Monday, January 8, 2024

সাব্রুমের আইসিটি ও স্থল বন্দর : সম্ভাবনা, সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা

সাব্রুমের আইসিপি ও স্থলবন্দর :  সম্ভাবনা সুযোগ ও প্রতিবন্ধকতা

 অশোকানন্দ রায়বর্ধন

ত্রিপুরার দক্ষিণ অংশের প্রান্তিক শহর সাব্রুম । এটি দক্ষিণ ত্রিপুরার একটি মহকুমা শহর । শহরের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে ফেনী নদী । এই নদী ভারত এবং বাংলাদেশের সীমানা নির্দেশ করে । ফেনী নদীর ওপারে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা সদর রামগড় । সম্প্রতি ফেনী নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে । দুদেশের সম্প্রীতির নিদর্শন স্বরূপ এই সেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু–১ ।
এই সেতুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সেতু সংলগ্ন স্থানে ভারতীয় ভূখন্ডে ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট স্থাপনের প্রক্রিয়া জোর কদমে চলছে । এর মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ফেনী নদীকে ব্যবহার করে দুপারে যাতায়াতের ইতিহাস রয়েছে । এই অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটসহ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে । বিশেষত ত্রিপুরারাজ্যের তিনদিকেই বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত । দক্ষিণ ত্রিপুরার এই অংশ দিয়ে বাংলাদেশ হয়ে ASEAN-ভুক্ত একটি দেশ মায়ানমারের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপনের সুযোগ রয়েছে । ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, মনিপুর এবং মিজোরামের সঙ্গে মায়ানমারের সীমানা রয়েছে । কিন্তু সেগুলো খুবই দুর্গম অঞ্চল । সেই তুলনায় বাংলাদেশের সঙ্গে টেকনাফে নাফ নদীপথে যোগাযোগ অনেক সহজ এবং দীর্ঘদিন যাবত এই যোগাযোগ রয়েছে । সাব্রুমে নবনির্মিত মৈত্রীসেতুর মাধ্যমে এই যোগাযোগ আরও সুদৃঢ় করা সম্ভব ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট  :  সাব্রুমের মৈত্রীসেতু এবং আইসিপিকে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যপথ বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে তা শুধুমাত্র ইদানিং কালের ঘটনা নয় । এর একটা সুদূর অতীত ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরার রাজআমলে মায়ানমারের ( তদানীন্তন আরাকান ) সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক তো ছিলই । খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর দিকে দক্ষিণ ত্রিপুরায় অবস্থিত পিলাক ছিল নামকরা শিক্ষা কেন্দ্র  । সে সময়ে মায়ানমার তথা পূর্বতন আরাকান থেকে ছাত্ররা পড়াশোনা করার জন্য পিলাকে আসত । এছাড়া সে সময়ের পিলাক ছিল বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র । ফলে আরাকান থেকে বহু বৌদ্ধ ধর্ম পিপাসুরাও এখানে আসতেন ।  মায়ানমার বা অতীত আরাকান থেকে মানুষজন এই পথেই চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে এসে ফেনী নদী পেরিয়ে পিলাকে যেতেন ।

এছাড়া 1857 সালে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল তার ঢেউ চট্টগ্রামেও আছড়ে পড়েছিল । সে বছরের ১৮ এবং ১৯ শে নভেম্বর হাবিলদার রজব আলী খানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে যে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল সেই বিদ্রোহী সেনারা কোষাগার থেকে অর্থ ও অস্ত্র নিয়ে এই পথ দিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন । চট্টগ্রাম শহরে সে সময়ে ক্যাপ্টেন P H K Dewool ছিলেন ৩৪ নম্বর রেজিমেন্ট এর প্রধান । তিনি বিদ্রোহের ঘটনাটির বিবরণ জানিয়ে ১৮ নভেম্বরের এক সপ্তাহ পরে 24 নভেম্বর একটি পত্র লিখেছিলেন মেজর জেনারেল Sir J Hearsey K C B- কাছে যিনি প্রেসিডেন্টি ডিভিশনের প্রধান ছিলেন সেই দুর্লভ চিঠিতে আছে—" I have been informed by a native named Thakur bux formally jemadar of Chittagong provincial battalion, whom the mutineerse forced to go some distance with them, that the pay-habilder of number-4 company named Rujab Ali Khan, has assumed command of the detectment, which we here has crossed the Feny river and entire the territories of Rajah of Tiperah. ( Orlich Leopold Von ( 1858 )- The Mutiny of India : Its Origin and Its Result, T and W boone, 29 newbond Street ). তিনি এই পত্রে উল্লেখ করেন যে, বিদ্রোহীরা ফেনী নদী পেরিয়ে ত্রিপুরার রাজার রাজ্যে প্রবেশ করেছে । এতে করে সাব্রুমের সীমান্ত অঞ্চলকেই বোঝায় । অর্থাৎ এই বিদ্রোহীরা রাজন্য ত্রিপুরার সাব্রুমের উপর দিয়েই সিলেট হয়ে মণিপুরের দিকে পলায়ন করেছেন । এছাড়া, সে সময়ের অন্যান্য সরকারি নথিপত্র থেকে আরও জানা যায় যে, ত্রিপুরা ও সিলেট হয়ে নেপাল যাওয়ার জন্য বিদ্রোহী সিপাহীরা সীতাকুণ্ড ফটিকছড়ি রামগড় হয়ে ফেনী নদী অতিক্রম করেছিলেন ( চট্টগ্রামের সংগ্রামী ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান প্রথম খন্ড )।

আর সাম্প্রতিককালের ঘটনা তো অনেকেরই স্মরণে আছে । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকেই । এবং চট্টগ্রাম থেকেই মূল সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল । সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রামগড় হয়ে ফেনীনদী পেরিয়েই ভারতের সাব্রুমে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং সাব্রুমের হরিনাতে মুক্তিযোদ্ধাদের একনম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার ইতিহাস তো সবারই জানা ।

