Monday, January 31, 2022

খোঁজ

খোঁজ

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

একটা নেশার ঘোরের মধ্যে আমি ঘুরি ফিরি এঘর, ওঘর ৷
এ উঠোন থেকে ও উঠোনের প্রতিটি পদক্ষেপে সন্ধিৎসা
উল্টে যাই ফেসবুকের পাতার পর পাতা আর মেসেজবক্সের খুপরি
যদি কোথাও তোমার স্বরলিপি খুঁজে পাই সেজন্যে অসীম আশা

তোমার অভিমান আমার কবিতার খাতা বেয়ে স্তুপাকার হয়
শব্দের গুচ্ছগ্রামে সন্ধান করি তোমার আরক্তিম মুখের বিন্যাস

Thursday, January 20, 2022

বিপ্লবী

বিপ্লবী

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

গড়পড়তামানুষের স্বভাব নুয়ে চলা
একপাশে কাত বা হেলে থাকার দস্তুর বলে
খুব একটা কেউ ঝামেলায় যেতে চায়না
তাই পাশবালিশ নিয়েই ঘুমোতে পছন্দ করে মানুষ
কুকুরও কুন্ডলি পাকিয়ে ঘুমাতে অভ‍্যস্ত
তবে তাদের কোনো অবলম্বন লাগেনা বলে
তারা তেড়ে উঠতে ভয় পায়না । মানুষ শুধু
পাশবালিশের দিকেই ঘেঁষে আসতে জানে ।

তবু মাঝে মাঝে কেউ ফোঁস করে ওঠে ।
মানুষ বিদ্রোহী হলে মানুষেরাই সম্মান করে।
দেশের মাটিও তাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেয় ।
আবহমানকাল তারাই গান গায় আর শেকল ছেঁড়ে ।

শেষবেলা

# + # শেষবেলা #+ #
--------------------------------
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
--------------------------------
বিকেলের ডাকে যে চিঠি আসবে
তাতে ভ্রূণসন্ধ্যার সিঁদুর মাখিয়ে
সারাটা পরিক্রমার নিখুঁত দিনলিপি
গাঁথার পর খামবন্দী করে তারিখের
মোহরচিহ্নে প্রত্যয়িত করার কথা

সাতকাহনে সাজার পর অন্ধসন্ধ্যায়
বলে দেবে,তুমি ঘরে ফিরে যাও
তোমার বেলা বহুক্ষণ আগেই শেষ ৷

Friday, January 14, 2022

মায়াবয়ন

মায়াবয়ন

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

জমানো পাতাগুলো উল্টে যেতেই হয় সামনের দিকে
ট্রাফিকনিয়মে দাঁড়ালেও থেমে থাকা যায় না
পেছনে নিঃশ্বাস ফেলে অগুনতি দ্রুত আরোহী
ফেলে আসা পথের ধুলো কখন হাওয়ায় উড়েছে
মুছে যায় সমস্ত মায়াচিহ্ন ফেরা তো যায় না

পেছনে মুছে গেছে আমার পায়ের কোমল দাগ
সমানে সামনে পা ফেলে আমি নিজেকেই হারাব 
 একদিন ৷ যেদিনের সংকেত জানা নেই আদৌ ৷

