Friday, August 11, 2023

লোকসাধারণের শিল্পী বিশ্বকর্মা : মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের আলোকে

লোকসাধারণের শিল্পী বিশ্বকর্মা :   মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যের আলোকে

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী । পুরাণে তিনি স্বর্গের একজন দেবতা । স্বর্গ মর্ত্যে নির্মাণ ও যন্ত্রপাতির দেবতা তিনি । কারিগরি সকল বিদ্যা বিশ্বকর্মার হাতে । ব্রহ্মাপুত্র বিশ্বকর্মা গোটা বিশ্বের নকশা তৈরি করেন । ঈশ্বরের প্রাসাদের নির্মাতাও বিশ্বকর্মা । মহাভারত অনুযায়ী বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পকলার দেবতা । সকল দেবতার প্রাসাদ, সকল প্রকার অলংকারের নির্মাতা । স্বর্গের অন্যান্য দেবতাদের ন্যায় বিশ্বকর্মারও পূজা হয় ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে অর্থাৎ কন্যাসংক্রান্তিতে । সাধারণত দু'ধরনের বিশ্বকর্মা পূজা হয় । 'তাঁত বিশ্বকর্মা' ও 'লোহা বিশ্বকর্মা' । শারদীয়ার আগে পূজা করা হয় 'লোহা বিশ্বকর্মাকে' । এই বিশ্বকর্মা চতুর্ভুজ এবং বাহন হাতি । আর 'তাঁত বিশ্বকর্মা' পূজা হয় শারদীয়া মহানবমীর নব্বই দিনের মাথায় । এই 'তাঁত বিশ্বকর্মা'র দুটি হাত মাত্র । এর বাহন ঘোড়া । এক হাতে তাঁতের মাকু ও লাটাই । অন্য হাতে চাবুক । বিশ্বকর্মা পূজা এলে বাংলার আকাশ বাতাস মেতে উঠে রংবেরঙের ঘুড়িতে ।

ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের দুটি বিশিষ্ট সূক্তে ( ৮১, ৮২ ) বিশ্বকর্মাকে স্তব করা হয়েছে । ঋগ্বেদ অনুসারে তিনি সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ । তাঁর চক্ষু, মুখমন্ডল, বাহু ও পদ সর্বদিকে পরিব্যাপ্ত । তিনি বাচস্পতি মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত । তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি । কোনো কোনো পুরাণে উল্লেখিত আছে বিশ্বকর্মার পিতা প্রভাস । প্রভাস হলেন অষ্টবসুর একজন । আর বিশ্বকর্মার মাতা হলেন বরবর্ণিনী । বরবর্ণিনী হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী । আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । আবার কোথাও বলা হয়েছে শিবের শরীর থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বিশ্বকর্মা । বিশ্বকর্মার জন্ম ও পিতামাতা সম্বন্ধে নানা গ্রন্থে নানা মত রয়েছে । ফলে তা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে । আসলে আমাদের বেদ পুরাণগুলোই আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিচ্ছে । এরকম অন্যান্য বহু দেবদেবীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় । বেদের মতো চারটি উপবেদও আছে । উপবেদ গুলো হল, আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গন্ধর্ববেদ ও স্থাপত্যবেদ । এই স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুবিদ্যার রচয়িতা হলেন বিশ্বকর্মা । বিশ্বকর্মার নামে প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রটির নাম "বিশ্বকর্মা বাস্তুশাস্ত্রম" । বাস্তুশাস্ত্রের শুরুতেই উল্লেখ আছে, 'জগতের কল্যাণ কামনায় এই শাস্ত্র প্রচার করেছেন' । 'বাস্তুশাস্ত্রং প্রবক্ষ্যামি লোকানাং হিতকাম্যায়া' । বিশ্বকর্মা অগস্ত্য মুনির ভবন, কুবেরের অলকাপুরী ও দিব্য বিমান, রাবণের স্বর্ণালংকা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাপুরী । রাবণের রাজপ্রাসাদের সাথে সুন্দর উদ্যান, গোষ্ঠ, মন্ত্রণাগৃহ, মনোরম ক্রীড়াস্থান, রাজপ্রাসাদের কারুকার্য ইত্যাদি নিখুঁতভাবে রচনা করেন । তাঁর অপর নিখুঁত নির্মাণ হল দেবপুরী । যে ধনুক দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন সেই ধনুক বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । বৃত্রাসুরকে বধ করার জন্য বিশ্বকর্মা দধীচি মুনির অস্থি থেকে বজ্র নির্মাণ করে দেবেন্দ্রকে দিয়েছিলেন । শিবের ত্রিশূল বিশ্বকর্মার সৃষ্টি । মহিষাসুরকে বধ করার জন্য দেবী মহামায়াকে তীক্ষ্ণ বর্শা, অভেদ্য কবচ,পরশু এবং বহু মারণাস্ত্র বিশ্বকর্মা দিয়েছিলেন । পুরীর জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরিতেও তিনি হাত লাগিয়েছিলেন বলে কথিত আছে । কিন্তু রাজার অতিরিক্ত ঔৎসুক্যের কারণে সেই মূর্তি অসমাপ্ত রাখতে হয় বিশ্বকর্মাকে ।