অবস্থানগত সুবিধা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা  :  সাব্রুমে আইসিটি স্থাপনের ফলে সাব্রুমের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন শহর রামগড়ও এই অঞ্চলের বাণিজ্য মানচিত্রে চলে এসেছে । ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই আইসিপির কার্যকলাপের সুফল হিসাবে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । সাব্রুম আইসিপি থেকে সড়কপথে ও রেলপথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দ্রুত যাওয়া সম্ভব হবে । এখনো সাব্রুম থেকে রামগড় পৌঁছানোর পর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই বারইয়ারহাট হয়ে বিশ্ব রোডের মাধ্যমে সে দেশের অভ্যন্তরে যে কোন জায়গায় যাওয়া যায় । সাব্রুমে আইসিপি স্থাপন হওয়ার ফলে সাব্রুম থেকে বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্র ও নদী বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে । চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক বন্দর । এটি সাব্রুম থেকে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । সেইসঙ্গে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চতুর্থ সমুদ্র বন্দরও ব্যবহার করা সম্ভব হবে ।  এছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে খুলনা বিভাগে অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দ্বিতীয় ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর মংলা বন্দরকেও ব্যবহার করা যাবে । বন্দরটি পশুর নদী ও মংলা নদীর বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী সংযোগস্থলে অবস্থিত । এটি সে দেশের অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর সমূহ ও খুলনা নগরীর মাধ্যমে সারাদেশের সাথে রেলপথে সংযুক্ত । এছাড়া সাব্রুম আইসিপির পশ্চাদভূমি হিসাবে বাংলাদেশের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকেও যুক্ত করা যাবে । চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে মাত্র তিন ঘন্টায় ট্রান্সক্রিপমেন্টের পণ্য আমাদের দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা সম্ভব । এখান থেকে সড়ক ও রেল পরিবহনের মাধ্যমে দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আটটি রাজ্যে সরাসরি পণ্য প্রেরণ করা সম্ভব হবে । ফলে এ অঞ্চলের পাঁচকোটির বেশি মানুষ উপকৃত হবেন । বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের পণ্য কলকাতা বন্দর থেকে আনা নেওয়ার ক্ষেত্রে ১২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয় ।  চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করে সাব্রুম আইসিপি দিয়ে এ দেশে পণ্য আনা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যে প্রেরণের সুযোগের ফলে যেমন দূরত্ব কমে যাবে তেমনি সময়ও কম লাগবে । পরিবহন ব্যয় কম হবে ও জ্বালানি সাশ্রয় হবে । এছাড়া বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ে অল্প দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এদেশের মাটিতে পণ্য নিয়ে আসার ফলে সেদেশের ভূমি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার যে কর দিতে হবে তাও আনুপাতিক হারে কম লাগবে । পণ্য পরিবহন পথের দূরত্ব কম হওয়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা স্বল্প ব্যয়ের পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারবেন । এছাড়া আইসিপি সন্নিহিত ল্যান্ডপোর্টে কারগো বিল্ডিং এর সুবিধা থাকায় সেখানে তাদের পণ্য মজুদও রাখতে পারবেন ।

আরেকটি লক্ষনীয় বিষয় যে, প্রায় প্রতিবছরই বর্ষার সময় পাহাড়ের ধ্বস নামার ফলে ত্রিপুরা মিজোরাম ও আসামের বরাক উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । ফলে বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থায় সেই সময়ে এই অঞ্চলে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । সাব্রুম আইসিপি ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হলে এই দুরবস্থার চিরস্থায়ী সমাধান হবে । সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে বাংলাদেশের রামগড় হয়ে আমাদের দেশের অভ্যন্তরের সড়ক পথ ও রেলপথ ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারও ত্রিপুরার খোয়াই, কমলপুর, কৈলাশহর ও আসামের কাছাড়ের করিমগঞ্জের সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের সিলেট ও ময়মনসিংহের মধ্যে পণ্য পরিবহন করতে পারবে । আমাদের দেশের অভ্যন্তরের উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল বাংলাদেশও গ্রহণ করতে পারবে । এছাড়া চট্টগ্রামের নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সে দেশের রেললাইন সম্প্রসারিত হলে এবং তা সাব্রুমের আইসিটি পর্যন্ত এগিয়ে আনা হলে এই পরিবহন ব্যবস্থা আরো সময় সাশ্রয়ী সুগম ও কম দূরত্বের হবে । টেকনাফ হয়ে মায়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধা থাকার ফলে সাবরুম আইসিপির শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক করিডোর হিসেবে প্রাধান্য লাভ করবে এই আইসিপির মাধ্যমে শুধু চট্টগ্রাম নৌবন্দর নয় এখান থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোন শহরে যাওয়া যাবে । পাশাপাশি সে দেশের মানুষ সাবরুম আইসিপি দিয়ে এসে মাত্র ৩০ টাকা ব্যায়ে আগরতলার মহারাজা বীর বিক্রম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরও সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে । প্রসঙ্গতা উল্লেখ্য যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু যে নদীটির উপর নির্মিত সেই ফেনী নদীতে যদি ড্রেজিং করে তার নাব্য্যতা বাড়ানো হয় তাহলে এই জলপথটিও পণ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যাবে এবং এই আইসিপিকে কেন্দ্র করে সাব্রুমে একটি নদীবন্দর গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে । এক সময়ে এই ফেনী নদীতে নৌযান চলাচল করত । নৌকা করে পণ্য পরিবহন চালু ছিল বহুদিন । এই নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপি থেকে বা সাব্রুম আইসিপিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের পণ্য সুলভে পরিবহনের এই মাধ্যমকে আবার শুরু করা যেতে পারে ।

