতিবাহক । গাড়ুই ব্রতে জুমের চালের ব্যবহার বাঙালির কৌমজীবনের অধ্যায়ের ক্ষীণ নিদর্শন । বাঙালি যতই জাতের বড়াই করুক । আদিতে তারা কৌম ও সংকর জাতি । বিবর্তনের সেই অধ্যায়টা অজানা বলে আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই করে মরি । পূজার উপকরণ আমাদের অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় যাতে আমরা বুঝি ।

Tuesday, October 7, 2025

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়

ভাষাবিহীন ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয় 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

গত পরশুদিন আমরা গেছি ব্যাঙ্গালোর শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিক্কাবাল্লাপুর পাহাড়ে ঈশা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত আদিযোগী শিবমূর্তি দেখার জন্যে । বিশাল পাহাড়কে পেছনে রেখে দিগন্ত খোলা আকাশ এবং বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে বিশাল ধ্যানমগ্ন শিবমূর্তি । সমস্ত চরাচর জুড়ে এক নীরব নিস্তব্ধ প্রসন্নতা বিরাজ করে এখানে । প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আদিযোগী মূর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় আলো ও শব্দের যুগলবন্দী মোহময় ধারাভাষ্য । সঙ্গে সদগুরুর প্রবচন । প্রায় ১৫ মিনিটের এই অনুষ্ঠান অন্ধকার প্রান্তরে মৌনতার মাঝখানে যেন দৈববাণী ও আলোর বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে এক অনৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । মেঘে ঢাকা অন্ধকার আকাশ থেকে ছড়িয়ে পড়া বিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে যোগেশ্বর শিবের মিথসমূহ একে একে উন্মোচিত হয় আলো ও শব্দের মোহজালে তখন সমগ্র চত্বরে মহাবিশ্বের ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ জড়িয়ে ধরে যেন সমস্ত সত্তাকে । মৌনী যোগেন্দ্রর সঙ্গে একাত্মবোধ জেগে ওঠে । ভারতের নানাপ্রদেশের মানুষের ছায়ামিশ্রণের এক প্রান্তর । এখানে হিংসাবিদ্বেষ নেই । পরিচয়হীন আত্মপরিচয়ে এক । 'আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়' ।

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর ফেরার পথে ছেলে ও বৌমা আমাদের নিয়ে এল সেই চত্বরের বাইরে একটা বড়ো খাবারের দোকানে । কি সুন্দর দৃষ্টিনন্দন রেস্টুরেন্ট। পাহাড়ের ঢাল কেটে ধাপে ধাপে গ্রাহকদের বসার জায়গা করা হয়েছে অনেকটা গ্যালারির মতো । আলো ঝলমল ও খোলামেলা, গাছগাছালিতে ভরপুর ।  পাহাড়ের উপরের অংশটা নিয়ে দোতলা । সেখানেও পরিপাটি বসে খাওয়ার ব্যবস্থা । এককথায় পাহাড়ের ঢালটাকে কি সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে । আমরা হলে টিলা কেটে সমান করতাম । এখানকার মানুষ প্রকৃতিচেতনায় সমৃদ্ধ । সারা ব্যাঙ্গালোরে এতো বিশাল বিশাল ইটকাঠের ইমারত টাওয়ার থাকলেও বন কিন্তু চোখে পড়ার মতো । একটু পরপরই গাছগাছালিতে ঘেরা পার্ক রয়েছে । সর্বক্ষণ একটা মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।  রেস্টুরেন্টে ঢোকার পরপরই এখানে কর্মরত কয়েকটি ছেলেকে দেখে আমার রক্তের ভেতর একটা দোলা দিয়ে গেল । ছেলেগুলো আমাদের খাবার পরিবেশন করল । বাসনপত্র নিয়ে গেল ধোয়ার জন্যে । সবাই মিলে কাজ করছে এখানে । 

একটা ছেলে একটু দূরে বসে কাজের ফাঁকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল আনমনে । আমি আমার খাওয়া সেরে তার পাশে বসলাম । পরিবারের সবাই আমাকে লক্ষ করছে । আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম, ভাই, তূমহারা ঘর কাঁহা ? ও বলল, ত্রিপুরা। নুং বরক দে ? আমি প্রশ্ন করলাম । সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বড়ো বড়ো করে জবাব দিল,  ইঁ , নুং ? আমাকে প্রশ্ন করল । আং ব ত্রিপুরা হা নি । আমি বললাম । প্রশ্ন করলাম নিনি নক বিয়াং । বলল, মনুঘাট । আমবাসানি কান্দার' । আং সাব্রুমনি সে ।  আমিও আমার স্থাননাম বললাম । আমার আধভাঙা ককবরক শুনে মনে হল সে খুশি । দেববর্মা দে নুং । ইঁহি । ত্রিপুরা। তাম' নিনি মুং । চিকনিয়া ত্রিপুরা । ও বলল । 

চিকনিয়া জানাল কয়েকমাস যাবত এখানে কাজ করছে । বেতন মাসে সতেরো হাজার টাকা । দুবেলা খাবার ও থাকার জায়গা মালিকের দেওয়া । সে নাকি সাব্রুমেও ছিল কিছুদিন । মাগরুমে একটি ব্রিজ  তৈরির কাজ করেছিল কিছুদিন । আমি বললাম, তোমাদের দেখেই আমি আমার পরিবারকে বলেছি এরা ত্রিপুরার হবে । ছেলেটি হাসল । সারল্যের হাসি । আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার খুব ভালো লাগছে । ঘরের মানুষের সঙ্গে যেমন কথা বলছি । আপনি বাঙালি আমি ত্রিপুরা কিছু মনে হচ্ছে না । সুন্দর বাংলা বলে ছেলেটা । আমাকে পেয়ে আরও বলল, এখানে কাজ করছি ভালোই। কিন্তু ওরা কানাড়ায় কথা বলে । আমরা না বুঝলে গালাগাল দেয় । এছাড়া আর সবই ভালো । আমি বললাম, চলো একটা ছবি নিই দুজনে । সঙ্গে সঙ্গে ও খুশি । আমার পাশে এসে বসল । সেলফি তুললাম । তারপরেই তার ডাক পড়ল । সে উঠে চলে গেল কাজে । 

আমি মহেশ্বর শিবের মতো স্থানু হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলাম । আমার রক্তের ভেতর যেন ইতিহাসের কোন অনাদিকালের নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় রক্তের মিশ্রণের এক ফল্গুর কল্লোল উঠছে । আমিও সেই । আদিযোগী ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৬ )

আজ বিজয়া দশমী । দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিন । ভারতের অন্য সব প্রান্তে এই দিনটি দশেরা উৎসব হিসেবে শ্রদ্ধা ভক্তির সঙ্গে পালিত হয় । রামায়ণ মহাকাব্যে বর্ণিত রামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ বিজয়ের এই দিনটিকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় হিসেবে পালিত হয় । কর্ণাটক রাজ্যের মহীশূরে চামুন্ডেশ্বরী মন্দির, কুর্গের মাদিকেরীসহ সর্বত্র এই দশেরা উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় । দশেরাকে কর্নাটকের আঞ্চলিক উৎসবও বলা হয় । নবরাত্রির দিন থেকে এই উৎসব শুরু হয় । আজ ব্যাঙ্গালোর জুড়েই দেখলাম দশেরার প্রস্তুতি । বাজারে প্রচুর ফুল ফল ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে । সবাই সাধ্যমত ফুল, ফল, ফুলের মালা, আমের পল্লব, কলার চারা নিয়ে যাচ্ছেন । সকাল থেকেই বাড়িঘর সাজানো হয়েছে ফুল ও ফুলের মালায় । সদর দরজার দুপাশে লাগানো হয়েছে কলার চারা । মাঝখানে আলপনা । প্রতিটি বাড়ির সামনে বড়ো বড়ো চালকুমড়ো ও নারকেল ফাটিয়ে রাখা হয়েছে । অনেকটা আমাদের দক্ষিণ ত্রিপুরায় চৈত্র সংক্রান্তির দিনের আমের কুশি কেটে সত্তুরওড়ানোর মতো । যানবাহনগুলোকে ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে । এদিকে বাঙালিদের পুজো প্যান্ডেলে বিজয়া দশমীর বিদায়ের সুর । সর্বত্র একটা নীরবতা । আনন্দ ও বেদনার পাশাপাশি অবস্থান । কি অদ্ভুত রসায়ন ! জীবনটাও এমনই ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৫ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালি দুর্গাপুজো (৫ )

এবারে আমি পরপর দুটি এপিসোডে বর্তমানে যেখানে আছি অর্থাৎ আমার বড়ো ছেলের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকার একটা বড়ো দুর্গাপূজোর বিষয়ে কিছু জানিয়ে এবং তারপরে এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতির একটি বিষয় যার সঙ্গে আমাদের দুর্গোৎসবের কিঞ্চিত সম্পর্ক রয়েছে তার উল্লেখ করে ব্যাঙ্গালোরের পূজা পরিক্রমা শেষ করব ।

দুর্গাপুজোর থিমে অনেক সময় চলচ্চিত্র বা সিনেমার বিষয় উঠে এসেছে । বিশেষ করে কলকাতা ও আগরতলার বড়ো বড়ো বারোয়ারি পুজোকমিটিও থিম পুজোগুলিতে।

এরকম কয়েকটি দৃষ্টান্ত:

1. সত্যজিৎ রায় স্মরণে থিম –

অনেক পুজো কমিটি “পথের পাঁচালী”, “অপু ট্রিলজি”, বা “গুপী গাইন বাঘা বাইন”–এর দৃশ্য দিয়ে থিম সাজিয়েছে।
বিশেষত ২০১৯-এ সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একাধিক পুজো তাঁকে কেন্দ্র করে থিম নিয়েছিল।
2. বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ –
কিছু পূজায় ৫০–৬০–৭০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের পোস্টার, গান, সেট, দৃশ্য ব্যবহার করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে।
যেমন: উত্তম-সুচিত্রার জনপ্রিয় ছবি সাগরিকা, হারানো সুর, পিকনিক ইত্যাদির আবহ।
3. বলিউড ও বিশ্বসিনেমা থিম –
মাঝে মাঝে “শোলে”, “মুঘল-এ-আজম”, এমনকি “হ্যারি পটার” বা “অ্যাভেঞ্জার্স”-এর চরিত্র নিয়ে থিম তৈরি হয়েছে।
তবে এসব সাধারণত আকর্ষণ করার জন্য, আধ্যাত্মিকতার সাথে মেলানোর চেষ্টা করা হয়।
4. সামাজিক বার্তা মূলক সিনেমা –
“পথের পাঁচালী” বা “মেঘে ঢাকা তারা”-র মতো সিনেমার দারিদ্র্য, সংগ্রাম, সমাজ-বাস্তবতার দিক তুলে ধরা হয়েছে।
থিমের মাধ্যমে বলা হয়, দেবী শক্তি শুধু পুজো নয়, বাস্তব জীবনের সংগ্রামে পাশে থাকার প্রতীক।

তেমনি একটি চলচ্চিত্রের থিমকে নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছেন ব্যাঙ্গালুরুর আরোহন সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন। কাঠগুড়ির পাশে বেলাথুরে তাঁদের পুজোমণ্ডপের এবারের থিম 'দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার' । থিমটি নেয়া হয়েছে 2019 সালের হিট বাংলা ছায়াছবি 'দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন' এর বিষয়েকে নিয়ে । কাহিনি ইতিহাসের একটা ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে থ্রিলারধর্মী করে তোলা হয়েছে । কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর জগৎ শেঠের কাছ থেকে প্রচুর ধনসম্পদ উপঢৌকন পেয়েছিলেন । সেই সম্পদ যাতে ইংরেজের হাতে না পড়ে সেজন্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সেগুলো দুর্গেশগড়ের দেবীদ্বার মন্দিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন । তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম সেই রহস্যময় সম্পদ খুঁজে পায়নি । ইতিহাসের অধ্যাপক সুবর্ণ সেন, ভাইপো আবির এবং তাঁর বন্ধু ঝিনুককে নিয়ে সেই রহস্য উন্মোচনের জন্য সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন । কাহিনির সেই দেবীদ্বারের আদলে তৈরি তাঁদের মন্ডপ । প্রতিমাও দৃষ্টিনন্দন । মন্ডপের ভেতরের সৌন্দর্যায়ন করেছেন সংগঠনেরই একঝাঁক শিল্পী । ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে পুজো ও প্রতিদিন মধ্যাহ্নে সবার জন্যে প্রসাদের ব্যবস্থা করেছেন । বিনোদনের ব্যবস্থাও ছিল জমাটি । প্রতি সন্ধ্যায় বহিরাগত শিল্পীরা ও সংগঠনের সদস্যগণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন । অষ্টমীর রাতে বরিষ্ঠ সদস্যদের নিয়ে এক অভিনব ফ্যাশন শোএর আয়োজন করেছেন উদ্যোক্তারা । ব্যাঙ্গালোরে সব পুজো প্যান্ডেলে দেখলাম বয়স্ক নাগরিকদের বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয় । পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শারীরিক অসুস্থতা, ডায়ালিসিসের কষ্ট সহ্য করেও অনেকে মঞ্চে ক্যাট ওয়াক করেছেন । এই ফ্যাশন শোএর বিষয় নেওয়া হয়েছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাজপোষাক ।

উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের কালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা সাহিত্য ও শিল্পকলা, সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন । সেই পরিবারের পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও আধুনিকতায় এগিয়েছিলেন । এই পরিবারের জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালিদের আধুনিক কায়দায় শাড়ি পরাতে শিখিয়েছিলেন । ঠাকুরবাড়ির বউদের শাড়ি পরার ধরনই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাঙালি রমণীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায় । পাশাপাশি এই পরিবারের সদস্য সদস্যারা অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছিলেন । ঠাকুর পরিবারের প্রথিতযশা পুরুষ ও রমণীদের চরিত্রাভিনয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এই ফ্যাশন শো । বিষয়টি অভিনব ও গবেষণালব্ধ । আধুনিক অঙ্গনে একটা সময়কে তুলে ধরা হয়েছে । এই সংগঠনের তরুণ সদস্যরাও কম যান কিসে ? তাঁরাও দল বেঁধে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বাঙালিবাবুটি সেজে মঞ্চে উঠেছিলেন এই সন্ধ্যায় । গত ত্রিশে সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজা পত্রিকার পাঁচের পাতায় আরোহন কালচারাল এসোসিয়েশনের প্রতিমার ছবি ছাপা হয়েছে যত্নের সঙ্গে ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৪ )

প্রবাসে দেবীর বশে :  ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৪ )

সার্জাপুরের এক প্রান্তে ন্যাশনাল পাবলিক স্কুল কূডলুর পাশেই হচ্ছে বর্ষা বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের পূজো । অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত তাদের এই পুজো মণ্ডপ । বাংলা এবং কর্নাটকের সংস্কৃতির মধ্যে এক আশ্চর্য মেলবন্ধনকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছেন তাঁরা । তাঁদের মণ্ডপসজ্জায় তাঁদের এবছরের পূজা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে ভাবনাটি তুলে ধরেছেন তার নাম দিয়েছেন 'চিত্রাগাণা' । বাংলা এবং কর্ণাটকের দুইটি বিশিষ্ট লোককথাভিত্তিক চিত্রকলার সংমিশ্রণ এখানে ঘটিয়েছেন । তাঁদের মন্ডপের সামনের দিকটাতেই এই থিম এর মাধ্যমে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র ছৌ মুখোশ এবং কর্নাটকের 'যক্ষগাণা'  ( Yakshagana ) চিত্রশৈলীর মুখোশের নিদর্শন রেখে দুটি প্রদেশের শিল্পমাধ্যমের মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা । পুরো মন্ডপ জুড়ে কর্ণাটকী লোককথা 'যক্ষগাণা' ও বাংলার ছৌ নৃত্যের মুখোশ । মন্ডপের ভেতরেও অসাধারণ সব কাজ ।পুজোর মাধ্যমে কর্নাটকের ও বাংলার ঐতিহ্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ ঘটিয়েছেন তাঁরা । এই সার্জাপুরের আর একটি পুজো করছেন SORRBA. তাঁরা এই পুজোর মাধ্যমে পঞ্চদুর্গা ও দশেরা  উদযাপন করছেন । প্রতিমাটি খুবই সুন্দর । কাঠখোদাই কাজের ধরনের । চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশও মনোরম ।

