Sunday, November 28, 2021

স্ব প্ন

স্বপ্ন 

এটিএমের কিউমুখী কবিতা
হাঁপিয়ে উঠলে হাওয়ামিঠাই
রঙচঙে ও লোভনীয় হয়ে ওঠে

যেমন ব্রেক আপ মিটমাট হলে
জলদাপাড়া কিংবা কাজিরাঙা
যেখানেই যাই ঝালাই মিস্ত্রিরা
বখশিসের হাত বাড়িয়েই রাখে ৷

Wednesday, November 24, 2021

#কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক#

কবিতার অন্তর্পর্যটনে সিদ্ধির কুহক

জীবনের দুই চেতনা । একটা বাইরের । আরেকটা ভেতরের । বহির্চেতনা আর অন্তর্চেতনা । বাইরেরর চেতনা মৌমাছির মতো আহরণ করে প্রকৃতি মকরন্দ ।আর সেই মকরন্দ জমা হয় অন্তরের মৌচাকে । রূপ নেয় মধুতে । জীবনের মধু-আর মননের মধু । বাইরের চেতনার আদিগন্তপাথার থেকে অন্তর্চেতনার মায়াঅলিন্দে । এই পরিনিমজ্জন ও পরিব্রাজন, এটাই মগ্ন চেতনার কেলিকুহেলি । মগ্ন চেতনার সহজসাধনায় প্রাণবিন্দু জেগে ওঠে । সৃষ্টি পা রাখে শিল্পের পৈঠায় । শিল্প হয়ে ওঠে প্রকৃত ও প্রাকৃত শিল্প । 

প্রতিটি সত্তা বাইরে ব্যক্তি । অন্তরে শিল্পী । কবিও অন্তর্লোকের শিল্পী । মগ্নসংসারের কারিগর ‌‌। মাটির তাল নিয়ে শিল্প গড়ে মৃৎশিল্পী ‌। এই মাটি যতক্ষণ ভূমিতে ততক্ষণ মাটি । শিল্পীর হাতে তা হয়ে ওঠে পার্থিব বস্তুর প্রতিরূপ ‌ প্রকৃতির নিপুণ সৌন্দর্যকে আহরণ করেন তিনি । আর আরোপ করেন তা নিজের সৃষ্টিতে । তাঁর মগ্নচেতনায় সৃষ্টিকে সুন্দর করার গোপন কৌশলগুলি জেগে ওঠে ।‌ শিল্পী সে কৌশল প্রয়োগ করেন তাঁর সৃষ্টিতে । বাইরের উঠোনের সৃষ্টিকে প্রাণিত করার তাগিদে অন্তরের প্রকোষ্ঠেও প্রবাহিত হয় আর এক সৃজনবাতাস । জেগে ওঠে কুলকুণ্ডলিনী, সৃষ্টিসম্ভবা ।

কবির অন্তরে বাহিরেও একই প্রক্রিয়া চলতে থাকে নিরন্তর । কবির সামনেও আছে প্রকৃতি । সে চিরন্তনী নারী । যাকে ভালোবেসে আশ মেটে না । যাকে দেখে দেখে নয়নের পিপাসা পরিসমাপ্তি হয় না । যার রূপ অরূপ, অপরূপ, সাগরপ্রতিম । সেই গহীন সাগরে ডুবে মরতে চান কবি । কিংবা চান অলীক রত্ন সন্ধান করতে । সে এক অনিঃশেষ কল্পমৈথুনে যুগনদ্ধ  হন কবি ও প্রকৃতি । জগৎ সৃষ্টির আদিকারণ নারী । আর আদিরমণী প্রকৃতি । প্রকৃতি আদ‍্যাশক্তি । প্রকৃতির শক্তিতে পুরুষ  শক্তিমান । প্রকৃতির শক্তিতে কবি হন শক্তিমান । যার নাম কবিত্বশক্তি । প্রকৃতি ভিন্না । কবি ভিন্ন । আবার কবি ও প্রকৃতি অভিন্ন অবশ্যই ।

 কবি ও প্রকৃতির পারস্পরিক শৃঙ্গারফসল কবিতা । প্রকৃতির আশ্লেষে নিষিক্ত হয় শব্দডিম্ব । কবির শুক্ররক্তের কল্পনারসের সঙ্গে শব্দের মিলনে সৃষ্টি হয় কাব্যভ্রূণ । এ এক পরাবোধিক প্রক্রিয়া । 'আলে গুরু উঅসই শিষ, / বাকপথাতীত কাহিব কিস / গুরু বোব সে শিষ কাল, / যত ভি বোলই / তত ভি টাল ।'–এর বর্ণনা বাক‍্যপথের অতীত । এর ভাষা অনুক্তপ্রয়াসী ।  এখানে এসেই মোড় নিতে হয় পথের । 'প্রভু কহে এহো বাহ‍্য, / আগে কহ আর ।'

কবি জীবনদাতা । কবি শব্দের জীবনদান করেন । শব্দের ব্যবহার হয় কবির হাতে গূঢ়ভাবে । সাংকেতিক অর্থে । কবির নিজস্ব ভুবনে শব্দ হয়ে ওঠে নবীন চিত্রভাষ্য । প্রতিটি শব্দের যে স্বাভাবিক চিত্রকল্প, চেনারূপ মানসপটে নিহিত থাকে তার মধ্যে কবির ব্যবহৃত শব্দ আনে নতুন ভাষা, নতুন রূপ,  নতুন ছলম । অর্থের দিক থেকেও এক নতুন জাদুকথার যেন সৃষ্টি হয় । কবির মননে এবং দর্শনে এক সান্দ্র ভাষাশৈলী তৈরি হয়ে যায়, যা কবির এক নিজস্ব ভাষাভূগোল । নিজস্ব ছন্দবাতায়ন । একান্ত আপন কাঁঠালিচাঁপায় সাজিয়ে তোলেন কবি । 

শব্দ যদি প্রকৃতির ভ্রূণ, কবি যা লেখেন প্রকৃতি নিয়ে লেখেন । কবির যা খেলাধুলো । শব্দকে নিয়েই সে সব । সব শব্দই যেন তার চেনা । শব্দ কে স্পর্শ করে তিনি অনুভব করতে পারেন ‌। শব্দের ঘ্রাণ তাঁকে মাদকতা দেয় । সৃষ্টির মাদকতা । শব্দের চিত্র তাঁর কল্পনাকে রৌদ্রমাখা আকাশে ওড়ার সাহস যোগায়  । শব্দের ছবি মেঘবজ্রকৃষ্টির নভোকালিমায় ভীরু বিরহী করে তোলে ।  শব্দকে কেমন ভাবে ব্যবহার করবেন সেটা কবির নিজস্ব পাকশৈলী । তাঁর মননতাঁতে কবি শব্দ সাজান টানা ও পোড়েনে । তার উপর দেন কারুজ্যামিতিক চিত্রকথা আর অলংকারের ছন্দিত কোলাজ । আর তাও শব্দেই সৃষ্ট । একটা আশ্চর্য উদ্ভাসিত ধানভূমি তৈরি করেন কবি তাঁর বয়নে । এ বয়ন চলতেই থাকে তো চলতেই থাকে । কবি থেমে থাকেন না । বুননে বয়নে ভরাট হয়ে উপছে পড়ে তাঁর সৃষ্টি ‌। তাকেই বলি কবিতা । কবিতার কোন থামা নেই । কবিতার কোন অবকাশ নেই । এক মহা প্রান্তরকে ক্রমশ ছেয়ে ফেলার জন্য তার উড়াল কিংবা ভাসান কিংবা পদযাত্রা । 