সাব্রুমের সম্ভাবনাময় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের ( Special Economic Zone ) প্রস্তুতি ও সুবিধা : সাব্রুমের পশ্চিম জলেফায় আইসিপি ও রেলস্টেশন সংলগ্ন স্থানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ জোর কদমে চলছে । এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প, চা ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বাঁশশিল্প, বস্ত্রশিল্প, রাবারভিত্তিক শিল্প, হস্ত-কারু ও ছোটো ছোটো কুটির শিল্প গড়ে তোলা হবে । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে ত্রিপুরা ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে এই স্পেশাল ইকোনমিক জোনে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য সাবরুম আইসিপিও স্থলবন্দর হয়ে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ি ও মংলা ও বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে ভোক্তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যাবে ।

সাব্রুম আই সি পি ও স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি রপ্তানি সম্ভাবনা  :  সাব্রুম আইসিটি ও স্থলবন্দর এর মাধ্যমে দুই ধরনের আদান-প্রদানের সম্ভাবনা রয়েছে প্রথমত পণ্য আদান-প্রদান এবং দ্বিতীয়টি হল পরিষেবা বিষয়ক আদান-প্রদান । পণ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাবারের কথা । এই অঞ্চলে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের রাবার উৎপন্ন হয় । সাব্রুমে বিশেষ শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার ফলে এখানে রাবার ভিত্তিক শিল্প কেন্দ্রে উৎপাদিত পণ্য এই পথ দিয়ে সরাসরি পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বাইরে বিপণনের ব্যবস্থা করা যাবে । ত্রিপুরা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরেকটি বিশেষ অর্থকরী ফসল হলো চা । ত্রিপুরার চা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের । ব্রিটিশ আমলে  ত্রিপুরায় উৎপন্ন চা চট্টগ্রামের চা-বাজারে তোলার উদাহরণ রয়েছে । পরবর্তী সময়ে দেশভাগের ফলে এই কার্যক্রমটি বন্ধ হয়ে যায় । সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বর্তমানে এই উদ্যোগটিকে আবার পুনর্জীবিত করা যায় । ত্রিপুরার অন্যতম বাগিচা ফসল আনারস বিখ্যাত । ইতোমধ্যে আনারস আরব আমিরশাহীতে রপ্তানি হচ্ছে । সাব্রুম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেন্দ্রে আনারস ও অন্যান্য স্থানীয় ফল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এর বাণিজ্যিক সুবিধা নেওয়া যেতে পারে । এছাড়া নানারকমের মশলা, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রাপ্য বিশেষ ধরনের পাথর ও এই আই সি পি ও স্থলবন্দরের এর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রেরণ করা যেতে পারে ।

সাব্রুম আইসিপির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে তৈরি পোশাক, মাছ ও শুটকি ইত্যাদি আনা যেতে পারে । উত্তর পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের মাছ ও শুটকির খাদ্যাভ্যাস রয়েছে হলে এই পণ্য গুলির ব্যাপক আমদানির সুযোগ রয়েছে এছাড়া বাংলাদেশ থেকে সুলভে ইট সিমেন্ট ও প্রসাধন সামগ্রী ইত্যাদি আনা যাবে ।

সাব্রুম আইসিটির মাধ্যমে পরিষেবা মূলক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প, উচ্চশিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিষেবার প্রসার ঘটানো যাবে । উত্তর-পূর্ব থেকে সমুদ্র সৈকতে দেখতে হলে আমাদের দিঘা কিংবা পুরীতে যেতে হয় বহু পথ পাড়ি দিয়ে । অথচ এই রাস্তা দিয়ে অতি সহজে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যাওয়া যায় । বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় হিন্দু জনগণেরও পরিভ্রমণ করার মতো অনেকগুলো তীর্থক্ষেত্র রয়েছে সেই তীর্থ ভ্রমণ করা যাবে এই আইসিপি দিয়ে । বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুরাও অতি অল্প সময়ে সাব্রুম আইসিপি পেরিয়ে সড়ক ও রেলপথে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের জন্য যেতে পারেন । পাশাপাশি বিত্তবান মানুষেরা এই পথ দিয়ে আগরতলায় গিয়ে বিমান যাত্রার সুযোগ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করতে পারেন । প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বহু রোগি চিকিৎসার জন্য কলকাতা চেন্নাই ব্যাঙ্গালোর ও হায়দ্রাবাদ যান । সাধারণত বাংলাদেশের বিত্তবান লোকেরাই এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন । নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পক্ষে তা অধরাই থেকে যায় । সাব্রুম আইসিপির অদূরে কিংবা ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরে কোথাও বিশ্বমানের হাসপাতাল তৈরি হলে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ রোগী অত্যন্ত কম ব্যয়ে এখানে এসে চিকিৎসার সুযোগ নিতে পারবেন । তাছাড়া এই অঞ্চলে দুপারের মানুষজনের ভাষা একই রকম হওয়ায় তারা চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়ার সময় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন । উভয় অঞ্চলে একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস থাকায় সে ক্ষেত্রেও কোন অসুবিধা হবে না । সর্বোপরি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষজনের পক্ষে এই সুযোগ ব্যয়বহুল বলে মনে হবে না । পর্যটন ও চিকিৎসা পরিষেবাকে কেন্দ্র করে এখানে অন্যান্য পণ্যাদির ব্যবসার পাশাপাশি হোটেল, লজ, ঔষধ এর দোকান ইত্যাদি ঘিরে করে প্রচুর কর্মসংস্থানের ও সুযোগ সৃষ্টি হবে ।

সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর পুরোদমে চালু হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা : ২০১৫ সালে মৈত্রীসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে প্রকল্পটি শেষ করে ২০২১ সালের ৯ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও সম্মেলনের মাধ্যমে ৪১২ মিটার দীর্ঘ ও ১৪'৮০ মিটার প্রস্থ ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুটির উদ্বোধন করেন । উদ্বোধন হওয়ার পর প্রায় দু বছর হতে চলল কিন্তু মৈত্রী সেতুর উপর দিয়ে চলাচলের পথ এখনো উন্মোচিত হয়নি । পাশাপাশি সময়ে স্থল বন্দরের কাজ শুরু হলেও আজ অবধি তার শেষ হয়নি । লক্ষ্য করা গেছে, এই নির্মাণ প্রকল্পের কাজের গতি ও খুব ধীর । এছাড়া মৈত্রীসেতু সংলগ্ন আইসিপিতে নিজস্ব ঘরসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কর্মীর অভাবে অন্তত মানুষজন পারাপারের ব্যবস্থাটিও আজ পর্যন্ত চালু করা যায়নি ।