ব্যাঙ্গালোর তথ্যপ্রযুক্তির মহানগর । ইলেকট্রনিক সিটি । কাজেই এখানকার পুজোতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারিক চমক তো থাকবেই । ইস্ট বেঙ্গালুরু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ( EBCA ) এর এবারের পুজোর থিম "প্রযুক্তির আলোয় প্রথাগত পূজা"  । এবছর তাঁরা তাঁদের পুজোয় আলোড়ন সৃষ্টিকারী ভাবনা নিয়ে এসেছেন । এবার তাদের ভাবনা হল ত্রিমাত্রিক নবদুর্গা যা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সারা পৃথিবীতেও আর কেউ কখনো উপস্থাপন করেনি বলে উদ্যোক্তারা দাবি করছেন । পূজা মন্ডপে নবদুর্গার নয়টি বিশেষ  প্রতিমার উপরের দিকে একটা করে কিউ আর কোড লাগানো আছে । পূজা মন্ডপে আগত দর্শণার্থীরা এখানে এসে তাদের মোবাইলে নবদুর্গার এই প্রতিকৃতিগুলির স্ক্যান করতে পারছেন এবং এই বিগ্রহ সমূহ তাদের মোবাইলের পর্দায় জীবন্ত দেখতে পারছেন । পরিবেশবান্ধব এই পুজোমণ্ডপ এবং দেবীপ্রতিমা নির্মাণ করেছেন কৃষ্ণনগরের এক শিল্পী কৌশিক দাঁ । ঠিক এমনই উত্তরণ সর্বজন সমন্বয়ের পুজোয় প্রতিমা তৈরি হয়েছে শিল্পী পৃথ্বীরাজ চৌধুরীর এক বিখ্যাত মা দুর্গার পেইন্টিংকে ভিত্তি করে চিত্রকরের 2D চিত্রকে 3D রূপে এখানে তুলে ধরা হচ্ছে প্রথমবার । আর সেই চিত্রকে মাথায় রেখে এবছর তাদের থিম হচ্ছে "কালীঘাটের চিত্রশিল্প"  । গুঞ্জুর লেক-এর উল্টোদিকে এস আর অক্ষতা প্যলেসে ( S R AKSHATA PALACE ) হচ্ছে ব্যাঙ্গালুরু সিলেটি কালচারাল এসোসিয়েশনের পুজো । এখানে  উত্তরপূর্বের শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, পাথারকান্দি ও ত্রিপুরার ধর্মনগর, খোয়াই, কৈলাশহর ও কমলপুরের অনেকেই এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত আছেন । তাঁরা সবাই কর্মসূত্রে এখানে আছেন । কেউ স্থায়ী আবাস করে নিয়েছেন ।  বয়স্ক মাবাবাকে নিয়ে এসেছেন ।কেউ বছরে এক দুবার বাড়ি যান । এককথায় উত্তরপূর্বের এই বিস্তীর্ণ সিলেটি ভাষাভাষী মানুষ এখানে সম্মিলিত হন পুজোকে কেন্দ্র করে । সিলেটি সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ । তারই প্রতিফলন রয়েছে তাদের পুজোয় । তাদের পুজোর ব্যানারে সিলেটি নাগরী লিপির নিদর্শন রেখেছেন । যথাযথ নিয়মে হোম যজ্ঞ সহকারে এখানে তাঁরা পুজোর আয়োজন করেন । সেই সঙ্গে থাকে ঢালাও প্রসাদের ব্যবস্থাও । 
এছাড়া আরো অনেক পুজো সারা ব্যাঙ্গালোর জুড়ে রয়েছে । ভক্তি নিষ্ঠা থিম মিলিয়ে কোনোটাই এড়িয়ে যাবার মতো নয় । কিন্তু সব মন্ডপই  অনেক দূরে দূরে একটা দুটো দেখতে গেলেই দিনের একাংশ চলে যায় ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৩ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপুজো ( ৩ )

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব । বাংলার প্রতিটি গ্রাম নগরে দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । সে ধারা আজও বহমান । আজ ভুবনায়নের যুগে বাঙালি মায়ের আঁচল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বময় । বাঙালি যেখানেই গেছেন তাঁদের সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন। সমস্ত রকমের সামাজিক অনুষ্ঠানসহ পূজাপার্বণ ও পালন করে আসছেন অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে । সেইমতো আজ দুর্গোৎসব হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে এবং বিদেশেও । দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্যকে তাঁরা ফুটিয়ে তুলছেন নানাভাবে । যখন যেখানে থাকছেন সেখানকার সংস্কৃতিকেও ধারণ করছেন আবার তার সাথে নিজেদের সংস্কৃতিকে মিশিয়ে এক মোহনায় নিয়ে আসছেন সৃষ্টিশীলতায় ও নিষ্ঠায় ।

হুগলির গুপ্তিপাড়াতে ১৭৯০ সালে ১২ জন বন্ধু মিলে যে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন তাই 'বারো ইয়ারি' বা 'বারোয়ারি' পূজা নামে পরিচিত হয় । প্রথমদিকে দুর্গাপুজো করতেন রাজরাজড়ারা, ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ বা জমিদারগণ । সেখানে সবার প্রবেশাধিকার ছিল না । বারোয়ারি পুজো শুরু হওয়ার পর থেকে দুর্গাপুজো সর্বজনীন রূপ নেয় । সেই থেকে বাঙালি যেখানেই গেছেন সেখানেই তাঁরা সমবেতভাবে দুর্গোৎসব পালন করছেন । ।

ভারতের বড়ো বড়ো শহরের মধ্যে ব্যাঙ্গালুরু অন্যতম । এই শহরে বাস করেন বহু বাঙালি । পিতৃমাতাভূমি ছেড়ে এসে এই প্রজন্মের অনেকে এখানে স্থায়ী বসত গড়ে নিয়েছেন । অনেকে রুটিরুজির প্রশ্নে এখানে এসে থাকছেন । যেখানে বাঙালি রয়েছে সেখানেই রয়েছে বাঙালি সমিতি, সংগঠন । তাঁরা শরৎকালে দুর্গোৎসবে মেতে উঠেন । সংবৎসর অন্যান্য পুজো, অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । ঐতিহ্যের অনুসারী হন । সেই সঙ্গে বাঙালি খোঁজেন তাঁদের আত্মপরিচয়ের শেকড় । সেই শেকড়ে ভর করেই তাঁরা পা বাড়ান আরেক ভবিষ্যতের দিকে । সে কারণেই ব্যাঙ্গালুরুর রামমূর্তিনগরের শ্রীহট্ট সম্মিলনী এবছর তাঁদের পুজোর ভাবনা রেখেছেন 'অস্তিত্ব' । তাঁরা দেবীপুজোর মাধ্যমে তাঁদের অস্তিত্বকে জানান দেন এবং এই নতুন ভূখণ্ডকে আপন করে নেওয়ার ভাবনায় ক্যাপশন দেন– "বাড়ি ছাইড়া বাসাত আইলাম / বাসারে আমার ঘর বানাইলাম" । স্মৃতিকাতারতা আর বাস্তবতার স্বীকারোক্তি এই উচ্চারণ ।

যতটুকু জানা যায়, ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের কয়েকজন অধ্যাপক সম্মিলিত উদ্যোগে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজোর সূচনা করেন । মূলত এই পুজো থেকেই বাঙালিরা এখানে নানা পুজোপার্বণ ও সামাজিক অনুষ্ঠান শুরু করেন । ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের মাধ্যমে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন তার কাজ শুরু করে এখানে । তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি । ব্যাঙ্গালুরুর নানা প্রান্তে শুরু হয় বাঙালিদের নানা সংগঠন, পুজো ও সামাজিক অনুষ্ঠান ।

কোলকাতা, আগরতলার পুজোতে যেমন দুর্গাপুজোর মন্ডপে ফুটে উঠে বিষয়ভাবনা তেমনি ব্যাঙ্গালোরের পুজোতেও জাঁকিয়ে বসেছে এই থিম । এখানে কদর রয়েছে থিম মেকারদেরও । পুজোর আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে থিম মেকার ও শিল্পীরা এসে মন্ডপ সাজিয়ে দেন । এখানে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের এবারের থিম শোভাবাজারের রাজবাড়ি । ১৭৫৭সালে ইংরেজদের হাতে শোভাবাজারের পতন ঘটার পর বিজয়োৎসবের আনন্দে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কোলকাতার শোভাবাজারের জমিদার নবকৃষ্ণ দেবের পুজোর মধ্য দিয়ে দুর্গাপুজোর সূচনা করা হয় । তাঁদের এবছরের মন্ডপ শোভাবাজারের রাজবাড়ির আদলে ।এবছর তাঁদের পুজো ৭৫ বছরে পড়ল ।

ব্যাঙ্গালুরুর প্রাচীন পুজোর মধ্যে এ বছর একাত্তরে পা দিল জয়মহল কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের দুর্গাপুজো । তাদের এ বছরের থিম হারিয়ে যাওয়া শৈশব ( Lost Childhood ) ।

আরটি নগর প্যালেস গ্রাউন্ডে কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের থিম 'মুক্তি' । মণ্ডপসজ্জায় রয়েছে বর্তমান জটিল জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতি । কর্পোরেট জীবন যেভাবে মানুষের ব্যক্তিগত সময়, আনন্দ, সুখ ও বিনোদনকে কেড়ে নিচ্ছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আর্তি রয়েছে এই মন্ডপের ভিতরের শিল্পকলায় । এই চত্বরেরই আর একটি পুজো ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশন নারী ক্ষমতায়নের থিমকে মাথায় রেখে নারী জাতিকে সম্মান জানাতে পুজো পরিচালনা, পুরোহিত ও ঢাকের বাজনায় অংশ নিয়েছেন একদল মহিলা । গ্রীন গ্লেন লেআউট অ্যাসোসিয়েশনের এবারের পূজোর থিম 'নটরাজ' । বর্তমানে চলা সারা বিশ্বময় অস্থিরতা, ধ্বংস, তান্ডবকে মাথায় রেখে তাঁরা বিশ্ববাসীর কাছে এই সংকটময় মুহূর্ত থেকে পরিত্রাণের বার্তা পৌঁছে দিতে চান । নটরাজের তাণ্ডব হিংসার বিরুদ্ধে শান্তির জয়বার্তা ঘোষণা করছে । কোরমঙ্গলার সারথি সোসিও কালচারাল এর পুজোর ২৩ তম বছরের থিম 'মিলে সুর তুমহারা হামারা' । বেশ কিছু বছর আগে দূরদর্শনে বিভিন্ন ভাষায় এই গানটি প্রচারিত হত । সেই ভাবনাকে নিয়ে নানা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠেছে এখানে । পূর্ব ব্যাঙ্গালোরে কেটিপিও গার্ডেনে পূর্বা ব্যাঙ্গালুরু কালচারাল এসোসিয়েশনের পুজোয় সাবেকিয়ানার ছাপ রয়েছে । বিশাল চত্বর নিয়ে তাঁদের পূজো মন্ডপে প্রতিদিন প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় হচ্ছে । জনভোগের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে ।  বরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি তাঁদের যত্ন লক্ষণীয় ।

ইন্দিরানগর ঐক্যতান হেব্বেল কালচারাল সোসাইটি তাঁদের এবারের সাতান্নতম বর্ষের দুর্গোৎসবে দর্শন ও আধ্যাত্মিকতাকে ভগবত গীতার মাধ্যমে তুলে ধরতে চান । তাঁরা মনে করেন গীতার বাণীর মাধ্যমে ব্যক্ত শিক্ষা বা বোধ আজকের দিনে খুবই অর্থবোধক যেখানে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রশ্নের সম্মুখীন । মন্ডপসজ্জায় গীতা  থেকে উদ্ধৃত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে সেই সময়ের পরিবেশকে স্পষ্ট করা হয়েছে । সারা প্যান্ডেল জুড়েই গীতার শ্লোকের মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী দর্শকের সামনে মেলে ধরা হয়েছে । নেল্লুরহাল্লি, হোয়াইট ফিল্ড কালচারাল এসোসিয়েশন তাদের মন্ডপ করেছেন কেদারনাথ মন্দিরের আদলে । এরকম বিবিএসইটির এ বছরের থিম হল পশ্চিম ভারতের রাজকীয় রাজস্থান । রাজস্থানের ঐতিহ্য প্রাচীন দুর্গ ইত্যাদি প্রদর্শন রয়েছে এখানে । তেমনি পূর্ব ভারতকেও তুলে আনা হয়েছে ব্যাঙ্গালুরুর পূজামন্ডপে । সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্গালুরু বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের পুজোর থিম 'পুরাতন বাংলার রাজবাড়ীর দুর্গোৎসব' । নর্থ বেঙ্গালুরু কালচারাল সমিতি এ বছর তাঁদের আয়োজিত দুর্গোৎসবের থিম করেছেন ভারতের ধ্রুপদী ইনডোর গেম দাবাকে কেন্দ্র করে দাবার জগৎ ( World Of Chess ) । তাঁরা এবছর সমস্ত গ্র্যান্ড মাস্টারদের স্মরণ করতে চাইছেন । এই পুজোর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা দাবার ৬৪ ঘর বা ঘুঁটির সঙ্গে শক্তির ৬৪ রূপ, মায়ের ৬৪ যোগিনীর সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাইছেন । তারা বলতে চাইছেন দাবা শক্তিরই অভিন্ন রূপ ।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজা ( ২ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্পুগাজো ( ২ )

ছেলে এবং বৌমা আজ আমাদের নিয়ে বেরুল ব্যঙ্গালোরে পুজো দেখার জন্যে । আজ দেখলাম দুটো পুজো । আরটিনগর সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন এবং হোয়াইট ফিল্ডের পিবিসিএতে  ( Purba Cultural Association ) । ব্যাঙ্গালোরে এবার ছোটো বড়ো মিলে পুজো হচ্ছে ২৭২ টির মতো । পুজো মন্ডপগুলো অনেক দূরে দূরে । তাই শরীরের উপর চোট না দিয়ে বড়ো শ্রীমান তার গাড়ি নিয়ে যে কয়টা পুজো পারে দেখাবে ।

এখানকার পুজোতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার মতো প্রবল উন্মাদনা না থাকলেও আন্তরিকতা ও একতা আছে । লক্ষ্যণীয় দুএকটি বিষয়ের মধ্যে  আরটিনগরের পুজোতে দেখলাম ঢালাও ভরপেট খাবারের আয়োজন । খাবারে ছিল ফ্রায়েড রাইস, লুচি, ছোলার ডাল, কাশ্মীরী আলুর দম,চাটনি ও মিস্টি । প্রতিমা সুন্দর । থিমও আকর্ষণীয় । মনে রাখার মতো ব্যাপার হল বরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য প্রসাদ গ্রহণের আলাদা লাইন, বিশ্রামের বিশেষ ব্যবস্থা নজর কেড়েছে । 

ব্যাঙ্গালোরের পুজো কেবলমাত্র ভক্তি, শ্রদ্ধা, উৎসব আর আনন্দ নয় । বিনোদনের পাশাপাশি বিপননও জমজমাট । বিশাল জায়গা জুড়ে পুজো মন্ডপ । প্রায় প্রতিটি মন্ডপেই রয়েছে । নানারকমের খাবারের দোকান, কাপড়ের বিশাল সম্ভার, ব্যাংক, ইন্সিওরেন্স, হাউজিং নির্মান সংস্থার প্রতিনিধিরা, ঘরগেরস্থালির সামগ্রীর দোকান, শিশুদের খেলনার দোকান, তাদের বিনোদনের দোলনা, টয়ট্রেন, ইত্যাদি মিলিয়ে এককথায় ছোটদের বিনোদনের ব্যবস্থাসহ একটা ছোটোখাটো মেলার মতো এলাহি ব্যবস্থাপনা ।  এসবের প্রতিনিধিরা মেলায় স্টল খুলে ব্যবসা করার জন্যে স্পনশরশিপ নিতে হয় । তার জন্যে পুজো কমিটিকে ভালো টাকা দিতে হয় । এটাই পুজো কমিটির একটা বড়ো আয় । সদস্য চাঁদা ছাড়া এই আয় দিয়েই তাদের পুজোর খরচাপাতি, সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান, জনকল্যাণমূলক কাজকর্মসহ সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে যায় । আমাদের অঞ্চলের মতো চাঁদাবাজির দুর্নাম কুড়োতে হয়না । আমাদের অঞ্চলের পুজোতেও এই পদক্ষেপ অনায়াসেই নেওয়া যায় । আইডিয়াটা দারুণ । আজ এটুকুই । সবাইকে শারদ শুভেচ্ছা‌।

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজো ( ১ )

প্রবাসে দেবীর বশে : ব্যাঙ্গালোরে বাঙালির দুর্গাপূজো ( ১ )

প্রাচীন ভারতে দেবীপূজার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকেও দেবী পূজার বহু প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে । মহীশূরের চামিন্ডা পাহাড়ে অবস্থিত চামুন্ডেশ্বরী মন্দির অন্যতম শক্তিপীঠ । দেবী এখানে মহিষাসুর বধরতা মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গারূপে বিরাজিতা । কিংবদন্তি অনুযায়ী মহিষাসুর মহীশূর রাজ্যের রাজা ছিলেন মহীশূর নামটি এসেছে প্রাচীন কন্নড় শব্দ  মহীশূরু থেকে । 'মহীশূরু' শব্দের অর্থ মহিষাসুরের গ্রাম । বহু শতাব্দী ধরে দেবী চামুন্ডেশ্বরী মহীশূর রাজ্যের রক্ষাকর্ত্রী দেবী  হিসেবে পূজা পেয়ে আসছেন। এই দেবী চামুন্ডা মহাশক্তির ভয়াল রূপ । তিনি অতি ভীষণা ও শক্তিশালী দেবী । তিনি আদ্যাশক্তি বা সর্বপ্রথম সৃষ্টিকর্তা নারীত্বের প্রতীক । তাঁকে মহাদেবী দুর্গার এক রূপ হিসেবে গণ্য করা হয় । আবার তিনি মা কালীর অবতার রূপেও পূজিতা । কথিত আছে, চন্ড ও মুন্ড নামে দুই দুর্ধর্ষ অসুরকে বধ করার ফলে তিনি 'চামুন্ডা' নামে পরিচিত । আবার মহিষাসুরকে নিধন করার জন্যে তিনিই আবার 'মহিষাসুরমর্দিনী'। তিনি চামুণ্ডা, চামুন্ডী, চামুন্ডেশ্বরী ও চর্চিকা নামেও পরিচিতা । হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন–এই তিন ধর্মেই তাঁর ভিন্ন ভিন্ন রূপে পূজা প্রচলিত আছে । চামুন্ডা দেবী তান্ত্রিক শক্তিরও গূঢ় আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক । মৃত্যু ধ্বংস, জরা ও অসুস্থতার দেবী রূপেও তিনি পূজিত হন । অন্যদিকে তিনি প্রতিকূলতা, অন্ধকার ও দুষ্টশক্তির বিরুদ্ধে বিজয়েরও প্রতীক।