তুমুল গৃহশ্রমে মগ্ন থেকেও কবি যেন নিঃসঙ্গ কীর্তনীয়া । গেয়ে ফেরেন ভোরাই একাকী । জনপদ থেকে জনকোলাহলে । বিষন্ন সায়াহ্নে কবি শব্দের ভিখারী হয়ে ওঠেন।  হয়ে যান শব্দের কাঙাল । প্রাত্যহিকের পরিখাপ্রাচীর ডিঙিয়ে কবির অভিসার । কোন ঘেরাটোপ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না । কোন দুর্বার বেড়ি তা়ঁকে বেঁধে রাখতে পারে না । বাস্তববন্দি শিবিরে অন্তরীণ থেকে খুঁজে নেন উন্মোচিত পরিসর । 

কবির প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিটি ক্ষণের চর্যায়  তাঁকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে না পারলেও কোন ক্ষতি নেই । কবি প্রতিদিন তার শরীরভাষাকে অবগুন্ঠিত রেখে নিভৃতে চর্চা করেন কবিতাযাপনের । অনুশীলন করেন কবি হয়ে ওঠার । কবিতা নির্মাণের করণকলা অধ্যয়নের । তার যাবতীয় অধ্যাবসায় শব্দকে নিয়ে ‌‌। সামগ্রিক আয়াশ কবিতার জন্যে ।  জীবন ও সন্ন্যাস এই দুই পরস্পর বিপরীত চর্যার বিরোধাভাসকে কবি প্রয়াসঅভিঘাতে ক্রমশ চূর্ণ করে দেন ব্যবধানের দেয়াল ।  জীবনের মধ্যে থেকেও কবি সন্ন্যাসকল্প পুরুষ । এ দুয়ের রসায়নে কবি খুঁজে পেতে চান আশ্চর্য সব কাব‍্যরহস্য ।

 কবির অন্তরে এক অনন্ত দহন । 'মন পড়ে সখি জগজনে জানী । বন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী ' । কবিও পোড়েন ।কবির অন্তর পোড়ে । পুড়তে পুড়তেই কবি দেখেন জগত । কবি অনুভব করেন জীবন । মনপোড়া কবির উপলব্ধির ঘটে কাব্যিক উন্মোচন । দগ্ধচিত্তে দেখেন আদিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত আকাশ ।কবি চিনে উঠতে পারেন তাঁর চিরপরিচিত আসমুদ্র সংসারক্ষেত্রটিকে । তাঁর মাথার উপরে আকাশ শূন্য । তাঁর পরিচিত ভূমি প্রদেশ চলিষ্ণুতায় উচ্ছল । এই উচ্ছলতার যে জলধিসুনামি  তাই কবিকে তোলপাড় করে । জীবনের মুহূর্মুহূ বদলে যাওয়ার বর্ণের বিচ্ছুরণে হয় কবির অন্তরের ইন্ধন । কবি জ্বলে উঠেন বারবার । 

কবির দেহেও আছে ষটচক্র । কবির সাধনাও দেহতাত্ত্বিক । কবির শরীরেও আছে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নাড়ি । কবি তাঁর সাধনায় প্রকৃতি ও জীবনরসের মায়াভ্রমণ ঘটান তার শরীরময় । নাভিপদ্মে নিদ্রিতা কুন্ডলিনীকে জাগান তিনি কাব্যিক ইশারায় । শব্দের পর শব্দের বাণসৃষ্টিতে  তিনি কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দেন । সেখানে ঘটে প্রকৃতি ও পুরুষের অদ্বয়মিলন । কবিও জীবনের মিলিত পরমানন্দ । এ আনন্দই কাব্যের মহাভাব । এ আনন্দ ই 'মহাসুহসঙ্গ' । এটা কবির অন্তরের স্থায়ী আনন্দ । যার জন্য কবির অনন্তবাসর । যার থেকে কবির সিদ্ধি । কবির  শরীরে তখন আসে কবিতার জোয়ার । কবি তাকে প্রবহমান রাখেন তার ইচ্ছানুরূপ । এভাবেই কবি পান স্থায়ী আনন্দ ।চিরসুখ । কবির পর্যটনসার ।

Monday, November 22, 2021

আত্মকথন

#খুব ছোটোবেলার কথা ৷ আমি তখন বাল্যশিক্ষা পড়ি ৷ একদিন মা তাঁর ট্রাংক খোলার পর লক্ষ করলাম সেখানে 'মহিলা' নামে একটা বই ৷ বাল্যশিক্ষা ছাড়া যে আর কোনো বই থাকতে পারে সে বয়সে তা আমার জানা ছিলনা ৷ মূলত সেটা ছিল সেসময়ের মহিলাদের মাসিকপত্র ৷ সেটা খুলে দেখেছিলাম পরপর কয়েকটি পৃষ্ঠার ওপরে 'বেনের মেয়ে' লেখা ৷ পরে জেনেছিলাম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ( ৬ডিসেম্বর ১৮৫৩— ১৭নভেম্বর ১৯৩১)  'বেনের মেয়ে' উপন্যাসটি প্রথম মহিলা মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের অংশবিশেষ 'আশ্বিনের ঝড়' নামে আমাদের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল# ৷

Friday, November 12, 2021

সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন: নমস্কার স্যার, আপনি কেমন আছেন?
উত্তর: নমস্কার । ভালো আছি আমি ।

প্রশ্ন: বর্তমানে অবসর জীবন কিভাবে কাটছে আপনার?

উ : কই ? আমার অবসর কোথায় ? সাংসারিক দায়দায়িত্ব, নানা সামাজিক কাজকর্ম, লেখালেখি, বইপড়া, ঘোরাঘুরি ও ঘুম । এই নিয়ে চলছে বেশ ।

প্রশ্ন: আজকের দিনে সাহিত্যে অনেকটা ব্যাপ্তি আপনার।সাহিত্যে আপনার হাতেখড়ি পর্বের কথা শুনতে চাই