বিশ্বকর্মা বিয়ে করেছিলেন ব্রহ্মার কন্যা বিশ্বকলাকে । বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে । এরা হলেন ঠাটের ( যারা পাথরের কাজ করেন  ), সোনার ( স্বর্ণকার বা স্যাকরা ), বারহাই ( ছুতোর ), মকান ( কারিগর বা রাজমিস্ত্রি ), কুমহার ( কুম্ভকার বা কুমোর ) । তবে অন্যান্য সূত্রে উল্লেখ রয়েছে বিশ্বকর্মার পাঁচ ছেলে হল, লোহার, কারাই, সালট, গুর্জর ও সাইভেস্ত । বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে, লোহার নাকি বিশ্বকর্মার ছেলে নয় । আসলে বিশ্বকর্মা নিজেই নাকি লোহার । তিনি উপবীত ধারণ করেন । পদ্মাপুরাণ অনুসারে বিশ্বকর্মার পুত্র দৈত্যশিল্পী ময়দানব । আবার রামায়ণ অনুসারে বানরশিল্পী নল ও নীল বিশ্বকর্মার পুত্র । বিশ্বকর্মার স্ত্রী এক বানরী ।ক্ষণিক প্রেমের ফলশ্রুতিতে বিশ্বকর্মার ঔরসে বানরীর গর্ভে নল ও নীল নামে দুই সন্তান জন্মগ্রহণ করে । তারা রামরাবণের যুদ্ধে ইন্দ্রজিতের হাতে নিহত হয়েছিলেন । বাংলার লোকাচারে ব্রহ্মার প্রতিমার দুইপাশে নল ও নীল মানুষরূপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ।

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে বিশ্বকর্মা ও তাঁর স্ত্রী ঘৃতাচী দুজনেই শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন । ঘৃতাচী ছিলেন স্বর্গের নর্তকী । তিনি এক গোপকন্যা হিসেবে প্রয়াগে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁদের নয়টি সন্তান । যথা– মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শংখকার, সূত্রধর, কুবিন্দক, কুম্ভকার, স্বর্ণকার ও চিত্রকার । বিশ্বকর্মা প্রত্যেককেই নানা শিল্প শিক্ষা দান করেন । তিনি মালাকারকে পুষ্পশিল্প, কর্মকারকে লৌহশিল্প, কাংস্যকারকে কাংস্যশিল্প, শঙ্খকারকে শঙ্খশিল্প, সূত্রধারকে দারুশিল্প, কুবিন্দককে বয়নশিল্প, কুম্ভকারকে মৃৎশিল্প, স্বর্ণকারকে অলংকারশিল্প, চিত্রকারকে অঙ্কনশিল্প শেখান ।

