Saturday, August 12, 2023

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীপূজার ধারাবাহিকতা

ত্রিপুরারাজ্যে দেবীপূজার ধারাবাহিকতা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


আদিম সমাজ ছিল মাতৃকেন্দ্রিক । যে সময়ে বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন ও বিধিনিষেধ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি, সে সময়ে মাতৃপরিচয়ই ছিল নির্ধারিত । প্রাকৃতিক কারণে মাতৃপরিচয় তখন জরুরি ছিল । জন্মদান, শিশুপালন থেকে শুরু করে কৃষিকর্ম ইত্যাদিতে মাতৃদায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই কৌমজীবনে মাতৃতন্ত্রের প্রাধান্য পায় বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন । যেহেতু গোষ্ঠীজীবনে মায়ের ভূমিকা প্রধান বলে বিবেচিত হয় সে কারণে প্রাচীনতম যে ধর্মবিশ্বাসটি তৈরি হয়েছিল সেখানেও মাতৃপ্রাধান্যই পরিলক্ষিত হয় । কৃষিকেন্দ্রিক জীবন ধারাতেও লক্ষ্য করা যায়, ভূমির উর্বরতার সঙ্গে শস্য উৎপাদনের বিষয়টি জড়িত । নারী ও ধরিত্রী উৎপাদনক্ষেত্রে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় । ফলে কৃষিকেন্দ্রিক জীবনকে কেন্দ্র করে যে ধর্মচেতনার সৃষ্টি হয় তার মধ্যে একটা দেবীভাবনা নিহিত থাকে । এই ধর্মধারাকেই বলা হয় মাতৃকা কৃষ্টি । 

মানবসভ্যতায় প্রাচীন ধর্মধারার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাতৃকাপূজার একটা ধারা প্রবহমান ছিল । বিশিষ্ট পন্ডিতবর্গ ধারণা করেন যে, একসময় ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে মাতৃপূজার ব্যাপক প্রচলন ছিল । এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন যে, "পন্ডিতদের মতে হিন্দুদের শক্তি উপাসনা এসেছে অনার্যদের কাছ থেকে । কোন কোন পন্ডিতের মতে শক্তি বা মাতৃকা উপাসনা প্রস্তর যুগ থেকে প্রচলিত ছিল । ইউরোপের সুপ্রাচীন যুগে ( Palaeolithic and Neolithic ages )  ভেনাসের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে । দুইটি সন্তান ও স্বামীসহ মাতৃকামূর্তির আবিষ্কারও ওই যুগের শক্তি পূজার প্রমাণ দেয় । সিরিয়া, এশিয়া মাইনর, প্যালেস্টাইন, সাইপ্রাস, ক্রিট ও মিশরে মাতৃকামূর্তি পাওয়া গেছে । মার্শাল সাহেবের মতে, নীলনদ থেকে সিন্ধুনদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভুভাগ মাতৃকাপূজার ক্ষেত্র ছিল"  ( হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তৃতীয় পর্ব পৃষ্ঠা ১৬০ ) ।

প্রস্তর যুগের যেসব নগ্নিকামূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোকে প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় 'ভেনাস ফিগারাইন্স' বলা হয় । এই নগ্নিকা মূর্তিসমূহের অন্যান্য প্রত্যঙ্গের তুলনায় মাতৃচিহ্নসূচক প্রত্যঙ্গসমূহ প্রকটভাবে চিহ্নিত করা হত । নারীসূচক দেহলক্ষণ প্রকট হওয়ায় প্রস্তর যুগের এই মূর্তিগুলিকে 'ভগবতী' বলা হয় । প্রাচীন ভারতের হিন্দুসভ্যতার নিদর্শন থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের মধ্যে একটি শিলমোহর চিত্রে দেখা যায় যে, একটি নগ্নিকার বিস্ফারিত জননাঙ্গ থেকে একটি শস্যের গুচ্ছ ঊর্ধ্বোত্থিত হয়ে আছে । সমাজবিজ্ঞানীরা সিলমোহরের এই নারীকে  'শাকম্ভরী' বলে চিহ্নিত করেছেন । হিন্দু পুরাণে দেবী দুর্গার আবাহন মন্ত্রে দেবীকে 'শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা'র রূপদাত্রী বলে কল্পনা করা হয়েছে । পৌরাণিক দুর্গার বোধনের 'নবপত্রিকা' এবং 'দশপ্রহরণধারিণীর' পরিবর্তে দেবীর দশহাতেতে দশ রকম শাকের কল্পনা মহামাত্রিকা দেবীকে শস্যদায়িনী দেবী রূপে প্রতীয়মানেরই নামান্তর । পৃথিবীকে শস্যপূর্ণা করার কারণেই শস্যের দেবী পরবর্তীতে মাতৃকাশক্তি বা শক্তিদেবীকে রূপান্তরিত হয়েছেন ।