উ: সাহিত‍্যপাঠে ও চর্চায় আমি এখনও শৈশব কাটিয়ে উঠতে পারিনি । স্কুলে পড়াশুনার সময় থেকেই টুকটাক ছড়া কবিতা লেখালেখির মধ‍্য দিয়ে সাহিত‍্যচর্চার হাতে খড়ি । আমার সৌভাগ‍্য যে, বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে ত্রিপুরার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে গল্পকার মানিক চক্রবর্তী, দেবতোষ চৌধুরী, সদ‍্যপ্রয়াত কাশিনাথ দাশ, সুখেন্দুবিকাশ চৌধুরী,প্রাণতোষ কর্মকার, মাণিকলাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মতো শিক্ষকদের নিবিড় স্নেহসাহচর্য পেয়েছি । তাঁরাই আমার লেখালেখিতে প্রেরণা জুগিয়েছেন । কুলাই হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের ম‍্যাগাজিন আমার প্রথম লেখালেখির প্ল‍্যাটফর্ম । বিলোনিয়া কলেজজীবনে অধ‍্যাপক অরূপরতন মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সরকার ( খ‍্যাতিমান ভাষাগবেষক পবিত্র সরকারের অনুজ ) প্রমুখ এবং হরিনারায়ণ সেনগুপ্ত, হরিভূষণ পাল, ভূপাল সিনহা, অশোক দাশগুপ্ত, সুবোধ কংসবনিক ও কৃষ্ণকুসুম পালের যত্ন পেয়েছি আমি । হরিনারায়ণদা আমাকে খুব কাছে কাছে রাখতেন । সে সময়ের  তরুণ গল্পকার রুমা পাল আমার লেখালেখির নিবিড় পাঠক ও সমালোচক ছিল । কিন্তু শক্তিময়ী রুমা একসময় লেখালেখি থেকে একদমই সরে যায় । যা আমাদের সাহিত‍্যপরিমন্ডলে তথা বাংলাসাহিত‍্যের জন‍্যে এক বিরাট ক্ষতি বলে আমি আজও মনে করি । আমার বাংলায় স্নাতকোত্তর যোগ‍্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমার গ্রামের শিক্ষক চিত্তরঞ্জন মজুমদারের( কবি রূপন মজুমদারের দাদু ) প্রত‍্যক্ষ অবদান আমি কোনোদিন ভুলবনা । পরবর্তী সময়ে রাজ‍্যের পরিমন্ডলে লেখালেখিতে অগ্রজ কবিমানস পাল ও নকুল রায় জাগরণ সাহিত‍্যবাসরের ও সৈকত সাময়িকীর মাধ‍্যমে হাত ধরে তুলে এনেছেন । প্রয়াত কবি অরুণ বনিক আমার দুঃখের দিনের মরূদ‍্যান ছিলেন । আমাকে তিনি পাঠসমৃদ্ধির জন‍্যে বহু বইপত্র জুগিয়ে গিয়েছেন । আমার বইপড়ার অভ‍্যাস ছোটোবেলা থেকেই । স্কুলবেলায় পেয়েছি স্কুল লাইব্রেরির সুযোগ । সেখানে সরকারি কোয়ার্টার্সে থাকতেন চিকিৎসক দম্পতি ডা. মুকুন্দলাল বসু ও ডা. লীলা বসু । তাঁদের একমাত্র সন্তান শিবাজী বসু বয়সে একটু ছোটো হলেও খেলার সাথী ছিল । তাদের একটা পারিবারিক লাইব্রেরি ছিল । সেখানে বাছাই করা সব বই, পুজো সংখ‍্যা, বিশ্বসাহিত‍্যের অনুবাদের বিশাল সংগ্রহ ছিল । আমি নাইন টেনে পড়তেই সেগুলো শেষ করেছি । তাঁরা সেসময় নবকল্লোল, শুকতারা ও দেশ পত্রিকা রাখতেন । আমার বাবা রাখতেন জাগরণ ও অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার । তারপর কলেজ লাইব্রেরি, বিলোনিয়া ও সাব্রুমের পাবলিক লাইব্রেরির সুযোগ তো পেয়েছিই । আর অনবরত উৎসাহ জুগিয়েছেন রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দিব‍্যেন্দু নাগ ও দিলীপ দাস । প্রবন্ধচর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিয়ে হাতে কলমে শিখিয়েছেন শ্রদ্ধেয় ভূপেন দত্তভৌমিক ও মৃণালকান্তি কর । লোকসংস্কৃতির পাঠ নিয়েছি ড. রঞ্জিত দে ও ড. ননীগোপাল চক্রবর্তীর কাছে ।

প্রশ্ন: এ যাবৎ আপনার ক'টি বই প্রকাশিত হয়েছে?
উ: পাঁচটি । বিনীত চুম্বন ( কাব‍্যগ্রন্থ ), ভার্চুয়াল রাই ( কাব‍্যগ্রন্থ ), ত্রিপুরার লোকজীবন ও সংস্কৃতি ( প্রবন্ধ ), লোকসংস্কৃতির তত্বরূপ ও স্বরূপসন্ধান ( প্রবন্ধ ), মগ জনজাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি (সম্পাদিত প্রবন্ধ ) ।

প্রশ্ন: সাহিত্যের কোন শাখায় অধিক যাপন আপনার এবং কেন?

উ: কবিতা এবং কবিতাবিষয়ক গদ‍্যরচনা । কারণ কবিতাই আমার প্রথম প্রেম । কবিতায় আমি স্বাচ্ছন্দ‍্য বোধ করি । জগৎ জীবন প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্বন্ধে আমার অনুভব, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, হতাশা, সংক্ষোভ, শ্লেষ, প্রতিবাদকে আমি কবিতার মাধ‍্যমেই প্রকাশ করতে অভ‍্যস্ত । আমার আত্মপর্যবেক্ষণের শব্দরূপও কবিতা ।

প্রশ্ন: লোকসংস্কৃতি গবেষণায় সুদীর্ঘ ব্যাপ্তি আপনার। ঠিক কিসের নেশায় এটাকে নিয়ে এতো চর্চা?

উ: ব‍্যাপ্তি শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে । ব‍্যাপ্তি শব্দের অর্থ বিশালতা । যা আমার আদৌ নেই । আমার শুধু তৃষ্ণা আছে । অপার তৃষা । তৃষ্ণা মেটানোর জন‍্যেই আমি  আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের উৎসজলসত্র  খুঁজে ফিরি । লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির সমূহ আত্মবীজ । সেখান থেকেই ছড়ায় তাবৎ সংস্কৃতির শাখা-প্রশাখা । যে জাতির লোকসংস্কৃতি যত সমৃদ্ধ সে জাতি সামগ্রিকভাবে তত সমৃদ্ধ । হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি একটা জাতির সংস্কৃতির শেকড় সন্ধান । সমাজেতিহাস সন্ধান । এই অনুসন্ধানও এক তীব্র নেশা । খুঁজতে খুঁজতে কত গভীরে চলে যাওয়া যায় । অরূপরতনের ভান্ডারে প্রবেশ করা যায় । একটা জাতির দর্শনকে উপলব্ধি করা যায় । সেই জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হয় জাতির গৌরবমন্ডিত অতীত । ইতিহাসেরও উপাদান । নেশাটা আমার ঠিক এখানেই । অতীতসমুদ্রে ডুবে থাকা মূল‍্যবান সাংস্কৃতিক বৈদুর্যমণি তুলে আনার ডুবুরির ভূমিকায় নবিশ আমি । 'ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন' । এ নেশাই আমার জন্মতিলক ।

প্রশ্ন: সাহিত্যের এ সুদীর্ঘ যাপনে যদি আপনার কোনো অভিমান, অভিযোগ,ক্ষোভ বা বিরক্তির কথা জানতে চাই, জানতে পারি কী?

