এক চিরঞ্জীব বজ্রকন্ঠের সঙ্গে ক্ষীণ পরিচয়
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি একাদশ শ্রেণির ছাত্র । তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৭০ সাল থেকে মোটামুটি আমি বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র সম্বন্ধে পরিচিত হই । সে বছর বাংলাদেশে এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছিল । একদিন আমাদের ক্লাসের ভূগোল স্যার সুখেন্দু চৌধুরী ক্লাসে ঢুকে খুব মনমরা হয়ে বসে রইলেন । অনেকক্ষণ যাবৎ কিছু পড়াচ্ছেন না । আমরাও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি । আমাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়ো সহপাঠী কৃষ্ণকান্তদা সাহস করে স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আপনার কি হয়েছে ? চুপচাপ বসে রয়েছেন কেন ?
স্যার ধীরে ধীরে বললেন, পাকিস্তানে আমার বাড়ি । সেখানে আমার পূর্ব পুরুষরা রয়েছেন । আমাদের যেখানটায় বাড়ি নোয়াখালীর সন্দীপ । সেটা দ্বীপাঞ্চল । গতকাল সেখানে প্রচন্ড জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেছে । বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে । আমার মা বাবারা এখনো সেখানে রয়েছেন । দেশের মায়া ছেড়ে সেখান থেকে আসেননি । জানিনা তারা কেমন আছেন । আদৌ বেঁচে আছেন কিনা বলতে পারছিনা । বলতে বলতে তাঁর চোখ ছল ছল করে উঠেছিল সেদিন ।
একটু পরেই তিনি একজন ছাত্রকে স্টাফরুম থেকে গ্লোবটা আর ভারত ও পাকিস্তানের দুটো ম্যাপ আনার জন্য বললেন । একজন গিয়ে সেগুলো নিয়ে এল । প্রথমে তিনি গ্লোব থেকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান আমাদের সামনে তুলে ধরলেন । পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থান স্পষ্ট করে দিলেন আমাদের কাছে ম্যাপের মাধ্যমে । তারপর পূর্ব-পাকিস্তানের কোথায় সন্দ্বীপ-হাতিয়া ও অন্যান্য চরাঞ্চল রয়েছে সেগুলো আমাদের দেখাতে লাগলেন । স্যার যখন বর্ণনা করছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, তিনি যেন পূর্বপাকিস্তানে অবস্থান করছেন । মনে হচ্ছিল যেন তিনি সন্দ্বীপের তার জন্মভিটে দাঁড়িয়ে আছেন । তাঁর নিজের গ্রামের বর্ণনা করছিলেন আবেগের সঙ্গে । আমরাও পরিচিত হচ্ছিলাম আমাদের পূর্বপুরুষের বাস্তুভূমি পূর্ববাংলা তথা পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে । যে দেশের কথা আমি আমার মা-বাবার মুখে বারবার শুনেছি । একসময় স্যার থামলেন । আমাদের সামনে মানচিত্র তুলে ধরে সেখানকার বর্ণনা করে সেদিন তিনি নিজেকে অনেক হালকা বোধ করেছিলেন ।
সেই সুখেন্দু স্যারের কাছে আমরা পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মার্চের এক ভোরে পড়া বুঝতে যাই । সুদর্শন সুখেন্দু স্যার তার ছোট্ট মেয়েটিকে কোলে নিয়ে সকালের প্রাতরাশ সারছিলেন । সামনে মারফি কোম্পানির একটা রেডিওতে সংবাদ চলছে । তিনি ইঙ্গিতে আমাদের বসতে বললেন । কথা বলতে বারণ করলেন । আমরা চুপচাপ বসে পড়লাম। একটু পরেই ভরাট এবং জোরালো কণ্ঠস্বর রেডিওতে ভেসে এলো । "ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি । আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন । আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি । কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে । আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায় ।...." যেন এক দৈবীকণ্ঠস্বরে স্যারের রুমটা গম গম করে উঠল । রেডিওর ছোটো ছোটো লাইটগুলো মুহুর্মুহু লাফিয়ে লাফিয়ে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে । কারো মুখে কোন কথা নেই আমরা কয়েকটা ছাত্র মগ্ন হয়ে বসে আছি স্যারের সামনে । এমন কণ্ঠস্বর আমি কখনো শুনিনি । আমার চোখের সামনে যেন হাওয়ায় ভাসছে আমাদের ইতিহাস বইয়ের 'ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে'র পাতা গুলো । ভেসে উঠছে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর মুখ, মাস্টারদা সূর্যসেনের মুখ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মুখ । তাহলে তারা কি এভাবেই জলদগম্ভীর ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন ? "...তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো । মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব ।এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । জয় বাংলা । জয় বাংলা । একসময় ১৮মিনিটের দীর্ঘ এই ভাষণ শেষ হয় । এক বিধ্বংসী ঝড় থেমে গেলে যেমন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে থাকে অনেকক্ষণ । তেমনি স্যারের পড়ার টেবিলে বসা আমরা কয়েকজন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইলাম ।
সেদিন আর স্যার পড়ালেন না । তিনি জানালেন আগের দিন ৭ মার্চ বিকাল বেলা ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানের ( বর্তমান সোরোয়ার্দী উদ্যান ) এক জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি ধীরে ধীরে আমাদের সামনে সেদিন তুলে ধরলেন সেদেশের ৫২র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তখনকার সময় পর্যন্ত গণআন্দোলনের ইতিহাস । সে দেশের সামরিক শাসক বর্গ যে বারবার তাদের উপর আঘাত হেনেছে তার কথা । আইয়ুব খানের মার্শাল ল'র কথা । ইয়াহিয়া খানের কূটনৈতিক চালের কথা । সে দেশের পূর্বপ্রান্তের এই অংশটি যে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে এগোচ্ছে তার ইঙ্গিতও সেদিন দিলেন সুখেন্দু স্যার । প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে গভীর প্রত্যয় নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম আর বারবার ভাবছিলাম এই মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী মানুষটি না জানি কেমন !
