সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরারাজ্যে অতি প্রাচীন কাল থেকেই শক্তি সাধনার ইতিহাস রয়েছে । ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির তারই একটা উজ্জ্বল উদাহরণ । ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানেও বহু কালীমন্দির রয়েছে এবং নিয়মিত পূজার্চনাও হয়ে আসছে । এক কথায় সারা ত্রিপুরা রাজ্যকেই শক্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছিল । রাজ্যের পিলাক, মাতাবাড়ি, বক্সনগর,এবং ঊনকোটির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলি লক্ষ্য করলেই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ।
এ রাজ্যের পাশাপাশি সাব্রুমেও শক্তি চর্চা হয়ে আসছে বহু প্রাচীনকাল থেকে । ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তিক শতাব্দীপ্রাচীন মহকুমা শহর সাব্রুম । তারপরই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজেলা শহর রামগড় । মাঝখানে সীমান্তরেখা চিহ্নিত করে বয়ে চলেছে ফেনী নদী । সাব্রুম শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ফেনীনদীর পাড়ে রয়েছে প্রাচীন কালীমন্দির । এই মন্দিরটি দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি নামে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত। খুবই জাগ্রত এই দেবী । সাব্রুমের আপামর জনগণ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে এই দেবীর আরাধনা করে থাকেন । দেবী এখানে 'দক্ষিণাকালী' নামে পূজিতা হয়ে আসছেন । রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের মন্দির হওয়ায় এই মন্দিরের দেবী কালিকার নাম সম্ভবত 'দক্ষিণাকালী' ।স্থানীয় জনগণের কাছে এটাও ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর ন্যায় এক পীঠস্থানের মতো । এই মন্দিরে নিত্য দেবীর পূজার্চনা হয়ে থাকে । সেই সঙ্গে এই কালীবাড়িতে প্রত্যেক অমাবস্যায় দেবী কালিকার পুজোসহ মেলা ও বিশেষ বিশেষ তিথিতে পূজা-অর্চনাও হয়ে থাকে । বহু বছর যাবত এই মন্দিরে শারদীয়া দুর্গোৎসব পালিত হয়ে আসছে । এককথায় বহু প্রাচীনকাল থেকে এখানকার জনগণের গভীর শ্রদ্ধার আসনে রয়েছেন দেবী দৈত্যেশ্বরী কালীমাতা । এই দেবীকে কেন্দ্র করে বহু অলৌকিক কাহিনি সর্বসাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে । এই মন্দিরের ইতিহাস সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে গণেশ চক্রবর্তী, লোকগবেষক ড. রঞ্জিত দে, কবি ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন প্রমুখগণসহ আরো অনেকে অনুসন্ধান, গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন ।
দেবী দৈত্যেশ্বরী মন্দির ও তার সৃষ্টিকাল সম্বন্ধে বহু লোককাহিনি প্রচলিত আছে । কেউ কেউ বলেন এই পাথরের বিগ্রহটি সাব্রুমের পশ্চিমপ্রান্তের গ্রাম দৌলবাড়ির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দৈত্যছরাতে পাওয়া যায় । সেখান থেকে হাতি দিয়ে তুলে এখানে আনা হয় । দৈত্যছরা থেকে পাওয়া যায় বলে এই বিগ্রহের নাম হয়েছে দৈত্যেশ্বরী । আবার একটা অংশের মত হল এই পাথরপ্রতিমাকে সাব্রুম শহরের পূর্বদিকে কিছু দূরের একটি ছরার পাড়ের পাহাড়ের একটি গুহার মধ্যে এই বিগ্রহটি ছিল । সেখান থেকে নৌকাযোগে তুলে এনে বর্তমান মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই কাহিনিটিরই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে একদল বলে থাকেন যে, এই বিগ্রহটি শিলাছড়িস্থিত শিলাগুহাথেকে রাজকর্মচারীরা তুলে নৌকা করে এনে এখানে স্থাপন করেন । এই মন্দিরের পাশেই ছিল রাজার তহশিল কাছারি । যা এখনও বর্তমান । যাই হোক, এ সমস্ত কিংবদন্তী বা লোকমুখে প্রচলিত এসব কাহিনি থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে এই মন্দিরের সৃষ্টির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ পরিবারের যোগাযোগ অবশ্যই ছিল ।
