মায়ালোক হতে ছায়াতরণী
বড়ো হাহাকৃত সময় । অস্থির, অবসন্ন, ক্ষীয়মাণ আর উৎকেন্দ্রিক কাল এখন। চিরঐতিহ্যের শিকড় মূলত্রাণসমেত উৎপাটিত । বিশ্বের উন্মুক্ত আকাশ ঢেকে দিচ্ছে কৃষ্ণবাণিজ্যমাদল । মানুষের চিরায়তচেতনায় দখল নিচ্ছে বাণিজ্যস্বভাব, পণ্যকৃষ্টি । মু দ্রাপিপাসু জীবন কাগজের নোটের পিছনে হাওয়ায় ভাসছে দিকচিহ্নহীন । কবির সামনে তাই অনবরত পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যকল্প, চিত্রকল্প । ফলে তাঁর কবিতার অন্তর্প্রকরণ আসছে পরাভাষা । মুদ্রার টংকারের মতো ধাতব নয় এ ভাষা কবির ভাষা হয়ে যাচ্ছে দূর পাহাড়ের নির্জন নিঃসঙ্গ নির্ঝরের নীরব ধ্বনিনিক্কন । নিরেট সভ্যতার জৌলুষকীর্তনের বিপরীতে বাস্তব অথচ বেদনায় আর্ত সত্যসংগীত । কালের কূটবয়নের মধ্যেই কবির সামনে মূর্ত কিংবা বিমূর্ত হয় চেতনাতালাশ ।
আত্ম চরাচরের বুকে বেদনার মন্ডল ঘিরে থাকলেও গীতিময় এক আবেশ আজও ব্যাপ্ত বলে প্রত্যাশিত জীবন। কবি তো চারণ । গীতিপ্রাণতার মধ্য দিয়ে সময়কে চিনে নেন কবি নিজে । এটাকে কালচিহ্ন বলে অভিহিত করে তুলে ধরেন সবার কাছে । গড়ানো জলের মত যে বিসর্পিল গতি সময়ের । তার যে রহস্যময় অগ্রগমন, তা দেশ ও কালের উপরিতলে পরিদৃশ্যমান নয় । অত্যন্ত গভীর সঞ্চালনশীল প্লেটের মত। যা সমাজকে নিয়ত ধ্বস্ত ও প্রকম্পিত করে তুলেছে । সময়ের নিভৃত স্পন্দন কবির বোধের রিখটারে ধরা দেয় । কবির কারুকৃষ্টির কৃ্ৎকলা মুর্ত করে এই চিহ্নায়ণের । কালের বিস্তীর্ণ ক্ষতদাগ, পথচ্যুতি, বিচ্ছিন্নতা, মানবিকতার অবনমন ইত্যাদি কবি ব্যক্ত করেন তার মায়াবাচনে ।
নিস্পৃহা, নির্লিপ্তি অতিক্রম করে কবি তাঁর বয়নকে করে তুলতে চান হৃদয় ও মননের নান্দনিক মেলবন্ধনে সমৃদ্ধ । কবিতাবস্ত্রের জমিনে রচিত মায়াশিল্প, জাদুভাষা । পরাকথা ও পুরাকথা একাকার হয়ে ছায়ানৌকা ভেসে ওঠে জীবনের বুকে । ছায়াময় চিত্র ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় । ফলে তাঁর কবিতাও হয়ে ওঠে অচেনা অথচ অপরিচিত । ভাষা জানা অথচ ভাব অজ্ঞাত । নির্মাণ পরিচিত অথচ নির্মিতি অজানা । ইন্দ্রিয়ানুভূত কল্পে আসে নতুন নতুন ভাষ্য । নতুন বিমিশ্রণ । ভেঙে যায়।বাচনিক শৃঙ্খলা । চিন্তা ও চেতনার জগতে দ্বন্দ্ব চলে অহর্নিশ । সময়ের প্রতিগতিতে সময়ের ভাষ্য হতে গিয়ে কবিতা পড়ে দ্বন্দ্বে । কবি পড়েন দোটানায় । তাঁর কবিতায় ঐতিহ্যানুগত্য এবং উৎপাতিত বিচ্ছিন্নতা পাশাপাশি এসে পড়ে । কবি প্রকাশিত হযন দ্বন্দ্বে ও বন্ধনে । এড়ানো সম্ভব হয় না ঐতিহ্যের অস্তিত্বকে । ছাড়াবার উপায় নেই সমকালের অনুষঙ্গকে ।