Thursday, January 6, 2022

চাঁদমঙ্গল

চাঁদমঙ্গল

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

অমোঘ বেদনার নিদান নিয়ে জেগে আছি আকাশের হাওরে । পুরাণের কথকেরা অপবাদ দিয়ে আমার জন্য তৈরি করে গেছেন চিরস্থায়ী মাথুর । হ্যাঁ, পুরাণ যাকে প্রেমিক বানায় সে প্রেমিক । যাতে এঁকে দেয় কলঙ্কে সে কলঙ্কিত  আজীবন । আমার কোন সহোদর নেই । আমার কোন প্রভু নেই । আমার প্রিয় ঘরনি নেই । পৃথিবী তার দিনলিপি খুলে আমাকে চিহ্নিত করে দ্বিঘাত বিভাজনে । কর্তনমুক্ত কাটাতে পারি এক পক্ষ । আমার ষোলোকলা ভাঙে আর গড়ে প্রতি পক্ষে । ভাঙা-গড়ার নিরন্তর উল্লাসের ভেতর রাতের পর রাত জাগছি আমি । জঠর ছেড়ে জীবনের পাঠ । পৃথিবীর দু প্রান্তেই আমার ঘর । আকাশের নীলহ্রদে বেয়ে চলি হলদেডিঙি । কি অদ্ভুত হাতেখড়ি দিয়ে শিখেছি বিষণ্ননামতা । পেয়েছি নির্জন এক  উদাসনগর । অগণিত নক্ষত্রমণ্ডলী আর ছায়াপথ সেখানে পারিজাতবাগিচা । মন্ত্রঃপূত মাদুলির ঘোরে যেন আমি সে পথে হাঁটি প্রতি রাত । এক আদিগন্ত দীঘলনদীর বুকে অন্ধকারে ছেড়ে যাই আমার নির্মলডিঙার বিহার । সন্ধ‍্যার বশীকরণে আমার প্রাচীন অবয়ব এগোতে থাকে অনিশ্চয় ঊষার রক্তিম ঘাটলার দিকে । কার অদৃশ‍্য আকর্ষণ নিয়ত টানে আমার উজ্জ্বল অবয়ব ? কার জন্য জাগি রাতের পর রাত ? আমার শরীরের কলঙ্ক দেখে সবাই । কলংক পারে শুধু তর্জনীশাসন । দূরের নগরী গন্তব‍্য প্রতিরাত । অথচ দেখিবার কেহ নাই । আমার ধ্রুবযাত্রা । কে আছো অনন্ত গোসাই ! তুমি কি আমার খবর জানো? পড়েছো কি আমার সঙ্গীহীন মায়াপথের মানচিত্র !

আমার শরীর বেয়ে ঝরে পড়ে উজ্জ্বল আলো । সোমপ্রভ আমি । আমার শরীর থেকে জন্ম নেয় আরেক মায়াতরুণীর শরীর । সুন্দর দোপাট্টা ছড়িয়ে সে এক অনুপম নারী । আমার প্রেমিকা । আমার দয়িতা । জোছনা তার নাম । হলুদ চন্দন তার শরীর । তাকে দেখে পাগল হয় মাতাল হরিণেরা । সে যখন সেজে ওঠে আমার পুরো শরীর জুড়ে তখন চরাচর জুড়ে অদ্ভুত মাদকতার ঘ্রাণ । আমাকে ভুলে যায় সবাই । বারোমাসি গান ধরে বাঙালি কবিয়াল । জোছনাকে নিয়ে আমার প্রেম । জোছনা আমার ঈর্ষা । আমি রূপবান সোম । প্রেমিক চন্দ্র । আমার প্রেম তো পুরাণপ্রবাহিত । কীর্তনকুলীন । আপন নাভিগন্ধে যেমন মাতাল হরিণী । আপন রূপে আমি গুণ মন ভোর । সুরলোকের তাবৎ তরুণীরা আমার প্রণয়েরর আশায় আতর মাখে গায় । অঙ্গরাগের কৌশল শেখে । রানিমক্ষিকার মতো একে একে কাছে আসে । আমিও বাঁধা পড়ি সুন্দরের কাছে । সুরসুন্দরীদের কাছে । পুরাণবন্দিত প্রেমিক আমি । সাতাশ দক্ষকন‍্যার মাঝেও আমি রোহিনীপুরুষ । রোহিনীপ্রেম আমাকে অভিশপ্ত করে । আবার শাপমোচনও হয় । আমার দেবদ্যুতি, আমার শৌর্য ও বীর্য প্রিয় হয়ে ওঠে দেবপত্নীসমাবেশে । চন্দ্রপ্রণয়ে ভেসে যায় তাদের সংসার । সমূহ আভিজাত‍্য ।দেববণিতাগণ ঘিরে থাকে আমাকে । আমি ডুবে যাই ভালবাসার অনন্তসায়রে । আমাকে আলিঙ্গন করেন আমার গুরুপত্নী স্বয়ং । অসামান্যা সেই রমণী আমার প্রেমের জোয়ার । জোছনাবান । নীতিশাস্ত্র পুড়ে যায় প্রণয়বহ্নির আগ্রাসী শিখায় । রাগবিলাসিনী সে রমণী তারা । স্বয়মাগতা । সেই মহামৈথুনে বুধসৃজন । চন্দ্র বংশের পত্তন । সেই প্রেম ঘরপালানো প্রেম। চারদেয়ালের বাঁধন ছেড়ে উদ্দাম হওয়ার প্রেম । আমার মিথভূষণ । এই প্রেমও আমায় করে অভিশপ্ত । আজন্ম কলঙ্কিত । আজও আমার বুকে চিরকলঙ্কের ক্ষতচিহ্নের ইঙ্গিত ।