চামুন্ডা অত্যন্ত প্রাচীন মাতৃকা । সিন্ধুসভ্যতায় প্রাপ্ত প্রত্নফলক অনুযায়ী, একজন বৃক্ষবাসিনী মাতৃকার সামনে ছাগবলি হত। সেই বলি গ্রহণ করতে সপ্তমাতৃকা উপস্থিত থাকতেন । এই সপ্তমাতৃকার  অন্যতম ছিলেন চামুন্ডা । প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার অবসানের দীর্ঘ আড়াই হাজার পরে পৌরাণিক যুগেও দেবী চামুন্ডা সপ্তমাতৃকার একজন হিসাবে পূজিতা হতে দেখা যায় । বর্তমান সময়ের দুর্গাপূজায়ও নবপত্রিকার নব আভরণের অন্যতম মানপত্রে বা মানকচুতে দেবী চামুন্ডার আধিষ্ঠান কল্পিত হয় ।

দুর্গাপূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে দেবী দুর্গা চামুন্ডা রূপে আবির্ভূতা হন । এই ক্ষণটাই মহাশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ । সন্ধিপূজার সময় দেবীকে নিবেদন করা হয় ১০৮ টি পদ্ম ও ১০৮ টি প্রদীপ । পদ্ম ভক্তির প্রতীক । দীপ জ্ঞানের প্রতীক । এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় নৈবেদ্যের থালা, সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপাচার, সবচেয়ে গভীর আরাধনা সবই নিবেদিত হয় দেবীর চরণে । এই ক্ষণে দেবীর প্রণাম মন্ত্র–

ওঁ দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালা বিভূষণে ।
চামুন্ডে মুন্ডমথনে নারায়ণী নমোহস্তু তে ।
দেবী চামুন্ডা তথা মহিষাসুরমর্দিনীকে কেন্দ্র করে মহীশূরসহ সমগ্র কর্ণাটকে নবরাত্রি ও দশেরা উপলক্ষ্যে উৎসব পালিত হয় ।

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালি হিন্দুদের প্রধানতম উৎসব ও শ্রেষ্ঠ পূজা হল দুর্গাপূজা । পুরাণ শাস্ত্রকারদের মতে দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া, উমা, চন্ডী, ভগবতী, ভবানী, অম্বিকা, পার্বতী, শিবানী, কাত্যায়নী, মহিষাসুরমর্দিনী, অদ্রিজা প্রভৃতি বহু নামে পরিচিত ও পূজিত হন । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবী ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও দেবী দুর্গার কাহিনী ও লীলা বর্ণনা সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় ।

দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে শুধু দেবীআরাধনেই নয় । এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব । এর মধ্যে যেমন আছে পৌরাণিক বিশ্বাস, মিথ তেমনি রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি, লোকাচার ও সামাজিকতার গভীর মেলবন্ধন । সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির জীবনে উৎসব এবং শ্রেষ্ঠতম পূজা হিসেবে দুর্গাপূজার প্রচলন রয়েছে । বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা । দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরী মল্ল রাজবংশের কুলদেবী । মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন । মল্লরাজবাড়ীর পূজায় দেবীপটের যে ব্যবহার দেখা যায় তা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির । বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না ।

 দুর্গাপূজার সূচনা কাল নিয়ে বহু মত থাকলেও বাংলায় ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রথম পূজা শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন । ১৫৮২ সালে রাজশাহীর তাহেরপুরের জমিদার বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম কংসনারায়ণ রায় তাঁর মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে মার্কন্ডেয় পুরাণের দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন । তিনি সেসময়ে দুর্গাপূজায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন বলে জানা যায় । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব রবার্ট ক্লাইভ এর সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন । সেকালে পূজা ও অনুষ্ঠানে বিপুল অর্থ ব্যয় হত বলে প্রথম দিকে মূলত রাজরাজড়া ও জমিদারদের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন সীমাবদ্ধ ছিল । ধীরে ধীরে বাঙালি জমিদারদের মধ্যে এই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয় ।

 সাম্প্রতিককালে প্রচলিত দুর্গাপূজা দুই ভাবে হয়ে থাকে । ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক কাঠামোতে যেখানে পূজার শাস্ত্রীয় বিধান নিয়মনিষ্ঠা অধিক পালন করা হয় । এবং বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে এলাকায় ভিত্তিক দুর্গোৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে । ১৭৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করে । ১২ ইয়ার বা ১২ বন্ধুর পূজা নামে পরিচিত এই পূজা একসময় বারোয়ারী নামে প্রতিষ্ঠা পায় । ১৮৩২ সালে কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ বারো ইয়ারের এই পূজা পদ্ধতি কলকাতা শুরু করেন । পরবর্তীতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বারোইয়ারী পূজা । ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মীয় উৎসাহিণী সভা, ভবানীপুর বলরাম বসু ঘাট লেনে, রামধন মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে বারোয়ারী পূজা হয় । অনেকের মতে একদিন দুর্গোৎসবের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে অস্তমিত করার উৎসব পালিত হয়েছিল । আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়  ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোসের দুর্গোৎসবে । তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গাপূজার উৎসবে আমন্ত্রণ জানান । স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গা পূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । কবি নজরুলের 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা এবং বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম' সংগীত যার গুরুত্ব অপরিসীম । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম গানটি দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই রচনা করেছিলেন যা একসময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল ।

 শরৎকালে যে দুর্গাপূজা হয় সেক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনি বা রীতি রেওয়াজ থাকলেও বাঙালি জনজীবনে তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ । সেকালের বাঙালিজীবনের ক্ষেত্রে দেখা যেত, এই সময়টা ফসল তোলার প্রাকমুহূর্তের অবসরকাল । মাঝে মাঝে তখন সবুজ ধানের ক্ষেতে ফসলের পুষ্টতা এসেছে । প্রকৃতি ও অপরূপ সাজে সজ্জিত । নীল আকাশে হালকা হালকা সাদা মেঘের আনাগোনা । নদীর চড়ায় বালির স্তুপে কাশফুলের দোলা । ইত্যাদি মিলে প্রকৃতি তার বর্ষণঋতু অতিক্রম করছে । এই সময় শ্রমজীবী মানুষের বিশ্রামের মধ্যে কিছুটা বিনোদনের উৎস খুঁজে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে । সেই হিসেবে শরৎঋতুর এই দুর্গোৎসব বাঙালির জীবনের অবসরের শূন্যতাকে পূরণ করে ।

দুর্গাপূজার শুরুর কাল থেকেই এই পূজার মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ছিল । সেকালে এই পূজা উপলক্ষে সাধারণ জনগণ এবং রাজা ও জমিদারবর্গের পরিবারের সদস্যরা কাছাকাছি আসার সুযোগ পেত । দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে বিরাজ করা ভীতি ও দূরত্ব তখন অপসারিত হয়ে যেত । সেকালে বাঙালি জীবনে সামাজিক সম্প্রীতির সূচনার ক্ষেত্রে দুর্গাপূজার মুখ্য ভূমিকা ছিল । অর্থনৈতিক কারণে দুর্গাপূজা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।
সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতি না থাকলেও বিভিন্নভাবে তারা তাদের বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে দুর্গাপূজার বিশাল কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়ার সুযোগ ছিল । প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপসজ্জা ইত্যাদিতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতেন । সেকালের দুর্গাপূজা ছিল মূলত পরিবারের সম্প্রদায়ের ও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে সম্মিলিত আয়োজন । গ্রামের জমিদার এবং অভিজাত সম্প্রদায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে তার প্রজাদের উদার আহ্বান জানাতেন এই বিরাট কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য । ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গ্রামের জমিদার ও বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিত্বের বাড়িতে লোকসমাগম হত । গ্রামের দুর্গাপুজায় কয়েকদিন ধরে পুজামণ্ডপে ঢোলের বাজনা, আরতি, শঙ্খ, উলুধ্বনি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা ইত্যাদিতে মুখরিত থাকত । এছাড়াও সেই পূজাকে কেন্দ্র করে কীর্তন, রামায়ণ গান, যাত্রাপালা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকত । এইসব বিনোদনমূলক আয়োজন গ্রামীণ সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখত । দেবী দুর্গার পূজায় যেমন আছে ভক্তি ও পৌরাণিক তাৎপর্য তেমনি আছে লৌকিক আনন্দ, সামাজিক ঐক্য ও মানবিক সহমর্মিতা এবং সেবার বহুমুখী দিক । দেবী দুর্গা যেন গ্রাম বাংলারই কোন গৃহস্থ পরিবারের কন্যা যাকে দূর দেশে বিবাহ দেওয়া হয়েছে । এই ঘরের মেয়ে পূজার সময় সন্তান-সন্ততি সহ শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে যান । দশমীতে সকলকে কাঁদিয়ে মেয়ে আবার কৈলাসে তার স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসেন । গ্রামীন সংস্কৃতিতে পূজার কয়েক দিন বিবাহিতা কন্যাকে বাপের বাড়িতে নাইওর আনার রীতি রেওয়াজ এখনও রয়েছে । প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, মা দুর্গার চালচিত্রের যে বর্তমান রূপ সেখানে দেবী তার চার সন্তান–লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশসহ বিরাজমান । এর মধ্য দিয়েও দেবীপ্রতিমায় এক পারিবারিক রূপের প্রকাশ ঘটে । এই পূজার আনন্দেরই অঙ্গ হিসেবে দশমীর দিন গৃহস্থ ঘরে ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করার রীতিও রয়েছে । সংবৎসরের পরিশ্রমী কৃষিজীবী মানুষ কাজের তাড়ায় ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ পান না বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য আসেনা । পুজোর এই কয়দিন আনন্দের ফাঁকে তাঁরা রসনার তৃপ্তি করে থাকেন এই উৎসবের মাধ্যমে । গ্রামের পূজোয় দেবীর পূজারমন্ডপ তৈরি, প্রতিমানির্মাণ থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই গ্রামের সমস্ত মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্পন্ন করে থাকেন ।

শহরের দুর্গাপূজা অনেক বেশি আধুনিক এবং ব্যয়বহুল । সেখানে দুর্গাপূজায় থিমভিত্তিক প্যান্ডেল, আলো ও প্রতিমার চমকপ্রদ উপস্থাপনা লক্ষ্য করা যায় । প্রতিমানির্মানে ও মন্ডপসজ্জায় যেমন সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকে তেমনি সামাজিক বার্তা ও সমসাময়িক বিষয়ও উঠে আসে । দেবী দুর্গা এখানে শুধু মহিষমর্দিনী, অসুর বিনাশিনী নন । তিনি নারীশক্তির প্রতীক । সমাজের অন্যায়, অবিচার, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেও উপস্থাপিত হন । পূজা-ভাবনা বা দেবীভাবনার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বাঙালির চিন্তাভাবনার বিবর্তনের সুকুমার দিকটাকে তুলে ধরে । আজকের দিনের দুর্গাপূজায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিশুদের মধ্যে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, সমাজ সচেতনতামূলক সিনেমা প্রদর্শনী ও নানারকম সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় । এর মাধ্যমে পূজায় ধর্মীয় দিকটা পালনের পাশাপাশি বিনোদনের ক্ষেত্রেও আজকের দিনে গুরুত্ব দেওয়া হয় । বর্তমান সময়ে দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণে রক্তদান শিবির, বস্ত্র দান, দুস্থ শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণসামগ্রী বিতরণ, স্বাস্থ্যপরীক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্গাপূজাকে আরো বেশি করে মানবসেবার উৎসব হিসেবেও পরিগণিত করার প্রয়াস নেওয়া হয় । দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা, বইমেলা, শারদসংখ্যা প্রকাশ আজকের দিনের নিয়মিত চর্চার বিষয় । পূজার সময় বিভিন্ন পূজা কমিটি শারদোৎসব উপলক্ষে বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করে থাকেন । তাতে পাড়ার খুদে লেখকলেখিকা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখালেখি প্রকাশ করার একটা সুযোগ থাকে । পূজাকে কেন্দ্র করে  সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার আবহ সৃষ্টির এই দিকটিও অনেক মূল্যবান ।

দেবীপূজা বা দেবীভাবনার এই বিবর্তনকে লক্ষ্য করলে দেখি যে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে । দুর্গাপূজা আজ শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালিরা আছেন সেখানেই তা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে । ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠীর হাতেই দেবী পূজার প্রচলন হয় হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য ও বিস্তৃত হয় । মাতৃ তান্ত্রিক দ্রাবিড় সভ্যতায় বিভিন্ন মাতৃ দেবীর পূজার প্রচলন ছিল । তারই ক্রম বিবর্তন আজকের দুর্গোৎসব । অতীত ও বর্তমানের দুর্গাপূজার মধ্যে বেশ কিছু ফারাক থাকলেও তার মূল স্রোত কিন্তু একই ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের বিবর্তন দুর্গাপূজার রূপকে বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত করছে এবং নতুন ভাবে উপস্থাপন করছে । দেবীপূজার পাশাপাশি বাঙালির মননেও চিন্তা ভাবনায় নানা কল্যাণকর ভাবনা যে রূপ পাচ্ছে এবং তা নতুন নতুন ভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে সেটাই হল পূজার আধুনিকতা । দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে এক চিরন্তন উৎসব যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে চলছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে । ফলে দুর্গাপূজা শুধুমাত্র দেবী আরাধনা নয় নানাবিধ নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুর্গাপূজা মানবসেবার উৎসবে পরিণত হচ্ছে এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে আলো ঝলমলে শহরে প্যান্ডেলের সর্বত্রই দুর্গাপূজা একতা ও সম্প্রীতির বাণী প্রকাশ করছে ।

Wednesday, September 24, 2025

My Pension From OCT 25

FOR FEB21 : BP=40500 DA=00 COMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 : DA (8% )=3240 REC=00
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET=37940
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=40500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 00 COMM = 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NET = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

FROM JAN24 : BP=40500 : DA ( 25% )= 10125 REC =<00 COMM = 6300 DID=00 IR = 00 OLD = 00 FMA= 500 TDS = 00 NET = 44825

FROM NOV24 : BP = 40500 : DS ( 30% ) = 12150 REV = 00 COMM : 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 NET = 46950

FROM APRL25 : BP = 40500 : DS ( 33% ) = 13365 REV = 00 : COMN : 6300 DID = 00 : IR : 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 NET = ( 53865 - 6300 +500 ) = 48065

FROM OCT25 : BP = 40500 : DS ( 36% ) = 14580 REV = 00 : COMN : 6300 DID = 00 : IR : 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 : NET : ( 55080 - 6300 +500 ) = 49280


Thursday, September 18, 2025

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান

দুর্গাপূজায় লৌকিকতা ও সামাজিকতা : অতীত ও বর্তমান 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বাঙালি হিন্দুদের প্রধানতম উৎসব ও শ্রেষ্ঠ পূজা হল দুর্গাপূজা । পুরাণ শাস্ত্রকারদের মতে দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া, উমা, চন্ডী, ভগবতী, ভবানী, অম্বিকা, পার্বতী, শিবানী, কাত্যায়নী, মহিষাসুরমর্দিনী, অদ্রিজা প্রভৃতি বহু নামে পরিচিত ও পূজিত হন । ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবী ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও দেবী দুর্গার কাহিনী ও লীলা বর্ণনা সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায় ।

দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে শুধু দেবীআরাধনেই নয় । এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব । এর মধ্যে যেমন আছে পৌরাণিক বিশ্বাস, মিথ তেমনি রয়েছে শিল্প-সংস্কৃতি, লোকাচার ও সামাজিকতার গভীর মেলবন্ধন । সুদূর প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির জীবনে উৎসব এবং শ্রেষ্ঠতম পূজা হিসেবে দুর্গাপূজার প্রচলন রয়েছে । বাংলার অন্যতম প্রাচীন দুর্গাপূজা হল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরের পূজা । দেবী মৃন্ময়ী ছিলেন মল্লভূম রাজ্যের রাজরাজেশ্বরী মল্ল রাজবংশের কুলদেবী । মল্লরাজ জগৎমল্ল ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে এই পূজার প্রবর্তন করেন । মল্লরাজবাড়ীর পূজায় দেবীপটের যে ব্যবহার দেখা যায় তা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির । বাংলার সাধারণ দুর্গাপূজায় এমন পটের ব্যবহার দেখা যায় না ।

 দুর্গাপূজার সূচনা কাল নিয়ে বহু মত থাকলেও বাংলায় ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রথম পূজা শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন । ১৫৮২ সালে রাজশাহীর তাহেরপুরের জমিদার বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম কংসনারায়ণ রায় তাঁর মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের বিকল্প হিসেবে মার্কন্ডেয় পুরাণের দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন । তিনি সেসময়ে দুর্গাপূজায় ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন বলে জানা যায় । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব রবার্ট ক্লাইভ এর সম্মানে দুর্গাপূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন । সেকালে পূজা ও অনুষ্ঠানে বিপুল অর্থ ব্যয় হত বলে প্রথম দিকে মূলত রাজরাজড়া ও জমিদারদের মধ্যে দুর্গাপূজার আয়োজন সীমাবদ্ধ ছিল । ধীরে ধীরে বাঙালি জমিদারদের মধ্যে এই দুর্গাপূজার প্রচলন শুরু হয় ।

 সাম্প্রতিককালে প্রচলিত দুর্গাপূজা দুই ভাবে হয়ে থাকে । ব্যক্তিগতভাবে পারিবারিক কাঠামোতে যেখানে পূজার শাস্ত্রীয় বিধান নিয়মনিষ্ঠা অধিক পালন করা হয় । এবং বারোয়ারি বা সর্বজনীনভাবে এলাকায় ভিত্তিক দুর্গোৎসব আয়োজন করা হয়ে থাকে । ১৭৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে চাঁদা তুলে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করে । ১২ ইয়ার বা ১২ বন্ধুর পূজা নামে পরিচিত এই পূজা একসময় বারোয়ারী নামে প্রতিষ্ঠা পায় । ১৮৩২ সালে কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ বারো ইয়ারের এই পূজা পদ্ধতি কলকাতা শুরু করেন । পরবর্তীতে উচ্চবর্ণীয় হিন্দু জমিদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বারোইয়ারী পূজা । ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মীয় উৎসাহিণী সভা, ভবানীপুর বলরাম বসু ঘাট লেনে, রামধন মিত্র লেন ও সিকদার বাগানে বারোয়ারী পূজা হয় । অনেকের মতে একদিন দুর্গোৎসবের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতাকে অস্তমিত করার উৎসব পালিত হয়েছিল । আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দুর্গাপূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায়  ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বোসের দুর্গোৎসবে । তিনি জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গাপূজার উৎসবে আমন্ত্রণ জানান । স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্গা পূজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । কবি নজরুলের 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা এবং বঙ্কিমচন্দ্রের 'বন্দেমাতরম' সংগীত যার গুরুত্ব অপরিসীম । সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বন্দেমাতরম গানটি দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই রচনা করেছিলেন যা একসময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল ।

