কবিতায় রোমান্টিক ভাবনা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
কবিতার মধ্যেই ফুটে উঠে কবির কাব্যব্যক্তিত্ব । কবি তাঁর কল্পনার পরিধিবিস্তারের মাধ্যমে তাঁর কাব্যপ্রতিভার স্বকীয়তাকে প্রকাশ করেন । এই প্রকাশের মূলে রয়েছে কবির ভাবনার সুদূরপ্রসারের ক্ষমতা । যার দ্বারা কবি নিজেকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে নির্মাণ করেন । এই আশ্চর্য কল্পনাপ্রবণতাকে সাহিত্যের ভাষায় রোমান্টিকতা বা রোমান্টিজম বলে । রোমান্টিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক হার্বাট বলেছেন, an extraordinary development of imaginative sensibility. কল্পনাপ্রবণতার ব্যতিক্রমী উন্নয়ন হল রোমান্টিজম । ওয়াটস ডাল্টন যেটাকে বলেন, Renascnce of wonder. অর্থাৎ বিস্ময়ের আবির্ভাব । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ ।'
বাংলা কাব্যের প্রথমদিকের গীতিকবিদের কাব্য ভাবনা রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন । পরবর্তী সময়ে বাংলা কাব্যপ্রবাহ অনেক দূর এগিয়ে গেছে । রোমান্টিকতা কবিতার প্রধান উপজীব্য হলেও তার প্রকাশভঙ্গিতে বহু পরিবর্তন হয়ে গেছে । পরিবর্তনই হল আধুনিকতা । প্রকাশভঙ্গির আধুনিকতায় কবিকে স্বকীয়তায় চিহ্নিত করে ।
কবি মায়া মজুমদার একজন সহজ সরল গ্রাম্য গৃহবধূ । জীবনের দীর্ঘসময় কর্মব্যস্ততায় নিজের সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকেছেন এবং সমাজসেবা মধ্যে মগ্ন থেকেও দীর্ঘদিন নীরবে কাব্যচর্চা চালিয়ে গেছেন ।জীবনের শেষ পর্বে এসে তাঁর কবিতাকে বৃহত্তর পরিসরে প্রকাশের প্রতি ঝুঁকেছেন । এই শতাব্দীর প্রথম দশকের শেষার্ধ থেকে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা প্রকাশে মনোনিবেশ করেছেন । সর্বাধুনিক সময়কালে বসে কবিতা রচিত হলেও তাঁর কবিতা কিন্তু সেই অনুযায়ী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না । এখনো তাঁর কবিতা প্রাক-আধুনিক কবিদের গীতিকবিতার লক্ষণাক্রান্ত বলা যেতে পারে । কিন্তু তাঁর অন্তর্মুখী নিভৃত সৃষ্টিতে তিনি বিরত নেই সেটাই বড়ো কথা ।
সময়ের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও দীর্ঘকালব্যাপী কবির কাব্যচর্চার নিরন্তর প্রয়াসের ফলশ্রুতিতেই ইতোমধ্যে তাঁর তিন তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে গেছে । তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে 'এই তো জীবন' এবং 'নীল মেঘের বেদনা' প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের আগরতলা বইমেলাতে এবং তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'থমকে যাওয়া মন' প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি ২০২২ এ । তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে ছাপ্পান্নটি করে কবিতা রয়েছে । সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব নির্বাহ করে বহু লিখিত কবিতা থেকে ঝাড়াই বাছাই করে একশো আটষট্টিটি কবিতা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা একজন গৃহবধূর পক্ষে অসাধ্যসাধনই বলা যেতে পারে নিরন্তর সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে যুক্ত থাকার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে । একারণে কবির এই দুরূহ প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাতেই হয় । তাঁর কবিতাগুলোর প্রায় সব কয়টি একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে । আলাদা করে নাম না করেও বলা যায় যে, তাঁর কবিতায় প্রধানত যে ভাবনাগুলো উঠে এসেছে তা হল–
১. কবিতায় তাঁর নিজস্ব ভালোলাগা মন্দলাগার প্রকাশ
২. জীবনের বাস্তবতাকে নির্মমভাবে প্রত্যক্ষ করে নিজের অতৃপ্তি ও অসন্তোষের প্রকাশ
৩. প্রকৃতির সজীব ও চৈতন্যময় সত্তার স্ফুরণ
৪. আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের উপাসনা
৫. কখনো কখনো বিষন্নতা ও নিঃসঙ্গবোধ
তিনটি কাব্যগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমেই কবিকে স্বতন্ত্রতায় চিহ্নিত করা যাবে । আলোচিত তিনটি কাব্যগ্রন্থই অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় রচিত এবং পড়ে ভালো লাগবে । প্রতিটি গ্রন্থ ই প্রকাশিত হয়েছে ত্রিপুরার বিশিষ্ট প্রকাশন সংস্থা 'মৌমিতা প্রকাশনী', আগরতলা থেকে ।
No comments:
Post a Comment