অন্যদিকে মৈত্রী সেতুর অপর প্রান্তে বাংলাদেশেও আই সি পি স্থাপনের কাজে তেমন কোন অগ্রগতির লক্ষণও নেই । গত নভেম্বর মাসের ১৪ তারিখে সে দেশে মৈত্রীসেতুসংলগ্ন স্থানে শুধুমাত্র প্যাসেঞ্জার টার্মিনালটির উদ্বোধন করা হয়েছে । এটিও এদেশের মত এখনো চালু করা হয়নি । রামগড়ের স্থলবন্দরের মূল কাজ কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে বলে সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে । এছাড়া নাজিরহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত বাংলাদেশের রেলপথ সম্প্রসারণের বিষয়টি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে । কবে তা শুরু হবে তাও জানা যাচ্ছে না । যতদিন পর্যন্ত দু দেশের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সমাধা না হয় ততদিন পর্যন্ত যতই আকাশচুম্বী স্বপ্ন থাকুক এই আইসিপি ও স্থলবন্দরের সুফলের শুরুটাও দেখা যাবে না । এক্ষেত্রে দু'দেশের কর্তৃপক্ষের দ্রুত যৌথ বৈঠক করে সামগ্রিক কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সীমানা সংক্রান্ত কোনো প্রোটকল থাকলে সে ক্ষেত্রে দুই দেশেই নরম মনোভাব গ্রহণ করে নিঃস্বার্থে এর সরলীকরণ করা দরকার । এই মৈত্রী সেতু ভারত-বাংলাদেশের জনগণের আবেগের বিষয় । সে কারণেই দু পারের স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে দাবি উঠছে, স্থলবন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়া সাপেক্ষে যেন দুপারের মানুষজন আসা-যাওয়ার ব্যাপারটি অন্তত ত্বরান্বিত করা হয় । এতে যেমন দুপারের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তেমনি দুদেশের মানুষজনের পণ্যের চাহিদার বিষয়টিও প্রকাশ্যে চলে আসবে ।

পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীসেতুকে কেন্দ্র করে সাব্রুম আইসিপি ও স্থলবন্দর নির্মাণের যে বিশাল কর্মকান্ড চলছে, এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সাব্রুম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য গুলির বাণিজ্যিক রাজধানী যে হয়ে উঠবে সেবিষয়ে সন্দেহ নেই । সেই সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেবে । পাশাপাশি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি সম্পর্ক ও সুদৃঢ় হবে । কোনো অঞ্চলের জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হলেই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায় । আসলে, এই কাজটা যতটা ত্বরান্বিত হবে তত শীঘ্রই এই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবেন ।

( লেখক ত্রিপুরার একজন সমাজ-সংস্কৃতিক ও লোকগবেষক । গত ৬ জানুয়ারি ২০২৪ ভারত সরকারের গবেষণা সংস্থা ASIAN Confluence-এর আমন্ত্রণে সাব্রুম আইসিপিতে আয়োজিত 'Technical Consultation On Upcoming ICP in Sabroom  :  Prospects, Opportunities and Challenges'-এ এই গবেষণাপত্রটি পেশ করেন ) ।

Monday, January 1, 2024

কবিতাবতী

কবিতাবতী গর্ভবতী কবিতা পড়তে গিয়ে 
ছন্দবতী কবিতা লেখে স্বপ্ন বুকে নিয়ে
কলম খাতা নিয়ে
কবিতাবতীর স্বপ্ন ভাঙে কবি হতে গিয়ে
অক্ষরবতী অশ্রু লেখে বিষাদ নিয়ে
ঝরনা কলম দিয়ে

Wednesday, December 27, 2023

অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব : প্রাঙ্গিক কথা

"অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব  :  প্রাসঙ্গিক কথা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

গত ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর তারিখ রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি ও বিসর্জনখ্যাত  ও রাজন্যস্মৃতি বিজড়িত শহর উদয়পুরে রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল "অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব" । প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত থাকতে না পারলেও দ্বিতীয়দিন শুরু থেকে  শেষ পর্যন্ত ঠায় বসে থেকে সমগ্র অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি । ঐতিহ্য ও আধুনিকতার নকশিকাঁথা জড়ানো এই শহরে রাজ্য ও বহির্রাজ্য থেকে  স্বনামধন্য অতিথি কবি সাহিত্যিক যাঁরাই এসেছেন প্রত্যেককেই শুরু থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন উদ্যোক্তারা । দ্বিতীয় দিন দ্বিতীয়বেলায় ফিরে যাবার তাড়া দেখে কবি অশোক দেব মঞ্চে যখন অনুযোগ করছিলেন তখন বিদায়ী অতিথিরা প্রত্যেকেই দুহাত তুলে তাঁদের আতিথেয়তার প্রশংসা করে গেছেন ।  আর দ্বিতীয়দিনটিতে আমি উপস্থিত থেকে উপলব্ধি করেছি এই উচ্ছ্বাস সত্যিই স্বতঃস্ফুর্ত ছিল । দ্বিতীয়দিন পুরোটা সময় ধাপে ধাপে কবিতাপাঠের আসর ছিল । ফাঁকে ফাঁকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । আলোচনায় উদয়পুরের প্রাচীন ইতিহাস, ভারতবর্ষের নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতা এবং কবিতায় স্বদেশভাবনা বিষয়ে মনোগ্রাহী আলোচনায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন যথাক্রমে বরিষ্ঠ সাংবাদিক বিমান ধর, নাট্যব্যক্তিত্ব পার্থ মজুমদার এবং সন্তকবি মিলনকান্তি দত্ত । সেখানে আমি কবিতাপাঠসহ উত্তপূর্বের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ও কার্বি ভাষার পাঁচজন কবিকে মঞ্চে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ও এই পর্যায়ের কবিতাপাঠে সামান্য সঞ্চালনার দায়িত্বও পালন করে কৃতার্থ হয়েছি । 