সেই অভিশপ্ত ক্ষণ থেকে আমার কোন গুরু নেই । আমার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই । আমার আবহমান দিঘলদরিয়ার কথকতায় দিনলিপিময় ডিঙিভ্রমণে হারিয়ে গেলেই আমাকে তুলে ধরে এক কৃশানু নারী । সে আমার চিরঅনুগামিনী । আমার তারা । সমস্ত সংস্কার ভেঙে প্রতিটি পক্ষে আমার নবীন শীর্ণ শরীরে সে দেয় মোক্ষম প্রলেপ । জ্যোৎস্নার চন্দন । আমার নাওবাঁকা শরীরে তারার আশ্রয় চিরকালের ।

ফাটিয়া যাওত ছাতিয়া

ফাটিয়া যাওত ছাতিয়া 

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

এক দীর্ঘ পদযাত্রার নাম জীবন । ভাবসাগর আর ভবসাগর অতিক্রমণের ভ্রমণবিন্যাস জীবনের ধারা ।  সবটাই পরিব্রাজন । হেঁটে যাওয়া কিংবা সাঁতার । জীবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের অন্তিমে ক্রমশ অনন্তের দিকে । ক্রমাগত পথ পেরোতে পেরোতে ফেলে আসা সাদা খইয়ের ধানের মতো স্মৃতির শুভ্র স্তবক । স্মৃতির দর্পণে ভাসে প্রিয় মুখ সব । যে মুখ জড়িয়ে আছে মায়াবন্দর । চলমান সময়ের স্রোতে ভালোবাসা এক একান্ত অনুষঙ্গ । জীবন পেরিয়ে যায় ভালোবাসার অলৌকিক জলপথ । যে পথের দু'ধারে স্বপ্ন সবুজ পাড় আর হৃদয়ের ছলাৎ ছলাৎ  জলধ্বনি । জীবননাইয়ার আলোআঁধারী নৌকো  তির তির করে এগিয়ে যায় । ভালোবাসার মরমি কথা মন ও মনন জুড়ে যখন বেজে যায় দুই দৈবীঘুঙুরের মতো । তখন জীবনের গান ও খোঁজে স্বরলিপির সাংকেতিক খাতা । ভালোবাসার গান বাঁধা হয় নিবিড় নান্দনিক স্বরলিপিতে । ভালোবাসা কি ? শুধু কি হৃদয়ে হৃদয় জড়ানো ব‍্যাকুল অনুভূতি ?  শুধু কি অন্তরঙ্গ আকর্ষণ ? নিভৃত মনের গোপন কথকতা ?  আবেশমুখর সময়ের দলিল ? প্রশ্ন জাগে বারবার । কখনো বিশ্বাস হয় । প্রত্যয় ভাঙে কখনোবা । নিরন্তর গূঢ়সন্ধান চলে নিবিড় বন্ধনের । যতক্ষণ মগ্ন থাকা যায়, ভালোবাসার কাছে নতজানু থাকা যায় । চেতনার গভীরে এক গাঢ়ছাপ স্পষ্ট হয়ে যায় । উল্কিপ্রকট মুহূর্তগুলো বিচ্ছুরিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে মেঠোপথময় অস্তিত্বের অবয়বে । শিমুল তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ে যায় ভালোবাসার স্বপ্ন । আকাশে ভাসমান মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে শুধুই ভাসে প্রিয় মুখ । ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী । ভালোবাসার বকুলসই । পরতের পর পরত অনিঃশেষ বস্ত্র জড়িয়ে যেতে থাকে শরীরে । ভালোবাসার নামে । সহস্র পেশির আকর্ষণেও খোলেনা যেন ভালোবাসার ব্যস্তবসন । জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে । শরীরময় । মন জুড়ে । 