উ: জীবনপথ তো কুসুমাস্তীর্ণ নয় । পায়ে ফোস্কা পড়বে বলে কী পথ চলবনা ? ' ভালোমন্দ সুখদুঃখ অন্ধকার আলো / এই নিয়ে ধরনির সবকিছু ভালো ।' নইলে সবই মিছে । কাজেই এসব মনে রেখে লাভ নেই । যেখানে মনান্তর ঘটে, বা মনে ব‍্যথা পাই, সংঘাতে যাইনা । নিরবে সরে আসি । আমার নিজস্ব অপূর্ণতা মনে করে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করি । আমার প্রাপ্ত অভিমান, অনুভবগুলো মনে গভীরে থেকে সৃষ্টির প্রেরণাদায়ক । নিজের কাছে নিজে কতটা সৎ , দিনান্তে চোখ বন্ধ করে সেটা ভাবি সর্বদা ।

প্রশ্ন : কখনো কখনো দেখা যায় একটা অদৃশ্য শক্তির ভয়ে থমকে যায় কলম-- বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?

উ: হ‍্যাঁ ,এরকমটা তো দেখা যায়ই । এটা সবটাই মননের ম‍্যাচুরিটির বিষয় । চেতনার উৎকর্ষতার স্তরানুযায়ী ফল ।সমৃদ্ধচেতনা ব‍্যক্তিকে অকুতোভয় করে । জীবন ধরা দেয় স্বচ্ছ কাঁচের মতো । ব‍্যক্তিকেন্দ্রিক বাসনা অতিক্রম করতে না পারলে নিজের চৌকাঠ থেকে বেরুনো যায়না । চেতনাদীপ্ত প্রাণ কোনো পরাশক্তিকে ভয় পায়না । ঊণচেতন দোলাচলে ভোগে । ভোগে সিদ্ধান্তহীনতায় । তার কলম সুযোগসন্ধানী । কর্তার ইচ্ছেতে যে কীর্তন করে তার কালির তলানিতে থাকে সেডিমেন্ট । শক্তিমান কর্তার বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কলম থিতু হয়ে যায় । সুদিনে যে কলমবাজ সুযোগের সন্ধানে মিছিলের অগ্রভাগে ব‍্যানারবাহক হয় সেই দুঃসময়ে সটকে পড়ে এবং নবব‍্যানারের লুব্ধবাহক হয় । তারই থাকে অদৃশ্যশক্তির রক্তচক্ষুর ভয় । প্রকৃত কলমশিল্পীর অদৃশ‍্যশক্তির ভয় নেই । কলমও থমকায়না তাঁর ।   তিনি চেনেন অশুভশক্তিকে । তাঁর স্পষ্ট ও দৃঢ় কলমকারি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে । দুঃখেও । দ্রোহেও । ফলে প্রিয়জনেরও তিনি বিরাগভাজন হন । যেখান থেকে তিনি সম্মান স্বীকৃতি পাওয়ার কথা সেখানেই তিনি বঞ্চিত হন । সুযোগসন্ধানী এবং স্তাবক  সুবোধরূপী গোপাল ননীভান্ড হাতিয়ে নেন । কিন্তু প্রকৃত শিল্পীর কলম থামেনা । আঁচড়ে আঁচড়ে সমাজের ক্ষত , অশুভশক্তির মুখোশ উন্মোচন করেন তিনি ।

প্রশ্ন: রাজ্যের দক্ষিণ জেলার বাসিন্দা আপনি। দক্ষিণ জেলার অধিকাংশ মানুষ নোয়াখালি ভাষায় কথা বলে। এ ভাষায় সাহিত্য বা সৃষ্টিকর্মের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার মতামত কী?

উ: কথায় বলে নোয়াখালির লোক নাকি আফ্রিকার অরণ‍্যেও নাকি পাওয়া যায় । নোয়াখালি ভাষা আমাদের পূর্বপুরুষের ভাষা । আমাদের অন্তর্গত অর্জন । পরিচয়ের ঠিকুজি । তার বিশাল লোকসাংস্কৃতিক ভান্ডারও রয়েছে । ভুল উচ্চারণে মান‍্য বাংলা বলা বা বাচ্চাদের শেখানোর অপপ্রয়াস করার চাইতে ব্রাত‍্য আঞ্চলিক ও পূর্বপুরুষের ভাষা নোয়াখাইল্লা উচ্চারণ অনেক ভালো । নোয়াখালি ভাষাতেও যে বৈচিত্র‍্য আছে সেটা জানতে হবে । জানতে হবে বৃহত্তর নোয়াখালির ইতিহাস । কুমিল্লাসীমান্ত সন্নিহিত লাকসম, চোদ্দগ্রাম, চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ, ভোলা, নোয়াখালি, মূল ভূখন্ড, নোয়াখালির সন্দীপ, চরবদু ইত‍্যাদি চরাঞ্চল, চট্টগ্রাম সীমান্তসংলগ্ন মীরসরাই, সীতাকুন্ড,ফেনীনদীর তীরবর্তী শুভপুর, মুহুরীগঞ্জ, খন্ডল পরগণা, লক্ষ্মীপুর, কোম্পানীগঞ্জ ইত‍্যাদি নোয়াখালি ভাষাভাষী অঞ্চলের উচ্চারণে কিছু কিছু ফারাক রয়েছে । উচ্চারণ শুনে বুঝতে হবে বক্তা কোন অংশের বাসিন্দা । আমাদের রাজ‍্যেও অবিভক্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বিরাট অংশে নোয়াখালি ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত । রাজ‍্যের অন‍্যত্র ও কম বেশি এই ভাষাভাষী মানুষ বাস করেন । এই জনবিন‍্যসটা স্পষ্ট জানা থাকা দরকার । এটা আয়াসসাধ‍্য ব‍্যাপার ।  সাহিত‍্যসৃষ্টিতে এই জ্ঞান অতি অপরিহার্য । অন‍্যথায় তর্ক চলতে থাকবে কে ঠিকঠাক নোয়াখালি ভাষাব‍্যবহার করছেন তা নিয়ে । বাংলাদেশে এই ভাষা নিয়ে কাজ হচ্ছে ভালোই । নোয়াখালি ভাষায় নাটক রচিত হচ্ছে । সংবাদ চ‍্যানেল কাজ করছে । সোস‍্যাল মিডিয়া, ইউ টিউবে চর্চা হচ্ছে । অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এই ভাষাব‍্যবহারে আগ্রহী ।
আমাদের রাজ‍্যেও নোয়াখালি ভাষায় কিছু কিছু সাহিত‍্যসৃষ্টি বিচ্ছিন্নভাবে হয়ে আসছে । এই চর্চা আরও নিবিড়ভাবে হওয়া দরকার । বিশেষ করে কথাসাহিত‍্যে এই ভাষাটি ব‍্যবহার করে দক্ষিণ ত্রিপুরার জীবনচিত্রের বাস্তব রূপ দেওয়া যায় । শুধু ভাষা নয় । নোয়াখালিভাষীদের বিভিন্ন সংস্কৃতি ও যাপনচিত্রও স্থান পেতে পারে সাহিত‍্যে । ফলে এই জেলার সাহিত‍্যের একটা নিজস্ব আইডেনটিটি তৈরি হবে । যা পক্ষান্তরে বাংলা আঞ্চলিক সাহিত‍্যকেই সমৃদ্ধ করবে । 

প্রশ্ন: ত্রিপুরার তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য আপনার বিশেষ পরামর্শ কী হবে ?