শক্তিপূজার আদি উৎস নিরূপণে পন্ডিতগণ  বেদ পুরাণের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন । ঋকবেদের দেবীসূত্রে দেখা যায়–

অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যাহমাদিতৈরুত বিশ্বদেবৈঃ ।
অহং মিত্রাবরুণোভো বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নি অহমাশ্বিনোমা ।।
সরলার্থ : আমি দুষ্টের দমনকারী এবং পৃথিবী আদি সমস্ত লোকের সাথে বাপ্য । আমি ১২ মাস এবং সমস্ত তেজোময় পদার্থের সাথে বাপ্য । দিন ও রাত্রি উভয়কে আমি ধারণ করি । সূর্য ও অগ্নি, দ্যুলোক ও পৃথ্বীলোক উভয়কেও আমি ধারণ করি ।

এছাড়া দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ আর মার্কন্ডেয় পুরাণেও শাক্তধর্মের বিকাশ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় । মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবী মাহাত্ম্যের ত্রয়োদশ  অধ্যায়ের ( যা শ্রীশ্রী চন্ডী নামে গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত )  দেবীকল্পনা অবশ্যই উল্লেখ্য । এখানে অসুরদলনী এক পরমা দেবীর মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে । তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া । মহাভারতেও বিরাট পর্বে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব এবং ভীষ্ম পর্বে যুদ্ধের প্রারম্ভ কালে শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন যে দুর্গাস্তুব করেছিলেন তার উল্লেখ পাওয়া যায় । এই মহাভারতেই ( ৪/৬, ৬/২৩ ) দুর্গাকে বাসুদেবের ভগিনী এবং নন্দকুলোদ্ভবা বলে ব্যক্ত করা হয়েছে । হরিবংশের আর্যাস্তবে ও তাঁকে লক্ষী, বলদেবের ভগিনী, নন্দগোপুসূতা প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে ।

পন্ডিত শাস্ত্রকারগণ ব্যতীত বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদগণ তাঁদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তার ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নিয়েছেন । তাঁদের মতে আর্যদের এদেশে আগমনের পূর্বে প্রাচীন জাতির মধ্যে কোল, ভিল, মুন্ডা, সাঁওতাল, শবর প্রভৃতি অস্ট্রিক জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল । অরণ্য, পর্বতে বসবাসকারী এই মানুষজনেরা ছিল মাতৃউপাসক । পুরাণে বর্ণিত 'চন্ডী' প্রাগার্য যুগে ওঁরাও, বিরহোড়দের 'চান্দী' বা 'চান্ডী' । আরণ্যক শবর জাতির আরাধ্যা দেবী 'পর্ণশবরী' কুশ বা কৌশিক জাতির দেবী 'কৌশিকী' । আর্যদের ধর্মগ্রন্থেও দেবীকে পুলিন্দ, শবর, কিরাত প্রভৃতি অনার্য জাতির উপাস্য দেবতা বলে স্বীকার করা হয়েছে–
পর্বতাগ্রেষু ঘোরেষু, নদীষু চ গুহাসু চ
 বাসবস্তব মহাদেবী বনেষু পবনেষু চ
 শবরৈব্বরৈশ্চৈব পুলিন্দৈশ্চ সুপূজিতা
ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনি লোকান্ ক্রমিশ সর্বশঃ
( খি‌ল হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব,তৃতীয় অধ্যায় )