ভালোবাসা এক প্রিয় গার্হস্থ‍্যের নাম । প্রতিদিন বেড়ে উঠে সে পরিপাটি হয়ে । অসীম যাতনার ভেতরেও অপার আনন্দ। ভালোবাসা এক করতে জানে । বিশাল জলপরিধি নিয়ে সেজে ওঠে ঘরকন্না ভালোবাসার নামে । চেতনার চিলেকোঠায় আলো দেখায় রহস্যময় প্রদীপের প্রজ্জ্বলিত সলতে  । কখনো কাঁপে বেদনায় তার শিখা । কখনোবা অত‍্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার রোশনাই । যাপিত জীবন ঘিরে ভালোবাসা মায়াকুহেলিকা রংধনু বিস্তার করে । ভালোবাসা এক অনন্য ফসল । নিরবধি চর্যার স্বপ্নভুবন । জীবনের মধুঘ্রাণ ভালোবাসায় বসত করে । পুরাকথার বুননের মত চেতনালগ্ন নীরবতা ভালোবাসার প্রান্তরে । সে প্রান্তর মধুবৃন্দাবন । বন-প্রান্তর, পাখপাখালি, লতাবিতান, ভ্রমণবিলাস, ময়ূর আর গোপজন মিলে ভালোবাসার আনন্দময়দান সেখানে । শ্রীরাধার কৃষ্ণপ্রীতি চিরকালীন ভালোবাসার উপমা । সেই শাশ্বতপ্রেমিক শ্রীকৃষ্ণ একদিন ছেড়ে যান তাঁর ভালোবাসার গোবাট । কংসবধের নিমিত্ত চলে যান মথুরায় । অতলান্ত দুঃখের পারাবারে ভেসে যেতে থাকে রাধার ভালোবাসা । ফেলে আসা ভালোবাসার জন্য কৃষ্ণ কী ব্যাকুল হয়েছেন কোনদিন ? হয়েছেন কি কোনদিন বিরহভাবুক তার দয়িতার জন্যে ? সে কথা লেখেনা কোনো পুরাকাহিনি । কৃষ্ণ পারেননি মহান করে রাখতে  তাঁর প্রেমকে । শুধুই কামুক ছলনায় কলঙ্কিত হয়েছে তাঁর ফেলে আসা ভালোবাসা । অতীন্দ্রিয় উন্নয়ন নেই তাঁর ভালোবাসায় । প্রেমিকের পরিণতি ঘটেছে রাজনেতৃত্বে ।
 
কৃষ্ণপ্রস্থানের সাথে সাথে কিন্তু অবসান হয়নি রাধাপ্রেমের । কালিয়ার পরিত্যক্ত প্রেম রাধার অন্তর ভাসিয়েছে সীমাহীন অনন্ত বিরহে । যে বিরহ সৃষ্টি করেছে হৃদয়দ্রাবী মাথুরপদাবলি । একের ফেলে আসা ভালোবাসা অন্যের জন্যে হৃদয়মথিত বেদনার আর্তি । বিদীর্ণ হৃদয়ের কারুণ্যমিশ্রিত শাশ্বত আলেখ্য । সান্নিধ্যনিবাসে ভালোবাসা ঝড় তোলে । স্বপ্নজগতের সুগন্ধীবাসভূমে পৌঁছায় । আর ছেড়ে গেলে সেই ভালোবাসা বাস্তবের আঘাতে ভেঙে যায় । ফেলে আসা ভালোবাসার দুই দিক । একদিকে বিরহের শোকোচ্ছ্বাস । অন্যদিকে জীবন সংগ্রামের বাস্তবমাথুর । এক পিঠে অনন্ত সুখের ভিতর দুঃখবিধুর একাকীত্ব । আর অপর পিঠে জীবনের কঠিন ও শাশ্বত সত্য । জীবনপ্রবাহের সত‍্যলোক স্পষ্ট হয় তাতে ।হৃদয়পারাবারের দুই পাড় ভাঙে  দুইভাবে । দুই অনুভবে ।