উ: ত্রিপুরার তরুণ কবি সাহিত‍্যিকরা প্রচুর লিখছেন এখন । ভার্চুয়ার দুনিয়ার সুবাদে তাঁরাও আজ বিশ্বপথিক । কাজেই সৃষ্টির মানের উত্তরোত্তর উন্নতি না ঘটালে টিঁকে থাকা যাবেনা । তার জন‍্যে লেগে থাকতে হবে । প্রচুর পড়াশুনা করতে হবে । প্রশংসার চোটে আত্মম্ভরী হলেই বিপদ । সাপলুডোতে অনেক উপরে উঠেও সাপের মাথায় পড়লে যা হয় তা পড়তে হবে । অন‍্যের লেখা পড়তে হবে মনযোগ দিয়ে । নিজের লেখার নিজেই সমালোচক হতে হবে । তাতেই আসবে সিদ্ধি ।

Tuesday, November 9, 2021

দা মি নী

দামিনী

আহা, ভেসে ওঠে অন্তহীন দীপালিকার সারি
তাহাদের কবোষ্ণ আহ্লাদ বিসর্পিল আন্দোলন
হিমেল বায়ুপ্রবাহ নৃত্যের সমিধ সাজিয়ে দিয়ে যায়
অচেনা নর্তকীর সমবেত শরীরী হিল্লোলে যে আবাহন থাকে
তাতে শুধু চোখের স্নান
শরীরের ঘন নির্যাস নেবার বশীকরণের টানে 
ছুটে গেলে, ছুঁতে গেলে এই শৈল্পিক অগ্নিরেখার 
কোমল হিন্দোল স্তব্ধ হিমরাতেও দাবানল হয়ে ওঠে
খান্ডবগ্রাসে খাক করে দেবে  নষ্ট ও কামুক শরীর 

বাহিরে ছন্দহীন শিশিরের অবিরাম পতনের মূর্ছনায়
দামিনীরা জেগে থাকে বুকে আগুনের আবলি নিয়ে

এক আসন্ন ক্রুদ্ধ রাতে তো জেগে উঠবে সমুহ সাহস নিয়ে

আঁধারবিনাশিনী হে

আঁধারবিনাশিনী হে

আজ সন্ধ্যেটা তোমার জন্যেই রেখে দেবো, রাই  !
সূর্যাস্তের পেরিয়ে যাওয়া পশ্চিমম সরোবর থেকে
লোককাব্যের ঘরোয়া বউটি সেজে তুমি যখন
চাটাবাতি হাতে উঠোনের এমাথা থেকে সেমাথা
দ্রুত হাত চালিয়ে যাবে এক একটি তেলসিক্ত
সলতের প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্যে,চক্ষুদানের জন্যে৷
আমি বুক ভরে দেখবো তোমার দীপদানের উচ্ছ্বাস

হাতের প্রদীপের মৃদু আলোয় তোমার আরক্ত মুখ
হাওয়ার ঝাপটায় বুক কাঁপা বাতিটা আলোছায়ার
সিল্যুএট তৈরি করবে তোমার মসৃণ মুখমন্ডলে
আধফোটা তোমার চোখের পাতা, তোমার নাকের
তিলফুল, কপালের ওপর দু একটা দলছুট চুল
কানের দু পাশে ঝুলে পড়া উজ্জ্বল ঝুমকো দুল
মৃত্যুঞ্জয়ী সিঁদুরে ঠোঁটের রঙে নেয়ে উঠে পবিত্র
প্রশান্তিতে বিরল বার্তা বইবে সুখময় গার্হস্থ্য দিনের

আলো জ্বালাতে জ্বালাতে তোমার যে চলনমূর্ছনা
তোমার যে প্রাঙ্গনপরিক্রমা, তা ওই কৃষ্ণকায়া নগ্নিকা
শবারোহীনীর লুকানো বীররসের ছটার মতো ছিটকে
উঠবে আজ এই মায়াসন্ধ্যার আঁধারবিনাশী বন্যায়
আমি সেই বানডাকা জোয়ারে ডুবে যেতে চাই আজ

তোমার ঘোমটার লালপাড়ে ডুবে যাওয়া আবছা মুখে
কোনো বরাভয় মুদ্রা কী লুকিয়ে রেখেছো, সহেলি রাই  !
আমি তাও দেখবো এ সন্ধ্যায় তুমুল তোলপাড় করে হে

সা ক্ষা ৎ কা র

লোক গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধনের মুখোমুখি সম্পাদক বিজন বোস 
--------------------------------