নির্লিপ্তির মধ্যে কবিতা আসেনা । কবির বাইরের পারিপার্শ্বিকের বৈচিত্র্যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় কোন আলোড়ন নেই । আসলে তা নয় । পার্শ্বপৃথিবীর ছোট্ট বুদবুদ গভীর ভাবের ঘরে সমুদ্রসমান ঢেউ তোলে । তাঁর অন্তর্লোক তোলপাড় করে । কবির দৃষ্টি গভীরে যায় । শব্দকে কবি নিজের মতো সাজান । অন্তরের নিঃশব্দ ঝড়কে শব্দ দিয়ে অবলোকন করেন । শব্দ ব্যবহৃত হয় কবির অভীপ্সায়, অভিপ্রায়ে । নির্মেদ আর নিরাভরণ শব্দই কবিতায় হয় আভরণ । কলমে বিন্যস্ত হয়ে শব্দকুল সাংকেতিক হয়ে ওঠে । চাটুকারচর্চিত সমকালীন জগতে সাংকেতিক ভাষা । শব্দ তার গড্ডালিকারেখা অতিক্রম করে এবং চিরায়ত বৃত্তের দিকে অগ্রসর হয় । শূন্যতা ও আঁধারঘেরা কালখন্ডে জাগে সংকেতীশব্দখচিত কবিতার আকাশ । ভাসে কবির কবিতার অতলান্তিক রহস্যের কূটইঙ্গিত ।
কবিতা কর্ম এখন চারুখননক্রিয়া । বস্তুর পরিমণ্ডল থেকে পরাবস্তুর দিকে এগিয়ে যাওয়া । সেই পরাবস্তুর পথ অবচেতনলোকে কাল বদলাচ্ছে । বিজ্ঞান এসে বদলে দিচ্ছে কবির নান্দনিক অভিলোকন । যেমন চাঁদ কবির চেতনায় সুদূরের সৌন্দর্য । বিজ্ঞান ভেঙে দিচ্ছে সেই সৌন্দর্য । সত্যকে উদঘাটিত করে সে খুলে ফেলছে চাঁদের সৌন্দর্যসম্ভার । নির্মম হলেও মহাজাগতিক সত্যই এখানে প্রকাশিত হচ্ছে । ফলে থমকে যায় কবিতার নন্দনচেতনা । 'আট কুঠুরি নয় দরোজা'র মানবশরীর নিয়ে কবির অবিরাম খেলা । লোকায়তনন্দনে অভিলোকিত হয় এই খাঁচা । আর বিজ্ঞান দেহতাত্ত্বিক নশ্বরতার সত্যকে তোলার পাশাপাশি কাঠামোর বীভৎসতাও প্রকাশ করছে । তাহলে, কবিকে তো নতুন পথ নিতে হবে । নতুন সত্যসন্ধান করতে হবে । চাঁদের বিজ্ঞানবাস্তবতাকে অতিক্রম করে কবিকে যেতে হবে পরাবাস্তবতার পথে । শরীর কাঠামোর বস্তুজগৎ পেরিয়ে যেতে হবে হাড়ের অন্তর্লীন সৌন্দর্য আহরণের খনন তৎপরতায় । হাড়ের তো বয়নশৃঙ্খলা আছে । আরো আরো সত্য আহরণের জন্য কবিতাভিযান অব্যাহত থাকবে কবির চর্চায় ।
সত্য নিয়ে বিজ্ঞানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাওয়া কবির কাজ নয় । কাজ নয় অস্বীকার করাও । কবি শুধু খনিশ্রমিকের মত চেতন থেকে অবচেতন, বাস্তব থেকে পরাবাস্তব, অভিবাস্তবের খনিপ্রকোষ্ঠে বিচরণ করবেন । কলমগাঁইতিতে তুলে আনবেন সত্যঅতিক্রমী অভিসত্যকে । এ কাজে কবির যে জগৎ তৈরি হবে তাই মায়ালোক । এই আলোকিত অন্ধকারে ছায়াডিঙা বেয়ে কবি ভেসে বেড়াবেন । ভাসাবেন নিজেকে । কবি জানবেন নতুন করে 'আমি'কে । স্বীয় ও বিশ্ব সত্তাকে । জানবেন 'তুমি'কে । অনাদি অনন্তকে । এভাবেই কবি প্রতিনিয়ত নবীন হবেন । কবিতাও হবে নিত্যনতুন । কবিকার্যক্রম থেমে থাকবে না । কবিও গতিশীল হবেন । দৃষ্টিতে, নন্দনে । আহরণে ও সৃজনে ।
No comments:
Post a Comment