এবারে আসা যাক, এই মন্দিরের সৃষ্টির ঐতিহাসিক সূত্রটির সন্ধানে । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাসসম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থটির নাম রাজমালা । এই রাজমালার প্রথম লহরের শুরুতে ত্রিপুরার আদিযুগের রাজাদের একটি তালিকা রয়েছে । এই তালিকার পঁয়তাল্লিশতম রাজা হলেন দৈত্য । তাঁর পিতা ছিলেন চিত্ররথ । সুশীলা নাম্নী মহিষীর গর্ভে যথাক্রমে চিত্রায়ুধ, চিত্রযোধি ও দৈত্য নামে তিন রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন । দৈত্যের বড়ো দুইভাইয়ের মৃত্যু হলে দৈত্য রাজা হন । রাজমালা প্রথম লহর ( যযাতি হইতে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ )-এ গ্রন্থারম্ভের পরই দৈত্য খন্ডের শুরুতে রয়েছে―
দ্রুহ্যু বংশে দৈত্য রাজা কিরাত নগর ।
অনেক সহস্র বর্ষ হইল অমর ।।
বহুকাল পরে তান পুত্র উপজিল ।
ত্রিবেগেতে জন্ম নাম ত্রিপুর রাখিল ।।
রাজা দৈত্যের সময়কাল থেকে রাজমালা প্রথম লহরের বর্ণনা শুরু । এই দৈত্য ছিলেন কালিকাদেবীর উপাসক । রাজ্যের প্রবীন গবেষক ড. জগদীশ গণচৌধুরী তাঁর 'ত্রিপুরার ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, ' একদা দৈত্যআশ্রম সন্নিহিত গভীর অরণ্যে ভ্রমণকালে এক মন্দির দেখিলেন । মন্দিরস্থিতা কালিকা দেবীর সশস্ত্র মূর্তি দর্শন করিয়া দৈত্যের মনে ক্ষত্রিয়তেজ জাগিল । দেবীর অর্চনা করিয়া নিষ্ঠার সহিত অস্ত্রবিদ্যা শিখিতে লাগিলেন পারদর্শিতা অর্জন করি এবং মায়ের আ । অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করিয়া এবং মায়ের আশীর্বাদ লইয়া তিনি পিতৃরাজ্যে প্রত্যাবর্তন পূর্বক পাত্র-মিত্র সৈন্য-সামন্ত যোগাড় করিয়া সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলেন।' এখানে ধারণা করা যায় যে, রাজা দৈত্য অরণ্যস্থিত যে দেবীর অর্চনা করে রাজধানীতে ফিরেছিলেন তিনিই এই দেবী দৈত্যেশ্বরী। এছাড়া মহারাজা রামমাণিক্যের পুত্র রত্নমাণিক্যের (১৬৮২–১৭১২ )দুই মাতুল দৈত্যনারয়ণ ও বলীভীমনারায়ণ নবীন রাজাকে রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করতেন ।বলীভীম নারায়ণ মতাই জোলাইবাড়ি অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন । রাজ্যের দক্ষিণ অংশ দেখাশুনা করতেন দৈত্যনারায়ণ । দৈত্যনারায়ণের প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁর নাম অনুসারে এই দেবীর নাম দৈত্যেশ্বরী হয়েছে বলে মনে করা হয় । বহু বহু প্রাচীনকালে এই সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল অরণ্যসংকুল ছিল । পরবর্তী রাজন্যকুল তাঁদের পূর্বজবংশধরের সাধনাস্থল ও দেবী সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিলেন বলেই পরবর্তী পুরুষেরা তার সন্ধান করে বিগ্রহটি উদ্ধার করেন । অমরমাণিক্যের ( ১৫৭৭–১৫৮৫ )সময়ে এই রাজ্যের দক্ষিণ অংশ মগদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল । তারাও এই দেবীবিগ্রহটি সরিয়ে গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখতে পারে । অনেকে বলেন মগগণ এই দেবীর পূজা করতেন । এই মন্দিরের ব্যয়নির্বাহসংক্রান্ত হিসাবের একটি পুরানো চিরকূটে চাঁদাদাতা হিসাবে মগ পুরুষ ও নারী ভক্তের নাম পাওয়া যায় । ( তথ্যসূত্র : মন্দিরের প্রথম পুরোহিতের বংশধর তপন চক্রবর্তী, সাব্রুম, দক্ষিণ ত্রিপুরা ) ।
এবিষয়ে রাজ্যের বিশিষ্ট কবি লোকসংস্কৃতি গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে,'এ অঞ্চল দুর্গম হওয়ায় এ এলাকা ডাকাত বা মগ দস্যুদের আস্তানা ছিল । এই দস্যুদের পূজিতা দেবী হিসাবে 'দৈস্যেশ্বরী' নামকরণ হতে পারে । এই দৈস্যেশ্বরীই রাজপুরুষ কর্তৃক উদ্ধার হওয়ার পর সংস্কৃতায়িত হয়ে 'দৈত্যেশ্বরী' হয়েছে । এছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত বাংলাভাষায় ( নোয়াখালি ) দৈত্যকে দৈস্য উচ্চারণ করা হয় । যেমন, ব্রহ্মদৈত্যকে বলা হয় ব্রহ্মদৈস্য । কাজেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দৈত্য শব্দটিই আসছে দেবীর নামকরণে উৎসরূপে ।' (সাব্রুমের দেবী দৈত্যেশ্বরীর ইতিহাস –অশোকানন্দ রায়বর্ধন ) । গবেষণার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ভক্তের কাছে নামে কি আসে যায় । মা তো মা । ভক্তের আকুল প্রার্থনার স্থল । তাঁর চরণপদ্মে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের হৃদয় ।
