Tuesday, May 2, 2023

হৃদয়ের কথা বলিতে..

হৃদয়ের কথা বলিতে...




ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের । ত্রিপুরার রাজপরিবারের মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) থেকে শুরু করে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য ( ১৮৯৬–১৯০৯ ), বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ( ১৯০৯–১৯২৬ ), এবং মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মাণিক্য ( ১৯২৬–১৯৪৭ ) পর্যন্ত পরপর চারজন রাজার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত নিবিড় সম্পর্ক ছিল । প্রকৃতপক্ষে এই সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথের সময় থেকে । বীরচন্দ্র মাণিক্যের পিতা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য ( ১৮৩০–১৮৪৯ ) হঠাৎ করে একটি সমস্যায় পড়ে যান । ১৮৩৬ সালে তৎকালীন চট্টগ্রামের কমিশনার হঠাৎ করে ঘোষণা করেন যে, ত্রিপুরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশীয় রাজ্য । মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্য এই ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন । তিনি জানান যে, ত্রিপুরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য । কখনোই ব্রিটিশ সরকারের অন্তর্ভুক্ত ছিল না । ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে ত্রিপুরারাজ্যকে রক্ষা করার জন্য সে সময়ে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মাণিক্য তখনকার প্রখ্যাত আইনজীবী প্রিন্স দ্বারকানাথের কাছে আইনি সাহায্য প্রার্থনা করেন । সেসময় ব্রিটিশের কবল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য ত্রিপুরাকে রক্ষা করার জন্য প্রিন্স দ্বারকানাথ ত্রিপুরার মহারাজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং ব্রিটিশকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছিলেন । এ কারণে ত্রিপুরার রাজন্যগণ শুধু নয়, ত্রিপুরার জনগণ ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ ।


 রবীন্দ্রনাথের পিতামহের সঙ্গে যে ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মাণিক্যের নিবিড় সম্পর্ক ছিল একথা রবীন্দ্রনাথ জানতেন । তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ত্রিপুরার রাজপরিবারের পুরনো সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যকে চিঠি লিখেও জানিয়েছিলেন ।


 ১২২৯ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রধানা মহিষী ভানুমতী দেবীর প্রয়াণ ঘটে । প্রিয় পত্নীর মৃত্যুতে বীরচন্দ্র গভীরভাবে শোকাহত হয়ে পড়েছিলেন । এই সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ে রবীন্দ্রনাথের 'ভগ্নহৃদয়' কাব্যটি । কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে তিনি তাঁর অকালপ্রয়াতা পত্নী বিয়োগের শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন । মহারাজা বীরচন্দ্রের বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ বছর । মহারাজা বীরচন্দ্র ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো বয়স্ক কোনো কবি । তিনি যে মাত্র কুড়ি বছর বয়সের একজন তরুণ কবি তা মহারাজা বীরচন্দ্র ধারণাও করতে পারেননি । মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করে তাঁকে 'কবি' হিসেবে সম্মান জানানোর জন্য তাঁর ব্যক্তিগত সচিব রাধারমন ঘোষকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে পাঠান । রবীন্দ্রনাথও সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনের প্রথম সম্মান লাভের সুযোগে আপ্লুত হয়ে পড়েন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'জীবনস্মৃতি'তে এই ঘটনার কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন । উনিশ শতকের শেষ ভাগে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ রবীন্দ্রনাথকে কবি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন । 


মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের গভীর সখ্যতার সৃষ্টি হয় । রবীন্দ্রনাথ সে সময়ে নানাভাবে ত্রিপুরার রাজাকে সহায়তা করে গেছেন । এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রগবেষক বিকচ চৌধুরী মহাশয় তাঁর 'রবীন্দ্র সান্নিধ্যে ত্রিপুরা' গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেছেন । তিনি লিখেছেন–