শাস্ত্র ও পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মাকে দেবশিল্পীর মর্যাদা দেওয়া হলেও দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বকর্মা মানব সমাজের বিভিন্ন লোকশিল্পীর জনক ও শিক্ষক । সমাজে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যে সমস্ত শিল্পোপকরণ নির্মাণ ও ব্যবহার করে থাকেন সেগুলোই লোকশিল্প । এই লোকশিল্প সমাজের নানা প্রয়োজনে সৃষ্টি হয় । পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অন্তরের সৌন্দর্যপ্রতিভারও প্রকাশ  ঘটায় । এই লোকশিল্পের মাধ্যমে লোকশিল্পীদের মধ্য থেকে সমাজে কিছু বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়ও গড়ে ওঠে । গ্রাম জনপদে এইসব শিল্পীরা তাদের নানারকম শিল্পকর্মকে জীবিকারূপে গ্রহণ করে থাকেন । তার ফলে সমাজে কিছু পেশাজীবী সম্প্রদায়েরও সৃষ্টি হয় । লোকপ্রযুক্তিতে দক্ষ  এইসব লোকশিল্পীর শিল্পসত্তার উৎসে আমরা বিশ্বকর্মাকেই পাচ্ছি । ফলে বিশ্বকর্মাকে আমরা শুধুমাত্র দেবশিল্পী না বলে তাঁকে লোকশিল্পীও বলতে পারি । তিনি শুধুমাত্র শিল্পী নন । দক্ষ শিল্পী, সংগঠক ও শিল্পশিক্ষকও বটে । পুরাণমতে তিনি শাপভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করে থাকলে তিনি তো মর্ত্যের মানবই । পেশাদারী বৃত্তিতে নিয়োজিত লৌকিক শিল্পীদের গুরু । বৃত্তিজীবী সম্প্রদায়ের লোকশিল্পাচার্য  ।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যগুলোতে আমরা দেখি যে, যখনি কোনো নির্মাণ বা স্থাপত্য কর্মের প্রয়োজন হয় তখনই বিশ্বকর্মার ডাক পড়ে । বিশ্বকর্মা যে সেকালে বাস্তুশাস্ত্রবিশারদ ছিলেন তা শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে জানা যায় । সেকারণে মধ্যযুগীয় কাব্য সমূহের ঘটনাক্রমের বর্ণনায় নির্মাণশৈলীর প্রয়োজনে বিশ্বকর্মার ডাক পড়ত । মালাধর বসুর 'শ্রীকৃষ্ণবিজয়' কাব্যে 'দ্বারকা নির্মাণ' অংশে আমরা দেখি, জরাসন্ধের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সমুদ্রের তীরে দ্বারকাপুরী নির্মাণের জন্য কৃষ্ণ ও বলরাম বিশ্বকর্মাকে দায়িত্ব অর্পণ করেন ।এখানে বিশ্বকর্মা পরিখা, প্রাচীরবেষ্টিত গড় নির্মাণ করেন । দ্বারকাপুরী নির্মাণের বর্ণনায় পাই–"গোঁসাঞির আজ্ঞা সিরেতে বন্দিয়া ।/ বিশ্বকর্মা রচে পুরী বৈকন্ঠ ভাবিয়া ।।/ বিচিত্র চৌখন্ডি ঘর দেখিতে সুন্দর ।/ আকাস মন্ডল পাইল গোঁসাঞির ঘর ।।/সমুদ্রের যথাযথ রত্ন দ্রর্ব্য ছিল ।/ সমুদ্র আনিয়া দ্রর্ব্য তড়িত জোগাইল।।/  নাটশাল পাকশাল অতি সুশোভিত ।/ চতুস্বালা সুখশালা কনক রচিত ।/  উগ্রসেন রাজধানী তিরপাট কৈল ।/ অক্রুর উদ্ধবের ঘর বিচিত্র বনাইল ।/ পাত্র মিত্র বন্ধুগণ যতেক আছএ ।/ মথুরা নগরের লোক যতেক বসএ ।/ একে একে রচিল সভাকার ঘর ।/ গড় পরিখা দুর্গ করিল গদাধর।।/.............../চিত্রবিচিত্র হইল দেখিতে নগর ।/ দ্বারকা বলিয়া নাম থুইল গদাধর ।।/ দ্বিতীয় বৈকন্ঠ হৈল পুরি অনুপাম ।/ মহাদুর্গ পুরী হৈল দ্বারাবতী নাম ।

পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে বিশিষ্ট কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ । বিশ্বকর্মা কর্তৃক লোহার বাসর নির্মাণের একটি সুন্দর বর্ণনা তাঁর কাব্যে পাই– 'নানা অস্ত্র সঙ্গে আছে, লৌহ কাটে লৌহ চাঁচে, লোহার বাসর গড়ে।/  লোহার বান্ধিল পাড়ি, বন্ধন করিল সিঁড়ি, লোহার দেওয়াল চারিভিতে । –বাসর ঘরটি লোহার চাল, লোহার মেঝে যুক্ত, লোহার দেওয়াল জুড়ে কুলুঙ্গি । লোহার কপাট ও খিলযুক্ত দরজাকে শক্ত করতে 'করিয়া লোহার কপাট, দিল চারি চৌকাঠ, বজ্র সম গঠন বিরাজ ।'–রূপে নির্মাণ করেন । শুধু তাই নয়, বিশ্বকর্মা এখানে হনুমানের সহায়তা নিয়ে শত শত শাল, পিয়াশাল কাঠ যোগাড় করে সমুদ্রযাত্রার উপযুক্ত ডিঙাও বানিয়েছিলেন ।