প্রশ্ন 
------- ১ ) আপনার জন্ম কী সাব্রুমেই ? উত্তর যদি না হয়ে থাকে তবে কখন এলেন?  সাব্রুমের আদি ইতিহাস সম্পর্কে যদি কিছু বলেন ...
  উ:--না । বাবার চাকুরিসুত্রে আমরা দীর্ঘদিন সাব্রুমের বাইরে কাটিয়েছি । মাঝে মধ‍্যে গ্রামের বাড়িতে আসতাম বাবার সঙ্গে । একাত্তরের যুদ্ধের সময় কিছুদিন এবং বাবার ছোটোখিল সরকারি ডিসপেনসারিতে বদলির কারণে বাহাত্তর সাল থেকে পাকাপাকিভাবে আছি । সাবরুম এর ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে রাজন্য ত্রিপুরার ইতিহাসের দিকে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২ খ্রি.– ১৮৯৬ খ্রি. ) পুত্র রাধা কিশোর মানিক্য (১৮৯৬ খ্রি.–১৯০৯ খ্রি. ) প্রায় 40 বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করেন যুবরাজ থাকাকালীন সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন পরিচালনার বিষয়ে তার দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন । রাধা কিশোর মানিক্য হাজার ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের পুলিশ ও তহশীল বিভাগকে আলাদা করেন পুলিশ বিভাগকে তহশীল ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় পুলিশ বিভাগকে পৃথক করার পর ত্রিপুরা রাজ্যে অনেকগুলি নতুন নতুন থানা ও তহশীল কাছারি গড়ে তোলা হয় সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যে প্রথম পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন সেই সময়ে সাবরুম থানা ও তহশীল কাছারি স্থাপন করা হয় বর্তমানে যেখানে থানার দালানটি রয়েছে তার বেশ কিছুটা দক্ষিনে সামনের দিকে দরজা স্থানীয় পর্যায়ের বেড়া দেওয়া চৌচালা বড় ঘর ছিল পাশে বড়বাবু থাকতেন । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২মার্চ ( ২৮ শে ফাল্গুন ১৩১৮ খ্রি. ) উত্তর ভারত তীর্থ ভ্রমণের সময় কাশী থেকে সারনাথ যাওয়ার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর কাশীরাজের বাড়ি নন্দেশ্বর কুঠিতে রাধা কিশোর মানিক্য শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । রাধাকিশোরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন হাজার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মহাসমারোহে বীরেন্দ্র কৃষ্ণের রাজ্যভিষেক হয় পরের বছর অর্থাৎ ১৯১০ সালে মার্চ মাসে সাব্রুম বিভাগ খোলা হয় । এর আগে এই বিভাগের কাজকর্ম উদয়পুর ওপরে বিলোনিয়া থেকে পরিচালিত হতো । ১৯১০ সালে সাবরুম বিভাগ খোলা হলেও যথেষ্ট পরিকাঠামোর অভাব ১৯৩০ সাল পর্যন্ত বিলোনিয়া থেকে সাব্রুম এর প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানো হতো । বিলোনিয়ার হাকিমই এই বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন । মাঝেমধ্যে বিভাগ পরিদর্শনে আসতেন । প্রথমদিকে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ঠাকুর বংশের বিশিষ্ট প্রশাসনিক ব্যক্তিরা সাব্রুম এর দায়িত্ব পালন করতেন । মহকুমা শাসককে সেকালে হাকিম বলা হত । এই থানার একটু দক্ষিণে অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় সেখানেই ছিল মহকুমা শাসকের কার্যালয় । আর একটু এগোলে পূর্বদিকে বর্তমান এসপি অফিসের পাশেই ছিল জেলখানা । চল্লিশের দশকের পর থেকে ক্রমান্বয়ে সাব্রুমে স্থায়ী হাকিম বা এসডিওরা আসতে থাকেন ।
২) বছর পঞ্চাশেক আগেও ছোটখিলের রাণীরবাজার ছিল সাব্রুমের প্রধান বাজার । এই সম্পর্কে এবং সাব্রুমের অনান্য বড় বাজারগুলির ব্যবসা বাণিজ্য তথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সাব্রুমের ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে চাই...
উ: -- বছর পঞ্চাশ নয় । তারও বহু আগে রাজন‍্য আমল থেকে শুরু করে বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক পর্যন্ত জমজমাট ব‍্যবসাকেন্দ্র ছিল ছোটোখিলের রানিগঞ্জ বাজার । মূলত রাজন্য আমলে রানিগঞ্জ বাজার সন্নিহিত বাগানবাড়িতে রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজপুরুষেরা আসতেন । সেই থেকে রানিরবাজার একটা জমজমাট গঞ্জে পরিণত হয় । রাজারা আখাউড়া থেকে রেলযোগে মুহুরীগঞ্জ এসে তারপর নৌপথে ফেনী নদীর উজান বেয়ে এই রানিগঞ্জ বাজার ঘাটে এসে নামতেন । একসময় এ বাজারে বাঙালি ও অবাঙালি মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের দোকানপাট ছিল । তেলের ঘানি ছিল । বড়ো বড়ো কাপড়ের দোকান ছিল । দামি মশলাপাতি সহ বড়ো বড়ো বাজেমালের দোকানও ছিল । সে সময়ে বিলোনিয়ার মাইছরা বিমান ঘাঁটি থেকে ঘোড়ার পিঠে করে পণ‍্য আনা হত এই রানিগঞ্জ বাজারে । ভারত ভুক্তির পর সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে এ বাজারটি । অবশ্য সবটাই ছিল কালোবাজারি ব্যবস্থা । এসময় ব্যবসা করে এই বাজারের অনেক ব্যবসায়ী যেমন ফুলে-ফেঁপে উঠেন তেমনি একেবারে কপর্দকশূন্য হয়ে যান অনেক ব্যবসায়ী । ষাটের দশকের শুরুতে এক বিধংসী অগ্নিকাণ্ডে এই বাজার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায় । এছাড়া সে সময়ে রানিগঞ্জ বাজারে ছিল এক বিশাল গোরুর হাট । পরবর্তী সময়ে সীমান্ত সংলগ্ন বাজার হওয়ার ফলে এখান থেকে বিক্রীত গরু ওপারে পাচার হয়ে যেত । ফলে স্থানীয়ভাবে  গোসম্পদের ঘাটতি দেখা দেয় । এদিকে গোরু চুরিও বেড়ে যায় খুব । তখন সরকার আইন করে রানিগঞ্জ বাজারের গোহাটটি বন্ধ করে দেন । মূলত অগ্নিকাণ্ড, গরুর বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কালোবাজারে এপার-ওপার পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার উপর সরকারি নজরদারি বেড়ে যাওয়ার ফলে রানীগঞ্জ বাজারের রমরমা ধীরে ধীরে পড়তির মুখে এসে যায় । ফলে অনেক বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী সাবরুম বাজারে এসে তাদের ব্যবসা শুরু করেন । মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা আগরতলা চলে যান ।

৩)  আপনার স্কুল জীবন সম্পর্কে  ...( এটার উত্তর দিতে গিয়ে যদি সাব্রুম না আসে তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও হবে )
উ:--আমার স্কুলস্তরের পড়াশুনো সাব্রুমে নয় । তবে বিশেষ অনুমতি নিয়ে উনিশ শো বাহাত্তর সালে পুজোর ছুটির পর কদিন সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে স্কুলজীবনের শেষসময়টা অলিখিতভাবে ক্লাশ করেছি । এবং সেন্টার চেঞ্জ করে কমলপুর থেকে সাব্রুম সেন্টারে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসেছি ।

৪) মানুষের জীবনে শিল্প সংস্কৃতি এক বড় অবদান রাখে ।  সাব্রুম মহকুমার সংস্কৃতি চর্চায় ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা সেকাল থেকে একাল -- কিছু বলুন 
উ:-- সাব্রুমের বৈশাখী মেলার একটা পুরোনো ঐতিহ‍্য রয়েছে । স্বাধীনতার পূর্বে সাবরুম শহরের মানুষজন ফেনী নদী পেরিয়ে ওপারের রামগড় বাজারে বাজার হাট করতেন । সে সময় ওই অঞ্চলে ছিল ব্রিটিশ সরকারের অধীন । স্বাধীনতা লাভের শুরুতে ত্রিপুরা রাজন‍্যশাসিত স্বাধীন রাজ্য ছিল । সাব্রুম সন্নিহিত ফেনী নদীর ওপারে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় । ফলে ওপারের রামগড়ে পাকিস্তানের শাসকেরা কড়াকড়ি শুরু করে দেন । ফলে এপারের মানুষজন ওপারে ততটা যাওয়া-আসা করতে পারতেন না । সেখানকার নাগরিকরাও এপারের মানুষ জনকে অনুরোধ করেন যাতে তারা আর ওপারে না আসেন কারণ পাকিস্তানী পুলিশ মিলিটারির দ্বার তাঁরা নাজেহাল ও অপমানিত হলে স্থানীয় মানুষজন তাদের সাহায্য করতে পারবেন না । এরপর থেকেই রামগড়ের সঙ্গে সাবরুম এর যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । স্থানীয় মানুষও সাব্রুমে বাজার প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করেন । ১৯৪৮ সালের ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ভুক্ত হয় এবং প্রায় সেই সমযয়েই সাবরুম বাজার প্রতিষ্ঠিত হয় । তারপরেই সাব্রুম এর প্রবীণ নাগরিক গণ সাবরুম বৈশাখী মেলার আয়োজন করেন । প্রথমে বৈশাখ মাসে বুদ্ধপূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হত । ঊনিশ শো পঞ্চাশ সাল থেকে এই মেলায় সব অংশের জনগণ সামিল হন । সেসময়ে পুরো বৈশাখমাসব‍্যাপী এই মেলা হত । এবং এই সময়ে শনি-মঙ্গলবারের নির্ধারিত বাজারটিও বর্তমান মেলারমাঠে বসত।