অনুষ্ঠানকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করার জন্যে কবি অশোক দেব, পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, মনোজিৎ ধর, ভাস্করনন্দন সরকার ও খোকন সাহার স্নেহচ্ছায়ায় অনিরুদ্ধ সাহা, মৃদুল দেবরায়, খোকন সাহা প্রমুখদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তরুণ কবিদের পুরো ব্রিগেড বেশ কদিন আগে থেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে  কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়েছিলেন । তারুণ্য ছাড়া এতবড়ো কর্মযজ্ঞ সাফল্যের শিখরে উঠতে পারে না । এই অনুষ্ঠানকেও তাঁরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন । 

উদ্যোগ সুশৃঙ্খল হলেও যাঁরা অংশগ্রহণ করেন তাঁদেরও বোধ-বিবেচনার প্রয়োজন হয় শৃঙ্খলার গতি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে । অপ্রিয় হলেও বলতেই হয়, সঞ্চালকদের বারবার ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের পাত্তা না দিয়ে কবিদের একাংশের একটার জায়গায় একাধিক কবিতা পাঠ, একটি হলেও দীর্ঘ কবিতা পাঠ, অনর্থক গৌরচন্দ্রিকা দান, কবিতাপাঠের প্রারম্ভিক ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের গতিকে অনেকাংশে শ্লথ করে দিয়েছে । ফলে রাজধানীমুখী কবিদের একাংশের ঘরে ফেরার তাগাদাকে বাড়িয়ে তোলে । অবস্থা বেগতিক দেখে সময়মতো কবি অশোক দেব নিজে সঞ্চালনার দায়িত্ব নিজের হাতে না নিলে অনুষ্ঠান কখন শেষ হত বলা যায় না ।

 কবিরা একটু মগ্নতায় থাকেন, খ্যাপাটে, পাগলাটে হন । তাই তাঁরা প্রশ্রয়ও পেয়ে থাকেন । এই প্রশ্রয়ের সুযোগে বারোজনের  একটা কবিটিম কিসব স্বঘোষিত কবিতা পড়ে গেছেন একফাঁকে । সেগুলো যেমন ছিল দীর্ঘ তেমনি গুগল থেকে তথ্য নিয়ে তৈরি করা আধানিবন্ধ আর পাঁচালি ধরনের ছাড়া কিছুই নয় । যখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ কবিরা তাদের অত্যাশ্চর্য সব কবিতা পড়ে শ্রোতৃমন্ডলীকে চমকে দিচ্ছিলেন তার মাঝখানে এঁরা ও আরো কয়েকজন এমনই কবিতানামক কিছু পড়ে বেরিয়ে গেলেন । আর এসবের কারণে কবিতা পড়তে না পেরে, মূল্যবান আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে না পেরে দুঃখ নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকজনকে । 

এর পরপরই আবার কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানকে গতিপথে ফিরিয়ে আনতে মঞ্চে উঠে এলেন রাজ্যের বেশ কজন সুখ্যাত বরিষ্ঠ কবি এবং উদয়পুরের সেই অক্লান্ত পরিশ্রমী বাহিনী । ঠিক সেই পর্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান যে নান্দনিক মাত্রায় পৌঁছেছিল, স্পষ্টতই বলব, যাঁরা অসময়ে ফিরে গেছেন তাঁরা রাজ্যের সাংস্কৃতিক সম্পদকে চাক্ষুষ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন । উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের পুরো নির্যাস নেওয়ার জন্য টানা দুদিন অবস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন । সবাই উপস্থিত থাকতে পারলে পারস্পরিক বহু বিষয়ে ভাববিনিময় করা যেত যা এ অঞ্চলের সাহিত্যের সমৃদ্ধির সহায়কও বটে । তবে তরুণরা এবং উত্তরপ্রান্তের ধর্মনগর, কৈলাশহর থেকে আসা কবিরা দেখেছি টানা দুদিন কাটিয়েই ঘরে ফিরেছেন । এটা এই উৎসবে আশার আলো । অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হয় বাঙালির লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি কবিগানের মাধ্যমে । দক্ষিণের দুই কবিয়াল দিলীপ দে এবং সুভাষ নাথ কৃষ্ণ ও গান্ধারীর ভূমিকা নিয়ে গান করে আসর মাত করে দেন । উদ্যোক্তারা যদি এই কবিগানের মাধ্যমে দ্বিতীয়দিনের অনুষ্ঠান শুরু করতেন তাহলে প্রথমত আমাদের ঐতিহ্য প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত । দ্বিতীয়ত, সকালের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল । তাদের সামনে এই অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা হলে আমাদের গৌরবময় অতীত সংস্কৃতিকে জানতে পারত । আগামীদিনে এজাতীয় অনুষ্ঠান হলে উদ্যোক্তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারেন ।

 আগত অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েতরাজ ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনে । শেষদিন রাত বারোটায় সর্বশেষ অতিথি প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হয়ে ঘুমোতে গেছেন । ঘুম তাঁদের কতটা হয়েছে জানিনা । সকালে আমরা বেরোনোর আগেই প্রতরাশ তৈরি । কথায় কথায় বললেন, বাইরে থেকে অতিথিরা এসেছেন বলেই উদয়পুরের সম্মান রক্ষার্থে তাঁরা নিয়ম ভেঙে রাত দশটার জায়গায় বারোটা পর্যন্ত লজ খোলা রেখেছেন ।

