মিলন হবে কতদিনে
মেলা ভেঙে গেলে মনটা নরম হয়ে যায় । ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে । কেবল শূন্যতা । কেবল ভাঙার শব্দ । ভাঙনের আওয়াজ। মেলার মাঠে স্তুপ হয়ে পড়ে থাকে আবর্জনা । ভাঙা বেড়া বাঁশের খুঁটি । পলিপ্যাকের টুকরো । হাজার মানুষের পায়ের চাপে ঘাস উঠে যাওয়া ধূসর মাটি । নিঃসঙ্গ বুদ্ধমন্দিরের নীরব গৈরিক চূড়া । বিধ্বস্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চ । প্রতিটি মেলা শেষে সেই পরিচিত চিত্র। 'হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!'
গত রাতে শেষ হয়েছে সাব্রুমের বৈশাখীমেলা। ত্রিপুরার দক্ষিণ সীমান্তিক শহরের প্রাচীনতম মেলা । বহু মানুষের স্বপ্নের মেলা । প্রতি বছরই বহু মানুষের সমাগম হয় এই মেলায় । এই জেলার মানুষজন ছাড়াও বাইরে থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে মেলার দিনগুলোতে । আত্মীয়তার সূত্রে । পরিচয়ের সূত্রে । নাম শুনে । পেশাগত কারণে যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁরাও বাড়ি ফেরেন মেলাকে কেন্দ্র করে । বাইরে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েরা বাপের বাড়িতে নাইওর আসেন মেলা উপলক্ষে । প্রায় প্রতি বাড়িতে কদিন হাট-বাজার একটু বেশি করতে হয় এ কদিন । 'অতিথি দেব ভব' ভাবনায় ।
গত দুই বছর করোনা মহামারীর কারণে মেলা হয়নি । ঘরবন্দী মানুষ দিন গুনেছেন মুক্তির । প্রকৃতিসৃষ্ট হোক বা মনুষ্যসৃষ্ট । মানুষকে বেঁধে রাখতে পারেনা কেউই । মানুষ ভেঙে ফেলে বন্দীত্বের শৃঙ্খল । সামাজিক দূরত্বের কারণে সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষ আবার মিলনের উৎসবে সম্মিলিত হয়েছে এই বৈশাখীমেলাকে কেন্দ্র করে । বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছে মেলার মাঠে । ঝড়-বাদলে প্রকৃতির পরিবর্তন, রাজ্য রাজনীতির পরিবর্তন এই মেলাপাগল মানুষের গায়ে কোনো
আঁচ ফেলতে পারেনি । নির্ঝঞ্ঝাট, নিরুপদ্রব আনন্দের অংশীদার হয়েছেন তাঁরা । মেলার পরিধি এবারে অনেক বিস্তৃত হলেও তিলধারণের জায়গা ছিলনা কোথাও । মেলাকে ঘিরে জনপ্লাবন বয়ে গেছে । এতো এতো মানুষের সমাগম । একটাও অপ্রীতিকর ঘটনার উদাহরণ নেই । এটাই এই মেলার বৈশিষ্ট্য। শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা সাব্রুমের চিরন্তন ঐতিহ্য । যার জন্যে সাব্রুমবাসী গর্ব করে । আশির দাঙ্গার বীভৎসতা দেখেনি এ মাটি । ঐক্য ও সম্প্রীতি সাব্রুমের মুকুটের বৈদুর্যমণি । সদ্যসমাপ্ত সেই মেলাতেও সেই ধারা রক্ষিত হয়েছে ।
তার পরেও মেলা শেষ হয় । বিষাদ নেমে আসে প্রান্তর জুড়ে । ফাঁকা ফাঁকা লাগে কোথায় যেন । ঘরে ফেরা মানুষের পায়ের ধুলো ওড়ে বাতাসে । আকাশেও মেঘ গুড় গুড় করে যেন বিসর্জনের বাজনা বাজায় । ক্লান্ত মানুষ ঘরে ফেরে । ফেরে যার যার সধ্যমতো তৈজসপত্র নিয়ে । ফেরে মিলনের বার্তা নিয়ে । প্রিয়জনের হাত ধরে ঘুম জড়ানো চোখে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে, আবার 'মিলন হবে কত দিনে...' ।
No comments:
Post a Comment