৫) সাব্রুম মহকুমা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা । সেখানকার রাষ্ট্রীয় জীবনের সুঃখ দুঃখ ত্রিপুরাবাসীকে আন্দোলিত করে । বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের অবদান সম্পর্কে কিছু বলুন 
উ:-- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাব্রুমের এক বিশেষ অবদান রয়েছে । প্রথমত উল্লেখ্য যে মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল সাব্রুম সন্নিহিত হরিনাতে ।এই এক নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী জেলার অংশবিশেষ অর্থাৎ মুহুরী নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত । ২৫ শে মার্চের পর প্রথম দিকে রামগড়ে মুক্তিবাহিনী তাদের ঘাঁটি গেড়ে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শানাতে আরম্ভ করে । রামগড় স্কুলের মাঠে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং হত । তারপর ২মে পাকবাহিনী প্রথম রামগড়ে হানা দেয় এবং তারা রামগড় তাদের দখলে নিয়ে নেয় । এরপরই মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রধান কার্যালয় সাব্রুমের হরিনাতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়ে অপারেশন চালানো হয় । এরপর থেকেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজারে শরণার্থী সাব্রুমে আশ্রয় গ্রহণ করে । পঁচিশে মার্চ রাতে ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর রামগড় বাগান বাজারের সেকান্তর মিয়া ওপার থেকে এম আর সিদ্দিকী জহুর আহমেদ ডক্টর নুরুল হাসান সহ আরো দুজন কে সঙ্গে নিয়ে রামগড় বাজার ঘাট দিয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাব্রুম এর সে সময়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ রায় চৌধুরী ও কালিপদ ব্যানার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেন । পরে তারা বিষয়টি শচীন্দ্রলাল সিংহকে জানালে তিনি দিল্লীতে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন । সেই অনুযায়ী তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারতের পক্ষে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যবল দিয়ে সাহায্য করার বার্তা দেওয়া হয় । রামগড় ও সাব্রুমের মাঝখানে ফেনী নদীর উপর সে সময়ে একটা বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দেওয়া হয় । সেই সাঁকো দিয়ে এপারর থেকে যুদ্ধের গাড়ি, সৈন্য এবং  মুক্তিবাহিনী সে দেশে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো হত । মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের প্রথমদিকে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান । তারপর পুরোপুরি দায়িত্বে আসেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরোত্তম । এই এক নম্বর সেক্টরটি আবার পাঁচটি সাব-সেক্টরে   ছিল । ঋষ‍্যমুখ সেক্টর, শ্রীনগর সেক্টর, মনুঘাট সেক্টর, তবলছড়ি সেক্টর এবং দেমাগ্রী সেক্টর। একনম্বর সেক্টর থেকে করেরহাট অপারেশন, করিমাটিলা সংঘর্ষ, বড়তাকিয়া ও মিরসরাই অপারেশন, পাতাকোট অ্যাম্বুশ, বাগান বাজার রেইড ও আমলীঘাট যুদ্ধ ইত্যাদি সংঘটিত হয় । এক নম্বর সেক্টর থেকে যুদ্ধে অংশ নেয় প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা । যেখানে ইপিআর, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রায় ২০০০ সৈন্য ছাড়াও প্রায় ৮ হাজারের মতো মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছেন । এই বাহিনীর গেরিলাদের অধীনে গ্রুপ নাম্বার ৯১ ৯২ ৯৩  ৯৪ এবং ৯৫ কে সংযুক্ত করা হয়েছিল । এক নম্বর সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়েছিল এই দল গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন রঞ্জন ত্রিপুরা । ৭ ডিসেম্বর নয়টা পঁচিশ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ের উপর বোমাবর্ষণ করে এরপর 8৮ডিসেম্বর ৯:৫০ এ পুনরায় দুটি বিমান পাক ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে । ৮ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে পাকবাহিনী রামগড় ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনীর ও মুক্তিপ্রাপ্ত জনগণ সেদিন রামগড়ে বাংলাদেশ পতাকা উড়িয়ে দেন । ৮ ডিসেম্বর রামগড়ে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় সে সময় সেসময় ভারতের পক্ষে তদানীন্তন ব্লক কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী উদয়পুরের তরুণ সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য উপস্থিত ছিলেন। তারপর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ বিজয় লাভ করে ।

৬) খেলাধুলা ও শরীরচর্চা  রাষ্ট্র গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ।  খেলাধূলায়   রাজ্যের সঙ্গে সাব্রুমের  তুল্যমূল্য আলোচনা শুনতে চাই 
উ:-- সাব্রুম খেলাধূলায়ও বিশেষ স্থান দখল করে আছে । অ্যাথলেটিকস, ফুটবল কাবাডি, খো খো, সাঁতার, ব‍্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ভলিবল এবং ক্রিকেটে বহু জাতীয় স্তরের কৃতী খেলোয়াড় বেরিয়েছে সাব্রুম থেকে ।
৭)  সাহিত‍্যচর্চায় সাব্রুম কতটা এগিয়ে আসতে পেরেছে বলে আপনার মনে হয় ।  উ:--সাহিত‍্যক্ষেত্রে সাব্রুমের উপস্থিতি বেশ প্রাচীন । ছয়ের দশক থেকে এখানে লাখালেখি করে আসছেন কৃষ্ণধন নাথ, ড.রঞ্জিত দে প্রমুখ । তাঁদের পরপরই আসেন ড. ননীগোপাল চক্রবর্তী, হরিহর দেবনাথ, প্রণব মজুমদার, নেপাল সেন, দীপক ( স্বপন ) দাস, প্রবীর বসাক ,অশোকানন্দ রায়বর্ধন । ধীরে ধীরে নতুনরা আসতে শুরু করেন । তাঁদের মধ‍্যে সমরেন্দ্রনাথ দাস, রতন চক্রবর্তী, বিনয় শীল, ব্রজেন্দ্র বিশ্বাস, সাচীরাম মানিক, সঞ্জীব দে, বিজন বোস, জয় দেবনাথ, রূপন মজুমদার, অভিজিৎ দে, চয়ন ধর, সংগীতা শীল, পূর্ণিমা বৈদ‍্য প্রমুখরা । নতুনদের অনেকেই ইতোমধ‍্যে বৃহত্তর পাঠকমহলের নজর কাড়তে পেরেছেন । প্রবীনদের অনেকেই রাজ‍্য ও রাজ‍্যের বাইরে সুপরিচিত ।