ভোরে বেরোবার আগে রাঙামাটির রাঙারোদ আমাদের গায়ে ইতিহাসের কুয়াশা মাখিয়ে দিচ্ছিল । রত্নমানিক্যের সমকালীন অসমরাজ স্বর্গদেব রুদ্রসিংহ ( ১৬৯৬–১৭৭৬ ) ত্রিপুরার রাজদরবার উদয়পুরে রত্নকন্দলী ও অর্জুনদাস বৈরাগি নামে দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন । সেদিন রাজা এই অতিথিদের সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন । সেই ধারারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল এ দুদিনের অনুষ্ঠানে । দুদিনের 'অটল কবিতা ও সাহিত্য উৎসব' এটাই উৎকর্ষতা

ছবি : সম্রাট শীল, অনামিকা লস্কর, রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, শ্রীমান দাস ও আরো অনেকে

Sunday, December 17, 2023

ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয়নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

 ত্রিপুরায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যচর্চার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন


নৃত্য মূলত এক ধরনের শারীরিক প্রকাশভঙ্গিমা । এই প্রকাশভঙ্গিমা সামাজিক, ধর্মীয় এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হতে লক্ষ করা যায় । মানব সমাজের আদিম পর্বের নৃত্যানুষ্ঠানের মধ্যে জাদুবিশ্বাসের একটা পর্যায় ছিল । এই জাদুবিশ্বাসজনিত প্রভাবে বিভিন্নক্ষেত্রে শুভ ও শুভ শক্তিকে সন্তুষ্ট করার একটা প্রক্রিয়া হল নৃত্য । শিকার ধরা, দেবতাকে সন্তুষ্ট করা, রোগ নিরাময়, ভূত-প্রেত ইত্যাদি কল্পিত শক্তি ও হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আদিম মানুষ নৃত্য ভঙ্গিমার ব্যবহার করত । মানবজীবনে নানা পর্যায়কে পালন করতে গিয়েও নৃত্যের বিষয়টা জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে । শিকারজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মানুষ সভ্যতার অগ্রগতির ফলে ক্রমান্বয়ে যখন কৃষি জীবনে পদার্পণ করে তখনও চাষবাসসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে আনন্দমুখর করে তোলার জন্য নাচের মাধ্যমকে গ্রহণ করেছে । কৃষিকর্ম ও কৃষিক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্তরে নাচের যে প্রচলন রয়েছে তার মধ্যেও জাদুবিশ্বাস অত্যন্ত প্রকট রয়ে গেছে । এককথায় প্রাচীন জনপদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নাচের প্রচলন ছিল । প্রাচীন মিশরীয় দেওয়ালচিত্র বা প্রাচীন ভারতীয় গুহাচিত্রে নৃত্যকলার বিভিন্ন ভঙ্গি খোদিত থাকতে দেখা গেছে । সে থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভারতবর্ষের মানবসংস্কৃতিতেও নৃত্যের সুদূর অতীতের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে । সময়ের ক্রমবিবর্তনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচের প্রচলনও বেড়ে গেছে ।

ভারতীয় সংস্কৃতিতে দুই ধরনের নৃত্যের প্রচলন রয়েছে । তার একটি হল লোকনৃত্য ও অপরটি শাস্ত্রীয় নৃত্য । সভ্যতার প্রাকলগ্নে প্রচলিত আদিম নৃত্য গোষ্ঠীজীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী নৃত্যকলায় পরিণত হয়েছে । তা একটা পর্যায়ে এসে মানুষের সমাজ জীবনচর্যায় সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে গেছে । তখন এর মধ্যে কিছু কিছু নান্দনিক ভাবনার সংযোজন ঘটেছে । এইসব নৃত্যের মধ্যে কিছু তাৎপর্যমূলক অনুষ্ঠানাদির সংযোজন ঘটেছে । ফসলের উৎসব, নর-নারীর মিলনোৎসব, শস্য ও সন্তান সংক্রান্ত উর্বরতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে নৃত্যানুষ্ঠান সম্পৃক্ত হয়ে গেছে । আদিম নৃত্যের এই পর্যায়ে এসে লোকনৃত্যে উত্তরণ ঘটেছে । বিভিন্ন পর্যায়ের লোকনৃত্যে দেখা গেছে যে, এই নৃত্যসমূহ দলবদ্ধভাবে পরিবেশন করা হয় । পাশাপাশি এই নৃত্যে সংঘবদ্ধ গান বা কোরাস সংগীত ও বিভিন্ন রকম লোকবাদ্য যেমন–ঢোল, কাঁসি, করতাল, বাঁশি, ধামসা, মাদল ও বিভিন্ন তারযন্ত্রের ব্যবহার করা হয় । এই নৃত্যসমূহ বিশেষ কোনো অঞ্চলের অধিবাসী উপজাতীয় জনগণের সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করে । ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী বিভিন্ন উপজাতীয় জনগণের স্ব স্ব লোকনৃত্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় । 

কোনো নৃত্যের বৈশিষ্ট্য হলো, তার গতি, মুদ্রা, সংযম ও ছন্দ । এর মাধ্যমে কোনো নৃত্যকে শাস্ত্রীয় বা লোকনৃত্য হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব । লোকনৃত্য ছন্দ বা সংযমের কঠোর নীতিনির্দেশিকা ততটা মান্য করে না । পাঞ্জাবি ভাংরা নৃত্য বা নাগা উপজাতিদের নৃত্যে যেরকম তীব্র গতি থাকে তার তুলনায় শাস্ত্রীয়নৃত্যে যথেষ্ট সংযম ও ছন্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় । আমাদের ত্রিপুরারাজ্যেও গড়িয়ানৃত্যেও জোরালো বাদ্যযন্ত্র ও গতি লক্ষ্য করা যায় । পক্ষান্তরে মনিপুরী নৃত্যে ধীর সংযম ও ছন্দের অবতারণা করতে দেখা যায় । এছাড়া লোকনৃত্যে পোশাক কেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । কিন্তু শাস্ত্রীয়নৃত্যের ক্ষেত্রে পোশাক ও সাজসজ্জা আর একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে । লোকনৃত্যের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর জীবিকার ধরন, সামাজিক রীতিনীতি ও ধর্মচর্চার গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান । ফলে তাদের জীবনাচরণের বিভিন্ন বিষয়কে গতিময় ও দলবদ্ধ পরিবেশন করতে দেখা যায় লোকনৃত্যে । এই নৃত্য তাদের জীবনঘনিষ্ঠ নৃত্য ।

ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের জাতি ও জনজাতিদের লোকনৃত্যের মত ত্রিপুরার জনজাতিগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের নিজস্ব সমৃদ্ধ লোকনৃত্যের ধারা রয়েছে । তারমধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনুসৃত নৃত্যধারাটি বৃহত্তর বাঙালি জাতির নৃত্যের ধারারই অনুসরণ । কিন্তু জনজাতীয়দের যে উনিশটি শাখা রয়েছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব লোকনৃত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা রয়েছে । তাদের মধ্যে একমাত্র রিয়াংদের নৃত্যের মধ্যে কিছুটা ধ্রুপদী আঙ্গিক লক্ষ্য করা যায় । যদিও তা ভারতীয় স্বীকৃত শাস্ত্রীয়নৃত্যের মধ্যে গণ্য নয় । ত্রিপুরারাজ্যে বসবাসকারী মনিপুরী জনগোষ্ঠীর নৃত্য, যা মণিপুরী নৃত্য নামে বিশ্বের সমাধিক পরিচিত তার উৎস মনিপুরে হলেও ত্রিপুরার রাজন্যপৃষ্ঠপোষকতা লাভের ফলে এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের অসীম আগ্রহের ফলে তাঁর সৃষ্ট শান্তিনিকেতনের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বিশাল পরিচিতি পেয়েছে । মনিপুরী নৃত্য আজ ভারতের অন্যতম শাস্ত্রীয় নৃত্য । এই নৃত্য বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত । ত্রিপুরা রাজ্যে এই শাস্ত্রীয় নৃত্য চর্চার নিবিড় ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে । যা আজও প্রবহমান ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার পত্রপত্রিকা ও সাংবাদিকদের ভূমিকা

অশোকানন্দ রায়বর্ধন 

 ১৬ই ডিসেম্বর । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস । একাত্তরের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে যে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল সেদেশে আজকের দিনে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আসে স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বস্তরের জনগণ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ববর্গ, বিভিন্ন পেশার মানুষজন,  সমাজকর্মী একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকেছিলেন ত্রিপুরার মানুষ । সেই দিনের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক, পত্র-পত্রিকাসমূহেরও বিরাট ভূমিকা ছিল । আগরতলা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সমর রাজধানী । সাব্রুমের হরিনা ছিল তাদের এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ।

দৈনিক সংবাদ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সেদিন এদেশের ও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একত্রিত হয়ে কলম ধরে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে । দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরাও এই প্রতিষ্ঠানে এসে তথ্য সংগ্রহ করতেন । যার দরুন খানসেনাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দৈনিক সংবাদ । দৈনিক সংবাদ অফিসকে ধ্বংস করার জন্য তারা গোলাও নিক্ষেপ করেছিল  দৈনিক সংবাদ অফিসের লক্ষ্য করে । কিন্তু সৌভাগ্যবশত সেদিন ওই গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিক, বিপুল মজুমদার, অধ্যাপক মিহির দেব, অধ্যাপক সুখময় ঘোষ, সেদিনের চিত্র সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত, তরুণ সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী প্রমুখগণ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন । অন্যান্যদের মধ্যে বিশেষভাবে নাম করতে হয় অনিল ভট্টাচার্য, স্বপন ভট্টাচার্য, ননীগোপাল চক্রবর্তী প্রমুখদের । মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহদানের লক্ষ্যে সৃষ্ট 'রোশেন আরা' মিথ তো বিকচ চৌধুরীর মেধাবী কলমপ্রসূত । আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রত্যক্ষচিত্র দুঃসাহসিকতার সঙ্গে ধারণ করেছিলেন চিত্রসাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত । ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল অরোরার সঙ্গে একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী বিমানে ঢাকা যাওয়ার বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন । একমাত্র তিনি ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেন পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ । ভারতীয় সাংবাদিকরা সেদিন ঢাকা পৌঁছাতে পারেননি । তাঁরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর PRO কর্নেল রিখির সঙ্গে ১৮ তারিখ ঢাকায় পৌঁছেছিলেন । মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে রবীন সেনগুপ্ত মৈমনসিংহ হয়ে ঢাকা পৌঁছেছিলেন ।এদিকে ৮ডিসেম্বর রামগড়ের হানাদার মুক্তির দিনে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক স্বপন ভট্টাচার্য ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা আজও তেমনভাবে জানানো হয়নি নতুন প্রজন্মকে । যেকারণেই প্রতিবেশী দেশ হয়েও এই প্রজন্মের একটা অংশ ক্রোধ ও ঘৃণা বর্ষণেই তৃপ্তি পায় । যা আদৌ কাম্য নয় । পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির মাধ্যমে তো বিশ্বসভায় প্রথম সারিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব ।

 আসুন, আজকের দিনে আমরা প্রতিবেশী হিসেবে মৈত্রীর কথা বলি, সম্প্রীতির কথা বলি, শান্তির কথা বলি । ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক ।

ছবিঋণ : চিত্রসাংবাদিকের ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধ– রবীন সেনগুপ্ত

