ত্রিপুরার প্রকাশনাশিল্প : ইতিহাস ও সাম্প্রতিক প্রবণতা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
মানুষের মননচর্চার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক গভীরভাবে সন্নিবিষ্ট । কোন জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের মাপকাঠি শুধু তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, মননচর্চার উৎকর্ষতার মধ্যেও তার উন্নয়ন নিহিত থাকে । মানুষের অনুভূতি, আবেগ, অভিজ্ঞতা, চিন্তা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, প্রকাশভঙ্গি, মনীষা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটে বইয়ের মাধ্যমে । বইকে সমাজ সভ্যতা থেকে আলাদা করে দেখলে পৃথিবীকে আবার আদিম প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ে চলে যেতে হবে । এবং সভ্যতা অচল, অসাড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে । সেই জন্য সভ্যতার অগ্রগমনকে অব্যাহত রাখার লক্ষ্যেই বই প্রকাশকে গুরুত্ব দেওয়া হয় । উন্নত ও সভ্য দেশসমূহে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বই প্রকাশকে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে । প্রাচীন রাজা-বাদশা-সম্রাটের আমলে জ্ঞানচর্চার জন্য বই প্রকাশের পৃষ্ঠপোষকতা করতে দেখা যায় । সে সময় হাতে লেখা মূল পান্ডুলিপি তৈরি করা হত । পরে মূল পান্ডুলিপি থেকে বহু অনুলিপি তৈরি হত । প্রাচীন রাজা-বাদশাদের রাজসরকারে মাসোহারাধারী কর্মচারী রাখা হত অনুলিখনের জন্য । তাদের 'করণ' বা 'করণিক' নামে পরিচিত হত । ত্রিপুরার মহারাজা ধর্মমাণিক্যের আমলে ( ১৪৩১ ১৪৬২ খ্রি. ) পন্ডিত শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর রাজপুরোহিত ও রাজার সভাপন্ডিত ছিলেন । মহারাজা ধর্মমাণিক্যের নির্দেশে চন্তাই দুর্লভেন্দ্রের সহায়তায় তাঁরা রাজমালা রচনা করেছিলেন ।
পরবর্তী সময়ে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথেই গ্রন্থপ্রকাশ সহজতর হয়ে ওঠে । ১৯০০ সালে বিশ্বের প্রাচীন মুদ্রিত গ্রন্থ 'হীরক সূত্র' পাওয়া যায় চীনের পশ্চিমাঞ্চলের তুং হুয়াং শহরের হাজার বুদ্ধের গুহায় । এই গ্রন্থটির মুদ্রণকাল ছিল ১১ মে ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ । কাঠ খোদাই করে এর লিপি লেখা হয়েছিল । এই গ্রন্থটি বুদ্ধের উপদেশাবলিতে পূর্ণ । ১৯০৭ সালে গবেষক ডক্টর অরেন স্টাইন এই পুস্তকটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম মুদ্রিত গ্রন্থ বলে প্রমাণ করেন ।
পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মানির গুটেনবার্গ ( ১৪০০-১৪৬৮ ) প্রথম আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন করেন । জার্মানিতে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার এর সাথে সাথে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে । তার ফলে সেসময় সারা ইউরোপের সর্বত্র প্রবল রেনেসাঁর জোয়ার দেখা দেয় । জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা সর্বক্ষেত্রেই এক অভূতপূর্ব বিপ্লব ঘটে যায় সমগ্র পশ্চিমাবিশ্বে । ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ।
ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন পর্তুগিজরা । ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের বছর অর্থাৎ মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ( ১৫৫৬-১৬০৫ ) ভারতে প্রথম ছাপাখানার প্রবর্তন করেন পর্তুগিজরা । ভারতে প্রথম ছাপা বইয়ের যে নিদর্শনটি পাওয়া যায় তা ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের ছাপা । বইটির নাম হল, 'কম্পেনডিও স্পিরিচ্যুয়াল দ্য ভিডা খ্রিস্টা' ( Compendio Espiritual da vida Christa ) । বইটি নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে । বাংলা ছাপাখানার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস । কোম্পানির কর্মচারীরা যাতে বাংলা ভাষা শিখতে পারে তার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস এর অন্যতম বন্ধু ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেব রচনা করেন, 'A grammar of the Bengali language' . বইটি ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বিদেশি বইব্যবসায়ী জন এন্ড্রুজ সাহেবের হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানা থেকে ছেপে বের হয় । বাংলা ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রথম বই এটি । মুদ্রাকর ছিলেন চার্লস উইলিকিনস । এন্ড্রুজের ছাপাখানায় বাংলাদেশের প্রথম ছাপাখানা । বাংলার দ্বিতীয় ছাপাখানা ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'কোম্পানির প্রেস' । ১৮০০ সালের ১০ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে স্থাপিত হয় শ্রীরামপুর মিশন । ওই বছরেই মার্চ মাসে উইলিয়াম কেরি 'শ্রীরামপুর মিশন প্রেস' নামে একটি ছাপাখানা খোলেন । এই মাসেই পঞ্চানন কর্মকারের সহযোগিতায় প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ 'মথী রচিত মঙ্গল সমাচার' ছাপা হয় মিশন প্রেস থেকে । উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাইবেল বাংলা ছাড়াও হিন্দি, অসমীয়া, উড়িয়া, মারাঠি প্রভৃতি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বই প্রকাশিত হয় এই প্রেস থেকে । ১৮৩৭ সালে এই ছাপাখানা টি বন্ধ হয়ে যায় ।
রাজন্য ত্রিপুরায়ও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নিদর্শন পাওয়া যায় । ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২-১৮৯৬ ) উদ্যোগে ত্রিপুরায় প্রথম মুদ্রণযন্ত্র অর্থাৎ ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । এই ছাপাখানা নাম ছিল 'বীর যন্ত্র' এই 'বীর যন্ত্র' থেকেই ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল 'গোবিন্দবাহ কৌমুদী' । বীরচন্দ্রের লেখা অকাল কুসুম ( ১৮৮৬ খ্রি. ) এবং ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল দুর্গামণি উজিরের 'রাজমালা' ।
আরো একটি তথ্য থেকে ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র ছাপার আগ্রহের কথা প্রকাশ পায় । ১৯৬১ সালের ২৫ শে বৈশাখ ( ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ ) ত্রিপুরার রাজ দরবার সেদিন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আশিতম জন্মদিবস পালন করেছিল । ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীর বিক্রমকিশোর মাণিক্য বাহাদুর সেদিনের অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে 'ভারত ভাস্কর' উপাধিতে ভূষিত করবেন । পাঁচ দিন পরে ( ৩০ বৈশাখ ) শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে আয়োজিত হয়েছিল সেই বিশেষ অনুষ্ঠান । অসুস্থ কবিকে সেদিন একটি হুইলচেয়ারে বসিয়ে সভাস্থলে আনা হয়েছিল । ত্রিপুরা রাজপ্রতিনিধিরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে কবির হাতে তুলে দিয়েছিলেন 'ভারত ভাস্কর' সম্মাননা এবং অর্ঘ । কবি ত্রিপুরার মহারাজার মানপত্র সসম্মানে গ্রহণ করেন । সেদিন কবির হাতে স্বাক্ষর করা ভাষণটি পাঠ করেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেই ভাষণে কবি উল্লেখ করেছিলেন—
