Saturday, August 19, 2023

আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য ( ১৯২৩- ১৯৪৭ )

আধুনিক ত্রিপুরার রূপকার মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য (১৯২৩–১৯৪৭ )

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার যুবরাজ বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্য ও যুবরানি অরুন্ধতী দেবীর পুত্র বীরবিক্রম ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন । ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ২৫ নভেম্বর বীরেন্দ্রকিশোরের রাজ্যভিষেক হয় । ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর মাত্র কুড়িবছর বয়সে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট পাশ্চাত্যমতে বীরবিক্রমের  রাজ্যাভিষেক হয় । তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে তদানীন্তন বাংলার গভর্নর জ্যাকশন সাহেব উপস্থিত ছিলেন । ১২৫ টি স্বর্ণমুদ্রা ভারত সরকারের
 প্রতিনিধি গভর্নরকে প্রদান করা হয় এবং গভর্নর একটি মুক্তার হার উপহারস্বরূপ প্রদান করেন । গভর্নর রাজাকে সিংহাসনে বসাবার কালে ১৯ বার তোপধ্বনি করা হয় ।

মহারাজা বীরবিক্রমের রাজত্বেই ত্রিপুরা রাজ্যের উন্নয়নের নবযুগের সূচনা হয় । ত্রিপুরারাজ্যের প্রশাসনিক সংস্কার, শিক্ষার সম্প্রসারণ, শিল্প ও কৃষির উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মহারাজা বীরবিক্রম একের পর এক জনমুখী কর্মসূচি রূপায়ণ করতে থাকেন । তিনি গ্রামস্তরে গ্রামমন্ডলীও স্থাপন করেছিলেন । এই গ্রাম মন্ডলীর হাতে গ্রামের প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । পার্বত্য প্রজাদের জন্য ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১১ হাজার দ্রোণ জমি তিনি সংরক্ষণের আওতায় আনেন । পরে প্রয়োজন বোধ হলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে আরও ১৯৫০ বর্গমাইল এলাকা সংরক্ষণের আওতায় আনেন । এ সময়ে বাংলাদেশে কয়েক লক্ষ লোক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে । ত্রিপুরাতেও এই ধরনের পরিস্থিতির সম্ভাবনা হতে পারে মনে করে মহারাজা বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বিশাল শস্যভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন । সেসময়ে আগরতলাতে কেন্দ্রীয় গুদাম ও মহকুমাতে ছোটো ছোটো গুদাম গড়া হয়েছিল । এইজন্য খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮৫০ টাকা । চরম অভাবের সময় কেনা দামে এই খাদ্যশস্য বন্টন করা হয়েছিল ।

তাঁর সময়েই ত্রিপুরা রাজ্যের স্বদেশী আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছিল । অনুশীলন সমিতির সদস্যরা ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে আশ্রয় নিতেন । উদয়পুর বিলোনিয়া দুটি বিপ্লবীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল । সাব্রুমের হার্বাতলিতেও ছিল একটি গোপন ঘাঁটি । এখানে গোপন অবস্থান নিয়ে বিপ্লবীরা নোয়াখালি, চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাঁদের সংগ্রামী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন ।

বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য তাঁর পূর্বসূরীদের মত শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতিরও একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক । ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ সকালবেলা উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের দরবার হলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান পালন করা হয় । সেই অনুষ্ঠানেই এক বিশেষ রোবকারি বা ঘোষণাপত্রে ত্রিপুরাধিপতি বীরবিক্রমকিশোর মানিক্য বাহাদুর বিশ্বকবিকে 'ভারত ভাস্কর' উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । এরপর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ৩০শে বৈশাখ শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে এক গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বকবির হাতে ত্রিপুরার মহারাজা প্রদত্ত 'ভারত ভাস্কর' উপাধি সনদ তুলে দেওয়া হয় । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ থাকায় তাঁকে হুইলচেয়ারে করে উত্তরায়ণে সভাস্থলে নিয়ে আসা হয়েছিল । সে বছরেই বাইশে শ্রাবণ কবির মহাপ্রয়াণ ঘটে ।

১৯৪৭ সালের ১৭ই মে ( ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৭ ) রাত্রি ৮ টা ৪০ মিনিটে মহারাজা বীরবিক্রমকিশোরের মহাজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে । তাঁর মৃত্যুসংবাদ পরদিন সাব্রুমে পৌঁছায় । সাব্রুমের তদানীন্তন প্রবীণ নাগরিক প্রয়াত প্রমোদরঞ্জন দেওয়ান বহু বছর আগে এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, সে সময়ে সাব্রুমে রেডিও বা বেতার যোগাযোগ ছিল না । সরকারি নির্দেশনামা, কাগজপত্র, চিঠিপত্র ইত্যাদি ডাকহরকরার মাধ্যমে আমলিঘাট থেকে সাব্রুমে আসত । মহারাজা বীরবিক্রমের মৃত্যুসংবাদ সেসময়ে রেডিও মারফত সম্প্রচারিত হয়েছিল । সে সংবাদটি শুনেছিলেন তখনকার রামগড় চা বাগানের ম্যানেজার । তখন সে অঞ্চল ছিল ব্রিটিশ ভারতের অধীন । তিনি পরদিন সকালে ফেনীনদীতে স্নান করার সময় এপারের লোকজনদের জানান যে, ত্রিপুরার মহারাজা আগের রাতে প্রয়াত হয়েছেন । সে সংবাদ সাব্রুম থানায় এসে পৌঁছালে তখন থানার কর্মকর্তারা থানার পতাকা সেসময়ের রাজলাঞ্ছনটি অর্ধনমিত করেন ।

No comments:

Post a Comment