প্র তী ক্ষা

প্রতীক্ষা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

কোমল আকাশ ভরে যায় ভাটের বন্দনাগানে ।
নির্জন চিলেকোঠা জেগে ওঠে নিঃসাড় ঘুম ভেঙে
তোমার পুজোর ফুলদূর্বা পবিত্র সাজিতে রেখে যাই
আমি ব‍্যস্ত দিনের উদ‍্যমঘোরে ভুলিনা তোমার কথা
কিন্তু ডেকে নেবার মতো সময় বের করতে পারিনা ।
গড়িয়ে পড়া কাজের সারি আমার চারধারে
ইটের বৃত্ত তৈরি করে ।
তুমি সবটাই দেখো সেই চিলেকোঠায় বসে
ঘুলঘুলি পেরিয়ে এক চিলতে হাওয়া তোমাকে সঙ্গ দেয় ।
তুমি দেখো আমার দৈনিক ঘানিটানা জীবন 
আমার আকাশের মেঘ বৃষ্টি রোদ্দুর তোমার জানা আছে

আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকি পাপে কিংবা পদ্মে
ঘোরলাগা দিনরাত শুধু জড়িয়ে থাকা স্থাবরে জঙ্গমে
ভুলে যাই তোমাকে কথা দিয়ে প্রতীক্ষায় রেখেছি ।
তুমি তো সহনশীল ওংকার । তাই আমার প্রতীক্ষায় 
বসে আছো অনন্তের মাঠে ।

প্ল‍্যা ট ফ র্ম

প্ল‍্যাটফর্ম

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ট্রেন চলে গেলে শূন‍্য প্ল‍্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকি একা ।
দুধারে রাবার বন । মাঝখানে মরানদীর মতো 
লুঙ্গার দীর্ঘ শরীর নিয়ে ঘুমন্ত রেললাইন ।
একপাশে সারাটা স্টেশনচত্বর দাঁড়িয়ে পাহারায় আছে ।
মাঝে মাঝে জেগে ওঠে রেললাইন হুইসেলের শব্দে
তার বুকের ওপর দিয়ে গড়ায় ধাতব অজগর ।
পাশের শহরে এখন এটাই আধুনিকতা ।  কিছুক্ষণের জন‍্যে চঞ্চল জীবন ।
তারপর আবার উত্তরের বাতাস দাপট শুরু করে

শীত এলেই রাবারের পাতাগুলো হারিয়ে যায় অনন্তে
কতোকালের ঘরদোর, খুনসুটি সংসার আর
ধীরে বড়ো হওয়া সন্তান নতুন স্বপ্নে উড়ে  যায় ।
শেকড় তাদের টানেনা । নতুন নিবাস কিংবা বাসা বাঁধে 
আকাশের কাছাকাছি । আরো উপরের কোঠায় ।

পরিচিত নিসর্গের বিন‍্যাস নেই আর আগের মতো ।
তাই সব সন্তানেরা দুধভাত ফেলে কর্পোরেট দানাপানির
খোঁজে পাড়ি দেয় সেইসব ধাতব পাতের পথে ।
চলে যাওয়া ট্রেনের গার্ডের হাতের সবুজ পতাকা
হাওয়ায় ওড়ে আর এক দীর্ঘ স্বপ্ন বদল হয় নতুন উড়ানে ।
ট্রেন চলে গেলে শূন‍্য প্ল‍্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকি একা ।

ঝ ড়

ঝড়

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

যে হাওয়া বয়ে যায় তোমার শরীর বেয়ে
তা যেন ঝড় হয়ে যায় । সেই দামাল সময়কালে 
আমি বেরিয়ে পড়ব বাইরের দুনিয়ায় ।
চাইছি একটা ঝড় উঠুক । সব উপড়ে ফেলার ঝড় ।

সব কিছু ভেঙে পড়ছে । আশা ও স্বপ্ন সরে যাচ্ছে
দূরের কোনো দ্বীপে । এখানে ভাঙচুর হয়ে পড়ে আছে
পাখির ডানা, নীড় । প্রভাতের সূর্যের রাজমহল 
ঘিরে কালো সেপাই । রাঙা আলো ঢেকে
 যায় আকস্মিক দৌরাত্ম‍্যে । তাই অসহায় আমি 
চাইছি প্রবল একটা ঝড় উঠুক ।  সেই ঝোড়ো তান্ডবে
তোমরা বেরিয়ে পড়বে সব বাধা ঠেলে ।

আমদের মিলিত হাত ধরাধরি আর
 সমবেত কোরাস তীব্র গর্জনে বেরিয়ে পড়বে
উত্তাল হাওয়ায় । ঝড়, ঝড়ই তো বয়ে আনবে
আসন্ন শান্তির সংকেত । চলো বেরিয়ে পড়ি ।
ঝড়ের বন্দনাগানই হোক আমাদের আগামী সংকেত ।

Saturday, November 6, 2021

সৌমিত বসু ও পৌলমী সরকারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ওয়েবজিন 'জলপাইদ্বীপের আলো'-র চাঁদ বিষয়ক দ্বিতীয় সংখ‍্যা গত ৬.১১.২০২১ সন্ধ‍্যা ৭-০০টায় ভার্চুয়ালি আমি উদ্বোধন ঘোষণা করি । এ সংখ‍্যায় আমার একটি মুক্তগদ‍্য 'চাঁদমঙ্গল' স্থান পেয়েছে । রচনাটি নিচে দেওয়া হল :–

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

Friday, November 5, 2021

ই রে জা র

এভাবেই মুছে যাই, মুছে যেতে হয়
যারা ভালোবাসে আর কাছে টেনে নেয়
তাদেরই কেউ কেউ মুছে ফেলে আমাকে 
আর অন্য যারা ভাসমান দোনামনায় আছে
তারাও অবসরবিনোদনের কালে পাঁজিপুথি দেখে
খুঁজছে মাহেন্দ্র কিংবা অমৃতযোগ
কখন ছেঁটে ফেলা যায় আমাকে

এইসব মোছামুছি আর ঘষাঘষির ফলে
আমার শরীরে এখন চুম্বনচিহ্নের মতো
শুধু ফ্যাকাশে ইরেজারের ঘষটানো দাগ

Tuesday, November 2, 2021

আ র শি ন গ র

বাড়ির পাশে আরশিনগরের কথা
বাউল বলেছেন বলেই
উঁকি ঝুকি দিই পাশের উঠোনে

ভাবি সীমান্তহাট খুললেই
খরচপাতি করে পাড়ের কড়ি নিতে পারি
আবার মনের ঝরোখাটাকে হাট করে খুলে দিতে পারি

তখন আর সীমানার কাঁটাতার থাকবে না

Monday, November 1, 2021

চোদ্দোপিদিম

যমআঁধারে আটকে আছেন পিতৃগণ
আলোর প্লাবনে না নিয়ে এলে
কোথায় পাবো চর্যাপদ
তাঁদের কাছেই তো আমাদের জিয়নকাঠি

এসো না এবার
পূর্বজদের ছায়াপথে চোদ্দোপিদিম জ্বালাই