দু'একদিনের মধ্যেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিরাট ছবিসহ শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সভার ছবি ফলাও করে প্রকাশিত হয় । সাদা রংয়ের পাঞ্জাবির উপর কালো হাতাকাটা কোট গায়ে পেছনদিকে আঁচড়ানো চুলের অধিকারী এক বিরাট সুপুরুষের তর্জনী তুলে ধরা শেখ মুজিবর এর ছবি সেদিন সব কাগজে বেরিয়েছিল । তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণের উন্মাদনা সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল এদেশের মাটিতেও । সেদিন রাজ্যের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একটি সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ পুরোপুরি তুলে ধরা হয়েছিল । পাশে ব্লক করে তুলে দেওয়া হয়েছিল 'জাগো অনশন বন্দী ওঠো রে যত / জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত'–গানটি ।
সেদিন থেকেই এদেশের পথে-প্রান্তরে, হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণটি সকলের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল । তারপর ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান বাহিনী নেমে পড়ে ঢাকার রাজপথে । ব্যাপক ধরপাকড়, নির্বিচারে গণহত্যা চালাতে থাকে । গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান এবং তাঁর পক্ষে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এই ঘোষণাটি সম্প্রচারিত হয় । নিজেদের জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে সেদেশ থেকে শরণার্থীর ঢল নামে ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় রাজ্যের বুকে । পরদিন স্কুলের প্রেয়ার মিটিংয়ে সুখেন্দু চৌধুরী স্যার, সুনীল বর্মন সার, কাশিনাথ দাশ স্যার সংক্ষেপে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন । শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য বার্তা দেন প্রধান শিক্ষক পূর্ণেন্দু বিকাশ দত্ত মহোদয় । সে অনুযায়ী আমি, প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের ছেলে মৃন্ময় দত্ত ও একাদশ শ্রেণির আরো কয়েকজন ছাত্রের নেতৃত্বে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ শুরু করি । আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকমন্ডলীর অধিকাংশেরই পূর্ব বাসস্থান পূর্ববঙ্গে হওয়ায় তাঁরা আমাদের একাজে উৎসাহ দিতে থাকেন । দেখতে দেখতে আমাদের লোকালয় শরণার্থীতে ভরে যায় ।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সেদিন যেন আমাদের প্রাণেও দোলা দিয়েছিল ১৯৭১ এর ১৩ এপ্রিল রাতে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিচিত্রায় প্রকাশ করা হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ । সেইসঙ্গে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা "শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি / আকাশে বাতাসে ওঠে রণি / বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ" গানটি বাজানো হয় । এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন এপারের বিশিষ্ট শিল্পী অংশুমান রায় । হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে ৪৫ আরপিএম এর একটি রেকর্ড বের করা হয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং অংশুমান রায়ের গানের । রেকর্ডটি সেদিন এত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে সেটি সে সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, পূজা প্যান্ডেলে প্রচুর বাজতে থাকে । সেই গানের রেকর্ড সেদিন ত্রিপুরার প্রত্যন্ত গ্রাম সাব্রুমের ছোটখিলের রানির বাজারের অনিল চৌধুরীর ( অনিল ঠাকুর ) চায়ের দোকানে অনবরত বাজত । সে সময় সারা সাব্রুমে একমাত্র অনিল ঠাকুরের কাছেই মাইকসরঞ্জাম ছিল । বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সেদিন অনবরত শুনতে শুনতে আমাদের মত কিশোর ও তরুণদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
তারপর ১০ মাস ব্যাপী বাংলাদেশের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের কথা সবারই জানা । ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের কাঙ্খিত স্বাধীনতা । দেশ স্বাধীন হলেও দেশবাসীর মনে শান্তি ছিল না । তাঁরা খুঁজছিলেন তাদের দেশ নায়ককে । আমরা এদেশের তরুণরাও সন্ধান করছিলাম প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ককে । বঙ্গবন্ধুকে । তিনি তখন পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন সহ্য করছেন ।