যতদূর জানা যায়,উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই মন্দিরে পূজার্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সাব্রুমের সম্ভ্রান্ত ব্যানার্জী পরিবার ( রাজ্যের একসময়ের শিক্ষামন্ত্রী কালিপদ ব্যানার্জীর পূর্বপুরুষ ) । এই বাড়ির এক কালীভক্ত সদস্য সতীশ ব্যানার্জী এই মন্দিরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি । এই মাতৃমন্দির ও মাতৃসাধক সতীশ ব্যানার্জীকে নিয়ে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে সাব্রুমে । উনিশ শতকে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব সময়কালে সারা বাংলাদেশ জুড়েই মাতৃসাধনার জোয়ার এসেছিল । তার প্রভাব সাব্রুমেও পড়ে ।
সাব্রুম অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ হলেও ভারতভুক্তির পূর্ব পর্যন্ত ( ১৫ অক্টোবর, ১৯৪৯ ) সাব্রুমের জনগণের ওপারের রামগড়ের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল বেশি । এখানকার মানুষ রামগড় বাজার থেকেই প্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতেন । রামগড়ের অনেক ব্যবসায়ীর জমিজমাও ছিল এখানে । তাঁরাও ব্যবসাসূত্রে সাব্রুমে অবস্থান করতেন । দৈত্যেশ্বরী মন্দিরের সঙ্গে তাঁদেরও নিবিড় সম্পর্ক ছিল । দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ির প্রথম পুরোহিত চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর পৌত্র বর্তমানে সাব্রুম শহরের বর্ষিয়ান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজলক্ষ্মী গেস্ট হাউসের মালিক শ্রীতপন চক্রবর্তী মহোদয়ের কাছে রক্ষিত তাঁর কাকা হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তীর হাতে লেখা তাঁদের বংশপরিচয় থেকে জানা যায় যে, ১৮৮৫ সালে রামগড়ের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিরীশচন্দ্র দাস অর্থাৎ গিরীশ মহাজন ( সাব্রুম নগর পঞ্চায়েতের সদ্যবিজয়ী জনপ্রতিনিধি দীপক দাস মহোদয়ের ঠাকুরদাদা ) সাব্রুমের দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়িতে পূজার্চনা করার জন্য তাঁর আদিনিবাস নোয়াখালির আন্ধারমাণিক গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীকে সাব্রুম নিয়ে আসেন । ত্রিপুরার রাজন্য ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায় যে, সে সময়টা ছিল মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের ( ১৮৬২–১৮৯৬ ) আমল ।
চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর চার সন্তান । যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, নগেন্দ্র চক্রবর্তী, হরেন্দ্র চক্রবর্তী । প্রথম সন্তান যোগেন্দ্র চক্রবর্তী ত্রিপুরার রাজকর্মচারী ছিলেন তাঁর কর্মস্থল ছিল খোয়াইতে । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী দেশের বাড়ি নোয়াখালির আন্ধারমাণিকে আসাযাওয়া করে পর্যায়ক্রমে এইমন্দিরে পূজার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন । চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর চৌত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর বয়স থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন এই মন্দিরে দেবীর পূজার্চনা করে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬শে অগ্রহায়ণ,শনিবার, কার্তিকী অমবস্যার রাত ৪-৩০ মিনিটে সাব্রুমে পরলোক গমন করেন । তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র নগেন্দ্র চক্রবর্তী মায়ের মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পান । দীর্ঘদিন মায়ের সেবার্চনা করার পর ১৯৬২ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন । তারপর কিছুদিন মায়ের মন্দিরে পুজো করেন উপেন্দ্র চক্রবর্তী । এরপর আবার চন্দ্রমাধব চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র হরেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মন্দিরের দায়িত্বে আসেন । হরেন্দ্র চক্রবর্তীর পরে বর্তমান পুরোহিত অজিত চক্রবর্তীর বাবা শিবশংকর চক্র বর্তী দায়িত্বে আসেন । তাঁরাই বিগত পঁয়ত্রিশ বছর যাবত মায়ের মন্দিরে পুজো করে আসছেন । ( তথ্যসূত্র : সুব্রত চক্রবর্তী, সাব্রুম ) ।