লোকসংস্কৃতিবিদগণ প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বৃক্ষপূজার মাধ্যমেও দেবীর প্রতীক অর্চনার সূত্র সন্ধান করেছেন । ডঃ উদয়চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'দুর্গা মাহাত্ম্য ও পূজা প্রসঙ্গে' উল্লেখ করেছেন যে,  "বৃক্ষ প্রতীকে দেবীপূজা ও অনার্য গোষ্ঠীর মধ্যে অনেককাল আগে থেকে প্রচলিত ছিল । বাংলা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গ্রামদেবীরা এখনো বৃক্ষে বসবাস করেন বলেই বিশ্বাস । বিভিন্ন গ্রামের দেবীস্থানগুলি বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ তলে অবস্থিত । ওইসব দেবীস্থানে যেসব গাছকে দেবীজ্ঞানে বা দেবীর আবাস হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয় সেগুলির সর্বদাই যে শাস্ত্রীয় মর্যাদা আছে তাও নয় । মনসা গাছে দেবী মনসার পূজা বাংলা সর্বত্র প্রচলিত । বৃক্ষকে দেবীর বাসস্থান হিসেবে শাস্ত্রকাররা উল্লেখ করেছেন । দুর্গাপূজার সময় যে নবপত্রিকা পূজিতা হন তার মধ্যে বৃক্ষরূপিণী দেবীর পূজার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে । 

দুর্গাপূজায় দেবীকাঠামোয় গণেশের মূর্তির পাশে নবপত্রিকা স্থাপনের বিধি রয়েছে । গণেশের পাশে অবস্থান করার কারণে একে অনেকের 'গণেশের বউ' বা 'কলা বউ' বলে থাকেন । এই নবপত্রিকায় একটি স্বপত্র কলাগাছের সঙ্গে আরো আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ অথবা সপত্র শাখা একত্র করে একজোড়া বেলসহ বেঁধে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেষ্টন করে লাল পাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে এই নবপত্রিকা তৈরি করা হয় । নবপত্রিকায় ব্যবহৃত নয়টি গাছের নাম হল– কলা, ডালিম, ধান, হলুদ, মানকচু, সাধারণ কচু, বেল,অশোক ও জয়ন্তী । স্মৃতি শাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের 'তিথি তত্ত্ব'র একটি শ্লোকে এই নবপত্রিকার বিবরণ পাওয়া যায়–

কদলী দাড়িমী ধান্যং হরিদ্রা মানকং কচুঃ ।
বিল্বশোকৌ জয়ন্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকা ।।

এই নবপত্রিকা নবদুর্গা নামে পরিচিত হন । নবপত্রিকায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি উদ্ভিদ দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয় । এই নবদুর্গা এবং নয়জন দেবী হলেন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুন্ডা, কচ্চাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, বিল্লাধিষ্টাত্রী শিবা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, জয়ন্তাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী । নবপত্রিকায় অধিষ্ঠাত্রী এই নয়জন দেবীকে 'নবপত্রিকা বাসীন্যৈই নবদুর্গায়ৈ নমঃ' মন্ত্রে পূজা করা হয় । শাস্ত্রকারগণ এবং লোকসংস্কৃতিবিদগণ একবাক্যে এই নবপত্রিকাকে শস্যদেবী বলেই অভিমত প্রকাশ করেন । নবপত্রিকার পূজা মানে শস্যদেবীর পূজা । শশীভূষণ দাশগুপ্ত মহোদয়ও উল্লেখ করেন যে, "এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজার মূলে বোধ হয় এই শস্য দেবীরই পূজা । পরবর্তীকালে বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে ।......বলা বাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটি সচেতন চেষ্টা । এই শস্যদেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ । সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও এই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে ।"(  ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য পৃষ্ঠা ২৫-২৬ )

 বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের অনুসৃত শস্যপূজা ভূমির উর্বরতাশক্তির প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জানিয়ে তার সৃজনক্ষমতাকে মাতৃরূপে পূজা বা শক্তি পূজার বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলার ধর্মসাধনায় দেবীভাবনার সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময়ে হিন্দু ধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছিল । সেখান থেকেই শাক্ততান্ত্রিক ভাবধরার জন্ম নিয়েছে । তারও একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে । 