Wednesday, December 13, 2023

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

ভিন্নপথের কবিতা ও এক পথিক

টিংকুরঞ্জন দাস। ত্রিপুরার একজন সুপরিচিত কবি । প্রেমপ্রবণতা, নিসর্গচেতনার সঙ্গে সমাজভাবনা যুক্ত হয়ে তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষাকে এক ভিন্নতর মাধুর্য দান করেছে । কবির অপর ভাবনার কারণে তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণও করেন 'ভিন্নপথের পথিক' ।  কবি তো পথিকই । জীবন ও সমাজ প্রকৃতির আলপথে বিচরণই তাঁর কাজ । এই পথের দুপাশে রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় বৈচিত্র্য ফুটে উঠে, আর সেই বৈচিত্র্যের মধ্যেই মানুষের জীবন প্রতিমুহূর্তে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে প্রবল সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যায় । কবি বাস্তবজীবনে দায়িত্বপূর্ণপদ সামলে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত । ফলে জীবনকে ভিন্ন রূপে দেখার সুযোগ রয়েছে তাঁর । রয়েছে দেখার চোখও—

স্কুলছুট কিংবা দীর্ঘ অনুপস্থিত ছেলে মেয়েদের ধরে আনতে 
বেরিয়ে পড়ি প্রায় সকালেই পাড়ার বাড়ি বাড়ি 
দুঃখ হলেও হাসিমুখে সব দোষ করি স্বীকার 
তবুও যেন ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে রেগুলার 
তারপরও শুনি পথে ঘাটে,
 ও, সে তো সাধারণ এক স্কুল টিচার
 কাজকর্ম ফেলে রেখে সারাদিন ঝাড়ে শুধু চক ডাস্টার ।'

চিরায়ত শিক্ষকমননজাত প্রেরণা থেকে জীবনের এক ভিন্ন রূপ, ভিন্ন মুখ দেখবার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর । তাঁর মধ্যে তাই রয়েছে এক তন্ময়তার ভাব। অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, জীবনের কঠোর-কর্কশ, সুন্দর-অসুন্দর পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা । মানুষের কল্যাণবোধ ও মঙ্গলভাবনা তাঁর কাব্যের উপজীব্য । সমকালের রাজনীতির সঙ্গে তিনি পরিচিত । দেখছেন রাজনীতির অস্থিরতা, রাজনীতির বাণিজ্য । কিন্তু হৃদয়ের বাণীই তাঁর কাব্যের প্রধান শর্ত । সেখানেই তাঁর কবিতার মুখ্য প্রেরণা—

তাই এবার আর মৌ নয়,
 এসো, একে অন্যের মুখে তুলে দেই এক মুঠো ক্ষুধার অন্ন 
বিবস্ত্র মানুষের গায়ে জড়িয়ে দিই সামান্য ভালোবাসার চিহ্ন 
একবার অন্তত বাঁচি 
সেই সব বিবস্ত্র অভুক্ত মানুষের জন্য ।

কবি টিংকুরঞ্জন দাসের কবিতার নিবিড় পাঠের মধ্যে যে কাব্যসূত্র সমূহ প্রকট হয়ে ওঠে সেগুলোকে ক্রমান্বয়ে সাজালে পাই—

ক) কবির হৃদয়ের মধ্যে কল্পনাচারিতা রয়েছে । তবে সেই কল্পনা বাস্তববিচ্যুত নয় । তার মনের মধ্যে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার যে স্বচ্ছতা রয়েছে তা তিনি নিজের মতো করে প্রকাশ করেন ।

খ) কবির হৃদয়ে যে চিন্তা বা চেতনার বিস্তার ঘটে তা শুধুমাত্র তাঁর কল্পনার জগতে নয় । বাস্তবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় তার প্রকাশে বলিষ্ঠতা রয়েছে ।

গ) তাঁর কবিতার বাকভঙ্গিমা আধুনিক কাব্যধারার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত না হলেও তাঁর কাব্যরচনার একটা নিজস্ব ক্ষমতা বা স্বতন্ত্র সারবত্তা রয়েছে ।

ঘ) বাস্তবক্ষেত্রে কবি বা সাহিত্যিকরা স্বাধীনচেতা হন । সে কারণেই নিজেকে কাব্যবেষ্টনীর মধ্যে না রেখে প্রকাশের স্বতন্ত্রতায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন এই কবি ।

কবি তাঁর কাব্যের উপাদান তাঁর পরিচিত নিসর্গ ও সমাজপারিপার্শ্ব থেকে গ্রহণ করেছেন । সেকারণেই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে হৃদয়নিঃসৃত ও স্বচ্ছ । তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা থাকে না । ভাষা ও ভাবে কৃত্রিমতা থাকলে তা কখনোই প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠতে পারেনা । পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতাময় এই সময়ে মানুষ, মানবতা ও সময়ের ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে বিক্ষত কবির হৃদয়ের ভাষা ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় । পাঠকচিত্তকে  অবশ্যই এক অন্যতর ভুবনে নিয়ে যাবে এই কাব্যগ্রন্থটি ।
                        অশোকানন্দ রায়বর্ধন

   দার্জিলিং টিলা, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা
          ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩৩০ বঙ্গাব্দ    ।                    

Thursday, December 7, 2023

শবশকট

শবশকট

অশোকানন্দ রায়বর্ধন

শববাহী গাড়িটা মায়াঘাটের শেষ দরোজায়
নির্ধারিত গমন শেষে আচমকা থেমে যায় ।
সারা পথ তার সাথে যায় লৌকিক আচার,
মাইকে বাঁধা বিচ্ছেদী সুরে কীর্তনগান,
নগ্নপদ মানুষের মৃদু শ্বাস, টবে রাখা তুলসি গাছ ।

এই গাড়িতে বসার আসন নেই । এ এক শয়নযান ।
অনন্তের যাত্রী কেবল এ যানের সওয়ার হয় ।
যে শব হয়ে চলে যায় সে জানে না তার
 সাথে কে যায়, কে না যায়, কে, না যায় !

শবশকটের রং কেউ বুঝে শুনে কালো করেছে
কারণ জীবনেরই থাকে আলোর কারুমশাল,
তারপরেই নেমে আসে কালো রঙের আঁধার ।

জীবন যাকে ছুটি দিয়েছে সেই কালো আঁধারের
কে যায়, কে না যায়, কি এসে যায় তার ।

তাকে ফেরাবার মতো কোনো বেহুলার জন্ম হয় না ।