বইমেলা ৷ আর দশটা মেলার মতো নয় এই মেলা ৷ সংবৎসর আর সব মেলা হয় যেখানে থাকে শুধু ব্যসনের সামগ্রী ৷ বৈভবের সমাহার ৷ বিত্তবাসনার নিবৃত্তির উপকরণ ৷ মনোহারী সব সরঞ্জামের সমাবেশ ৷ বইমেলা এসব থেকে পুরোটাই আলাদা ৷ হ্যাঁ বইমেলারও একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে ৷ এ টেনে নেয় গুণীজনকে ৷ মননশীলতাকে ৷ ঐতিহ্যের প্রতিও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে বইমেলা তার পারিপার্শ্বিকতায় ৷ বইয়ের প্রতি প্রণয় আত্মার আকর্ষণ ৷ বিশ্বকে আপন করে নেবার প্রক্রিয়ায় কালো অক্ষরের আনন্দযজ্ঞ ৷ বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বিশ্ব ইতিহাস সংস্কৃতিকে ভালোবাসা ৷ তার টানেই বইমেলায় সামিল হওয়া ৷ অজান্তেই মন বলে ওঠে- বইমেলা ‘ এই কী তোমার প্রেম ওগো হৃদয়হরণ? ‘
তেমনি এক হার্দ্য বইমেলার নাম আগরতলা বইমেলা ৷ বিশ্বের বঙ্গভাষী অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম বইমেলা ৷ আজ ছত্রিশ বছরে পড়ল এই বইমেলা ৷ উনিশ শো একাশি সালের তিরিশে মার্চ মাত্র চব্বিশটি স্টল নিয়ে আগরতলা রবীন্দ্রভবন প্রাঙ্গনে শুরু হয়েছিল এই বইমেলা ৷ তারপর জুরি-দেও-মনু-হাওড়া-গোমতী-মুহুরী-ফেনির বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জলস্রোত ৷ শৈশব পেরিয়ে, কৈশোর অতিক্রম করে, যৌবনের শ্যামল গরিমায় পৌঁছে গেছে আগরতলা বইমেলা ৷ আজ বিশ্বের নানাপ্রান্তের মানুষ জেনে গেছে আগরতলা বইমেলার নামমাহাত্ম্য ৷ আজই যখন দিবসের দাবদাহ ক্রমশ শীতল হয়ে আসবে, চৈতালি হাওয়ার বাসন্তী আমেজে যখন অপরাহ্ণ ভরে উঠবে কোমল মায়ায়, সেইক্ষণে উদ্বোধন হবে আগরতলা বইমেলার ৷ রাজ্যের মননের উৎসবমালার প্রধান মন্ডপের ৷
বই মানুষের সভ্যতার অপরিহার্য জীবনবীজ ৷ মানব ইতিহাস, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ৷ বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষ পরস্পর মননের আনন্দ ভাগ করে নেন ৷ আগরতলা বইমেলাও সেজে উঠছে সেই নেশায় ৷ সেই আকর্ষণে ৷ রাতদিন খাটাখাটনির পর চলছে শেষ তুলির টান ৷ নির্মিয়মান স্থায়ী মঞ্চের অলঙ্করণ ৷ বইমেলাকে কেন্দ্র করে আগরতলা শহর জুড়ে শুরু হয় বইপ্রকাশের উন্মাদনা ৷ ইতিমধ্যে হৈ চৈ বাঁধিয়ে অনুষ্ঠান করে একঝাঁক বই প্রকাশ করে ফেলেছেন নীহারিকা, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী,ভাষা, তুলসী পাবলিশিং হাউসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ৷ মফস্বল শহর কুমারঘাট থেকে এসে আগরতলা শহরে গ্রন্থপ্রকাশ উৎসব সেরে ফেলেছেন স্রোত প্রকাশনের মতো বনেদি প্রতিষ্ঠান ৷ কেউ কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বই প্রকাশ করছেন ৷ মেলা চলাকালীন হবে আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ৷
এই মননের আনন্দে বসে নেই আজকের তারুণ্যও ৷ সরকারী চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের একঝাঁক ছাত্রছাত্রী ৷ তাঁরা হত কদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলপনায় আলপনায় দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন বইমেলার প্রবেশপথ ৷ আমাদের চিরন্তন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যে এ ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ ৷ সময় এগিয়ে গেলেও, চারদিকে বিশ্বায়ণের থাবা বিস্তৃত হলেও, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রকট রূপ নেওয়া সত্বেও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যে জাতির সংস্কৃতির গভীরে প্রবাহিত হয়, বইমেলার অভিমুখে এই পথশিল্প তারই ইঙ্গিতবাহী ৷ আগামী কদিন আগরতলা বইমেলা
জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনের পীঠভূমি হয়ে উঠুক ৷