প্রাকবৈদিক যুগ থেকে মাতৃকাপূজা বা শক্তিসাধনার একটা ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয় ও তার পাশাপাশি তন্ত্রসাধনারও একটি ধারা প্রবাহিত হতে থাকে সেই সময় থেকে । বৌদ্ধ প্রভাবে তন্ত্রসাধনার ধারাটি বাংলায় পরিপুষ্টি লাভ করেছিল । বৌদ্ধরা 'তারা', 'প্রজ্ঞা', 'পারমিতা', একজটা দেবীর কল্পনা করেছেন । প্রায় দেড়হাজার বছর কাল আগে থেকে বাংলাদেশ শাক্ত ও তন্ত্র পীঠস্থান হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে ।বাংলায় পাল রাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে । অষ্টম ও দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মহাজনপন্থী বৌদ্ধধর্মের তন্ত্রের প্রভাব ছিল । তার প্রমাণ আমরা চর্যাপদের মধ্যে পেয়ে থাকি । চর্যাপদে ডোম্বি জোইনি, চন্ডালী ইত্যাদি মাতৃকাচরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় । চর্যায় উল্লেখ আছে যে, 'আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভৈলি । নিঅ নারী ছাড়ি চন্ডালি লেলি ।'

 চর্যায় শূন্যতার মধ্য দিয়ে প্রজ্ঞা ও করুণার নৈব্যক্তিক সাধনার পথে মাতৃকার জয়জয়কার করা হয়েছে । তারাদেবী অবলোকিতেশ্বরের করুণা থেকে সৃষ্ট এবং বৌদ্ধধর্ম মতাদর্শে পূজিতা । তিনি উমা, কুশলা, পদ্মাবতী ( মনসা ) এবং বেদমাতা গায়ত্রীর সাথে একীভূত হয়েছেন । ফলে মাতৃকা বৈদিক, বৌদ্ধ, লৌকিক ও পৌরাণিক ধর্মের মাধ্যমে আবর্তিত হয়েছে । ক্রমাগত সংমিশ্রণ ও বিমিশ্রণের মাধ্যমে বিশ্বমাতার রূপ পরিগ্রহ করেছে । এই সময়ে মহিপালের মুদ্রায় বিশ্বপ্রসবিনী মাতৃকার চিত্র দেখা যায় । মহিপালের তাম্রশাসনের শুরু হয় দেবী ভবানীর জয়গান করে । এই সময়ে বাঙালির সর্বাধিক পুজিতা মাতৃকাশক্তি দেবী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে । ধীরে ধীরে সেনযুগের এই সূত্র ধরেই একাধিক শক্তিপীঠের পুনরুত্থান ঘটে । বাংলাদেশের সপ্তদশ শতাব্দীতে শাক্ত ধর্মের প্রসার হয় । ঊনবিংশ শতক থেকে 'শাক্ত পদাবলি' নামে একটি স্বতন্ত্র কাব্য ও সঙ্গীতধারা বাংলাসাহিত্যে স্থান করে নেয় ।

মানবসভ্যতায় প্রাচীন ধর্মধারার ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতিগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাতৃকাপূজার একটা ধারা প্রবাহমান ছিল । এই মাতৃকাপূজা থেকেই পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে শক্তিপূজার বা দেবীভাবনার উদ্ভব হয় । পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাতৃপূজা, শক্তিপূজা বা দেবীপূজার ধারা পরিলক্ষিত হয় । প্রাচীন বাংলায়ও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না । 

প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে ত্রিপুরা রাজ্যের অবস্থান লক্ষ্য করা যায় । এমনকি ত্রিপুরার রাজাগণ একসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরভাগেও তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন । খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীতে ত্রিপুরাধিপতি মহারাজা ছেংথুমফা বা নামান্তরে কীর্তিধর মেহেরকুল ( প্রাচীন কমলাঙ্ক বা পাটিকারা রাজ্য ) জয় করেছিলেন । তিনি ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তবর্তী কোনো এক রাজাকে পরাজিত করে মেঘনা নদ পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করেছিলেন । মহারাজা বিজয়মানিক্য বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের মধ্যবর্তী সমগ্র সমগ্র সুহ্মদেশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন । বাংলার সন্নিহিত অঞ্চল ও বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে সমসাময়িক বাংলায় যে ধর্মধারার প্রচলন ছিল তার প্রভাব ত্রিপুরার উপরও পড়ে । এইভাবে ত্রিপুরার সেই সময়ের শাসকবৃন্দ ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীপূজার প্রচলন করেন ।