 শরৎকালে যে দুর্গাপূজা হয় সেক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনি বা রীতি রেওয়াজ থাকলেও বাঙালি জনজীবনে তা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ । সেকালের বাঙালিজীবনের ক্ষেত্রে দেখা যেত, এই সময়টা ফসল তোলার প্রাকমুহূর্তের অবসরকাল । মাঝে মাঝে তখন সবুজ ধানের ক্ষেতে ফসলের পুষ্টতা এসেছে । প্রকৃতি ও অপরূপ সাজে সজ্জিত । নীল আকাশে হালকা হালকা সাদা মেঘের আনাগোনা । নদীর চড়ায় বালির স্তুপে কাশফুলের দোলা । ইত্যাদি মিলে প্রকৃতি তার বর্ষণঋতু অতিক্রম করছে । এই সময় শ্রমজীবী মানুষের বিশ্রামের মধ্যে কিছুটা বিনোদনের উৎস খুঁজে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে । সেই হিসেবে শরৎঋতুর এই দুর্গোৎসব বাঙালির জীবনের অবসরের শূন্যতাকে পূরণ করে ।

দুর্গাপূজার শুরুর কাল থেকেই এই পূজার মধ্যে একটা সর্বজনীনতা ছিল । সেকালে এই পূজা উপলক্ষে সাধারণ জনগণ এবং রাজা ও জমিদারবর্গের পরিবারের সদস্যরা কাছাকাছি আসার সুযোগ পেত । দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে রাজা ও প্রজাদের মধ্যে বিরাজ করা ভীতি ও দূরত্ব তখন অপসারিত হয়ে যেত । সেকালে বাঙালি জীবনে সামাজিক সম্প্রীতির সূচনার ক্ষেত্রে দুর্গাপূজার মুখ্য ভূমিকা ছিল । অর্থনৈতিক কারণে দুর্গাপূজা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল ।
সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতি না থাকলেও বিভিন্নভাবে তারা তাদের বিভিন্ন পেশার মাধ্যমে দুর্গাপূজার বিশাল কর্মকান্ডের অংশীদার হওয়ার সুযোগ ছিল । প্রতিমা নির্মাণ, মণ্ডপসজ্জা ইত্যাদিতে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করতেন । সেকালের দুর্গাপূজা ছিল মূলত পরিবারের সম্প্রদায়ের ও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে সম্মিলিত আয়োজন । গ্রামের জমিদার এবং অভিজাত সম্প্রদায় দুর্গাপূজার প্রাক্কালে তার প্রজাদের উদার আহ্বান জানাতেন এই বিরাট কর্মযজ্ঞে সহায়তা করার জন্য । ফলে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গ্রামের জমিদার ও বর্ধিষ্ণু ব্যক্তিত্বের বাড়িতে লোকসমাগম হত । গ্রামের দুর্গাপুজায় কয়েকদিন ধরে পুজামণ্ডপে ঢোলের বাজনা, আরতি, শঙ্খ, উলুধ্বনি, ধুনুচি নাচ, সিঁদুর খেলা ইত্যাদিতে মুখরিত থাকত । এছাড়াও সেই পূজাকে কেন্দ্র করে কীর্তন, রামায়ণ গান, যাত্রাপালা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থাকত । এইসব বিনোদনমূলক আয়োজন গ্রামীণ সংস্কৃতিকে জীবন্ত রাখত । দেবী দুর্গার পূজায় যেমন আছে ভক্তি ও পৌরাণিক তাৎপর্য তেমনি আছে লৌকিক আনন্দ, সামাজিক ঐক্য ও মানবিক সহমর্মিতা এবং সেবার বহুমুখী দিক । দেবী দুর্গা যেন গ্রাম বাংলারই কোন গৃহস্থ পরিবারের কন্যা যাকে দূর দেশে বিবাহ দেওয়া হয়েছে । এই ঘরের মেয়ে পূজার সময় সন্তান-সন্ততি সহ শ্বশুরঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে যান । দশমীতে সকলকে কাঁদিয়ে মেয়ে আবার কৈলাসে তার স্বামীর বাড়িতে ফিরে আসেন । গ্রামীন সংস্কৃতিতে পূজার কয়েক দিন বিবাহিতা কন্যাকে বাপের বাড়িতে নাইওর আনার রীতি রেওয়াজ এখনও রয়েছে । প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, মা দুর্গার চালচিত্রের যে বর্তমান রূপ সেখানে দেবী তার চার সন্তান–লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশসহ বিরাজমান । এর মধ্য দিয়েও দেবীপ্রতিমায় এক পারিবারিক রূপের প্রকাশ ঘটে । এই পূজার আনন্দেরই অঙ্গ হিসেবে দশমীর দিন গৃহস্থ ঘরে ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করার রীতিও রয়েছে । সংবৎসরের পরিশ্রমী কৃষিজীবী মানুষ কাজের তাড়ায় ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ পান না বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য আসেনা । পুজোর এই কয়দিন আনন্দের ফাঁকে তাঁরা রসনার তৃপ্তি করে থাকেন এই উৎসবের মাধ্যমে । গ্রামের পূজোয় দেবীর পূজারমন্ডপ তৈরি, প্রতিমানির্মাণ থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত প্রতিটি কাজেই গ্রামের সমস্ত মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্পন্ন করে থাকেন ।

শহরের দুর্গাপূজা অনেক বেশি আধুনিক এবং ব্যয়বহুল । সেখানে দুর্গাপূজায় থিমভিত্তিক প্যান্ডেল, আলো ও প্রতিমার চমকপ্রদ উপস্থাপনা লক্ষ্য করা যায় । প্রতিমানির্মানে ও মন্ডপসজ্জায় যেমন সৃজনশীলতার ছোঁয়া থাকে তেমনি সামাজিক বার্তা ও সমসাময়িক বিষয়ও উঠে আসে । দেবী দুর্গা এখানে শুধু মহিষমর্দিনী, অসুর বিনাশিনী নন । তিনি নারীশক্তির প্রতীক । সমাজের অন্যায়, অবিচার, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হিসেবেও উপস্থাপিত হন । পূজা-ভাবনা বা দেবীভাবনার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন বাঙালির চিন্তাভাবনার বিবর্তনের সুকুমার দিকটাকে তুলে ধরে । আজকের দিনের দুর্গাপূজায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিশুদের মধ্যে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, সমাজ সচেতনতামূলক সিনেমা প্রদর্শনী ও নানারকম সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় । এর মাধ্যমে পূজায় ধর্মীয় দিকটা পালনের পাশাপাশি বিনোদনের ক্ষেত্রেও আজকের দিনে গুরুত্ব দেওয়া হয় । বর্তমান সময়ে দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণে রক্তদান শিবির, বস্ত্র দান, দুস্থ শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণসামগ্রী বিতরণ, স্বাস্থ্যপরীক্ষা ইত্যাদি সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্গাপূজাকে আরো বেশি করে মানবসেবার উৎসব হিসেবেও পরিগণিত করার প্রয়াস নেওয়া হয় । দুর্গা পুজোকে কেন্দ্র করে সাহিত্যচর্চা, বইমেলা, শারদসংখ্যা প্রকাশ আজকের দিনের নিয়মিত চর্চার বিষয় । পূজার সময় বিভিন্ন পূজা কমিটি শারদোৎসব উপলক্ষে বিশেষ স্মরণিকা প্রকাশ করে থাকেন । তাতে পাড়ার খুদে লেখকলেখিকা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের লেখালেখি প্রকাশ করার একটা সুযোগ থাকে । পূজাকে কেন্দ্র করে  সাহিত্যসংস্কৃতিচর্চার আবহ সৃষ্টির এই দিকটিও অনেক মূল্যবান ।

দেবীপূজা বা দেবীভাবনার এই বিবর্তনকে লক্ষ্য করলে দেখি যে, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে দুর্গোৎসব আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে । দুর্গাপূজা আজ শুধু বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে নয়, পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালিরা আছেন সেখানেই তা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে । ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে প্রায় ২২ হাজার বছর পূর্বে ভারতের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠীর হাতেই দেবী পূজার প্রচলন হয় হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য ও বিস্তৃত হয় । মাতৃ তান্ত্রিক দ্রাবিড় সভ্যতায় বিভিন্ন মাতৃ দেবীর পূজার প্রচলন ছিল । তারই ক্রম বিবর্তন আজকের দুর্গোৎসব । অতীত ও বর্তমানের দুর্গাপূজার মধ্যে বেশ কিছু ফারাক থাকলেও তার মূল স্রোত কিন্তু একই ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজের বিবর্তন দুর্গাপূজার রূপকে বিভিন্ন সময়ের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত করছে এবং নতুন ভাবে উপস্থাপন করছে । দেবীপূজার পাশাপাশি বাঙালির মননেও চিন্তা ভাবনায় নানা কল্যাণকর ভাবনা যে রূপ পাচ্ছে এবং তা নতুন নতুন ভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে সেটাই হল পূজার আধুনিকতা । দুর্গাপূজা বাঙালির কাছে এক চিরন্তন উৎসব যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়ে চলছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে । ফলে দুর্গাপূজা শুধুমাত্র দেবী আরাধনা নয় নানাবিধ নতুন নতুন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুর্গাপূজা মানবসেবার উৎসবে পরিণত হচ্ছে এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে আলো ঝলমলে শহরে প্যান্ডেলের সর্বত্রই দুর্গাপূজা একতা ও সম্প্রীতির বাণী প্রকাশ করছে ।

Friday, September 12, 2025

লোকসংসকৃতির উন্নিদ্র প্রহরী ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুমের একজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেঙ্গাফ্রু মগ । তিনি ১৯৫৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সাব্রুমের মনুবাজারের দক্ষিণ কালাপানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম প্রয়াত অংগিয় মগ ও মা প্রয়াতা নিবাইফ্রু মগ । তিনি মনু এইচএস স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন এবং এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন । ১৯৭৮ সালে সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন । ১৯৮৩ সালে বিলোনিয়া কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাস করেন । ১৯৯১ সালে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন একজন প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে তিনি ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের শিক্ষাদপ্তরে চাকরিতে যোগদান করে ক্রমান্বয়ে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে ২০০২ সালে প্রধান শিক্ষক পদে উন্নীত হন । দীর্ঘদিন সুনামের সাথে শিক্ষকতা করার পর ২০১৯ সালের ৩০ শে নভেম্বর মনু উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন । তাঁর অসাধারণ কণ্ঠসুষমার জন্য তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সংগীতের ক্ষেত্রে ও বিশেষ সুনাম অর্জন করেন । রাজ্যের ও রাজ্যের বাইরে তিনি সংগীত পরিবেশন করে ভুয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । মগ জনজাতির সংগীত, নৃত্য ও লোকসংস্কৃতির একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব তিনি । তাঁর নিজের সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান 'ফোক কালচারাল একাডেমি'র মাধ্যমে তিনি লোকনৃত্য, মনিপুরী নৃত্য ইত্যাদির চর্চা ও প্রসার ঘটিয়ে চলেছেন । ঐতিহ্যবাহী মগ লোকনৃত্যকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে । তাঁর গুরু নীরেন্দ্রনাথ আচার্জির মতো তাঁরও অসংখ্য গুনমুগ্ধ শিক্ষার্থী রয়েছে । জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি সংগীত ও নৃত্য চর্চার মাধ্যমেই সুকুমারচর্চা করে দিন যাপন করছেন ।

Thursday, September 4, 2025

'ত্র্যহস্পর্শ'– লুপ্ত 'অ'

'ত্র্যহস্পর্শ' শব্দের উচ্চারণ

উচ্চারণটা হবে 'ত্রঅস্পর্শ' (ত্রয়স্পর্শ ) ।  মূল শব্দটি ত্র্যহস্পর্শ । এখানে সন্ধির নিয়মের মাধ্যমে শব্দটি গঠিত হয়েছে । ত্রি+ অহ+ স্পর্শ = ত্র্যহস্পর্শ । তিনটি তিথি যেখানে স্পর্শ করেছে । স্বরসন্ধির নিয়ম অনুসারে পূর্বপদের 'ই' ও পরপদের 'অ' মিলে 'য' ফলা হয়েছে । বাংলা উচ্চারণে 'য' ফলাটি উহ্য হয়ে যায় । সংস্কৃত শব্দ বাংলা লিপিতে হ এর মতো একটি বর্ণ লেখা হয় এবং এই 'হ' বর্ণটি লুপ্ত 'অ' বর্ণ বলে পরিচিত হয়েছে । যেমন- 'সোহহম' ( সোঅহম ) । লুপ্ত 'অ' বর্ণটি অর্ধমাত্রাযুক্ত হ বর্ণ দিয়ে বোঝানো হয় । এটিকে হ এর মতো উচ্চারণ করা ঠিক হবে না । বাংলাবর্ণমালায় এই বর্ণটি নেই । তবে সংস্কৃত বর্ণমালায় রয়েছে এবং তার ব্যবহারও রয়েছে । এই লুপ্ত 'অ' এর উচ্চারণ 'হ' উচ্চারণ করতে যতটা জোর বা শ্বাসাঘাত হয় ততটা হয় না । অনেকটা 'অ' এর মতো বা তার চেয়ে কম জোর দেওয়া হয় ।

Wednesday, September 3, 2025

অশোকানন্দ রায়বর্ধনের পরিচয়পঞ্জী

আমার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী ও সাহিত্যকর্ম
১) নাম : অশোকানন্দ রায়বর্ধন
২) বাবাi ও মার নাম : প্রয়াত মনোরঞ্জন বর্ধন, ঊষারানি বর্ধন
৩) জন্মের তারিখ : ১১ জানুয়ারি, ১৯৫৬

৫) পেশা : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শক
৬) শিক্ষাগত যোগ্যতা : বাংলা
ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও বিএড 
৭) সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
জীবনের প্রথম পাঠ শুরু ডিব্রুগড় শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ প্রতিষ্ঠিত অখণ্ডমণ্ডলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে । পরবর্তী সময়ে বাবার চাকরির সুবাদে ত্রিপুরার পেচার‌থল, বক্সনগর,কুলাইসহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ধলাই জেলার কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন  ( ১৯৭৩ )। বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় ( অধুনা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয় ) থেকে ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছেন । ১০৭৯ সালে সহকারী শিক্ষক হিসাবে সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন । পরবর্তী সময়ে পদোন্নতি পেয়ে প্রধানশিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন করেন জয়কুমার রোয়াজা পাড়া উচ্চ বুনিয়াদি বিদ্যালয় এবং উত্তর দৌলবাড়ি উচ্চ বনিয়াদী বিদ্যালয়ে । ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ের পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান এবং সরাসরি বিদ্যালয় পরিদর্শক পদে যথেষ্ট  নিষ্ঠার সাথে কাজ করে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন ।


৮ ) সাহিত্যকর্ম : 

সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের মুখপত্র 'আন্তর'-এ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর লেখালেখি শুরু । নবম শ্রেণিতে পাঠকালীন বিদ্যাiukলয়ের মুখপত্রের সম্পাদনার দায়িত্ব পান । কবি হিসেবে পরিচিতি শুরু হলেও তিনি রাজ্যের একজন সাহিত্যসমালোচনা ও সমাজবিষয়ক প্রবন্ধরচনাকার । লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষণাকর্মে রত ।ইতোমধ্যে তাঁর বহু কবিতা, গল্প ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ দেশের ও দেশের বাইরে নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । অনেকগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠ করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন । ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার ফলে ইতোমধ্যে ভারতে ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন স্থানের বেশ কয়েকটি  সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি । এই বয়সেও সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক 
ইতিহাস নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও লেখালেখিতে রত আছেন। নিজের গবেষণা সংক্রান্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও রাজ্যের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট গবেষকের গবেষণাপত্র রচনা ক্ষেত্রে ক্ষেত্রসমীক্ষা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তিনি ।সংশ্লিষ্ট গবেষকগণও তাঁদের গবেষণাপত্রে তাঁর সাহচর্য বিষয়ে বেশ যত্ন সহকারে উল্লেখ্য করেছেন । সেই সুবাদে সম্প্রতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষিকা ইশিতা ভৌমিকের গবেষণাপত্রের সহতত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব ও পালন করেছেন তিনি । 
তিনি নাটক লেখা ও অভিনয়েও দক্ষ ।জীবনে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন । নাটক লিখেছেন । নাট্যকর্মশালায় প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছেন । 'ভাঙন' ও 'রাঙামাটির পথে' নামে ত্রিপুরার দুটি টেলিফিল্মে অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন ।
রেছেন ।বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রয়েছেন । তিনি ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের রাজ্য কমিটির উপদেষ্টামন্ডলীরও অন্যতম সদস্য । সামাজিক কাজকর্ম, সাহিত্যসৃষ্টি ও গবেষণাকর্মের মধ্যে ডুবে থেকেই তিনি তাঁর বর্তমান অবসর জীবন অতিবাহিত করছেন ।

৯) প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা :

    ক) ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), ভাষা, আগরতলা ২০০২ 
    খ) বিনীত চুম্বন ( কবিতা ),  89স্রোত, কুমারঘাট, ২০০৭ 
     গ) ত্রিপুরার লোকসংস্কৃতির তত্ত্বরূপ সন্ধান ও বিষয়বিন্যাস ও বিষয় বিন্যাস (প্রবন্ধ ), স্রোত, কুমারঘাট ২০১৩ 
      ঘ) ত্রিপুরার মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ সম্পাদনা ), স্রোত, কুমারঘাট, ২০১৬
i        চ ) জোছনার হাওরে বলিরেখা ( কবিতা ), ত্রিধারা, ২০২২ 
        ছ )  অন্তরে দহন অনন্ত ( মুক্তগদ্য ), ত্রিধারা, ২০২৩ 
         জ ) কুসুমে কুসুমে রেখে যাওয়া চরণচিহ্ন :99 ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের ১২৫ বছর ( প্রবন্ধ ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঝ ) ফেনী নদীর প্রত্নকথা ও মানুষের উপখ্যান ( আঞ্চলিক ইতিহাস ), স্রোত, ২০২৩ 
          ঞ ) ত্রিপুরার লোক ধর্ম ও লোকাচার ( প্রবন্ধ ) অন্যপাঠ , ২০২৩

১০)  সম্মান,পুরস্কার ও স্বীকৃতি :

           ক ) অগ্রণী পুরস্কার, বিলোনিয়া, ত্রিপুরা ১৯৭৫
           খ ) সংবাদ সাহিত্য পুরস্কার, আগরতলা, ১৯৯৫ 
            গ ) লোকসংস্কৃতি সম্মাননা, মনুবাজার,২০১৫
             ঘ ) সাহিত্য সম্মান– তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, ত্রিপুরা সরকার ২০১৭
            ঙ ) সমভূমি সাহিত্য সম্মান, বাইখোরা,  দ. ত্রিপুরা ২০১৭
             চ ) সৃজন সাহিত্য সম্মান, ইসলামপুর, উত্তর দিনাlজপুর, প. বঙ্গ, ২০১৮
             ছ ) স্রোত রজতজয়ন্তী প্রকাশনা উৎসব সম্মাননা, সুকান্ত একাডেমি আগরতলা, ২০১৯ 
             জ ) বনতট সাহিত্য সম্মান, কাঞ্চনপুর, উত্তর ত্রিপুরা ২০২০ 
             ঝ ) দেবদ্বীপ সম্মান, শান্তির বাজার, ২০২২ 
              ঞ ) গবেষক সংবর্ধনা, ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ, উদয়পুর ২০২৩
              চ ) বরিষ্ঠ সাংবাদিক সম্মাননা, ত্রিপুরা ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, আগরতলা, ২০২৪
               ছ )ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সম্মাননা, বিশ্ব বাঙালি সংসদ বাংলাদেশ, ঢাকা ২০২৪
               জ) সৃষ্টি সাহিত্য সম্মান ২০২৪, সৃষ্টি সাহিত্য পত্রিকা, নলুয়া বিলোনিয়া ।
               সলিলকৃষ্ণ দেববর্মণ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ( ত্রিপুরা সরকার ) ২০২৪

এছাড়া জাতীয় শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসের 'প্রজেক্ট গাইড' হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মান ২০০৩ প্রাপক ।

Wednesday, May 28, 2025

MY PENSION FROM = 0CT 2025

FOR FEB21 : BP
=40500 DA=00 ঞঞCOMM=6300 FMA= 500 NET = 34700



FROM MAR21 : BP= 40500 DA( 3% )=1225 REC=00 COMM=6300 DIS=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 NET।=35925 PNBHOGBD

FROM JULY22 : BP=40500 :।ন DA (8% )=3240 REC=00😂
COMM=6300 DID=00 IR=00 OLD=00 FMA=500 TDS=00 ।
40500 -6300 = 34200+ 500 + 38240 ( 8% DA ) =37940

FROM DEC22 : BP=4এ0500 : DA ( 12% )= 8100 REC = 
00 COMM = 6300😭 DID = 00 IR = 00 OLD = m00 FM 500 TDS = 00 NETন = 42800
40500 - 6300 = 34200 + 500 + 8100 ( 20% DA ) = 42800

FROM JAN24 : BP=40500 : DA ( 25% )= 10125 REC =<00 COMM = 6300 DID=00 IR = 00 OLD = 00 FMA= 500 TDS = 00 NET = 44825

FROM NOV24 : B = 40500 : DA ( 30% ) = 12150 : REV = 00 COMM : 6300 DID = 00 IR = 00 OLD = 00 FMA = 500 TDS = 00 NET = 46850

FROM APRL25 : BP = 40500 : DA ( 33% ) = 13365 : REV = 00 COMM : 6300 : DID = 00 : IR = 00 : OLD = 00 : FMA = 500 : TDS = 00 : NET = 48065/-

FROM OCT25 : BP = 40500 : DA (36%) = 14580
REV = 00 COMN : 6300 : DID = 00 : IR = 00 : OLD = 00 : FMA = 500 : TDS = 00 : NET = 49280

Sunday, May 4, 2025

রবীন্দ্রসৃষ্টিতে পূর্ববাংলার ভাষা, জীবন ও কৃষ্টিসংস্কৃতির প্রভাব

রবীন্দ্রসৃষ্টিতে পূর্ববাংলার ভাষা, জীবন ও কৃষ্টিসংস্কৃতির প্রভাব

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯–১৯০১ সাল পর্যন্ত শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর ও কালিগঞ্জ অঞ্চলে কবির জীবনের ২৮ থেকে ৪০ বছর সময়কালের ১২ বছর অতিবাহিত করেন । পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে বিয়ের দুদিন আগে ২২ অগ্রাহায়ন ১২৯০ বঙ্গাব্দে একটি চিঠিতে তার পূর্ববঙ্গের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করেন । সেই চিঠিতে তিনি লেখেন–'এইক্ষণে তুমি জমিদারীর কার্য পর্যবেক্ষণ করবার জন্য প্রস্তুত হও; প্রথমে সদর কাছারিতে নিয়মিত রূপে বসিয়া সদর আমিনের নিকট হইতে জমাওয়াশিল বাকি ও জমাখরচ দেখিতে থাক এবং প্রতিদিনের আমদানি রপ্তানি পত্র সকল দেখিয়া তাহার সারমর্ম নোট করিয়া রাখ ।' ( রবিজীবনী, তৃতীয় খন্ড, কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. ২০০৯ । পৃষ্ঠা ১১৯ ) । তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ২২ বৎসর সেই থেকে ক্রমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার জমিদারি সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন । রবীন্দ্রনাথের জীবনপঞ্জি অনুযায়ী দেখা যায় যে আরও প্রায় ছয় বছর পরে তার আঠাশ বছর বয়সে ১৮৮৯ সালের ২৮শে নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের জমিদারির দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন । ( তদেব ) ।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে শিলাইদহপর্ব তাঁর কল্পনার জগতকে সমৃদ্ধিদানের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে । শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর ও কালীগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ লেখালেখির উৎকর্ষতার সুযোগ পান । রবীন্দ্রনাথের এই পর্বের সৃষ্টিকে গবেষকগণ শিলাইদহপর্ব বলে আখ্যায়িত করেন । এখানে এসে তিনি পরিচিত হন গ্রাম বাংলার উদার শ্যামল প্রকৃতির সঙ্গে । এখানকার পদ্মা, গড়াই, আত্রাই, নাগর, বড়াল ও ইছামতি নদী তাঁকে প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডেকেছে । সর্বোপরি এখানকার দরিদ্র চাষি জনগণের জীবন দেখেছেন তিনি খুব কাছে থেকে । তাদের চিরক্রন্দনময় জীবন দেখে তিনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন । তিনি লিখেছেন–'কেবলই ভাবছি আমাদের দেশজোড়া চাষীদের দুঃখের কথা । আমার যৌবনের আরম্ভ কাল থেকেই বাংলাদেশের পল্লীগ্রামের সঙ্গে আমার নিকট পরিচয় হয়েছে । তখন চাষীদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ ছিল দেখাশোনা–ওদের সব নালিশ উঠেছে আমার কানে । আমি জানি ওদের মতো নিঃসহায় জীব অল্পই আছে, ওরা সমাজের যে তলায় তলিয়ে সেখানে জ্ঞানের আলো অল্পই পৌছয়, প্রাণের হাওয়া বয় না বললেই হয় ।' ( রাশিয়ার চিঠি, রবীন্দ্ররচনাবলী, পৃষ্ঠা ৬৮৩ ) ।

পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কবির সম্পর্ক ছিল অবিনাশী । পদ্মার তরঙ্গ-বিভঙ্গে নৌকায় ভেসে ভেসে তিনি নিবিড়ভাবে অবলোকন করেছেন এ অঞ্চলের শান্ত শ্যামল পল্লীপ্রকৃতি ও সহজ সরল প্রজাসাধারণ ও তাদের জীবনযাত্রা । রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ পর্বে সৃষ্টি হয়েছে সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কথা, কাহিনী, কল্পনা, কণিকা, ক্ষণিকা, নৈবেদ্য ইত্যাদি ঐশ্বর্যময় কাব্য সম্ভার । 'সোনার তরী' কাব্যে পদ্মার তীর, বর্ষার বন্যা, নৌকা, চর ক্ষেতের ফসল, চাষির জীবন, নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি । 'সোনার তরী' কবিতায় ১) গান গেয়ে তুলিবে কে আসে পারে দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ২ ) রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা ৩ ) পরপারে দেখি আঁকা তরু-ছায়া মুসলিম মাখা, গ্রামখানি মেঘে ঢাকা প্রভাতবেলায় ৪ ) ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা  ইত্যাদি পংক্তিতে পদ্মাতীরের নয়নমুগ্ধকর চিত্র ফুটে উঠে ।

'চিত্রা' কাব্যের বিষয়বস্তু সৌন্দর্যবোধ হলেও গ্রামীন চাষিজীবনের সংকট ফুটে উঠেছে 'এবার ফেরাও মোরে' কবিতায় । দরিদ্র চাষিদের সংকটমোচনের জন্য তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন–'এইসব মূঢ় ম্লান মুখ মুখে / দিতে হবে ভাষা–এইসব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা–' । 'চৈতালি' কাব্যে পদ্মাকে নিয়ে রয়েছে কবিতা, 'হে পদ্মা আমার /তোমায় আমায় দেখা শত শত বার ।' 'কথা' ও 'কাহিনী' কাব্যে বারবার এসেছে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের কথা । 'দুই বিঘা জমি'র উপেন মিথ হয়ে আছে । এর কাহিনি নাকি রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল । এই কবিতায় তিনি পূববাংলার পল্লীপ্রকৃতির একটি চিত্র তুলে ধরেন–'ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি / পল্লব ঘন আম্রকানন রাখালের খেলা গেহ / স্তব্ধ অতল দিঘি কালো জল নিশীথ শীতল স্নেহ / বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে / মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে ।' ক্ষণিকা কাব্যেও রয়েছে নিসর্গ ও মানুষ । 'আষাঢ়' ও 'নববর্ষা' কবিতায় বর্ষার গুরুগম্ভীর রূপ প্রকাশ পেয়েছে । 'নৈবেদ্য' কাব্য প্রকাশের সময় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন । নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে ঈশ্বরোপলব্ধির ভূমিকা প্রধান থাকলেও বাংলার দিগন্তপ্রসারী উদার প্রকৃতির প্রভাবও রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টিতে ।

রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের ৯৪টি গল্পের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গল্প তিনি রচনা করেছেন শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে অবস্থানকালে । গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত সুখদুঃখ, আশানিরাশা, কৃষ্টিসংস্কৃতির জীবন্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাঁর ছোটোগল্পসমূহে । পূর্ববাংলায় বসে লেখা তাঁর গল্পগুলোতে বাংলাদেশের শ্যামল সুন্দর প্রকৃতি, অজ্ঞ, অসহায়, অশিক্ষিত ও দরিদ্র জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধ যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি জমিদারি শাসনের নেতিবাচক শৃংখলে পর্যুদস্ত জীবনচিত্র ও প্রতিফলিত হয়েছে । তাঁর রচিত 'ছুটি', 'পোস্টমাস্টার', 'সমাপ্তি', 'দেনা পাওনা' 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা', 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' ইত্যাদি গল্পে কৃষক, গৃহিণী, দরিদ্র প্রজা, জমিদারের কর্মচারী, এমনকি গ্রামীন বালকের জীবন সংগ্রাম দুঃখ-কষ্ট নিঃসঙ্গতা ও নীরব অভিমান অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উঠে এসেছে । 'পোস্টমাস্টার' গল্পে গ্রামীন জনপদের নিঃসঙ্গ পোস্টমাস্টার ও ছোটো রতনের মধ্যে আবেগময় সম্পর্কের মানবিকতা, 'ছুটি' গল্পে ফটিক চরিত্রের মাধ্যমে গ্রামীণ বালকের জীবনযুদ্ধ, 'দেনা পাওনা'য় পণপ্রথা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর অসহায়ত্ব,  'সমাপ্তি' গল্পে গ্রামীন শিক্ষকের সহজ জীবন ও স্বাভাবিক প্রেমের বিকাশ এগুলো শুধু শিল্প সুষমায় সমৃদ্ধ নয় বরং গ্রামবাংলার ইতিহাস, জীবনপ্রবাহ ও সংস্কৃতির অনন্য দলিল ।

পূর্ববাংলার নদীমাতৃক প্রকৃতি লোকজ  জীবনধারা, নদী, নৌকা, কৃষিজীবন ও লোকসংগীত রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে । তিনি বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকগানের সহজ সরল আবেগপ্রবণ ধারাকে আধুনিক সাহিত্যে ও সঙ্গীতে ব্যবহার করে নতুন মাত্রা দিয়েছেন । নদী ও নৌকার সঙ্গে সম্পর্কিত ভাটিয়ালি গানের সুর ও ছন্দ রবীন্দ্রসংগীতে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে । 'এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী' এই জাতীয় গানের উদাহরণ । লোকগানে ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দ, সহজ, সরল, ভাষাব্যবহার ও চিত্রকল্প রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায় সাবলীলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে । ফলে তাঁর সৃষ্টি সর্বজনগ্রাহ্য আবেদন এনে দিয়েছে । তিনি লোকসংগীতের ঢঙে নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করেছেন । আবার কখনো সরাসরি লোকসুর ব্যবহার করেও গান রচনা করেছেন । রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের শ্রাবণ ( ৭ই আগস্ট ) রচনা করেছিলেন 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি । এই গানটি গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে' গানটির সুরে রচিত । এই গানটি এতটা জনপ্রিয় হয়েছিল যে ৭১এ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে ফিরত । পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রূপে গানটি গৃহীত হয় । লোকসংগীতের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক আবেদন রয়েছে তেমনি রবীন্দ্রনাথের অনেক গান ও কবিতার মধ্যে ঈশ্বরোপলব্ধি বা জীবনের গভীর সত্যের অনুসন্ধান লক্ষ্য করা যায় । 'রূপ সাগরে ডুব দিয়েছি অরূপ রতন আশা করে',  'তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি',  'তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছ নিচে /তোমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর আমার প্রেম হতো যে মিছে' গানগুলো এ প্হঙ্গে উল্লেখ করা যায় ।' শিলাইদহে বাউলদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় পরিচয় ঘটে । এখানে অবস্থানকালে গগন হরকরা, কাঙাল হরিনাথ, গোঁসাই রামলাল, গোসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, লালনের শিষ্যসামন্তদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখাসাক্ষাৎ ও আলোচনা হত । শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া থেকে তিনি লালন ফকির ও গগন হরকরার গান সংগ্রহ করে বিদগ্ধ মহলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সংগৃহীত গানগুলো 'বাউল' নামে গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল । তিনি তাঁর কয়েকটি নাটকেও বাউল গান ব্যবহার করেছেন । 'মানুষের ধর্ম' গ্রন্থে ঔপনিষদীয় আত্মতত্ত্ব ও বাউল দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা তিনি করেছেন । তাঁর চিত্রাঙ্গদা ও চন্ডালিকা নাটকে লোকজ আঙ্গিক এবং নারীচেতনার দেশজ স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে । এই নাটক দুটিতে সমাজের নারী, জাতপাত ও মূল্যবোধের জটিলতাকে শিল্পিত ও মানবিক রূপে উপস্থাপন করেছেন ।

রবীন্দ্রনাথের গদ্য ও পদ্যে বহুবার পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক শব্দ, ধ্বনি ও বাক্যবন্ধ ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন সাজু, লাউ, চাষা, নাও, মাঝি, ডিঙি, পাল, গাঙ, জোয়াল, তালগাছ ইত্যাদি শব্দ তাঁর রচনায় দেখা যায় । শিলাইদহে থাকাকালীন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রসমূহ 'ছিন্নপত্রে' যেমন পূর্ববঙ্গের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে তেমনি সেখানকার মানুষের মুখের ভাষা ও উচ্চারণের ছাপ স্পষ্ট । তার উদাহরণ, 'চাষার ভাষায়, মহারাজ ফসল ভালো হয় নাই, তবে আল্লার কৃপা হইলে বাঁচুম ।' এই জাতীয় সংলাপ তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের উদাহরণ ।

তাঁর বিসর্জন, ডাকঘর, মালিনী নাটকে সহজিয়া ভাষাব্যবহারের ছাপ রয়েছে । সংলাপে গানে আঞ্চলিক শব্দ ও লোকজ ভাষাভঙ্গের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । যেমন–রে !ওরে !হে দাদা ! বাপু তুমি না কেমন করো না রে ! তুই বড় গেঁয়ো জাতীয় শব্দ নাটকের চরিত্রদের সংলাপে ব্যবহৃত হয়েছে । 'চন্ডালিকা' নাটকের একটি সংলাপে দেখি–'তুমি তো জাতের লোক, আমি তো চন্ডালের মেয়ে ' জাতপাতের লোকজ দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব । 'মুকুট' নাটকে 'ওগো রে ! মুকুট যে মাথার উপর বসে সেই জানে ওটা কত ভারী ।' প্রবাদপ্রতিম বাক্যে একদিকে দার্শনিকতা আবার অন্যদিকে লোকজবোধের প্রকাশ ঘটে ।