"ত্রিপুরা রাজবংশ থেকে একদা আমি অপ্রত্যাশিত সম্মান পেয়েছিলাম তা আজ বিশেষ করে স্মরণ করবার ও স্মরণীয় করবার দিন উপস্থিত হয়েছে । এরকম প্রত্যাশিত সম্মান ইতিহাসের দুর্লভ । সেদিন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য এই কথাটি আমাকে জানাবার জন্য তাঁর দূত আমার কাছে প্রেরণ করেছিলেন যে, তিনি আমার তৎকালীন রচনার মধ্যে একটি বৃহৎ ভবিষ্যতের সূচনা দেখেছেন । সেদিন এ কথাটি সম্পূর্ণ আশ্বাসের সহিত গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল । আমার তখন বয়স অল্প; লেখার পরিমাণ কম। এবং দেশের অধিকাংশ পাঠক তাকে বাল্যলীলা বলে বিদ্রুপ করত । বীরচন্দ্র তা জানতেন এবং তাতে তিনি দুঃখবোধ করেছিলেন । সেজন্য তাঁর একটি প্রস্তাব ছিল লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি একটি স্বতন্ত্র ছাপাখানা কিনবেন এবং সেই ছাপাখানায় আমার অলংকৃত কবিতা সংস্করণ ছাপানো হবে । তখন তিনি ছিলেন কার্শিয়াং পাহাড়ে, বায়ু পরিবর্তনের জন্য । কলকাতায় ফিরে এসে অল্পকালের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয় ।"
বীরচন্দ্র মানিক্য তাঁর স্বপ্নের সেই ছাপাখানাটি করে যেতে না পারলেও তাঁর রাজত্বকালে 'বীর যন্ত্র' ছাড়াও 'ললিত যন্ত্র' নামে আরেকটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন । এরপরে ত্রিপুরায় পর্যায়ক্রমে স্থাপিত হয়েছিল রাজমালা প্রেস ও ত্রিপুরা স্টেট প্রেস । এই ছাপাখানাগুলো থেকে তখনকার সময়ে কিছু কিছু বইপত্র ছাপা হয়েছিল । ভারতভূক্তির পরে ত্রিপুরারাজ্যের আগরতলা ছাড়াও কৈলাসহর, উদয়পুর ও বিলোনিয়াতে ছোটো ছোটো ছাপাখানা স্থাপিত হয়েছিল । সেগুলো থেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছাপার কাজ না হলেও কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।
মূলত, ছাপাখানা থাকলেই প্রকাশনার গুরুত্ব বাড়ে । ছাপাখানাকে কেন্দ্র করেই প্রকশনাশিল্প উন্নতির পথ খুঁজে পায় । ত্রিপুরারাজ্যেও বিগত শতাব্দীর ছয়-সাতের দশক থেকে প্রকাশনাশিল্প উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির পথে এগোতে থাকে । ষাট সত্তরের দশকে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে সলিলকৃষ্ণ দেববর্মনের 'জলের ভেতর বুকের ভেতর', গল্পকার বিমল চৌধুরীর 'মানুষের চন্দ্র বিজয় ও তারানাথ' স্বপন সেনগুপ্ত-র ' নীল আকাশ : পাখী, প্রবীর দাস ও শ্রীবাস ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় কবিতা সংকলন 'এক আকাশ তারা', মিহির দেবের 'বাংলাদেশ, স্বদেশ ও আমি, কল্যাণব্রত চক্রবর্তীর কবিতার বই 'অন্ধকারে প্রণামের ইচ্ছা হয়',তাপস শীলের 'কার্বন লাইট', নকুল রায়ের শানিত দীপমল্লিকা, মানস পালের 'ঘুম নেই অরণ্য চোখে', অধ্যাপক কমলকুমার মিত্রের 'ক্রীড়াঞ্জলি' উল্লেখযোগ্য । এই সময়ে বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হতে থাকে । আটের দশকের শুরুতেই আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করেই ধীরে ধীরে ত্রিপুরার প্রকাশনা শিল্প মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে । প্রথমদিকে আগরতলা বইমেলায় প্রকাশিত রাজ্যের বিভিন্ন প্রকাশনীর বইগুলো পাঠকের খুব একটা আগ্রহ সৃষ্টি করতে না পারলেও বর্তমানে ত্রিপুরার প্রকাশিত গ্রন্থ দেশের তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ঈর্ষণীয় পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে ।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনাশিল্প ভীষণ বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে । করোনাকালীন সময় থেকেই প্রকাশনা শিল্পের বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে । তবে শুধু প্রকাশনাশিল্পই নয় । সারা বিশ্ববাজারে বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে । এক্ষেত্রে করোনা মহামারী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, টাকার মূল্যের অস্বাভাবিক পতন ইত্যাদি কারণে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে ব্যবসায়ী, ভোক্তা, লেখক, পাঠক প্রকাশক, সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত । বর্তমানে আর্থিক মন্দার বাজারে সংসারের প্রতিদিনের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সংগ্রহ করতেই মানুষ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন । ফলে পারিবারিক সমস্ত ব্যয়ভার নির্বাহ করে বই কেনার কথা ভাবতেই পারেন না পাঠকসমাজ ।
এছাড়া প্রকাশনা জগতের প্রতি বর্তমানে অনেকেই আকৃষ্ট হওয়ার ফলে এই শিল্পক্ষেত্রে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে । বই প্রকাশের বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে কাগজ, কালি, প্লেট ইত্যাদির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে । ফলে ব্যবসার পুঁজি এবং ঝুঁকি ও বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে । আগে যেরকম পাঁচশো হাজার কপি ছাপানো হত সেই জায়গায় বর্তমানে তা একশো কপিতে এসে দাঁড়িয়েছে । বেশি বই ছাপিয়ে কেউ এখন আর ঝুঁকি নিতে চান না । এখন প্রকাশনার ক্ষেত্রে 'প্রি বুকিং' চালু হয়েছে । বাজারের অবস্থা বুঝে বই ছাপানো হয় । কিছু কিছু প্রকাশক এখন আর ব্যবসা ক্ষেত্রে পুঁজি খাটাতে চান না । তাঁরা কইয়ের তেলে কই ভাজার মত লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপেন । টাকা নিয়ে বই ছাপাটা মোটেই দোষের কিছু নয় । 'আউটসোর্সিং' বিষয়টা এখন সব ব্যবসাতেই রয়েছে । তবে এতে প্রকাশকের কোন দায় থাকে না । এতে প্রকাশনাশিল্পের উৎকর্ষ ও লেখকের সৃজনশীলতার মানের মূল্যায়ন হয় না । টাকার বিনিময়ে প্রকাশক লেখক এর পান্ডুলিপির গুণগত মান যাচাই না করেই বই ছাপেন । আসলে যজমানের পয়সা দিয়েই একশ্রেণীর প্রকাশক তাদের নৈবেদ্য সাজান । তেল অনুযায়ী নির্ধারিত হয় ভাজা কতটা মুচমুচে হবে । বই প্রকাশের পূর্বাহ্নেই লেখকের সঙ্গে দর কষাকষি করে ঠিক করে নেওয়া হয় বইয়ের মান অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয়ের হিসাব । তার উপরে নির্ভর করে বইয়ের গুণগত মান, নির্ভুলভাবে প্রকাশ করার আগ্রহ, সুন্দর সম্পাদনা ইত্যাদি ।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশনা এবং মুদ্রণশিল্পে যুগান্তর সাধিত হয়ে গেছে । আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের সুবিধা নিয়ে এখন যে কোনো মুহূর্তেই ঝাঁ চকচকে বই প্রকাশ করা যায় যা এক নজরে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ । শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দন প্রকাশনাই গ্রন্থপ্রকাশের শেষ কথা নয় । বই প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও পেশাদারী মনোভাবের খুবই গুরুত্ব রয়েছে । বইপ্রকাশ এক ধরনের নেশা ও বটে । বই প্রকাশিত হয়ে পরিচিতি পেলে কিংবা মর্যাদা পেলে সেই প্রকাশককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না । ভালো বিক্রি হলে বই প্রকাশের উৎসাহ আরো বেড়ে যায় । প্রকাশনা জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় । পরিচিতি বেড়ে যায় । সমাজের মননশীল মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে । বলা যায়, প্রকাশকেরও যশের মহিমা রয়েছে । সেজন্যে বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে খুব সচেতন ভাবে কাজ করতে হয় । ভালো প্রকাশক হতে গেলে ভালো বইয়ের পান্ডুলিপির খোঁজ করতে হবে । ভালো লেখককে বই প্রকাশে উৎসাহিত করতে হবে ।