ত্রিপুরার প্রাচীন ইতিহাস অনুধাবন করলে জানা যায় যে, ডাঙ্গরফার কনিষ্ঠ পুত্র রত্নফা গৌড়ের নবাবের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরা সিংহাসন অধিকার করেন । কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি গৌড়ের নবাবকে  একশ হাতিসহ একটি মণি উপহার দেন । গৌড়েশ্বর তাঁকে মানিক্য উপাধি প্রদান করেন । সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা মানিক্য উপাধি ব্যবহার শুরু করেন । কৈলাসচন্দ্র সিংহের মতে রত্নমানিক্য ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা সিংহাসন দখল করলেও আগরতলার মিউজিয়ামের রক্ষিত রত্নমানিক্যের যে মুদ্রা দেখতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি ১৪৬৪ খ্রিস্টাব্দের ও অন্যটি ১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দের । ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী রত্নমানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৬৪–১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ ধরা হয় । কারণ, পরবর্তীকালে রাজা মুকুট মানিক্যের ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা পাওয়া যায় । রত্নমানিক্যই প্রথম ত্রিপুরায় মুদ্রার প্রবর্তন করেন । পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরার অন্যান্য রাজারাও মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । এইসব মুদ্রা ছিল স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈরি । ভাষা সংস্কৃত হলেও অক্ষর ছিল বাংলা । ব্যবহৃত অব্দ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে শকাব্দ ও পরবর্তী সময়ে ত্রিপুরাব্দ । এই মুদ্রাগুলিতে পুরুষ দেবতার সঙ্গে স্ত্রীদেবতার প্রতীক অঙ্কিত থাকত । শিবদুর্গা, হরপার্বতী, লক্ষীনারায়ন ইত্যাদি দেবদেবী ও প্রতীক হিসাবে দেবীবাহন সিংহ, ত্রিশূলও মুদ্রাতে উৎকীর্ণ থাকত । 

দ্বিতীয় রত্নমানিক্যের ( ১৬৮৫–১৭৭২ ) কীর্তি হলো প্রাচীন কৈলাগড় বা কসবা দুর্গে মহিষাসুরমর্দিনী দশভূজা, ভগবতীর মূর্তি স্থাপন । এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও ঐতিহাসিকগণের মতে কল্যাণ মানিক্য কসবায় মন্দির নির্মাণ করেছিলেন । বিগ্রহ স্থাপন করেছিলেন রত্নমানিক্য । এই সম্পর্কে প্রাচীন রাজমালায় আছে—

" কসবাতে কালী মূর্তি করিল স্থাপন
 দশভূজা ভগবতীর পতিত তারণ ।"

 দশভুজা দেবীমূর্তি হলেও এটি সাধারণ্যে জয়কালী মন্দির বা কসবা কালীবাড়ি নামে পরিচিত । ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এই মূর্তিটির ব্যতিক্রমী রূপ বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে । এই রত্নমানিক্য বারানসী থেকে মূর্তি এনে কুমিল্লায় রাজরাজেশ্বরী বিগ্রহকে স্থাপন করেন । এই প্রসঙ্গে ত্রিপুর বংশাবলিতে আছে—

"মহারাজ রত্ন মানিক্য বাহাদুর 
কাশীধাম হইতে কালী আনিল সত্ত্বর
 সেই কালি কুমিল্লা নগরের স্থাপিল
 রাজরাজেশ্বরী বলি নামকরণ দিল ।"

ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মানিকের কীর্তি ত্রিপুরার আরেকটি মন্দির উদয়পুরের মাতাবাড়ি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির । এটি ৫১ পীঠের একপীঠ বলা হয় । এখানে দেবীর দক্ষিণপদ পড়েছিল । পীঠমালা তন্ত্রে উল্লেখ আছে–

ত্রিপুরায়াং দক্ষিণপাদো দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী
ভৈরবস্ত্রিপুরেশশ্চ সর্বভিষ্ট ফলপ্রদঃ ।

