সহস্র বরষার উন্মাদনার মন্ত্র
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
মানবিকতা হল মানুষের আচরণের এক সুন্দর প্রকাশ যা মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যকে সমৃদ্ধ করে । মনুষ্যসৃষ্ট সমাজ কাঠামোর কারণে এবং প্রকৃতিসৃষ্ট কারণে সমাজে বৃহৎ একশ্রেণির মানুষ দুস্থ ও অসহায় হয়ে পড়েন । সেই অসহায় মানুষজনের বেদনাদায়ক আর্তিতে বিচলিত হন কিছু মানুষ । কিছু মানুষ সুযোগ নেন মানুষের অসহায়তার । নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি আর বাস্তুহারা মানুষ অসহায় চোখে চেয়ে থাকে সমাজের দিকে । সামান্য সহায়তার জন্যে । পাশে দাঁড়ানোর জন্যে । তাদের অসহায়তার উৎস তারা চেনে না । আর চিনলেও তারা তাকে চিহ্নিত করে না বা প্রতিবাদ করেনা । অদৃষ্ট নামের এক কাল্পনিক চাঁদমারিকে দোষারোপ করে । তাদের দুঃখদৈন্যবর্ষিত অন্ধকারে সামান্য সাহায্য নিয়ে কেউ পাশে দাঁড়ালে তাকে তারা দেবদূত মনে করে । তখন এই দুখি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নামই মানবিকতা । সম্মিলিত মানবিকতা একটি দর্শন । একটি বিশ্ববীক্ষা । মানুষের অভিজ্ঞতা বলে, মানব প্রকৃতির দুটি দিক আছে । একটি আত্মকেন্দ্রিক । যার নাম স্বার্থসিদ্ধি । আর অপরটি নৈতিকতার দিক । যার নাম মানবিকতা ।
মানবসমাজে একেকটা সময় আসে যে সময়টাকে বলে যুগসন্ধিক্ষণ । যে সময়ে একদিকে চলে মানবিকতার অবমূল্যায়ন । আর্ত মানুষের হাহাকার আর কান্নায় ভরে যায় বিশ্বজনপদ । বিশেষ কোনো রাষ্ট্রনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কখনো কখনো মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে । এই ব্যাপক অসহায়তার সুযোগে একশ্রেণির মানুষ প্রসারিত করে তার লোভের থাবা । অর্থবিত্ত আর প্রতাপের দম্ভে সুযোগ-সন্ধানী মানুষেরা নিজের স্বার্থে ভূলুণ্ঠিত করে মানবাত্মা । এই মানুষগুলোর লোভের কাছে, অর্থগৃধ্নুতার কাছে শোষিত ও নিঃশেষিত হতে থাকে আর্ত মানুষ । বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়া মানুষগুলো নির্মম হয়ে ওঠে এই সময়ে । যুগে যুগে মনীষীগণ মানবপ্রেমের বার্তা নিয়ে গেলেও একদল স্বার্থমগ্ন মানুষের কানে পৌঁছায় না সে বাণী। আর একদল মানুষ এই দুঃসময়ে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে অবহেলা করে এগিয়ে আসে মানুষের পাশে । আর্তের সেবায় । পরের জন্য জীবন-মৃত্যুর ব্যাবধান ঠেলে সরিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে । তাদের কাছে জীবন আসে মানবিকতার রূপে । মানুষের কল্যাণ, সমাজের কল্যাণে তারা খুঁজে পায় জীবনের মহামন্ত্র । এভাবেই অন্ধ তিমির ভেদ করে আসে নতুন ভোর । নিরাশার বিপরীতে আশার প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা এক নতুন সমাজ ।
আজকের সময়েও বিশ্বব্যাপী চলছে এক মহাসংকট । হারিয়ে যেতে বসেছে মানুষের বিচারবুদ্ধি, মূল্যবোধ । এই সময় চলেছে এক অনিশ্চিত হননের পথে । কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের নন্দন । প্রত্যয়ের অন্বেষা । মূল্যবোধ ও ঐকান্তিক বিষয়গুলো যেন মহার্ঘ হয়ে পড়ছে । চেতনার প্রকোষ্ঠে বাসা বাঁধে সংকীর্ণতা, লোভ আর নাশকতা । আত্মকেন্দ্রিক সুখ আর ভোগের উল্লাস প্রকট সর্বত্র । মননের সন্ন্যাস নেই । অল্পসুখের শান্তি নেই । বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতিযোগিতা প্রতিনিয়ত । বিচ্ছুরণ নেই জীবন দর্শনের । অস্বচ্ছতায় আচ্ছন্ন জীবনবোধের গৈরিক বৈরাগ্য । কোথায় সুশৃংখল আত্মনিয়ন্ত্রণ ! কোথায় বিবেকের উজ্জ্বল আলোক ! ক্রমশ বেড়ে চলেছে নেতির মিছিল । চারিদিকে আলোহীন আশাহীনতার দরুন যন্ত্রণার আর্তনাদ । হতাশায় কুঁকড়ে যাওয়া মানবাত্মা, প্রান্তিক মানুষের উপর নির্যাতন, লোভের আঘাত, পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতার বাতাবরণ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও ভাঙন, মারণ রোগ, দারিদ্র, ক্ষুধা, ক্ষমতার দম্ভ, শক্তির আস্ফালন,সহিষ্ণুতার অভাব, সন্ত্রাসবাদ, অতিমারীর ঢেউয়ের পরে ঢেউ, ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি, আত্মহননের প্রবণতা সমস্ত বিশ্বকে আজ অন্ধকার পথে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ।
এক অতিমারীর কবলে আজ বিশ্রস্ত গোটা বিশ্ব । গত দু'বছর যাবৎ পৃথিবী করোনা নামক এক মারণ ভাইরাসের আক্রমণে জবুথবু । জীবন বিপর্যস্ত । সভ্যতা দাঁড়িয়েছে হুমকির মুখে । এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ আজ ত্রস্ত । সংশয়াপন্ন । এও এক ক্রান্তিকাল । সেই চিরাচরিত চিত্রটি আজও আবার প্রকট হয়ে উঠেছে । চারিদিকে আর্তরব । ত্রাসে, সংশয়ে, কর্মহীনতায়, প্রবাসে, রোগপ্রকোপে, চিকিৎসার অভাবে । সমাজবিচ্ছিন্ন অবস্থায় । এই দোলাচলে স্বার্থান্বেষী মানুষ জেগে উঠেছে আবার আত্মমগ্নতায় । মানবতার লাঞ্ছনায় । দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ চেয়ে থাকে কবে যে 'সম্ভমামি যুগে যুগে' বাস্তবতা লাভ করে । কবে জানি 'ঐ মহামানব আসে' । শুনে আসা মানবিকতার পুরাকথা কবে প্রাণ পাবে করোনজর্জর পৃথিবীতে। হ্যাঁ । তুমুল অসহায়তার এই অথৈ পারাবারে সত্যিই দেখা গেছে মানবিক মুখ । কী এক অনুপ্রেরণায় মহল্লায় মহল্লায় তরুণ প্রজন্মের মানবিক মুখ ছুটে গেছে আর্তের পাশে । আক্রান্তকে পৌঁছে দিয়েছে নির্ধারিত চিকিৎসালয়ে । যোগাড় করেছে জীবনদায়ী ঔষধ, রক্ত । রাতবিরেতে ছুটে গেছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার কাঁধে বয়ে । নিভৃতবাসে যারা রয়েছে সেই উপার্জনহীন মানুষগুলোর কাছে পৌঁছে দিয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও ঔষধ । প্রতিবেশীর অসম্মানজনক ব্যবহার ও বেদনাজনক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে জুগিয়েছে
সাহস । মৃত্যুর নিশ্চিত সম্ভাবনা জেনেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিঃস্বার্থে দিয়ে গেছে সেবা । চোখের সামনে সতীর্থকে আক্রান্ত হতে দেখেছে । চিরতরে হারিয়েও গেছে কতজন । তবুও থেমে থাকেনি তারা । সেবা আর মানবিকতায় জীবন-মৃত্যুর পার্থক্যকে ঘুচিয়ে দিয়েছে তারা । করোনাকাল আবার মনে করিয়ে দিয়েছে মানবিকতার বার্তা । শুনিয়েছে মানবতার মুখ । মূল্যবোধের অবলুপ্তির আশংকায় কৃষ্ণগহ্বরের অতলে ডুবে গিয়েছিল মানবিকতার লক্ষ্মীপ্রতিমা । করোনামারীর ধ্বংসাত্মক রূপ মানুষকে প্ররোচিত করেছে মানবিকতার সন্ধান করতে । মানুষের সম্মিলিত বিবেকের সমুদ্রমন্থনেই উঠে এসেছে কমলাসনা মানবিকতা । অগণিত মৃত্যুর পরিসংখ্যানের অন্ধকারের বিপরীতে মানবিকতা উজ্জ্বল মুখ এই সময়ের প্রতিটি মানুষ তা চাক্ষুস করেছেন । দেখছেন 'অসংখ্য মানুষের হাহাকার' নিবৃত্ত করে আবার জীবন জাগছে 'আলোয় আলোয়' ।
No comments:
Post a Comment