আমাদের রাজ্যে প্রকাশনাশিল্পের তেমন দৈন্যদশা না থাকলেও হাতেগোনা অল্প কয়েকটি সংস্থা সুপরিকল্পিতভাবে বই প্রকাশ করেন । দায়িত্বশীল ও পেশাদারী মনোভাবাপন্ন প্রকাশকের অভাব রয়েছে এই রাজ্যে । আমাদের রাজ্যের মধ্যে গুণগত মানের প্রকাশনার চাইতে সংখ্যাগত দিক দিয়ে বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করার আগ্রহ বা মানসিকতা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে । এটা বাস্তব যে, অধিক সংখ্যক বই একবারে প্রকাশ করলে সবগুলোর ক্ষেত্রে বইয়ের গুণগত মানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায় না । প্রকাশনার বাজারটি প্রতিযোগিতামূলক । তবে সংখ্যাগত দিকের প্রতিযোগিতা নয় । গুণগত মানের দিকের প্রতিযোগিতা । এই কথাটা প্রকাশককে মনে রাখতে হবে ।
আমাদের রাজ্যে বইপ্রকাশের ক্ষেত্রে সাহিত্যের সকল শাখায় ততটা বিস্তৃত নয় । সৃজনশীল প্রকাশনার একটি সংকট এই রাজ্যে রয়েই গেছে । আমাদের এখানে সাহিত্যসমালোচনার ধারাটি এখনো সংগঠিত হয়ে ওঠেনি । সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে যেমন ধ্রুপদী সাহিত্য সমূহের সমালোচনা থাকবে, তেমনি ত্রিপুরার বুকে স্থানীয় লেখকরা যে সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি করছেন তারও সমালোচনামূলক গ্রন্থ থাকা দরকার । তবেই তো রাজ্যের সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি, লেখকদের সৃজনশীলতা সম্পর্কে বহির্রাজ্যের পাঠকরা জানতে পারবেন । পাশাপাশি লেখকরা ও বৃহত্তর ও পরিসরে আলোচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন । এতে তাঁরা সাহিত্যসৃষ্টিতে আরও বেশি উৎসাহিত হবেন । তবে সম্প্রতি রাজ্যের সমালোচনাসাহিত্যের অঙ্গনে বেশ কয়েকজন এ প্রজন্মের প্রতিনিধি উঠে এসেছেন । তাঁদের মধ্যে তমালকিশোর দে, সুস্মিতা দাস, সৌম্যদীপ দেব, রণিতা নাথ প্রমুখগণ এই ধারাটি সমৃদ্ধ করার জন্য এগিয়ে এসেছেন । এর দ্বারা প্রকাশকরা ও উপকৃত হবেন । ভালো লেখক ও তাঁরা নির্বাচন করতে পারবেন । সাহিত্য ক্ষেত্রে সমালোচনাসাহিত্য যত সমৃদ্ধ হবে সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তত সুদৃঢ় হবে ।
মননশীল ও সৃজনশীল লেখক তৈরীর ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সরকারি তরফে লেখককে উৎসাহ দেওয়া, লেখকের গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশককে বিশেষ কিছু সুযোগ ও আর্থিক অনুদান প্রদান করা যেতে পারে । সরকার উদ্যোগী হয়ে বই কিনে নিলেও প্রকাশক উপকৃত হন । কিন্তু কখনো কখনো প্রকাশনাশিল্পে সরকারি একদেশদর্শিতা লক্ষ্য করা যায় । যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন তখন তাঁর নিজ দলের মতাদর্শের অনুসারী লেখক বা প্রকাশকের বই বেশি করে সরকারি উদ্যোগে কিনে নেওয়া হয় । বিগত দিনগুলোতে রাজ্যে এই ধরনের প্রবণতার ভুরি ভুরি উদাহরণ দেওয়া যায় । প্রকাশকরা ও বিক্রয়ের ও ব্যবসার আশায় সেই অনুযায়ী লেখক নির্বাচন করেন । তাতে ব্যবসার ঝুঁকি থাকে না । সৃজনশীল প্রকাশনাকে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ স্পষ্ট থাকা দরকার । সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গন যেন রাজনৈতিক মতবাদ প্রভাবিত না হয় সেই দিকে সরকার খেয়াল রাখতে পারেন ।
