'হারিয়ে যাওয়ার আগে' : একটি গ্রন্থপাঠের গৌরচন্দ্রিকা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
শিক্ষকতার পেশায় এসে শেখানোর চাইতে শিখেই গেছি দীর্ঘদিন । এখনও শিখছি । আমার চাকরি জীবন শুরু হয় সাব্রুম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে । এই স্কুলে সেকালের ডাকসাইটে দিকপাল শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এসে ছিলাম আমি । আমাকে প্রথম দিন স্কুলের দরজা থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্যর । হাত ধরে প্রথম ক্লাসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ দাস, অর্থনীতির শিক্ষক । এভাবে ধীরে ধীরে গোপাল দেবনাথ, রমনীমোহন নাথ, রঞ্জিত দেবনাথ, ড.ননীগোপাল চক্রবর্তী,কমল অধিকারী, নারায়ণ রায়, ড. রঞ্জিত দে প্রমুখ বেশ কয়েকজন নামজাদা শিক্ষকের স্নেহের ছায়ায় কাটিয়েছিলাম দীর্ঘদিন । চাকুরি চলাকালীন সময়ে অনেকে নতুন এসে জয়েন করেছেন । অনেকে নতুন কর্মক্ষেত্রে বদলি হয়ে গেছেন । অনেকে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন । আমার কয়েক দিন আগে এই স্কুলে জয়েন করেছিলেন আমার অগ্রজপ্রতিম দীপক দাস । সেসময়ে আমাদের স্টাফ রুম ছিল জমজমাট । পড়াশোনা, আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদি নিয়ে জ্ঞানচর্চার একটা বৃহৎ পরিসরের মধ্যে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম । শম্ভু চৌধুরী, শিখা ভট্টাচার্য্য, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য, গৌরগোপাল দাস, চম্পাকলি বিশ্বাস, নেপাল সরকার, অর্জুন শর্মা, নিতাই ভৌমিক এঁরাও প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে ছিলেন জ্ঞানভান্ডার । শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষক আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ ছিলেন বেশ কয়েকজন । লক্ষ্যণীয় হল এই শিক্ষকমন্ডলীর অধিকাংশেরই ছিল সাহিত্যে অগাধ বিচরণ । লিখতেও পারতেন হাত খুলে । যাঁদের মধ্যে আজও অনেকে রাজ্যের লেখালেখির জগতে সুনামের সঙ্গে বিচরণ করছেন । ফলে 'চন্দন গাছের সঙ্গে থেকে ভেরেন্ডা গাছ ও যেমন চন্দনের বৈশিষ্ট্য লাভ করে তেমনি আমিও এই গুণীজনদের মধ্যে মধ্যে থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করবার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম । আমাকে বিভিন্নভাবে তাঁরা সাহায্য করতেন যাতে লেখালেখিতে উৎকর্ষ আসে । তীক্ষ্ণ সমালোচনাও করতেন । এঁদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি প্রতিদিন আমাকে নতুন করে জাগাত ।
আমার অগ্রজপ্রতিম দীপকদা যার সঙ্গে আমি দীর্ঘ আটাশ বছর এই স্কুলে কাজ করেছি । বাংলাসাহিত্যে অবাধ বিচরণ তাঁর । ক্ষুরধার যুক্তির জাল বিস্তার করে বক্তব্য রাখতে পারেন । মুহুর্মুহু বেদ-পুরাণ-নীতিগল্প থেকে উদাহরণ টেনে বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করতে পারেন তিনি । কবিতা আর গান ছাড়া তাঁর বক্তব্য সম্পূর্ণ হয়না । তবে কিছুটা আবেগপ্রবণ তিনি । আবেগের রাশ টানতে পারেননা । আর এই আবেগময়তার কারণেই তাঁর অনেক গুণগ্রাহী শ্রোতা রয়েছেন । আর তাঁর আর একটি গুণ হল কাউকে তিনি অবমূল্যায়ন করেননা । তাঁর স্পষ্টবাদিতারও শিল্প রয়েছে । আমার লেখার একজন মনযোগী পাঠক ও গঠনমূলক সমালোচক তিনি । দীর্ঘদিন লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন । সম্প্রতি তাঁর সেইসব লেখার বাছাই করা কিছু নিবন্ধকে দুই মলাটে বন্দী করেছেন 'হারিয়ে যাওয়ার আগে' শিরোনামে । এবারের বইমেলায় আগরতলার প্রকাশন সংস্থা 'নীহারিকা' থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই গ্রন্থ । কথাবলার মতো ঝরঝরে ভাষায় লেখা এই লেখায় তাঁর পাঠব্যাপ্তি পাঠক প্রতি ছত্রে ছত্রে অনুভব করবেন । প্রতিটি লেখায় ঝরঝরে গদ্যশৈলী, কবিতার উদ্ধৃতি, গ্রন্থপাঠের নির্যাস পাঠককে মুগ্ধ করবে । তাঁর লেখা জুড়ে মৃত্যুচেতনা এক নিপুণ অনুষঙ্গ । যা জীবনবোধে স্নাত করে ।
গত পরশু আমাদের পূর্বতন কর্মক্ষেত্র সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয় এবং শিক্ষক নিতাই ভৌমিক আমাকে ও দীপকদাকে গতকাল স্কুলে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানান । গতকাল নিতাই ভৌমিকের চাকরিজীবনের অবসরগ্রহণ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে । প্রধানশিক্ষক দিলীপচন্দ্র দাস মহোদয় কিছুদিন আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে পেয়েছিলেন । সেই অনুষ্ঠানে আচমকাই দীপকদা আমাকে এবং নিতাই ভৌমিককে তাঁর সদ্যপ্রকাশিত গ্রন্থ 'হারিয়ে যাওয়ার আগে' তুলে দেন ।
আসলে আমি দীপকদাদের মতো অগ্রজদের স্নেহ এবং দিলীপচন্দ্র দাস স্যর এবং নিতাই ভৌমিকদের মতো অনুজদের শুভেচ্ছায় বাঁচার রসদ পাই ।
এই ভরসাতেই ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে পাঠকের রসভঙ্গ করার সাহস পাই ।
সবার জন্যে শুভকামনা ।
No comments:
Post a Comment