১৯০১ সালের পর রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে গিয়ে শান্তিনিকেতনে বসবাস করলেও পরবর্তী সময়ে বহুবার শিলাইদহ এসেছেন । এখান থেকেই তিনি সংগ্রহ করেছেন তাঁর সারাজীবনের সৃজনের সঞ্চয় । এ প্রসঙ্গে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ তাঁর 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন–'আমার ধারণা বাবার গদ্য ও পদ্য দু'রকম লেখারই উৎস যেমন খুলে গিয়েছিল শিলাইদহে, একদিনের জন্য কলম বন্ধ হয়নি । শিলাইদহের যে রূপবৈচিত্র তার মধ্যেই পেয়েছিলেন তিনি লেখার অনুকূল পরিবেশ ' । এই পূর্ববাংলার জল, মাটি, হাওয়া, নদী ও মানুষের মধ্যেই রবীন্দ্রমানসের, রবীন্দ্রমননের সূচনা হয় । রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীজীবনে আঁকা চিত্রসম্ভারেও শিলাইদহ তথা পূর্ব বাংলার প্রভাব নিহিত ছিল । রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতরণি একদিন পূর্ববঙ্গেরই সোনার ধানে ভরে গিয়েছিল ।

Monday, March 17, 2025

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

নবোন্মেষ ও সমতট-র বসন্তোৎসব ও শ্রীরাধা ঠাকুরানি

গতকাল বামুটিয়া কালিবাজার সংলগ্ন পাতাবাজারে নবোন্মেষ ও সমতট সাহিত্যপত্রের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত উৎসব । অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে রঙে রঙে রাঙিয়ে বনভূমিবেষ্টিত এই নির্জন পল্লীতে রাজ্যের প্রায় ৩০০ জন গুণী ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, আলোকচিত্রী, সংগীতশিল্পীর সম্মিলিত সমাবেশে এই মনোগ্রাহী অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় । প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই অনুষ্ঠান ও মধ্যাহ্নের আহার্য খিচুড়ি ও সবজি সবাইকে মনে প্রাণে তৃপ্তি দেয় । আয়োজকদের প্রত্যেকের অকুন্ঠ আতিথেয়তায় সবাই অভিভূত। আলোচনা, নৃত্য পরিবেশন কবিতাপাঠে গোটা অনুষ্ঠান ছিল প্রাণবন্ত । এ জাতীয় অনুষ্ঠানে শুধু সৃজনশীলতার চর্চাই হয় না । ভাবের আদান-প্রদানসহ আন্তরিক সম্পর্কও তৈরি করে । 

অনুষ্ঠানের একটা পর্বে ছিল রাজ্যর বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কুমার কমলের আকর্ষণীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, যা সকলের মন জয় করে । কুমার কমলকে হোলির গান গাওয়ার জন্য জন্য অনুরোধ করলে তিনি তাঁর অপারগতার কথা অকপটে স্বীকার করেন । কিন্তু তিনি শেষদিকে উপস্থিত গুণীজনের জন্যে একটা প্রশ্ন রেখে যান । তাঁর কাছে নাকি পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে । এবং তিনি নাকি সেসব গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছেন । তিনি নাকি বেদ-পুরান-ভাগবতের কোথাও 'রাধা' শব্দটি পাননি । উপস্থিত গুণীজনদের কাছে তিনি তার ব্যাখ্যা চেয়েছেন । এ নিয়ে উপস্থিত সকলের মধ্যে প্রশ্ন ও কিঞ্চিৎ গুঞ্জন সৃষ্টি হয় । দু-একজন আমার কাছে বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন । আমার শাস্ত্রগ্রন্থাদির তেমন পাঠ নেই । কিন্তু বাংলাসাহিত্যের দীন ছাত্র হিসেবে যে সমস্ত গ্রন্থ সামান্য পাঠ করেছি কেবল পরীক্ষা পাশের জন্য সেখানে কিন্তু 'রাধা' নাম আমি পেয়েছি । এমনিতেই অনুষ্ঠানটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল না তাই আমি আরও সময় নষ্ট করে ব্যাখ্যায় যাইনি ।

সবার অবগতির জন্য আমি আমার সামান্য জ্ঞান থেকে এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি কোথায় কোথায় 'রাধা' নামের কিরূপ অবস্থান রয়েছে । এবিষয়ে যাঁরা নিবিড় চর্চা করেন তাঁরা আরও  বিস্তৃত বিশ্লেষণ করতে পারবেন । জয়দেবের 'গীতগোবিন্দম্' গ্রন্থে রাধাকৃষ্ণের মিলন, বিরহ, অভিলাষ, প্রত্যাশা, নিরাশা, মান, ঈর্ষা, হর্ষোল্লাস তথা পুনর্মিলনের কাহিনি মধুর লালিত্যমন্ডিত পদ দ্বারা সংবদ্ধিত হয়েছে । কাব্যের শেষে ভগবানরূপী শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার চরণযুগল মস্তকে ধারণের প্রার্থনা করেছেন 'দেহি পদপল্লবমুদারম' বলে । আমাদের পাঠ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটিও রাধাকৃষ্ণের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট । সেখানে 'রাধাবিরহ' নামে একটা ছিন্ন খন্ড রয়েছে। এছাড়া বাংলার কাব্য, সাহিত্য, গীতিকা, পদাবলী বা বৈষ্ণবকবিতা, বৈষ্ণবাচার্যদের টীকা-টিপ্পনীসমূহে তো বহুভাবে  রাধাপ্রসঙ্গের  উল্লেখ রয়েছে । পুরাণের মধ্যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও পদ্মপুরাণ এর নানা স্থানে রাধা নামের উল্লেখ রয়েছে । মৎস্যপুরাণে 'রুক্মিণী দ্বারাবত্যাং তু রাধা বৃন্দাবনে ।' বায়ুপুরাণে  'রাধা বিলাস রসিকং' । বরাহপুরাণে  'তস্য রাধা সমাশ্লিষ্য ' রয়েছে । ঋকবেদেও ১/২২/৭-৮ এবং ৮/৪৫/২৮ সূক্তে 'রাধা' 'রাধস' 'গোপি' শব্দের উল্লেখ আছে সামবেদে শ্রীরাধার সহস্র নাম আছে । তার মধ্যে ষোড়শ নাম প্রধান । অথর্ববেদ এবং অথর্ববেদের অন্তর্গত পুরুষবোধিনী শ্রুতি ( রাধা যস্যা ), গোপালতাপনী শ্রুতি, গৌতমীয় তন্ত্র ( রাধিকা পরদেবতা ) তৈত্তরীয় উপনিষদ, রাধাতন্ত্র এবং নারদপঞ্চরাত্রতেও ( জগন্মাতা চ রাধিকা ) রাধা নাম উল্লেখিত আছে । শ্রীমৎ ভাগবত গীতা হল শ্রী ভগবানের বাণী । এখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ময়দানে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের পারস্পরিক সংলাপে অন্য কোন চরিত্রের উপস্থিতি অস্বাভাবিক । বিষয়বস্তু ও আলাদা । রাধার উপস্থিতিও অপ্রাসঙ্গিক । এখানে একটি দর্শনকে উপস্থাপন করা হয়েছে ।

শ্রীমদ্ভাগবত গ্রন্থে প্রকাশ্যে রাধা নাম না থাকলেও রাধাকৃষ্ণকে নিয়েই এই গ্রন্থ । প্রাণবিহীন যেমন দেহের অর্থ নেই । প্রাণই দেহের মূল । তেমনি শ্রীরাধা ভাগবতের প্রাণ । শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের প্রাণ । শ্রীল শুকদেব গোস্বামী শ্রীরাধিকার প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণে বৈষ্ণবীয় বিনম্রতায় ভাগবতে রাধা নাম উল্লেখ করেননি । শুকদেব কেন শ্রীমতি রাধারানি নাম উচ্চারণ করেননি সেই প্রসঙ্গে সনাতন গোস্বামীর ব্যাখ্যায় রয়েছে–

 "গোপীনাং বিততিদ্ভুতস্ফুটতর নামপ্রেমানলার্চিশ্চটাদগ্ধানাং কিল নাম কীর্তনকৃতাত্তাসাং স্পর্শেন সদ্যো মহাবৈকল্যং 
স ভজন কদাপি ন মুখে নামানি কর্তুং প্রভুঃ ।" 

অনুবাদ:– 'শুকদেব শ্রীমদ্ভাগবতকথা, কীর্তন করার সময় গোপীদের কারো নাম উচ্চারণ করতে সমর্থ হননি । তার কারণ গোপীদের নাম উচ্চারণ করলে তিনি ভাবাবেগে আত্মবিহ্বল হয়ে সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন । যার ফলে তিনি আর ভাগবতের কথা বলতে পারতেন না । ফলে মহারাজ পরীক্ষিতের ভাগবত গ্রন্থ শ্রবণ ব্যাহত হয়ে পড়ে । তাই শুকদেব গোস্বামী এখানে কৌশল অবলম্বন করেন । ভাগবতের রাসলীলা বর্ণনায় একজন ভাগ্যশালিনী গোপিনী প্রিয়তমা গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তরালে বিবিধ বিলাস করার বর্ণনা রয়েছে । আসলে অন্যতমা এই গোপিনী শ্রীকৃষ্ণের বক্ষবিলাসিনী শ্রীমতী রাধাঠাকুরানি । ভাগবতের 'অনয়ারাধিতো নূনং ভগবান হরিরীশ্বরী' এই শ্লোকের 'অনয়ারাধিত'  শব্দে রাধা নাম আছে । টীকাকার শ্রীসনাতন গোস্বামী বলেছেন, 'আরাধিত' শব্দের মাধ্যমে এখানে রাধা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এই বাক্যের মাধ্যমে  শুকদেব গোস্বামী রাধাকে দর্শন করেছেন। 'রাধেতি  নামকরঞ্চ দর্শিতং ।' ব্যাসদেব রচিত হরিবংশেও 'যুবতী গোপ কন্যাশ্চ' শব্দের মাধ্যমে রাধিকাকে বোঝানো হয়েছে । ভাগবতের ন্যায় শ্রীমতি রাধিকা এখানেও লুক্কায়িত । কিন্তু যেখানে রাস আছে সেখানেই রাসেশ্বরী শ্রীমতি রাধাঠাকুরানি আছেন । ভগবানের শক্তির তিনটি ভাব আছে । একটি সদ্ভাব ( সন্ধিনী শক্তি ), দ্বিতীয় চিৎ ভাব ( সম্বিৎশক্তি ), তৃতীয়টি আনন্দ ভাব ( হ্লাদিনী শক্তি ) । এই হ্লাদিনী শক্তি ভগবানের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত স্বরূপ-আনন্দ শক্তি । ইনি নিত্য-বৃন্দাবনেশ্বরী শ্রীমতি রাধারানী ।

কবিরাজ কৃষ্ণ দাস গোস্বামী তার চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে রাধা নামের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন । তিনি তার গ্রন্থের মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর দক্ষিণ ভারত ভ্রমণকালে রায় রামানন্দ  সাক্ষাৎ করলে তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণের বিবিধ বিলাসতত্ত্ব ও সাধ্যসাধন তত্ত্বকে তুলে ধরেন । সেখানে কান্তাপ্রেমের ব্যাখ্যায় বলেছেন কান্তভাব প্রেম সর্বসাধ্য সার অর্থাৎ পরম পুরুষ ভগবানের সঙ্গে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক স্থাপন হল ভক্তিপূর্ণ জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটি সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় একমাত্র গোপীগণ ও শ্রীমতি রাধারানী তা সম্ভব করে তোলেন । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন–
 
রাধা কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি । 
অন্যোন্যে বিলশে রস আস্বাদন করি ।। 
সেই দুই এক এবি চৈতন্য গোঁসাঞি 
ভাব-আস্বাদিতে দোঁহে হইল এক ঠাঁই ।

অর্থাৎ রাধা ও কৃষ্ণ এক আত্মা । রাধাকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি । 

হ্লাদিনী সার 'প্রেম' প্রেম সার 'ভাব' ।
 ভাবের পরমকাষ্ঠা নাম মহাভাব ।।
মহাভাব স্বরূপা শ্রীরাধা ঠাকুরানি ।
 সর্বগুণখনি কৃষ্ণ কান্তা শিরোমণি ।।

শক্তি ও শক্তিমানের অভেদের কারণে রাধা কৃষ্ণ স্বরূপত এক ও অভিন্ন । তবু লীলারস আস্বাদন করার জন্য ভিন্ন দেহ ধারণ করে লীলা-বিলাস করেছেন কিন্তু পুনরায় এই রস আস্বাদন করার জন্য রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহ শ্রীচৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন । কবি চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের মুখ্য কারণটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–

শ্রীরাধায়াঃ প্রণয়মহিমা কিদৃশো বানয়ৈবা 
স্বাদ্যো যেনাদ্ভুত মধুরিমা কিদৃশো বা মদীয় ।
 সৌখ্যং চাস্যা মদনুভবতঃ কী দৃশং বেতি লোভা
 তদ্ভাবাঢ়্যঃ সমজনি শচীগর্ভসিন্ধৌ হরীন্দুঃ ।

অর্থাৎ, শ্রীরাধার প্রেমমাহাত্ম্য কেমন এই প্রেমের দ্বারা রাধাকৃষ্ণ যে অদ্ভুত মাধুর্যরস আস্বাদন করেন, রাধা যে সুখ পান সেই সুখই বা কেমন, এই সমস্ত বিষয়ে জানার ইচ্ছার কারণেই রাধার ভাব গ্রহণ করে কৃষ্ণ শচীগর্ভে চৈতন্যদেব রূপে আবির্ভূত হয়েছেন ।

বৃন্দাবনে গোপিগণের প্রেম ছিল কামগন্ধহীন । কবিরাজ গোস্বামী কাম ও প্রেমের বিভাজন করেছেন–

আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা তারে বলি কাম ।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম ।।

গোপীদের মধ্যে রাধারানি শ্রেষ্ঠ । কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন– 
সেই গোপিগণ মধ্যে উত্তম রাধিকা ।
 রূপেগুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্বাধিকা ।।

বাংলার সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলি ও অন্যান্য বৈষ্ণবসাহিত্যের কেন্দ্রভূমিতেই রয়েছেন শ্রীরাধিকা ।

ভারতের সমস্ত মহান ভক্তিশাস্ত্রে রাধাকৃষ্ণের অতীন্দ্রিয় অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে । যাঁরা রাধানাম অস্বীকার করেন তাঁরাই এই ধরনের প্রশ্ন তোলেন এবং শ্রীরাধার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ বা সংশয় প্রকাশ করেন । যথাযথ গ্রন্থের নিবিড় অধ্যয়নের মাধ্যমে এই সংশয় দূর করা যাবে । ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে এমন বহু প্রশ্নই থেকে যায় বা রাখা যায় ।
সতেরো, তিন, দুহাজার পঁচিশ ।

Monday, March 10, 2025

ত্রিপুরার অরণ্যের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় প্রাণী

ত্রিপুরার অরণ্যের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় প্রাণী 

ত্রিপুরার অরণ্য একসময় নানারকমের প্রাণীকুলে সমৃদ্ধ ছিল । কিন্তু ক্রমান্বয়ে অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে বহু প্রাণী আজ হারিয়ে গেছে । বহু প্রাণী বিলুপ্তির পথে । সেরকমই  উড়ুক্বু বেড়াল । সিভ্যাট ক্যাট । একেবারেই বিলুপ্তির পথে । এরা গভীর অরণ্যে থাকে । একসময় ত্রিপুরার জঙ্গলেও ছিল । বন ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে । এখন ক্বচিৎ কদাচিৎ দুএকটা লোকালয়ে এসে পড়ে । এরকম এ অঞ্চলের আরও কয়েকটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী কেন্দাবাঘ, ভল্লুক, চশমা বানর ও লজ্জাবতী বানর।  হারিয়ে গেছে  বনরুই, রামকুত্তা, শজারু ও মথুরা নামের ময়ূরের মতো পাখিটি । আরও কতরকমের সরীসৃপ, পাখি ও কীটপতঙ্গ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না ।কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও অরণ্যসংকুল হওয়ায় এমন বিলুপ্তপ্রায় অনেক প্রাণী এখনও দেখা যাচ্ছে । বন যত হারিয়ে ততই এইসব প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।

Saturday, February 8, 2025

অনুষ্ঠিতব্য না অনুষ্ঠাতব্য

অনুষ্ঠাতব্য বা অনুষ্ঠেয় এদুটো শুদ্ধ (  ভবিষ্যতে অনুষ্ঠানযোগ্য অর্থে )
প্রত্যয় বিযুক্ত করলে দাঁড়ায়–
অনুষ্ঠাতব্য—অনু+✓স্থা+তব্য
অনুষ্ঠেয়— অনু+✓স্থা+য