" রাজকোষের সংকট, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিঘ্ন, ইংরেজ সরকারের কুমন্ত্রণা, রাজকুমারদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা, মন্ত্রী নিয়োগ, প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার ইত্যাদি নানান সমস্যার জাল থেকে এই ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে মুক্তি দেবার দুরুহ ব্রত রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন । আর কি বিপুল নিষ্ঠায় তিনি তা পালন করেছিলেন তা ভেবে আজও অবাক হতে হয় । রবীন্দ্রনাথের এই বিরল বিচিত্র প্রতিভার স্বাক্ষর গোটা রবীন্দ্রকান্ডের মধ্যে আর কোথাও কোনোভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না । ত্রিপুরা এখানেই এক অনন্য গৌরবের অধিকারী । এই দুর্লভ গৌরবের দাবি কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতেই বারবার ধন্য হয়েছে ।"


মহারাজা বীরচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় এর সূত্রপাত হলেও মহারাজা রাধা কিশোরের মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১৪ চৈত্র ( ২৭ মার্চ ১৮৯৯ ) সাল মাসে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ত্রিপুরায় পদার্পণ করেন । দ্বিতীয়বার আসেন ১৩০৮ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে মহারাজ রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই । পুনরায় রাধাকিশোর মাণিক্যের আমন্ত্রণেই ১৩১২ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে এসে ত্রিপুরা সাহিত্য সম্মিলনীর সভায় সভাপতিত্ব করেন । চতুর্থবার তিনি আসেন ১৩১২ বঙ্গাব্দের ১৭ কার্তিক রমনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের রাজমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হওয়ার দিন । ১৩১২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে বরিশালে 'প্রাদেশিক বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে' সভাপতিত্ব করতে যাওয়ার পথে তিনি পঞ্চমবার ত্রিপুরায় আসেন । এরপর ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে কবি পূর্ব বঙ্গ, শ্রীহট্ট ভ্রমণের পর ত্রিপুরায় আসেন । সপ্তমবার অর্থাৎ শেষবার রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় আসেন ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১০ ফাল্গুন মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোরের আমন্ত্রণে । সেবার কবিকে কিশোর সাহিত্য সমাজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় ।


গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় পদার্পণের বর্ষটি থেকে হিসাব করলে এই বছর তা একশো পঁচিশতম বর্ষে পদার্পণ করল । কবির ত্রিপুরায় পদধূলি দেওয়ায় ত্রিপুরা পূণ্য কবিতীর্থে পরিণত হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ যেমন ত্রিপুরাকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন তেমনি ত্রিপুরার মানুষও রবীন্দ্রনাথকে তাঁদের আত্মার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথে নিয়েছেন । রবীন্দ্র পদধূলি ত্রিপুরার মাটিকে অভিষিক্ত করার ইতিহাস কে স্মরণীয় করার লক্ষ্যেই এই গ্রন্থ রচনার প্রয়াস । এব্যাপারে আমাকে নানা তথ্য ও প্রচুর সহায়ক গ্রন্থ সরবরাহ করে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করেছেন রাজ্যের বিশিষ্ট কবি ও প্রকাশক গোবিন্দ ধর । তাছাড়া তাঁর মননশীল প্রকাশনা 'স্রোত' থেকে গ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন । গ্রন্থে লিখিত প্রতিটি প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথের ত্রিপুরায় অবস্থানের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটগুলি উপস্থাপন করার প্রয়াস নিয়েছি । গ্রন্থটি পাঠ করে সুধী পাঠক সমাজ যদি ত্রিপুরায় রবীন্দ্র পদার্পণের সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ত্রিপুরার আন্তরিক সম্পর্কটি অনুধাবন করতে পারেন তাহলেই আমার শ্রম সার্থক হবে বলে আমি মনে করি ।

                                                                            


     ২৬ মে, ২০২৩

আগরতলা, ত্রিপুরা                                         

                                



                           ‌‌                                    রবীন্দ্রানুগত

                                                        অশোকানন্দ রায় বর্ধন

No comments:

Post a Comment