তাঁর মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সাথে আমাদের দেশের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন । চাপে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে মুক্তি দেয় । পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে একটি কবরও খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল ।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭জানুয়ারি রাত ২ টায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটি বিমান লন্ডনের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করে । লন্ডন থেকে নয়াদিল্লি ফিরে এসে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । তিনি জনসমক্ষে ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী ও 'ভারতের জনগণ আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু' বলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন । ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি তিনি তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন ।
দেশে ফিরেই তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন । দেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিবিড় করার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন । কিন্তু তার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সেদিন স্বাধীনতার শত্রুরা পার পেয়ে যায় । আর সেই সুযোগে তারা গোপনে বিষদাঁত, নখ বিস্তার করতে থাকে সে দেশের মাটিতে ।
তখন আমি কলেজে পড়ি । ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট । যেদিন আমাদের দেশে স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রস্তুতি চলছে । রাত পোহালেই যেদিন দেশজুড়ে উড়বে তেরঙ্গা পতাকা । ঠিক সেদিনই ভোররাতে একদল সেনা কর্মকর্তা ট্যাংক নিয়ে সদ্যোজাত প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর ঘিরে ফেলে । ঘিরে ফেলে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাসভবন এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার ও ব্যক্তিগত কর্মচারীদের নির্বিচারে হত্যা করে ।
সেদিন ভোরে আমরা ছোটখিল থেকে দলবেঁধে সাব্রুম শহরে এসেছিলাম মেলার মাঠে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান দেখার জন্য । সকালের আকাশবাণীর সংবাদ সম্প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই জেনে যায় নির্মম মুজিব হত্যাকাণ্ডের সংবাদ । আমরা একদল ছুটে যাই সাব্রুম বাজার ঘাটে ফেনী নদীর পাড়ে । ওপারেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় থানা । দেখি সৈনিকের পোশাকপরা একজন থানার পেছনে নদীর দিকে এসে চিৎকার করে কাঁদছে আর থানার দেওয়ালে মাথা ঠুকছে । তার বুকফাটা আর্তনাদে দুপারের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে । কিছুক্ষণ পরে কয়েক জন অস্ত্রধারী সৈনিক এসে তাকে নিয়ে যায় ভেতরের দিকে । সেদিন আমাদের এখানেও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান নিষ্প্রভ হয়ে যায় । সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের পর সবাইকে দ্রুত স্থান ত্যাগ এর নির্দেশ দেওয়া হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ।
আজ আমি দাঁড়িয়ে আছি ২০২২ এ । বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক ও একটি জাতিরাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ পূর্তিলগ্নে । বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিকালে । হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭-তম শাহদত বার্ষিকীতে । কৈশোর থেকে বার্ধক্যকালীন সময় ধরে আমার জীবনের এই পথ চলায় গোমতী-ব্রহ্মপুত্র-গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার বুক বেয়ে অবিরত জলধারা বয়ে গেছে । আমাদের প্রজন্ম দেখেছে আমাদের পূর্বজদের স্বপ্নে দেখা বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, আর জীবনানন্দের রূপসী বাংলার,প্রথম শুভক্ষণ । চোখে না দেখলেও শুনেছি তার জনকের উদাত্ত কণ্ঠস্বর । তার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরের প্রবাহ বহমান নদীর মতো আমাদেরও চেতনায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তাঁর ঘোষিত ভ্রাতৃত্ববোধই আমাদের প্রতিবেশী সম্পর্ককে দৃঢ় করবে । ভালোভাবে চেনার আগেই নৃশংস ঘাতক তাঁকে কেড়ে নিয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে । এ শূন্যতা পূর্ণ হবার নয় । তবুও দুই দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রতিবশীর মতো হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে । বঙ্গবন্ধু জেগে থাকবেন আমার হৃদয়ে, আমাদের অন্তরে । জয় হিন্দ । জয় বাংলা । ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক ।
No comments:
Post a Comment