Friday, February 7, 2025

আমার কুম্ভস্নান ও অগণিত রত্নঢেউ

        ফ‌

Saturday, January 25, 2025

আমার কুম্ভস্নান ও অগণিত রত্নঢেউ

আমার কুম্ভস্নান ও অগণিত রত্নঢেউ । 

আজ কুম্ভস্নানতিথি । মহাকুম্ভস্নানের ক্ষণ ।  আমার কুম্ভস্নান । বইমেলা আমার কুম্ভমেলা । এই মেলার শুরুর দিন থেকে প্রতিবছর অগণিত জনসমুদ্রে অবগাহন করে এসেছি । আজ এল আমার সেই মহালগ্ন । পূর্ণ আমার অমৃতকুম্ভের সন্ধান । আমার জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার পিতৃদেবকে । যিনি আমার শৈশবের কোন একদিন আমাদের পারিবারিক আরাধ্য দেবতাবর্গের পটের সামনে বসিয়ে হালকা আবির রঙের এক পাখির পালক দোয়াতে ডুবিয়ে কলাপাতায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন । তারপর ক্রমান্বয়ে আমি খাগের কলম, বাঁশের কঞ্চির কলম,স্লেটপেন্সিল,  কাঠপেন্সিল, ফাউন্টেন পেন বলপেন ও আজকের দিনের মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপে অক্ষর সাজিয়ে চলেছি । আমার অক্ষর বিন্যাসের মহড়ায় শৈশব থেকে আমাকে নিয়ত লালন করে গেছেন বহু শ্রদ্ধেয়জন । আজ কুম্ভজলের প্রতিটি ঢেউয়ের আলোড়নে অমার অন্তরাত্মা বারবার উচ্চারণ করছে তাঁদের নাম যাঁরা আমার জীবনের নানাক্ষেত্রে আমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন । শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানশিক্ষক প্রমোদরঞ্জন দে, পূর্ণেন্দুবিকিশ দত্ত, সন্তোষ ভট্টাচার্য, ও লালকৃষ্ণ দাশসহ সুনীল বর্মন, নিখিল চৌধুরী, গোপাল চক্রবর্তী,  দীপংকর নাথ, সত্যজিৎ ভট্টাচার্য, প্রদ্যোৎ পাল, বিক্রমজিৎ দেব, নিকুঞ্জবিহারী নাথ, দেবলমোহন ভট্টাচার্য, সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী, নিখিল চৌধুরী, অমিয়প্রভা চৌধুরী, স্বপ্না ভট্টাচার্য, সুরেশ দত্ত, প্রাণতোষ কর্মকার, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক দেবতোষ চৌধুরী ও মানিক চক্রবর্তী ( গল্পকার ), কাশীনাথ দাস  প্রমুখ সেকালের দিকপাল শিক্ষকরা । শৈশব কৈশোরে বাবার চাকুরিসূত্রে কাটিয়েছি কুলাইতে । সে স্কুলের গ্রন্থাগারটিও ছিল সেযুগে সমৃদ্ধ । পড়ার বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি সেখানে । কুলাই হাসপাতালে চিকিৎসক দম্পতি ছিলেন ড. এম এল বোস এবং ড. লীলা বোস । তাঁদের একমাত্র সন্তান কুশল আমার বাল্যবন্ধু । তাদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল । সেখানে আমি গোগ্রাসে পড়েছি আগকার দিনের সেই পূজাবার্ষিকীগুলো, দেশ, অমৃত, শুকতারা, নবকল্লোল, প্রসাদ, উল্টোরথ, সিনেমা জগৎসহ, টারজান, নন্টে-ফন্টে, ইন্দ্রজাল কমিকস, স্বপনকুমার সিরিজসহ বিশ্বসাহিত্যের বহু অনুবাদগ্রন্থ ।  কুশল অর্থাৎ শিবাজী বসুর দিদি ভাস্বতী বসু রত্নাদির সঙ্গে আমার বইপড়ার প্রতিযোগিতা চলত ।  পিসিমা ড. লীলা বসু বেশ উৎসাহ দিতেন আমাদের । ওরা সবাই এখন কলকাতাবাসী । সাব্রুম মহকুমায় আমি সাহচর্য পেয়েছি ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, ড. রঞ্জিত দে, কৃষ্ণধন নাথ, তিমিরবরণ চাকমা, গোপীরঞ্জন বসাক, কানাইলাল নাথ, জয়দেব বসাক, প্রদীপ চৌধুরী, দীপক দাস রতন চক্রবর্তী, থেঙ্গাফ্রু মগ, সঞ্জিৎ মালাকার প্রমুখগণের । সাব্রুম উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূত্রে আমি সেই বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলাম দীর্ঘদিন । এখানে আমি পড়েছি প্রচুর । সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি শ্রদ্ধাস্পদ প্রধান শিক্ষক লালকৃষ্ণ দাস, স্বপন মুখার্জী ও ব্যোমকেশসখা দেবনাথ, পন্ডিতমশাই যশোদাজীবন গোস্বামী, মানিকলাল ব্যানার্জী, সুভাষ  দাস, রমণীমোহন নাথ, রণজিৎ দেবনাথ, গোপাল দেবনাথ, ড. রঞ্জিত দে, ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, শংকর বনিক, শম্ভু চৌধুরী, শিখা ভট্টাচার্য, শম্ভুনাথ সাহা আলপনা চক্রবর্তী, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, সুব্রতা দে, অর্জুন শর্মা, সাধন মজুমদার, টুটুল মজূমদার, গণেশ কর, রাখাল সোম, সাধন পাল, সাধন মজুমদার, পার্থ দেব, পার্থ সাহা, গীতা চক্রবর্তী, রণজিৎ চক্রবর্তী  প্রমুখ দিকপাল শিক্ষক শিক্ষিকাদের । বিলোনিয়া মহাবিদ্যালয় পড়ার সময় নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি অধ্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়, কালিপদ হুই, প্রাণকৃষ্ণ মন্ডল, পরিতোষ সরকার ( ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর পবিত্র সরকার এর অনুজ ), রণজিৎ দত্তকে এবং হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, হরিভূষণ পাল, অশোক দাশগুপ্ত, কুসুমকুমার পাল, ভূপাল সিনহা প্রমুখ সেকালের বিলোনিয়ার অগ্রজ সাহিত্যসেবীগণের । গত শতকের সাতের দশকের শেষ দিকে আমার দুর্দিনে আমাকে মরুদ্যানপ্রতিম সাহচর্য দিয়েছেন প্রয়াত কবি অরুণ বনিক । তিনি আমাকে বিশ্বসাহিত্যের বিশিষ্ট লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করান সেদিন । ছোটোখিলের মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আমার কবিতা নিয়ে গ্রুপ সেঞ্চুরির উদ্যোগে আয়োজিত আগরতলা পোস্ট অফিসের সামনে অনুষ্ঠানে পাঠ করে শোনান । এই দশকেই জাগরণ সাহিত্য বাসরের সৌজন্যে আমার পরিচয় হয় রাজ্যের বরিষ্ঠ কবি নকুল রায় ও মানস পালের সঙ্গে । এই দুজন আমাকে ফুটে ওঠার জন্য তুমুল ভাবে উত্তাপ দিয়ে যাচ্ছেন । তাঁদের মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছি সে যুগের দিকপাল সব সাহিত্যিকদের সঙ্গে । আগরতলায় বন্ধুবর কবি কৃত্তিবাস চক্রবর্তীর  বাড়িতে আসত নানাধরনের বই ম্যাগাজিন । আসতেন রাজ্যের দিকপাল সাহিত্যসেবীরা । সেখানে নিবিড় অধ্যয়নের পাশাপাশি আমি পরিচিত হয়েছি তাঁদের সাথে । আশির দশকের শুরুতে বইমেলা যেন আমাকে সাগর সঙ্গমে নিয়ে এল । সেদিন যাদের অভিভাবকত্বে আমি বেড়ে উঠেছিলাম তাঁরা হলেন ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য, বিমল চৌধুরী, কালিপদ চক্রবর্তী, অসীম দত্তরায়, ননী কর, দিব্যেন্দু নাগ, পূর্ণেন্দু গুপ্ত, সমরজিৎ সিংহ, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিলীপ দাস, সুজিতরঞ্জন দাস করুণাময় শর্মা । আরো অনেকেই আমাকে লালন করেছিলেন সেদিন যাদের নাম আমি আজ আর মনে করতে পারছি না । আমার সময়ে কৃত্তিবাস চক্রবর্তী, বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, সন্তোষ রায় লক্ষ্মণ বণিক, সমর চক্রবর্তী, প্রত্যুষরঞ্জন দেব, মাধব বনিক প্রমুখগণ আমাকে ক্রমাগত উৎসাহিত করেছেন । আমার পরবর্তী প্রজন্মের দেবাশিস চক্রবর্তী, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, আকবর আহমেদ, অশোক দেব, প্রবুদ্ধসুন্দর কর, মিলনকান্তি দত্ত, গোবিন্দ ধর অপাংশু দেবনাথ, গোপেশ চক্রবর্তী, তারাপ্রসাদ বনিক, অভীককুমার দে, বিজন বোস থেকে শুরু করে আজকের দিনের সপ্তশ্রী কর্মকার, মিঠু মল্লিক বৈদ্য, অনামিকা লস্কর, শংকর সাহা, গোপা সাহা, টিঙ্কুরঞ্জন দাস, অর্ধেন্দু ভৌমিক সাচীরাম মানিক, রুপন মজুমদার, রাহুল শীল, ভবানী বিশ্বাস তাদের সৌহার্দ্যবলয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছেন । জীবনের সাঁঝবেলা হলেও নবীন প্রজন্মের সাথে আমি পা মিলিয়ে চলেছি আলোপথে । কালের কাছে আমার প্রার্থনা, আরো আরো সময় দাও আমাকে হে! আরো বেশি করে যেন খুঁজতে পারি সাহিত্যের মণি-মানিক । আমার এই সাহিত্যসম্মান ত্রিপুরার সমস্ত সাহিত্যপ্রাণ মানুষের জন্য উৎসর্গ করছি ।
১৪ জানুয়ারি, ২০২৫
আগরতলা বইমেলা প্রাঙ্গন ।

No comments:

Thursday, February 6, 2025

অন্তর্বয়নের আলোকিত উদ্ভাস

অন্তর্বয়নের আলোকিত উদ্ভাস 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কাঁটার খোঁচা শরীরের প্রত্যঙ্গে ব্যথার অনুভূতি জাগায় । তেমনি কাঁটাটা খুলে ফেলতে পারলে যন্ত্রণাটারও সমাপ্তি আসে । মনটা মুক্ত হয় অস্বস্তি থেকে । হ্যাঁ, তেমনি একটা অস্বস্তির কন্টক বয়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছি আর ফেরা অব্দি কাঁটাটা তার তীব্র প্রদাহে জানান দিচ্ছে খাঁচাটার ভেতর বসত করা অস্বস্তির অস্তিত্ব । তবে ঝেড়ে ফেলা যাক, এই আপাত বর্জ্য যন্ত্রণাটাকে । সদ্য সমাপ্ত ৫ম উত্তর-পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলন থেকে ফেরার পর প্রতিক্ষণে বৃদ্ধাতর্জনীমধ্যমা চঞ্চল হয়ে চাইছে ধারালো নিবের সান্নিধ্য । অন্তরীণ বোধের কাছে জবাবদিহি তো করা দরকার । সম্মেলন থেকে কোন অতিদূর রশ্মি আন্তরিকতায় আত্মসমর্পণ করল না শুধু, অধরাই রইল অরূপের মাধুরী ।

সাহিত্যকে সীমানা দিয়ে চিহ্নিত করা যায় না । এ তো সূর্যের মতো সত্য । তাই তো সচেতন চেতনা থেকে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন ওঠে । সীমানাকে মানতে চান না কোন ধীমান । তার পরমাত্মা তো বিশ্ব মহাবিশ্ব সমস্তকেই অন্তর্লোকের একই সীমানার মধ্যে পেতে চায় । তবুও বসে যায় সীমানার নির্ধারক স্তম্ভ । তবে এই সীমানা সমাপ্তি নির্ধারক নয় । এ হল পথরেখার সংকেত মাত্র। পরবর্তী পথের প্রবেশের সিংদরোজার নির্দেশচিহ্ন । যে চিহ্নাতিচিহ্ন থেকে এক মহাদীর্ঘসূত্র রচনা হয়ে যাবে গ্রন্থিত মালিকার মতো । চৌকাঠ পেরিয়ে ফটক, ফটক পেরিয়ে মহাসড়ক। এভাবে অতিক্রমণই যে গতি । সাহিত্যের চলাচল । উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলনও সেই মহাজাগতিক পথেরই একটি একটি আলপথ মাত্র ।

তবুও কথা থাকে, কথা হয় । কি পেলাম আমরা এই অতিসাম্প্রতিক পরিভ্রমনে। নিজস্ব কড়চায় কি তুলেছি, ভূতত্ত্ববিদের নির্ধারিত সীমানার এই ভূখণ্ডের অন্তর্শরীর কতটুকু বৃষ্টিপাতে উর্বর হয়েছে । কতটা কাঁপন উঠেছে এই ভূমিভাগের চায়ের কচিপাতায়, গৈরিক কমলাবনে, সুসবুজ বাঁশ আর বেতের অরণ্যে, হরিৎ থেকে স্বর্ণিলবর্ণে রূপান্তরিত শস্যক্ষেত্রে । কি গান শোনায় এর ক্ষীণতোয়া ঝর্ণা থেকে শুরু করে কুলপ্লাবি শ্রোতঃস্বলা নদী ! কোন আমন্ত্রণলিপি অথবা প্রত্যাখ্যানপত্র রচনা করছে এখানের পাথরপ্রতিম দেহসুষমা আর মাখনকোমল অন্তঃকরণের অধিকারী মানুষ মানুষীরা ।

৮-১০ জানুয়ারি '৯৪, তিনদিনের উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলনের ৫ম বার্ষিকীকে একটি মাত্র রূপকল্পে অভিসঞ্চিত করা যায়, এ হল ঐশ্বর্যের মহামিলন । ঐশ্বর্য তার বোদ্ধার উপস্থিতিতে, ঐশ্বর্য তার অন্তর্কল্প, প্রস্তাবনার প্রকাশবৈদগ্ধ্যে, ঐশ্বর্য তার হার্দ্য সংবেদনশীলতায়, ঐশ্বর্য তার সম্মিলিত কন্ঠে উচ্চারিত সামগানে, আরও ঐশ্বর্য তার সৃষ্টিকর্মকে অনিরুদ্ধ রাখার ঐকান্তিক প্রতিজ্ঞাদৃঢ় উজ্জ্বল দৃষ্টিদ্যুতির স্বতোৎসারিত স্ফুরণে ।

তবুও বলা ভালো । সব ঐশ্বর্য সুখের নয় । যেমন দৃষ্টিনন্দন নয় সন্ন্যাসীর ভস্মাবলিপ্ত বাহুতে বদ্ধ স্বর্ণকবচ । কাঞ্চনের ঐশ্বর্য স্থলনই আনে । বণিককুল গোপন স্যাবোটাজে ধ্বংস করে শিল্পের নন্দনোদ্যান । ছিল কি এবার বিগত চার সম্মেলনের বনবিহারসুলভ বৈরাগ্যশোভন উন্মুক্ততা । বৃন্দাবনে মহারাসের উজ্জ্বলরসের মাহাত্ম্য কি জানে নগরগণিকা ? এ সৌখিন মজদুরি ভালো কি মন্দ বিচার করুন, যাঁরা এই সম্মেলনসমূহের সৃষ্টি থেকে নিজেকে নিঃশেষ করে চলেছেন । এমনকি কথা ছিল প্রথম দিন ? যে দীর্ঘ দেহী আন্তরঅভ্যর্থনায়পূর্ণ বন্ধুটি নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে গেছেন সম্মেলনের আসমাপ্তিকাল তার কেন কবিতা পড়ার সুযোগ হলো না ? কেন রবীন্দ্রভবনের বাইরে আলোতেই নিজেকে লুকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস নিয়েছেন তিনি ।  মনে হয় কারা যেন দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তালিকাশোভন অলংকারই হয়েছিলেন শুধু ।

এবার তবে শুরু হোক ক্ষেত্রকর্ম । তিন দিনের সম্মেলনে যে সমস্ত আলোচ্য বিষয় বারবার উচ্চকিত হয়েছে, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উৎস মুখে ফিরে যাওয়ার যে আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে, যে বিদগ্ধ বিদ্বৎমন্ডলী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক এ অঞ্চলের মৃত্তিকা সংলগ্ন সমস্যাসমূহ পরিস্থিতি সাহিত্য শিল্পকর্মের কালানুক্রমিক গতিপ্রকৃতি পারস্পরিক সম্পর্কে একাত্মীকরণ প্রয়াস ইত্যাদি বিষয়ে যে জ্ঞানগর্ভ অভিজ্ঞতা লব্ধ দিকনির্দেশ দিয়েছেন তা ছড়িয়ে দেওয়া হোক পুষ্প বৃষ্টির মত এ অঞ্চলের প্রতিটি তৃণাগ্রশিখরে । আরও আরও সুদৃঢ়বন্ধনে বেষ্টিত হোক সকলের হৃদয়পল্লব । বিচ্ছিন্নতার কূটকীটের বিরুদ্ধে আরম্ভ হোক তীব্র জীবননাশক সিঞ্চনের ন্যায় আন্তরিক ধারাবর্ষণ । 

আর ভাবা যাক কি অপূর্ণতা রেখে এসেছি আমরা অতিক্রান্ত সোপান নির্মাণে । ছিল কি লোকউপাদানের প্রতি আমাদের আন্তরিক টান ? হয়তোবা মনের ভুলে সহস্র কর্মের প্রবাহে অনুক্তূ রয়ে গেছে লোকশিল্প লোকসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতির বিষয়ে আলোচনার অবতারণার নির্ধারিত ব্যবস্থা । তাই হয়তো এ অঞ্চলের প্রখ্যাত লোক গবেষককে দেখেছি ভবন চত্বরে অপান্তেও পদচারণায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখতে । অথচ বক্তাআলোচক প্রত্যেকেই এই মৃত্তিকাগন্ধী আঙ্গিক এর প্রতি হার্দ্য অনুভব জানিয়েছেন আলাপচারিতায় ।