রাজন্য আমলে রাজা বা রাজপুরুষেরা মন্দির সংলগ্ন তহশিলী কাছারিতে খাজনা আদায় বা পুণ্যাহের জন্য এলে মায়ের মন্দিরে পুজো দিয়েই তাঁদের কাজ শুরু করতেন । রাজার আমল থেকে এই পুজো চলে আসছে কিন্তু এই মন্দিরের কোনরকম রাজানুকুল্য বা সরকারি বরাদ্দ আজ অবধি নেই । পুরোহিতদেরও কোনো মাসোহারা বরাদ্দ নেই । একসময়ে মন্দিরের সামনে ও পেছনের সামান্য ভূমিতে খেতকৃষি করে তাঁরা সংসার চালাতেন । মন্দির কমিটি তাঁদের সামান্য মাসোহারা বরাদ্দ করেন । য়ন্দিরটিও ছোট্ট একটি চারচালা ঘর ছিল । মন্দিরের পেছনেই ছিল পুরোহিতের আবাস । আর ভক্তদের দানদক্ষিণায় তাঁদের সংসার চলে । মন্দিরেরও নিজস্ব কোনো স্থায়ী তহবিল নেই । ভক্তবৃন্দের আর্থিক অনুদানে মায়ের মন্দিরের সব ব্যয় নির্বাহ হয় ।
রাজন্য আমল ও তার পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে দীর্ঘদিন মন্দিরের উত্তরদিকের নাতিউচ্চ টিলাটিতে ছিল মহকুমা শাসকের অফিস । বর্তমানে এটি সাব্রুম দ্বাদশ শ্রেণি বালিকা বিদ্যালয় । তার সামনের পুকুরটি 'কালীপুকুর নামে পরিচিত । মন্দিরের কালিকাবিগ্রহ একখন্ড পাথরবিশেষ । শ্রদ্ধেয় তপন চক্রবর্তী মহোদয় আলাপচারিতায় জানিয়েছেন এই বিগ্রহ মাটির নীচে অনেকখানি প্রোথিত আছে । লোকমুখে প্রচলিত আছে যে, এই বিগ্রহ পূর্বে আরো ছোটো ছিল । ধীরে ধীরে বিগ্রহের উচ্চতা বেড়ে বর্তমান আকার নিয়েছে ।
দৈত্যেশ্বরী কালীবাড়ি সাব্রুম ও তৎসন্নিহিত বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িত । একসময় রাস্তাঘাট দুর্গম থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটে উদয়পুরের ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরে যেতেন পুজো দেওয়া কিংবা মানত রক্ষার জন্য । পরবর্তীসময়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে তার মাধ্যমে যাতায়াত করতেন । কিন্তু যাঁরা আর্থিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল তাঁদের জন্য দৈত্যেশ্বরী মা একমাত্র আশ্রয়স্থল । শক্তিতীর্থভূমি । মা তো জগজ্জননী । ভক্তগণ এখানেই মায়ের চরণে ভক্তি নিবেদন করেন । এই মন্দিরে স্থানীয় জনগণ ভক্তিচিত্তে পুজো, মানত করেন । বিয়ের উদ্যেশ্যে যাত্রা করে এবং বিয়ে করে নববধূকে নিয়ে গৃহপ্রবেশের আগে বিয়েবাড়ির সবাই এই মন্দিরে এসে প্রণাম করার রেওয়াজ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন যাবত প্রচলিত । জাগ্রত দৈত্যেশ্বরী মাকে বালিকাবেশে গভীর রাতে মন্দিরচত্বরে পরিভ্রমন করতে দেখেছেন বলে দাবি করেন অনেক ভক্ত । এই মায়ের মন্দিরের খ্যাতি এতদূর বিস্তৃত যে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত, রাজ্যের বাইরে ও বাংলাদেশ থেকেও ভক্তরা এখানে মায়ের দর্শন করতে আসেন ।
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে দক্ষিণ ত্রিপুরার জেলাশাসক থাকাকালীন সময়ে মাণিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় মায়ের বাড়ির উন্নয়নের জন্য অর্থবরাদ্দ করেছিলেন । শোনা যায় তিনি মায়ের বিগ্রহের দুই নয়ন স্বর্ণ দিয়ে নির্মান করে দিয়েছিলেন । পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এই মায়ের মন্দিরের বর্তমান মন্দির ও প্রাঙ্গনের সামনের দিকে অবস্থিত শিবমন্দিরটি ছাড়া লক্ষণযোগ্য তেমন কাজ হয়নি ।
সাব্রুমে ফেনীনদীর উপর মৈত্রীসেতু নির্মানের পর মহকুমার বাইরে থেকে প্রতিদিন বহু মানুষ দৈত্যেশ্বরী মন্দির দর্শনের জন্য আসেন । ফলে এই মন্দিরের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে । এখানে এসে তাঁরা মন্দির চত্বরে বিশ্রাম করেন ও পুজো দেন । এই সুপ্রাচীন মন্দিরকে ভক্তমন্ডলী ও পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার লক্ষ্যে অতি সত্বরই সুপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া আবশ্যক ।