এসো শান্তি, এসো মঙ্গল
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
সর্বেষাং স্বস্তির্ভবতু ।
সর্বেষাং শান্তিরভবতু ।।
সর্বেষাং পূর্ণং ভবতু ।
সর্বষাং মঙ্গলং ভবতু ।।
আমাদের কোন জমিজিরেত ছিল না । বাবা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন । তাই পরিযায়ী জীবনটাই দেখেছি বহুবছর । তারপরও আমাদের জন্য এসেছে বারো মাসে তেরো পার্বণ । কৃষি জীবনের পাশাপাশি আমাদের জীবন । কৃষক পরিবার নবান্নের দিনে আমাদের 'নিতা' না দিয়ে তাঁদের অন্ন গ্রহণ করেননি । অন্ততপক্ষে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন চাল-ডাল-আনাজ-মসলাপাতি ভর্তি এক ডালা 'সিধা' । প্রতিবেশীর প্রতি মর্মবোধে । প্রতিবেশীর সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে । প্রতিবেশীর মুখে আনন্দ না থাকলে গৃহস্থের আনন্দে ও তৃপ্তি আসে না । শান্তি পাওয়া যায় না । লোকাচার পালিত হলেও মনটা থাকে ভারাক্রান্ত । গৃহস্থ চান প্রতিবেশী ও শান্তিতে থাকুন । আনন্দে থাকুন । আমাদের উপনিষদ সেই স্বস্তির কথাই বলে । সেই শান্তির কথাই বলে । সেই পূর্ণত্বের কথা বলে । বলে সকলের মঙ্গলের কথা ।
৪৩-তম আগরতলা বইমেলায় এই ভূখণ্ডের প্রতিবেশীরা যখন পরস্পর আরো আরো বেশি বেশি করে পরস্পরকে বেঁধে বেঁধে রাখতে চাইছেন, যখন বাংলা প্রকাশনার পাশাপাশি ককবরক ও অন্যান্য প্রকাশনা সুশোভিত হয়ে উঠছে, সংখ্যার দিক থেকে এক অংক থেকে দুই অংকের পথে পা বাড়াচ্ছে, তখনই অনুভব হয় ঘরোয়া প্রতিবেশীর সৃজনসম্ভবনার, শ্রীবৃদ্ধির । সকলের নিশ্চিন্তির । সকলের শান্তির । আবার এ ব্যথা ও জাগে মনে যে, এবার তো আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিবেশীকে 'এসো আমার ঘরে এসো' বলে উদাত্ত আহ্বান জানাতে পারলাম না । পারলাম না একই রংয়ের রক্তের দোসরকে কাছে পেতে । সেই প্রতিবেশীর ঘরে আজ স্বস্তি নেই । শান্তি সেখানে বিঘ্নিত । অমঙ্গলের বিষবাষ্প, বিদ্বেষকলুষ আকাশে বাতাসে । পরস্পর থেকে আমরা ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছি । আমরা যেন অপরিচিত হয়ে যাচ্ছি একে অন্যের কাছে । এবারের বইমেলায় কাব্যজনের উচ্চারণে, সারস্বতজনের ভাষণে, শিল্পীর কন্ঠে প্রতিটি শৈল্পিক গলিতে, প্রতিটি মঞ্চে একই উৎকণ্ঠা আমাদের সেই প্রতিবেশীর জন্যে । সবারই আশা, এই মেঘ কেটে যাবে । এ অন্ধকার অপসারিত হবে একদিন । আবার আমরা কাছাকাছি আসব । পাশাপাশি বসব । 'প্রাণ জুড়াবে তায়' ।
এই সময়ের আর এক যন্ত্রণা, আর এক অস্বস্তি তারুণ্যকে নিয়ে । কেমন অদ্ভুত নেশার কবলে ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে আজকের প্রজন্ম । এ সমাজের আগামীর প্রতিনিধি তারা । অথচ দলে দলে জাটিংগার পাখির মতো ঝাঁপ দিয়ে চলেছে বিষাক্ত জতুগৃহে । তাদের স্বপ্নিল চোখে দুনিয়াকে দেখা, তাদের প্রেম, বিরহ ও সৃষ্টিশীলতা আজ এক শূন্যতার মাঝে সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাদের মায়াবোধ । এই অশনিকাল থেকে উত্তরণেরও এক নিদান বই এবং বই । এক নির্বাক বান্ধব । বেপথুমান প্রজন্মটাকে দিশায় আনতে গেল বইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে এদের । বইও হতে পারে দুঃসময়ের মৃতসঞ্জীবনী । তাই এই পথহারাদের বইয়ের ভিড়ে মিশিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি । সচেতন মহল থেকে জোরালো হয়ে উঠে আসছে সে দাবি । সুস্থতার বোধনের যজ্ঞশালা হোক বইমেলার মাঠ । বইয়ের বুকে কান পেতে শুনুক ওরা জাগরণের গান ।
বইমেলা প্রবেশপথের সুদৃশ্য তোরণে স্থাপিত যাবতীয় মুদ্রাসমূহ আর সর্বশীর্ষে শোভিত তথাগত বুদ্ধের প্রতীকী বিগ্রহ বিশ্বমৈত্রী, শান্তি আর করুণার বার্তাকে বহন করে । এই দুঃসময়ে প্রতিবেশীর রণোন্মাদনা, বিচ্ছিন্নতার উস্কানি, সীমান্তে গোলাবারুদের শংকা, আকাশে বোমারু বিমানের আসন্ন গর্জনভীতির মাঝেই আমাদের দেশ 'বহুজন হিতায় বহু জন সুখায়' নিরব নিশ্চল ও অচঞ্চল । শান্তির বার্তা ভারতাত্মার মর্মবাণী । এই বইমেলাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে সেই আত্মস্তব । প্রতিদিন কত কত গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে এই শান্তিবনে । তরুণ কবির উচ্চারণে, লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভেলিয়ানে জমাটি আড্ডায় ভালোবাসার কথা আর গান । মঙ্গলাচরণ । সর্বতো মঙ্গলে । এই বইমেলার অপরাহ্ণের নরম আলোয় যখন সদ্যবিবাহিত দম্পতি গলির মোড়ে পরস্পর মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে ফটোশ্যুট করেন তখন আমি তাঁদের অন্তরের ভেতরটা পড়ে ফেলি । সেখানে দেখি, তাঁরাও চান 'সমুখে শান্তির পারাবার' হোক । তাঁদের স্বপ্ন জানিয়ে দেয় যেন, আমরা চিরদিনই বলে যাব জ্ঞান, বিবেক, ও সংহতির অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত হোক সবার অন্তরে । তার সঙ্গে আরো আরো প্রার্থনা–
সর্বে ভবন্তু সুখীনঃ ।
সর্বে সন্ত নিরাময়াঃ ।।
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু ।
মা কশ্চিৎ দুঃখমাপ্নুয়াত ।।