স্মরণ করা যাক, কবিতা পাঠের মর্যাদা কতটা রক্ষিত হয়েছে । কৌলিন্যরক্ষার্থে অশিতিপর বৃদ্ধের কাছে অনুঢ়াদানের মতো দায়সারা আয়োজন কাব্যপাঠের । বাইরে সংগীতানুষ্ঠানমুখর মুক্তমঞ্চের তান্ডবের বিপরীতে প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে শ্রোতাহীন, পাঠকহীন মঞ্চে সভাপতিমন্ডলীর অস্বস্তি, ভাঙা বাজারের ধূসরিত হওয়া বড় বেশি করে বিদ্রুপাত্মক করে তুলেছিল এই পর্যায়কে । একদিকে স্কুলপালানো ছেলের মত বারবার নাম রাখার পরও অনুপস্থিত সব প্রতিভাধর কবিরা অন্যদিকে ভিতরে প্রবেশ না করে স্বতোৎসারিত ক্ষোভে ভ্রাম্যমান অতি তরুণ প্রতিভাবান কবিরা । তারই মধ্যে বিদ্যুৎস্ফুরণের মতো অনর্গল কাব্যবোধে মহাবিশ্ব স্বভাবকবি, সংগীত ময়তায় তন্ময় গায়ককবি, শায়েরী স্রষ্টা কবি আর উটকো ঝামেলার বেড়া ডিঙিয়ে ক্ষেতে ঢুকে পড়া শব্দদূষণের কবির চিৎকার রসপিপাসুকে রস দিয়েছেই । তবুও কবিতার প্রতি যা কিছু প্রস্ফুট অনীহা যত অতলান্তই হোক ডুব দিয়ে খোঁজা দরকার ।

সুখ, তার সবটাই যদি সুখের হয় তাহলেও সুখ নেই । বেদনার দংশন না থাকলে অনুভব হয় না প্রেমার্তি । তাই বোধহয় কিছু কিছু যন্ত্রণাদগ্ধ মুহূর্ত আরো বেশি মুগ্ধকর করে তুলেছে এর অঙ্গসজ্জা । আর বেদনা না জাগিয়ে ইচ্ছে হয় সম্পাদনা করি আগামী পরিশুদ্ধ পরিক্রমার নির্দেশ পঞ্জিকা হিসেবে এক ইপ্সিত ইশতেহার :

অ ) আমরা আমাদের ঐতিহ্যের কাছে দায়বদ্ধ । আমাদের লোকজ উপাদান আমাদের কম্পাস । লৌকিক সম্মান আমরা দেবই ।

আ) কবিতার জন্য আমরা নিভৃত সাধনপীঠ গড়ে যাবই । ঋষিপ্রতিম মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করব আমাদের আগামী কবিতা ।

ই ) পির ফকির আর বাউলের মননশীল আন্তরিকতা থাকবে আমাদের যাপনে । আলোকিত মুদ্রাক্ষয়ী ঐশ্বর্য আমরা চাই না ।

ঈ ) সম্মিলিত দীর্ঘপদযাত্রায় সমতলীয় কৃষকের খামার থেকে পর্বতোচ্চ জুমের টঙঘর পর্যন্ত সর্ববিস্তৃত নম্র আত্মীয়তা আমরা গড়বই ।

উ ) কেন্দ্র থেকে বিচ্ছরিত আলোকণার মতো আমরা একে অন্যে, অন্যে সকলে, বৃত্তের পরিধিকে বাড়াতে আন্তর প্রচেষ্ট হব । ফাঁক এবং ফাঁকি দুইই অচ্ছুত থাকবে ।

( পঞ্চম উত্তর পূর্বাঞ্চল সাহিত্য সম্মেলন প্রসঙ্গে : দৈনিক সংবাদ ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৪ প্রকাশিত । )

Sunday, February 2, 2025

জ্যোতির্ময় রায়, আমার জ্যোতিদা

জ্যোতির্ময় রায়, আমার জ্যোতিদা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বয়সে ছোটো হলেও জ্যোতির্ময়দাই  ডাকতাম আমি । তিনিও আমাকে অশোকদাই ডাকতেন । বছর দশেক আগে আগরতলার বইমলায় আমার সঙ্গে পরিচয় ধর্মনগরের আমার কবিবন্ধু এবং লোকসংস্কৃতিপ্রাণ লংম্যান সমর চক্রবর্তীর মাধ্যমে । জীবনের শেষভাগে এসে এক অমায়িক মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলাম আমি । তারপর পরিচয় ক্রমে বয়সের বাধা এড়িয়ে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে । বহু অনুষ্ঠানে আমরা একসঙ্গে মঞ্চে বসেছি । আলোচনায় অংশ নিয়েছি । আমার লেখা তিনি বরাক উপত্যকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছেন ।  তাঁর সম্পাদিত প্রজন্মচত্বরে আমার কবিতা ছেপেছেন । ৭–৮ জানুয়ারি ২০২৩শিলচরে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্রের উদ্যোগে আয়োজিত নবম উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় লিটল ম্যাগাজিন সম্মেলনে আমাকে গোপেশ চক্রবর্তী নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জলীয় সংবাদের প্রতিনিধি করে । শিলচর স্টেশন থেকে দেবদূত মোড়ের সন্নিকটে হোটেল কল্পতরুতে টুকটুকে চড়ে পৌঁছানোর দায়িত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিয়েছিলেন প্রজন্ম চত্বর সম্পাদক জ্যোতির্ময় রায়দাদা । সেবারে আসতে যেতে ট্রেনে কী জমাট আড্ডা । ভুলি কি করে ! লিটল ম্যাগ নিয়ে আমরা দুজন পাশাপাশি বসেছিলাম ।  জ্যোতির্ময়দার পরিচিতি বিশাল । যাঁর সঙ্গেই কথা বলতেন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন তাঁর সঙ্গে । তারপর তাঁর শারীরিক অসুস্থতার সংবাদও পেয়েছি । চিকিৎসার পর ফিরে এসেছেন । একদিন আমরা মাঝদুপুরে নিবিড় আড্ডা দিয়েছিলাম আইজিএম চত্বরে । মাঝে নাট্যব্যক্তিত্ব সুভাষ দাসও কাটিয়ে গেছেন কিছু সময় । অসুস্থ মানুষ অথচ চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছেন তাঁর শ্যালককে । নিজের শারীরিক কষ্ট ভুলে এতটা দায়িত্বপূর্ণ তিনি । এই মানুষটাই এবছর এগারো জানুয়ারি আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে দীর্ঘায়ু কামনা করে স্বয়ং চলে গেলেন অনন্তভ্রমণে । এ কেমন কথা জ্যোতির্ময়দা !

Sunday, January 26, 2025

দধীচি

দধীচি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জগত জুড়ে উদার সুরে প্রচার করলেও যুদ্ধ থামেনা ।
 রক্তাক্ত মহাকাব্য লেখা যেন মানুষের ধর্ম ।

বোধিবৃক্ষ তলে বসে শাক্যমুনি কার কথা বলেন ?
কাদের কান্না শুনে তিনি প্রাসাদে ছেড়েছেন ?

শাসকের ললাটের লেখা । যতক্ষণ তখতে থাকেন ততক্ষণ 
শিবিরে শিবিরে তার পতাকা ওড়ে । সিংহাসন ভেঙে গেলে ভিমরুলেরা  ঝাঁক বেঁধে নিশানা করে প্রণম্য বীরকেও ।

 তবুও যুদ্ধবিহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে বহু সাধারণ নাগরিক 
দুধভাত না হোক, তবুও প্রতিবেশীসহ শান্তি চায় সবাই। 

হাজারো হৃদয়ের গভীর আওয়াজ, কুম্ভমুখী জনঢল 
সন্ত্রাস ও হিংসাকে পায়ে দলে খুঁজে ফেরে পূর্বজদের হাড় ।
যুগে যুগে দধীচিরা এ রেখে গেছেন পাহাড় প্রমান ।

Saturday, January 25, 2025

আমলিঘাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিংবদন্তী ও ইতিহাস

আমলিঘাট ও সন্নিহিত অঞ্চলের কিংবদন্তী ও ইতিহাস 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

আনুমানিক ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ শিক পরগনার কৈয়রা গ্রামে শমসের গাজীর জন্ম হয় । ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরারাজ্যের রাজধানী শমসের গাজির অধিকারভুক্ত হয় । তখন থেকে ১২ বছর তিনি ত্রিপুরারাজ্যের সর্বময় কর্তা ছিলেন । শমসের গাজির জীবনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর মৃত্যুর পর শেখ মনুহর গাজি নামে এক পল্লীকবি রচনা করেন গাজীনামা । ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালির সেরেস্তাদার মৌলবি খবির মুদ্রিত করেন এই গাজীনামা । ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত কাব্যগ্রন্থ গাজীনামায়  শমসের গাজির গড় জগন্নাথ-সোনাপুর গ্রামের বর্ণনায় পাই, 'দক্ষিনে ফেনী নন্দী / পূর্বে গিরি মুড়াবন্দি / উত্তরেতে এহেন জলধি । /  পশ্চিমে মলয়া পানি / তার মধ্যে ভদ্রাখানি / মধ্যে যেন খিরুদের দধি ।।

 এখানেও শমসের গাজীর গড়বন্দী গ্রামের সীমার উল্লেখ রয়েছে । ফেনীপাড়ের এই বিদ্রোহী বীরের উত্থানে সেদিন ত্রিপুরার রাজসিংহাসন কেঁপে উঠেছিল । ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শমসের গাজীর কিল্লা এবং বিশাল দিঘিটি আজও দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমার পশ্চিম প্রান্তস্থ সীমান্ত গ্রাম আমলিঘাটে বিদ্যমান । আমলিঘাট থেকেই ফেনীনদীর নিম্নগতির শুরু এবং প্রশস্ত জলপ্রবাহের রূপ ধরে দক্ষিণাভিমুখী হয়ে বাংলাদেশের সমতল ক্ষেত্রে উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে ।

ফেনী নদীপ্রবাহের ভারত ভূখণ্ডের শেষ প্রান্তিক জনপদ আমলিঘাট । সাব্রুম মহকুমার প্রত্যন্ত গ্রাম । একসময় আমলিঘাট বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল । ত্রিপুরার প্রায় প্রতিটি নদীপ্রবাহের সীমান্ত অঞ্চলে রাজআমলে গড়ে উঠেছিল বনকর ঘাট । ফেনীনদীর ঘাটের ইজারার সুবাদে আমলিঘাটে গড়ে উঠেছিল ফেনীঘাট নামে বনকর ঘাট । আর তাকে কেন্দ্র করে তহশীল অফিস । ১৮৮৮ সালের আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ ও ত্রিপুরার যৌথ সরকারের তরফে একজন অফিসার এই ঘাটের তদারকি করতেন । বনজ সম্পদ আহরণের উপর ত্রিপুরার রাজা ও ব্রিটিশ সরকার ১০ আনা : ৬ আনা হারে কর আদায় করতেন । ১৮৭১ সালে ফেনীঘাটের ইজারা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ২০০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১২০০০ টাকা হয়েছিল । রিয়াং ও চাকমা গোষ্ঠীর লোকেরা তখন 'কোন্দা' এবং 'লং' নামে বিশেষ ধরনের নৌকা দিয়ে ফেনী ও গোমতী দিয়ে সমতল ত্রিপুরায় পণ্য পাঠাতেন । এসব কারণেই আমলিঘাটের গুরুত্ব ছিল । ১৯১৬ সালে সাব্রুম থেকে আমলিঘাটের রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয় ।

আমলীঘাট ও তার পার্শ্ববর্তী লোকালয় ঘিরে বেশ কিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও লোককাহিনি জড়িয়ে আছে । এখানে অবস্থিত শমসের গাজির দিঘি ও কেল্লাটি আজ জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে । দিঘির বৃহত্তর অংশই কাঁটাতারের ওপারে, যার একাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত । দিঘিটির তেমন সংস্কার নেই । পাড় কেটে অনেকে চাষের জমি বানিয়ে ফেলেছে । এই দিঘিকে কেন্দ্র করে লোককাহিনিও প্রচলিত ছিল একসময় লোকমুখে । দিঘির পাড়ে তালিকা রেখে মানত করলে নাকি বাসনকোশন পাওয়া যেত উৎসব অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণের কাজ সমাধা করার জন্য । দিঘির এক কোনা থেকে একটা সুড়ঙ্গপথ শমসের গাজির কেল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে যা এখন বনজঙ্গল ঘেরা এবং বাদুড়, চামচিকে, সরীসৃপের আবাসস্থল । লোকপ্রচলিত কথা আছে, এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে শমসের গাজির কেল্লার অভ্যন্তরের পর্দানশীন মহিলারা দিঘির জলে স্নান করতে যেতেন । 

শমশের গাজির এই দিঘিটির চারধারে যে উর্বর নিম্নসমভূমি রয়েছে এবং যা বর্তমানে বাংলাদেশের অংশের চাষের ভূখণ্ড তার নাম 'কালিদহ' । এই কালিদহকে কেন্দ্র করেও একটি পুরানো লোককথা প্রচলিত রয়েছে । সেই অনুযায়ী জানা যায় যে, এই কালিদহে নাকি চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা ডুবেছিল । বছর ৪০ এর আগেও এখানকার ভূমিতে প্রোথিত নৌকার গলুইয়ের মত কিছু একটার উর্ধ্বভাগ দেখা যেত। এটাকে ধারণা করা হত চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া নৌকার গলুইয়ের অংশবিশেষ । এই বস্তুটি ১৯৭৪ সালে এই প্রতিবেদক এবং ত্রিপুরার বিশিষ্ট লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে প্রত্যক্ষ করেছেন । গ্রাম্য ললনারা এখানে দীর্ঘদিন ধূপ দীপ জ্বালাতেন । পাশের বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত গ্রামটির নাম 'চম্পকনগর' ।  বলা হয় এখানে চাঁদ সওদাগরের বাড়ি ছিল । আমলিঘাটের প্রায় এক দেড় কিলোমিটার দূরে ফেনীনদীর উজানের দিকে একটি গভীর খাত রয়েছে । এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে জলঘূর্ণির সৃষ্টি হয় । জলের এই পাকের মধ্যে কিছু এসে পড়লে কুন্ডলি পাকিয়ে জল তা অনেক দূরে নিয়ে ফেলে । এই স্থানটিতে জলের গভীরতাও প্রচুর । ৫০-৬০ হাত লম্বা বাঁশ ফেলেও ঠাঁই পাওয়া যায় না । এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় বলে মৎস্যশিকারিদের জন্য লোভনীয় স্থান এটি । এই জায়গাটির নাম 'মেরুকুম' । সন্নিহিত জনপদের নাম মেরুপাড়া ।  ত্রিপুরার দক্ষিণপ্রান্তের শেষ ভূখন্ড বলেই হয়তো ভৌগোলিক 'মেরু' শব্দটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে । এখানে বিস্তৃত চরভূমি রয়েছে । মেরুকুমের এই চরভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখা বিকেলবেলা সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত নয়নমুগ্ধকর । লোকশ্রুতি আছে, এখানেই নাকি মনসামঙ্গল খ্যাত বেহুলার বাবা সায়বেনের বাড়ি ছিল। একসময় এই মেরুকুম পর্যন্ত সমুদ্রের জোয়ারের জল আসত । ফেনীনদীর বাঁকে অবস্থিতএই মেরুকুম-আমলিঘাট-কালিদহ-চম্পকনগর ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে সত্যিই মনসামঙ্গলে বর্ণিত কাব্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করে । এই আমলীঘাটের পাশেই ফেনীনদীর পাড়ে একটি নাতিউচ্চ পাহাড়ে রয়েছে একটি প্রাচীন শিবমন্দির । এই পাহাড়টিকে বলা হয় সন্ন্যাসী টিলা । বহুকাল আগে এই টিলাতে একজন সন্ন্যাসী একাকী বাস করতেন বলে এর নাম সন্ন্যাসী টিলা হয়েছে । এখানকার শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করেও রয়েছে মিথ । কথিত আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের বিখ্যাত শৈবতীর্থে যাওয়ার আগে ভক্তরা এখানে বিশ্রাম করতেন । এই পাহাড়টায় প্রচুর বেলগাছ রয়েছে । বলা হয় এই বেলগাছ আপনাতেই গজায় । কেউ লাগাতে হয় না । কেউ কেউ বলেন, এখানে শিবপার্বতী বিশ্রাম করেন । প্রতিবছর শিবচতুর্দশীতে এখানে বিরাট মেলা বসে । এটিও চন্দ্রনাথ শিবতীর্থের ক্ষুদ্র রূপ । মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্য দ্বিজ রতিদেবের 'মৃগলুব্ধ'তে যে শিকারির কাহিনি রয়েছে তাতে উল্লেখিত রঘুনন্দন পাহাড়ের শেষ প্রান্ত হল এই সন্ন্যাসী টিলা । মৃগলুব্ধ কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী এই সন্ন্যাসী টিলার সঙ্গে কিছু মিল পাওয়া যায় । কালের গ্রাসে বহু কিছু হারিয়ে গেছে । হয়তো দ্বিজ রতিদেব কোন কারণে এই অঞ্চল পরিভ্রমণ করে গিয়ে তাঁর মৃগলুব্ধ কাব্য লিখে থাকবেন । সে দিক দিয়েও এ স্থানটির মাহাত্ম্য রয়েছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ও আমলিঘাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল । এক কথায় আমলিঘাটকে ঘিরে পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে । সরকার এ ব্যাপারে সহৃদয় দৃষ্টি দিতে পারেন ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস–কৈলাস চন্দ্র সিংহ
    ২. গাজিনামা–শেখ মনোহর গাজী
     ৩. ত্রিপুরার ইতিহাস–ড. জগদীশগণ চৌধুরী
     ৪. ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম–ড. রঞ্জিত দে
      ৫. ত্রিপুরার লোক সাহিত্য ও জনজীবন–ড. রঞ্জিত দে 
      ৬. ত্রিপুরার লোকসমাজ ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
      ৭. সাব্রুমের ইতিহাস ও সংস্কৃতি–অশোকানন্দ রায়বর্ধন
      ৮. মানিক্যশাসনাধীন ত্রিপুরা–নলিনীরঞ্জন রায়চৌধুরী