বৈশাখের চেতনাময় পংক্তিমালা
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
বৈশাখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস । চৈত্র মাসের শেষবসন্তের বিকেলে যখন অমলতাস বৃক্ষ ছেয়ে যায় পাকা সোনারঙা হলুদ ফুলের ঝাড়ে, কৃষ্ণচূড়া যখন গাছে গাছে লাল রং বিছিয়ে জাঁকিয়ে বসে তখনই আসে বৈশাখ । চৈত্রের চেতনাবিনাশী খরতাপের মধ্যেই প্রাণের স্পন্দন তৈরি করে আসে বৈশাখ । প্রখর তপ্ত দহন নিয়ে বৈশাখের আগমন ঘটে । বৈশাখের থাকে অগ্নিজ্বালা । কিন্তু তার মধ্যেই থাকে নূতন সৃষ্টির বার্তা । প্রাণের গুঞ্জরণ । ঋতু পরিবর্তনের শরীরীভাষ্য নিয়ে আসে প্রকৃতি । বৈশাখের মাঝেই প্রকৃতির দুই রূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে । সূর্যের রুদ্র তেজোদীপ্ত মূর্তির পাশাপাশি সৌম্য শান্ত রূপও দেখা যায় বৈশাখে । বৈশাখেই প্রকৃতিতে আসে তুমুল ধ্বংসাত্মক রূপ । তেমনি বৈশাখেই দেখি শান্ত সমাহিত উদাসী প্রকৃতিকে ।
এই বৈশাখেরই একটা প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী ঝড় । যার নাম 'কালবৈশাখী' । কালবৈশাখী একটি স্থানীয় বৃষ্টিপাত ও বজ্রবিদ্যুৎসহ জোরালো ঝড় যা ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, আসাম, বিহার, ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড ও বাংলাদেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রবাহিত হয়ে থাকে । কবি মোহিতলাল মজুমদারের কবিতায়ও– 'নববর্ষের পুণ্যবাসরের কালবৈশাখী আসে' এবং 'চৈত্রের চিতাভস্ম উড়ায়ে জুড়াইয়া জ্বালা পৃথ্বীর' কালবৈশাখী ধেয়ে যায় । এই কালবৈশাখীকে নজরুল জাগরণের বার্তাবাহীরূপে দেখেন । তাঁর গানে পাই– 'নাচে ওই কালবোশাখী/ কাটাবি কাল বসে কি?/ দে রে দেখি/ ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি ।'
আমাদের গ্রামজীবনে কালবৈশাখী নতুন জীবনযাত্রার সংকেত নিয়ে আসে । বাংলা ভাষাভাষী জনগণ অধ্যুষিত অঞ্চলে বৈশাখের প্রথমদিন পালিত হয় নববর্ষ উৎসব । যা রূপ নেয় অসাম্প্রদায়িক উৎসবের । জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আত্মীয়-পরিজন, প্রিয়জনের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, ভালো খাওয়াদাওয়া এদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য । হালখাতা দিয়ে শুরু হয় ব্যবসায়িক কাজকর্ম । পালিত হয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা উৎসব । ত্রিপুরিদের 'বুইসু', চাকমাদের 'বিঝু', মগদের 'সাংগ্রাই' ইত্যাদি ।
এই বৈশাখেরই শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে পালিত হয় ' অক্ষয় তৃতীয়া' । 'অক্ষয়' মানে যার ক্ষয় নাই । প্রাচীন বিশ্বাস, এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভ কাজ করলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয় । এ দিনেই ছয়মাস বন্ধ থাকা কেদার-বদ্রী-যমুনোত্রীর মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয় । দরজা খুললেই দেখা যায় ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে রেখে যাওয়া অক্ষয়প্রদীপের শিখা । এছাড়াও অক্ষয়তৃতীয়াকে কেন্দ্র করে বহু পৌরাণিক কাহিনি ও ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে । সম্প্রতি উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পড়েছে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন স্বর্ণ কেনার রীতি-রেওয়াজ । লৌকিক বিশ্বাস এই শুভতিথিতে রত্ন বা জিনিস পত্র কিনলে গৃহে শুভযোগ বৃদ্ধি পায় । সুখ-শান্তি ও সম্পদ বৃদ্ধি পায় । এই আশাতেই মানুষ এদিন কিছু না কিছু ক্রয় করে থাকেন ।
বৈশাখমাস বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মমাস । স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বৈশাখকে দেখেছেন অনন্য বিভঙ্গে । তাঁর গানে পাই–
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক
এসো এসো ।
এসো হে বৈশাখ এসো এসো
যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা ।
রবীন্দ্রদৃষ্টিতে বৈশাখ এসেছে গৈরিকরূপে । গেরুয়া রঙ বৈরাগ্যের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের রূপে দেখেছেন গৈরিক বৈরাগ্য ।
এবছর এই বৈশাখেই পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাঙালি দুই জনগোষ্ঠী হিন্দুদের 'অক্ষয়তৃতীয়া' ও মুসলমানদের 'ঈদ-উল-ফিতর' । এই দুই অনুষ্ঠানের মধ্যেই রয়েছে প্রাচীন কৃষিজীবি মানুষের লোকায়ত বিশ্বাস । 'অক্ষয়তৃতীয়া'য় রয়েছে গোষ্ঠীজীবনের কৃষিপণ্যের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির ভাবনা । 'ঈদ'এর অর্থ উৎসব । কৃষিকার্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত কৃষিজ ফসল সম্মিলিতভাবে ভাগ করে নেওয়ার প্রাচীন আনন্দোৎসব 'ঈদ' উৎসবের উৎস । এ দুয়ের মধ্যে কেমন এক মেলবন্ধনের ফল্গুধারা প্রবাহিত ।
সেই সূত্র ধরেই আমাদের প্রার্থনা হোক আজকের দিনে, এই বৈশাখে–অক্ষয় তৃতীয়া আর ঈদোৎসবের মিলনে অক্ষয় হোক আমাদের পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহাবস্থান ।
No comments:
Post a Comment