প্রকাশনাশিল্পকে শুধু শিল্প হিসেবেই মনে করলে চলবে না । সমৃদ্ধ ও সুশিক্ষিত জাতিগঠনে প্রকাশনাশিল্পের বিরাট ভূমিকা রয়েছে । সেক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যেমন জরুরি তেমনি প্রকাশকদেরও বিভিন্ন গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন । দেশে ও বিদেশে বহু প্রকাশন সংস্থা দেশের সৃজনশীল চর্চাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকেন । বইমেলা, গ্রন্থপ্রকাশ, বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার, সম্মেলন, লেখকদের সম্মানিত করা ইত্যাদি প্রকাশক সংস্থাগুলো নিয়মিত করে থাকেন । ত্রিপুরারাজ্যে প্রকাশকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন রয়েছে । সৃষ্টিশীল কাজ ও প্রকাশনাকে জনপ্রিয় করার জন্য তাঁরাও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন । কিন্তু তা যথেষ্ট নয় । প্রকাশকদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু রাজ্যিক বা জাতীয় স্তরের কাজ করা দরকার । প্রকাশকদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় স্তরের সম্মেলন, সমাবেশ ইত্যাদি করলে তার বিস্তৃতি লাভ ঘটে । বিভিন্ন রাজ্যের লেখক, পাঠক এক মঞ্চে এলে পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় সম্ভবপর হয় । রাজ্যের প্রকাশকরা বহির্রাজ্যের লেখকের গ্রন্থও এতে প্রকাশ করার সুযোগ পান । আবার বহির্রাজ্যের প্রকাশকও এই রাজ্যের লেখককে বড় পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে পারেন ।
প্রকাশকদের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ইচ্ছে করলে লেখকদের কাছ থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে প্রকাশনা চালিয়ে যেতে পারেন । তাতে সবাই একযোগে এগিয়ে যেতে পারবেন । লেখকের পান্ডুলিপি নিয়ে বসে পর্যালোচনা করার সময় লেখককে সামনে রেখে তাঁর সৃষ্টিকে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় এ বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন প্রকাশক সংগঠন । প্রয়োজনে লেখককে সহায়ক পুস্তক সরবরাহ করা যেতে পারে । এছাড়া প্রকাশকদের সম্মিলিত মঞ্চ থেকে প্রকাশনার দায়িত্বও নেওয়া যায় । সমষ্টির পুঁজিতে প্রকাশনা চললে কোন একক উদ্যোগীর কাঁধে আর্থিক চাপ পড়ে না । প্রকাশনাশিল্পের সঙ্গে যাঁরা সরাসরি যুক্ত থাকেন তাঁরাই বোঝেন এই শিল্পের সমস্যাটা কোথায় ? এ ব্যাপারে সরকারি কোনোরকম সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন হলে তা প্রকাশকরা সম্মিলিতভাবে সরকারের গোচরে আনতে পারেন । প্রকাশনাশিল্পের প্রয়োজনীয় উপকরণ ভর্তুকিতে পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন । প্রসঙ্গত, আগরতলা বইমেলাকে কেন্দ্র করে একটা অংশের প্রকাশকের সঙ্গে সরকারের যে মান অভিমানের পালা চলছে হাঁপানিয়াতে বইমেলা স্থানান্তরিত করায় । সেক্ষেত্রে মেলার স্টল গুলোর ভাড়ায় কিছুটা ছাড় দিলে বোধহয় এই প্রকাশকদের মান ভাঙবে । সেমিনার, সম্মেলন করার ক্ষেত্রে হল ভাড়া মুকুব, সরকারি উদ্যোগে অতিথিদের খাওয়া-থাকার ব্যবস্থা, এ ধরনের আরও বহু বিষয়ে প্রকাশকগণ সম্মিলিতভাবে সরকারকে জ্ঞাত করতে পারেন । এর দ্বারা রাজ্যের প্রকাশনাশিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে । পাশাপাশি রাজ্যের মননশীল লেখালেখির উন্নয়ন ঘটবে । প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে লেখক ও পাঠকের সরাসরি যোগ ঘটে । প্রকাশক বুঝেন পাঠকের রুচি । পাঠক মনস্তত্ত্ব বুঝে প্রকাশক লেখককে উৎসাহিত করবেন । সৃজনের ফসল পেতে এক কথায়, প্রকাশন শিল্পই 'পান্ডুলিপি পরে আয়োজন ।'
No comments:
Post a Comment