কথিত আছে মহারাজা ধন্যমানিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে এই বিগ্রহ এনে এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । এছাড়া অমরপুরে অমরসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে মঙ্গলচন্ডীর মন্দির । অমরপুরের গভীর অরণ্যে গোমতী নদীর তীরে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা দেবীমূর্তি রয়েছে । স্থানটিকে ছবিমুড়া বলা হয় । পিলাকের প্রত্নক্ষেত্রেও দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে । আগরতলা শহরে রয়েছে লক্ষীনারায়ণ মন্দির । দিঘির পূর্ব পাড়ে উমামহেশ্বর মন্দির অবস্থিত । ত্রিপুরার সর্বশেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন । ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি মহকুমা সদরে কিম্বা মহকুমার মধ্যে বহু দেবীমন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । তার মধ্যে সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী, বিলোনিয়ার যোগমায়া কালীবাড়ি, মতাইর বুড়াকালী বাড়ি, মুহুরীপুরের রাজরাজেশ্বরী মন্দির, উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, কমলপুরে কমলেশ্বরী, কুমারঘাটে ভুবনেশ্বরী মন্দির, ধর্মনগরের কালিবাড়ি বিখ্যাত । একদিকে বাংলার শক্তিপীঠসমূহ অন্যদিকে আসামের শক্তিপীঠ কামাখ্যা মন্দিরের প্রভাবে ত্রিপুরাও শক্তি আরাধনার একটি বিশিষ্ট অঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল । সেই সুবাদে ত্রিপুরা রাজ্যে অতি প্রাচীনকাল থেকে কালিকাপূজা ও দুর্গাপূজা প্রচলন রয়েছে । রাজন্য প্রতিষ্ঠিত দুর্গাবাড়ি ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায় প্রাণকেন্দ্রে  রয়েছে । এখানে নিয়মিত দেবীর পূজার্চনা হয় । ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন প্রামাণ্য তথ্য এখানে তুলে ধরে এই নিবন্ধের সমাপ্তি টানব । 

রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ১৬৯৬–১৭৭৪ ত্রিপুরারাজ্যের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন । তিনি ১৬৩২ শকাব্দের আষাঢ় মাসে ( জুন-জুলাই ১৭১০ ) খ্রিস্টাব্দ রত্নমানিক্যের আমলে রত্নকন্দলি ও অর্জুনদাস বৈরাগী নামে দুজন দূতকে ত্রিপুরার রাজধানী রাঙামাটিতে ( বর্তমান উদয়পুর ) পাঠিয়েছিলেন । সেই ভ্রমণকাহিনির উপর ভিত্তি করে অহমিয়া ভাষায় লেখা হয়েছিল "ত্রিপুরা দেশের কথা" । এটির বঙ্গানুবাদ করেছিলেন বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরচন্দ্র সেন । এই ভ্রমণ বিবরণীতে সেকালের ত্রিপুরার বহু ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে । এই বিবরণীটির সপ্তম অধ্যায়ে ত্রিপুরার দূতগণের দুর্গোৎসব দর্শনের বর্ণনা রয়েছে–

"ত্রিপুরার দুতগণের বিদায় দেওয়া হইয়া গেলে পর দুর্গোৎসবের কাল আসিল । তখন মহারাজা বড়বড়ুয়াকে দিয়া তাহাদের জিজ্ঞাসা করিলেন, 'তাহারা সেখানের দুর্গাপূজা দেখিতে ইচ্ছা করে কিনা ।' এই কথা শুনিয়া ত্রিপুরার দূতগণ বলিলেন, 'বড়বড়ুয়া, নবাবের অনুগ্রহে যদি আমরা ঈশ্বর দর্শন করিতে পাই ; ঠাকুরানীর দর্শন করিতে পাই  তবে আমাদের পরম ভাগ্য বলিতে হইবে ।" এরপর মহারাজের আদেশে এই দূতদ্বয়কে অষ্টমীর দিন সূর্য, গণেশ, নারায়ণসহ দুর্গাপূজার জায়গায় নিয়ে গিয়ে দেবী দুর্গাকে দর্শন করানো হয় । এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সুপ্রাচীনকালেও ত্রিপুরারাজ্যে দেবীদুর্গা পূজার প্রচলন ছিল । এছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যে দেবীভাবনা ও দেবীপূজার আরো বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে স্থানাভাবে বিস্তৃত আলোচনা করা গেল না ।

সহায়ক গ্রন্থ :

১. শ্রী রাজমালা ভূপেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী
২. ত্রিপুরা রাজমালা–পুরঞ্জনপ্রসাদ চক্রবর্তী
 ৪. ত্রিপুরার ইতিহাস–ডক্টর জগদীশ পণ চৌধুরী 
৫.ত্রিপুরার ইতিহাস–সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬. শতাব্দীর ত্রিপুরা–সম্পা.  নির্মল দাস     রামপ্রসাদ দত্ত
 ৭. ত্রিপুরার স্মৃতি–শ্রী সমরেন্দ্র চন্দ্র দেববর্মন
 ৮. ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৯. ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস–নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment