Monday, March 28, 2022

বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা

বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কবিতার ধারাটি সমৃদ্ধ । এরাজ্যে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভাষায় নিরন্তর কবিতা রচনা হচ্ছে । ছিলোমিলো এখানকার চা-বাগান অঞ্চলের মানুষজনের ভাষা  । এই ভাষাতে যে কয়জন কবিতা রচনা করে ইতোমধ্যে পাঠকমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন তাদের মধ্যে বিপ্লব উরাং এর নাম অবশ্যই উচ্চারণ করতে হয় । বিপ্লব উরাং মোহনপুর মহকুমার ঈশানপুরে চা-শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ফলে তাঁর মাতৃভাষাও ছিলোমিলো । পাশাপাশি বাংলা কবিতায় ও তিনি সমান দক্ষতার ছাপ রাখেন ।তাঁর কবিতায় চা বাগান অঞ্চলের জীবন-সংস্কৃতি ও তাদের সংগ্রামের পাশাপাশি বর্তমান সময়ের মানুষের যন্ত্রণা ও লড়াকু মানসিকতার কথা তীক্ষ্ণ ও তীর্যকভাবে ফুটে ওঠে একেবারে সরল শব্দে । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এক বিঘত জমিন' প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে । তারপর থেকে তাঁর কাব্য খ্যাতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে আরও বৃহত্তর সড়কপথে যাত্রা করেছে ।

আগরতলা বইমেলার চতুর্থদিন সন্ধ‍্যায় লিটল ম‍্যাগাজিন এনক্লেভে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম । এই সময়ে একটি টেবিলে চোখে পড়ল 'বিপ্লব উরাং-এর নির্বাচিত কবিতা' বইটির দিকে । সদ‍্য বেরিয়েছে আগরতলার প্রকাশনা সংস্থা 'তিনকাল' থেকে । সংগ্রহ করলাম বইটি । বত্রিশ পাতার ছোট্ট শরীরের বইটিতে রয়েছে একুশটি কবিতা । কবি তাঁর শৈশব থেকে দেখে এসেছেন চা-শ্রমিকদের নিত‍্যদিনের জীবনযুদ্ধ । পুরুষানুক্রমে বাহিত হয়ে আসা এই সংগ্রামের কথা লেখার জন‍্যে তিনি তাগিদ অনুভব করেন । তাই তিনি লেখেন ১.'তকে লিখতে হবেক/ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘরে থাকে/কুপিবাতি জ্বলায় করে/লিখাই পড়হা করেছিস ।/ঘরপেন্দারে স্কুল নাই ছিল ।/গাড়িভাড়ার অভাবে কখন সখন পায়ে হাঁটে স্কুল করেছিস ।' ( তকে লিখতে হবেক )
২.'বাগানে কলঘরে কাম করতে যাইয়ে/বেনুকাকার হাত দুইটা/মেসিনে দুই টুকরা হইয়ে যাইয়েছিল/বিনা চিকিচ্ছায় তিনমাস পিছে/টপাস করে চলে গেল ।' ( তকে লিখতে হবেক ) । সময়ের প্রেক্ষিতে কবি লিখতে গিয়ে সংশয়াপন্নও হয়ে পড়েন । 'চখেত কত কিছুই দেখছি ।/সাচ কথা লিখতে গেলে ডর ডর লাগে ।' ( মনটা ছটফটাছে ) ।উৎকন্ঠাসংকুল মন নিয়েও কবি দগ্ধ সময়ের রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেন । 'আনধার চারদিকেই আন্ধার ।/আনধারে ডুবে থাকেও ক‍্যানে/কে জানি লতুন সকালের জনে/হামরা একসঙ্গে লড়তে নাই পারি ।/সপন দেখি এক সুন্দর সকালের ।' ( সপন দেখা ) 
বিপ্লব উরাং এর কবিতায় কবি বারবার 'বেচারাম'কে এনেছেন । ১. বেচারাম পড়ে শুনায়-/হাঁ করে শুনি আর বিড়বিড়ায়-/চুতিয়ারা মুরগির ঠ‍্যাং খাইয়ে/ঝুটা কথা লিখে দিয়েছিস-/শরমিকরা ভাল আছে ! ( খবরিওয়ালা ) ২. নাই বেচারাম, চুপ করে আর ঝোপতে/ থাকলে চাকরী নাই পাবি । ( ছিনাই করে লিব ) ৩. বেচারাম,/ শুনলম তুই ন কবি। হয়েছিস ।/ কবতা লিখছিস ।/ বাঃ, ভালা কথা । ( তকে লিখতে হবেক ) ।

মনে হয় বেচারাম কবিরই আত্মসী । অথবা সেইসব শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধি, যুগ যুগ ধরে যাদের শ্রম-ঘাম বিক্রি হয়ে আছে মালিকের গদিতে । যারা 'মাথাপিছু হপ্তাহে/চাল আটা মিলায় তিন কেজি, দুইশগেরাম' রেশন দেয় শ্রমের বিনিময়ে । তাও ' ক‍্যামন চাল জানিস/পাথর মিশাইল !/আর আটায় ভুষি ভর্তি ।' ( রেশন ) । কী নিদারুণ দুঃখভরা রসিকতা উঠে আসে বিপ্লব উরাং-র কবিতায় ।

No comments:

Post a Comment