নিভৃতনগরীর দামালজলধি

নিভৃতনগরীর দামালজলধি

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

সবার একটা নদী  আছে ।  সে নদীর দুই ধারা ।চোখের জমিনে বসত করে সেই নদী । সে এক নীরব নদী । অন্তর্গত গুহাজল । সে নদীর জোয়ার আসে ।মাঝে মাঝে সে নদী হয় খরধারা । সে কেবল গড়াতেই জানে । শব্দহীন কথা বলে সে নদী । বেদনায় কিংবা আনন্দে  ।  আবেগনির্ঝর । ব‍্যথাসই । ভালো  লাগার দোসরজন । মেরুকরণের উপকরণ ।মনের গভীরে লুকানো বৈভবকে বের করে আনে এই সুপ্তস্রোত । যখন বাঁধ ভাঙে তখন তীব্র তার গতি । ধূলিস‍্যাৎ করে দিতে পারে সব অভিমান সব দম্ভ । মনের উঠোনের কালিমাকাজল ধুয়ে নেয় গড়িয়ে পড়া অপাপবিন্দু । দীর্ণ অন্তরভুবন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয় তার উতলধারায় । গৌরমাতন ঝরায় জল । মহানামে গভীর হয় চোখের আর্দ্রতা । বাজে জলতরঙ্গ মাদলের বোলে । ঝরে জল অবিরল । জল কখনও অতিজাগতিক উল্লাস । বুকের মধ্যে আনন্দমৃদঙ্গ বেজে উঠলে বিমলবৃষ্টি নেমে আসে চোখ বেয়ে । প্রাপ্তির আনন্দ আনে নয়নবারি । আনন্দনির্ঝর জাগিয়ে তোলে ভালোবাসা । সে ভালোবাসা মানুষ মানুষীর প্রিয় বাঁধনকে করে সুদৃঢ়তর । আবার জীবনের প্রতি টানও বেড়ে যায় । পরমপুরুষের সঙ্গে ভক্তের হয় ভাবসম্মিলন । আনন্দধারা ভাসে চিরায়ত চকোর-চকোরী । প্রেমিকার চোখের দুঃখবারি চঞ্চল করে প্রেমিকের মন । আরো আরো বেশি করে ভালোবেসে মুছে দিতে চায় কষ্টের জল । জীবন বাজি রেখে শ্বাপদসংকুল যাত্রা শেষে নিষিদ্ধ স্ফটিক স্তম্ভ ভেঙে তুলে আনে আশ্চর্য কমল । বিশ্বাসের মধুগন্ধ প্রিয়নিলয়ের সুখ ।

আয় জল, আয় ঝেঁপে । বুকের পাড় ভেঙে আয় । তুই কেবল জলের বিন্দু  নোস । তুই তো উথালি-পাথালি শরীরের কোণে জমা মেঘবিন্দু । আয় জলসই । আবেগের ঝরনা রেখে যাক তোর জলছাপ । মায়াবিধৌত হৃৎকমলে প্রশান্তিপ্রলেপ । ধ‍্যানবদ্ধ শরীর যেন মেঘমল্লার শোনে নিভৃতে । বারিপ্রবাহে ডুবে ডুবে যায়রে শরীর ! যায় । যায় । বিচ্ছেদের ও আছে বেদনাবিলাপ । মাথুরবিরহের রাইগুঞ্জন বাজে হৃদিব্রজে । অনন্তপ্রতীক্ষার নদী ভরে যায় উত্তাল উচ্ছ্বাসে । জীবনের আকাশ মেদুর হয় ।অযাচিত বিদায়ের তীব্র তির কখনও বর্ষা নামে দেহজনপদে পদাবলির সুরে । মেঘলাগোঠের আর্দ্রভুবন গুমরে কাঁদে । আর্তবিলাপের প্রতীকপ্রবাহে ভিজে যায় রাধাপথ । বৃদ্ধাশ্রমে নির্বাসিত নিঃসঙ্গ মায়ের সিক্ত আঁচলে জমা হয় স্মৃতি । ইতিকথায় ভরপুর ঘোলাটে চোখ বেয়েও নামে মায়াঢল । জলমহল ভাঙে ছলনার মুখোশ । কাজললতার  অনুশাসন । স্তনযন্ত্রণা । দুঃখ যার চিরসখা কান্না তার পারানি । কান্নাপুকুরে ডুব দিয়ে উঠলে হয় শুদ্ধস্নান । অলৌকিক অবগাহন । এ তো জলের  জলধি । এ নদীতে খেয়া দেয় বোধনের নাইয়া । যে নিয়ে যায় নতুন জীবনের পারে । আলোকিত আকাশের দিগন্তরেখায় । ভোরমহল্লার আজান ভেসে আসে নির্মলভেলায় ।

বেহুলা পেরিয়ে গেছে যে গাঙুর, সেও এক কান্নানদী । শবসন্নিহিত মান্দাসনিঃসঙ্গ যাত্রায় মৃতনদীর চড়া আর বালিয়াড়িকে সজল করেছে তার অনন্ত অশ্রুসলিল । উৎসবমুখরিত দেবসভার উচ্ছল নক্ষত্র ভেসে গেছে তার নোনাজলে ।

প্রতিটি অশ্রুবিন্দু জীবনের রঙধনু । মনের গোপন নির্মানের মলাট উন্মোচন । এ নিছক জলবিন্দু নয় । জীবনতিলক । বৃষ্টি নিয়ে খেলা যায় । অশ্রু নিয়ে নয় । প্রাণ কখনও আকুল হয়ে ডাকে, 

        আয় ! অশ্রু আয় ।
           আয় রে, জোছনার গান ।
     ভালোবাসার শ্রাবণ রে তুই ।
 আয়, আয় বেদনামূর্ছনা । আদুরে উল্লাস ।