মনসামঙ্গলের আরেকজন কবি বিজয়গুপ্ত । তাঁর লিখিত 'পদ্মপুরাণে' 'বিশ্বকর্মা কর্তৃক জয়ন্তীনগরের মনসার পুরী নির্মাণ' পর্বে মনসার নির্দেশে বিশ্বকর্মার পুরী নির্মাণের প্রসঙ্গ আছে– 'পদ্মার আদেশ বিশাই যখন শুনিল ।/  আপনার অস্ত্র লয়ে জয়ন্তীতে গেল ।।/  বিশ্বকর্মা বলে শুন দেবী বিষহরি ।/ যে কর্ম করিতে কহ সেই কর্ম করি ।।/বিষহরি বলে যদি রাখ মোর মান ।/ সুন্দর করিয়া গড় পুরী একখান ।।/  .................../কহিলা যদি দেবী বিষহরি ।/ বিশ্বকর্মা আপনে নির্মাণ করে পুরী ।/ অতি সুললিত পুরী দেখিতে সুঠাম ।/ সুন্দর রতনপুরী করিল নির্মাণ ।।/......................./ দেউড়ি বিস্তর বিশাই করে স্থানে স্থান ।/সুবর্ণ খচিত ঘর করিল নির্মাণ ।।/– বিশ্বকর্মা পুরী নির্মাণের পাশাপাশি ঘাটবাঁধানো সরোবরও খনন করে দিয়েছিলেন ।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চন্ডীমঙ্গলে' বিশ্বকর্মা দেবী চণ্ডীর জন্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । সেই মন্দিরে শ্বেতচামরও রেখেছিলেন । কবির ভাষায় পাই, 'ধবল চামর দিল ত্রিসক  পতাকা ।/ রাকাপতি বেড়ি যেন ফিরএ বলাকা ।।/–এই কাব্যে কবি পুরীনির্মাণ এবং কালকেতুর গৃহনির্মাণের কথা বলেছেন । দেবীর আজ্ঞায় বিশ্বকর্মা হনুমানকে সঙ্গে নিয়ে পুরী নির্মাণ করেছেন । 'প্রথমে প্রাচীর বিশাই কৈল চারিপাট ।/ বাউটি পাথরের বীর দিল ঝানকাট ।।/ তাল তরু সম উচ্চ হৈল প্রাচীর ।/ পাথরের দাঁত্যা দিল হনুমান বীর ।।/ মুড়লি রচিয়া তাহে আরোপিল কাট ।/  চারি হালা খড়েতে ছাইল চারি পাট।।/ উত্তরে খিড়কি সিংহদ্বার পূর্ব দেশে ।/ শিলাতে রচিত নাটশাল চারিপাশে।।/

রামেশ্বর ভট্টাচার্যের 'শিবায়ন' অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত । এই শিবায়ন কাব্যে শিবের চাষবাস প্রসঙ্গে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন উপকরণের কথা আছে । মূলত, মধ্যযুগের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর । সেইসময়ে প্রচলিত পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ চলত । ফলে কাব্যেও এসেছে সেকালের সেইসব কৃষিসরঞ্জামের বর্ণনা । শিবের কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় লাঙ্গল, জোয়াল, ফাল, মই, নিরানি, কোদাল ইত্যাদি বিশ্বকর্মা নির্মাণ করে শিবকে দিয়েছিলেন । কৃষিকাজের প্রস্তুতির জন্য শিব ও পার্বতীর মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে– 'শিবা বলে সে হলে যদ্যপি পাইলে ভয় ।/ বিশ্বকর্মা হৈতে কোন কর্ম নাহি হয় ।।/ দেখো বিনা বেতনে বিশাইয়ে বলে কালি ।/গাছ কাটি গড়াইব লাঙ্গল-জুয়ালি ।।/ ঘাত করে ঘরে তার পাতাইব শাল ।/ শূল ভাঙ্গি সাজসজ্জা করাইব ফাল ।।/ শূল ভেঙে কৃষি সরঞ্জাম তৈরির কথা শুনে শিব রেগে যান । পরে 'ঈশ্বরীর ইচ্ছায় বিশাই পায়ে পড়ে ।/ লাঙ্গল জুয়ালি মই সদ্য দিল গড়ে ।।/–বিশ্বকর্মা নৈপুণ্যের সহিত বিভিন্ন কৃষিসরঞ্জাম তৈরি করে দেন । 'বিশাই বুঝিয়া কার্য কৈল সাবধান ।/  লাঙ্গল-জোয়াল ফাল করিল নির্মাণ ।।/  হলধর পাশী মাইরা পুরাইল ফল ।/ আড় চাল লাঙলের জোড়া রাখে আল ।।/ বাটা দিল কোদালে জোয়ালে দিল সলি ।/  পুরস্কার পাইয়া বিশ্বকর্মা গেল চলি ।।

রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গলে'ও কয়েকটি নির্মাণকার্যে বিশ্বকর্মার প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ্য করি । ভব ভাবি চিতে, পুরী নির্মাইতে, কইলো ধ্যান ।/ বিশ্বকর্মা আসি, প্রবেশিলা কাশী, জোড়হাতে সাবধান।। বিশ্বকর্মে হর, কহিলা বিস্তর,  শুনরে বাছা বিশাই ।/ বিশ্বকর্মা শুনি,  নিজ পূণ্য গণি,  দেউল কইলা নির্মাণ ।' দেউল নির্মাণের পর বিশ্বকর্মা সেখানে দেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি নির্মাণ করেন । তিনি অন্নদাকে রত্নকিঙ্কিনি, রত্নমুকুট, পানপাত্র, হাতা, ভূষণ, কাঁচুলি, শাড়ি ইত্যাদি আভরণে সজ্জিত করেন । বিশ্বকর্মা দেউলের শোভা দেখে মোহিত হয়ে সেখানে অন্নপূর্ণার পুরীও নির্মাণ করেন । সামনে ঘাটবাঁধানো সরোবর, স্ফটিকের তৈরি রাজহংস, সূর্যকান্ত মণি দিয়ে পদ্ম, চন্দ্রকান্ত মণি দিয়ে উৎপল, নীলমণি দিয়ে মৌচাক, নানা রকম জলচর পাখি, হাঙ্গর, কুমির ইত্যাদি জলচর প্রাণী, নানা রকম মাছ, বাগানে নানারকম ফুলের ও ফলের গাছের সমারোহে  গড়ে তোলেন অন্নপূর্ণার পুরী । গাছে গাছে নানারকম পাখি, নানা আরণ্যক প্রাণী, সরীসৃপ 'সৃষ্টি হেতু জোরে জোরে সৃজিলা বিশাই ।'

মধ্যযুগের কাব্য থেকে আমরা দেখতে পাই, বিশ্বকর্মা এখানে দেবতাদের শিল্পী নন । তিনি সমাজের সাধারণ একজন মানুষের মতোই কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত । এবং লক্ষ করা গেছে যে, তিনি লোকপ্রযুক্তিতে দক্ষ একজন শিল্পী । তিনি কখনো গৃহনির্মানে পটু । কখনো কর্মকার । ত্রিশূল ভেঙে লাঙল, ফাল, কোদাল তৈরি করছেন । কখনো ছুতারদের ন্যায় কাঠ দিয়ে ডিঙা, লাঙল, জোয়াল তৈরি করছেন । কখনো অলংকার তৈরি করছেন । কখনো শঙ্খ কেটে শাঁখা তৈরি করছেন, কখনো বাগিচা-কৃষি করছেন, বনায়ন করছেন । লোকশিল্প ও প্রযুক্তি তাঁর নখদর্পণে । রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখেছেন,–'তুমি বিশ্ব গড়......তাই বিশ্বকর্মা নাম ।' তিনি সমাজের অনেকগুলি বৃত্তিজীবির স্রষ্টা ও শিক্ষক । কাজেই তিনি শুধুমাত্র দেবশিল্পী নন । লোকশিল্পীও । তিনিও সাধারণ মানুষ । প্রায় প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই তাঁকে 'বিশাই' সম্বোধন করে মানবত্ব আরোপ করে আপন করে নেওয়া হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আমি' কবিতায় লিখেছেন–'মানুষের অহংকার পটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প ।'

সহায়ক গ্রন্থ :
১. বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস–ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য 
২. শ্রীকৃষ্ণ বিজয়–মালাধর বসু
৩. মনসামঙ্গল–ক্ষেমানন্দ দাস ৪. চন্ডীমঙ্গল–কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
৪. শিবায়ন–রামেশ্বর ভট্টাচার্য
৫.  অন্নদামঙ্গল–রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র
৬.  মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংলা ও বাঙালি সমাজ–মুহম্মদ আব্দুল জলিল
৭.  বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত–তৃতীয় খন্ড, দ্বিতীয় পর্ব–অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।

No comments:

Post a Comment